আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২৪ ● ১৯ ফাল্গুন - ২ চৈত্র, ১৪৩০
প্রবন্ধ
বিজ্ঞান-কংগ্রেসের বন্ধ দরজায় দাঁড়িয়ে যে দু-চারটে কথা বলতে পারি
সত্যবান রায়
ইতিহাসের যদি পুনর্নির্মাণ কিংবা পুনর্লিখন হইতে পারে তবে বিজ্ঞানেরই বা না হইবে কেন? মহাত্মা বিদুর কি এই কথা কভু কহিয়াছিলেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি? বর্তমান কলমচির তাহা জানা নাই। সে কেবল স্মরণ করিতে পারে, অধুনা ডমিনিক ল্যাপিয়েরের 'আনন্দনগরী' বা নটগুরু উৎপল দত্তের 'দুঃস্বপ্নের নগরী' যে নামেই ডাকি না কেন, সে ছিল একদিন আমাদের যৌবনের কলকাতা...।
হাতে মাথা কাটার প্রশ্ন ওঠে না, তবে ভারতবর্ষের বিজ্ঞান প্রবাহের ধারা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে আমি যাঁর চিন্তার দুয়ারে ফিরে তাকাই তিনি দর্শন-অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। চার দশকেরও আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তি বিভাগে স্নাতকোত্তর যাপনের দিনগুলিতে সেই যে হাতে পেয়েছিলাম তাঁর সদ্য প্রকাশিত 'সায়েন্স এন্ড সোসাইটি ইন এনসেন্ট ইন্ডিয়া', [১] সেটি আজও আমার সঙ্গী হৃদমাঝারে - বিজ্ঞান-ভাবনার যে কোনও সংকটে মনে-মননে। ১৯৯১ সালে তাঁর পরবর্তী বই - 'হিস্ট্রি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি ইন এনসেন্ট ইন্ডিয়া-২' বইখানির পর্যালোচনায় সমালোচক রবার্ট টেম্পল-এর মর্মোপবলব্ধিতে দেবীপ্রসাদের দৃষ্টিভঙ্গীর মূল সুরটি ধরা পড়েঃ
“বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে আজ পর্যন্ত যত বই লেখা হয়েছে এটি তার মধ্যে বিষণ্ণতম। কারণ হিন্দু সংস্কৃতির মতো আর কোনও সংস্কৃতি কখনও বৈজ্ঞানিক প্রগতিকে এত সাফল্যের সঙ্গে শ্বাসরুদ্ধ করতে পারেনি। ধর্মপ্রাণতার এহেন প্রবল আত্মসন্তুষ্টি - এবং যারা একটি সাম্প্রতিক নির্বাচনে প্রায় জিততে বসেছিল - বিজ্ঞানের উজ্বল মেধাগুলিকে বহু প্রজন্ম ধরে ভিজে কম্বল দিয়ে চাপা রেখেছে।... ভারতবর্ষ যদি এভাবে বিজ্ঞানকে ছাড়িয়ে ধর্মের মাথা চাড়িয়ে ওঠাকে প্রশ্রয় দিয়ে যেতে থাকে, তবে যে গল্প চট্টোপাধ্যায় আমাদের শুনিয়েছেন তার অন্তিম পরিণামের অপেক্ষায় থাকতে হবে, ভারতবর্ষ আবার ফিরে যাবে প্রস্তরযুগে। তাঁর আখ্যানের খোলাখুলি বার্তা এইটুকুই”। [২]
১৯৯১ সালে অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায়ের 'উদ্ভাসী' বইখানি প্রকাশের পরে প্রায় তেত্রিশ বছর কেটে গেছে, কেউ কি কথা রাখেনি? কারা রাখেনি? ২০২৪-এর হ্যাপি নিউ ইয়ারের প্রথমেই জেনে গেছি ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনের ১০৯ বছরের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছে। কোনও কারণ না দেখিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এ বছরের অধিবেশন। জানুয়ারির তিন তারিখ থেকে যার পাঁচ দিনের সূচি নির্ধারিত ছিল উত্তরপ্রদেশের লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতিমধ্যে প্রায় প্রকাশ্যে আসে ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরের সঙ্গে স্বশাসিত বিজ্ঞান কংগ্রেস সংস্থার বিসম্বাদ। সরকারি এই দপ্তরই বিজ্ঞান কংগ্রেস অধিবেশনের আর্থিক ব্যয়ভারের মূল উৎস। হাত গুটিয়ে নেয় লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়। আয়োজক সংস্থা অধিবেশনের স্থান পরিবর্তন করে জলন্ধরের 'লাভলি প্রফেশনাল বিশ্ববিদ্যালয়'-এ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরের উষ্মা তাতে চরমে ওঠে, সংস্থার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের একটি ভাসাভাসা অভিযোগ আনে দপ্তর। লাভলিও হাত গুটিয়ে নেয়। বিজ্ঞান কংগ্রেস সংস্থা আদালতের দ্বারস্থ হয় অবাঞ্ছিত সরকারি হস্তক্ষেপের অভিযোগ নিয়ে। [৩]
সে ছিল একদিন যখন যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন ছিল বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনের জন্য অতিথি হওয়ার বাসনায়। ২০২৪-এ বিজ্ঞান কংগ্রেস সংস্থা পথে নেমেছেন অতিথি-বিশ্ববিদ্যালয়ের খোঁজে, বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে। এখনও কোন বিশ্ববিদ্যালয় দুঃসাহস নিয়ে দরজা খোলেনি। এখনও শতাব্দী পেরিয়ে যাওয়া বিজ্ঞান কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ কী আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়নি। দপ্তর বনাম সংস্থার অসম দ্বৈরথে - 'সোর্ড ইজ মাইটার দ্যান পেন' - ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস সংস্থা একটি কমিটি তৈরি করেছে অধিবেশনস্থলের সন্ধানে। ২০১৫ সাল থেকেই তারা দেখে আসছেন আমাদের রাষ্ট্র যে হার্দিক নৈপুণ্যে ISCA-এর বদলে কোল দিয়ে আসছেন IISF-কে - ভারত আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান উৎসবকে, যা একটি বাৎসরিক সমান্তরাল সম্মেলন। খুব একটা বেশি মানুষের জানা নেই যে এর পৃষ্ঠপোষক 'বিজ্ঞানভারতী' - রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের একটি ফ্রন্ট। সেই সঙ্গে আছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, ভূবিজ্ঞান মন্ত্রণালয়, মহাকাশ ও পারমাণবিক শক্তি দপ্তর। বহু জ্যোতিষ্কের পরম্পরায় উজ্বল ১০৯ বছরের অস্তিত্বের স্বশাসিত 'ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস' সংস্থাটি কি তবে রাষ্ট্রীয় বিমুখতার সঙ্গে অসম দ্বৈরথে নিঃসঙ্গ অস্তিত্বের সেন্ট হেলেনায় নির্বাসনের নিয়তি-দুষ্ট? যে প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞানের গৌরব-গাঁথা নিয়ে একদল লাঠিসোটা-ঢাকঢোল নিয়ে ময়দানে নেমে পড়েছে, সেই প্রাচীনতার আড়াল থেকে যে মুখগুলি গবেষকের পৃষ্ঠায় উঁকি দেয়, তাদেরই একজন কি উদ্দালক আরুণি (Uddālaka Āruṇi)? অনুরূপ নিঃসঙ্গতার দিকেই কি একদা একঘরে হয়ে গিয়েছিলেন মানবজাতির মননেতিহাসের প্রথম ‘প্রকৃতি বিজ্ঞানী’ উদ্দালক আরুণি? অধ্যাপক দেবীপ্রসাদের গবেষণার তাত্ত্বিক কাঠামো সেভাবেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল ছান্দোগ্য উপনিষদের পৃষ্ঠা থেকে পৃষ্ঠান্তরে বিরাজমান এই বৈদিক শিক্ষাগুরুকে। উদ্দালক আরুণিকে সোজাসুজি অস্বীকার করেনি ঔপনিষদিক বৃত্ত। সূক্ষ্ণভাবে তাঁর ব্যবহৃত কিছু শব্দ এবং বাচনিক প্রকাশকে মোচড় দিয়েছিল, ফলত তাঁর শিক্ষার অভিমুখও বদলে গিয়েছিল, খাপ খাইয়ে নিয়েছিল ঔপনিষদিক তত্ত্ববিশ্বের অতিজাগতিক ধাঁচের সঙ্গে। তবে এই সূক্ষ্ণতার আড়ালটুকুও আজ প্রয়োজন হয় না, যখন গণপতির সঙ্গে জূড়ে যায় প্লাস্টিক সার্জারির অনুসঙ্গ, পুষ্পক রথের সঙ্গে বিমানের, মিথের সঙ্গে ইতিহাসের। না রক্ষিত হয় মিথের কাব্যিক রূপমাধুরী, না সম্মানিত হয় সেকালের বৈজ্ঞানিক পদচিহ্ন।
দেবীপ্রসাদের 'হোয়াট ইজ লিভিং এন্ড হোয়াট ইজ ডেড ইন ইন্ডিয়ান ফিলজফি'-র (পূর্বল্লিখিত বইয়ের কিছু পরে যার প্রকাশ) গভীর তাত্ত্বিক পরিক্রমা এখন হারিয়ে যায় একদেশদর্শীতার ঘুর্ণিতে। অন্ধ প্রাচীনত্বের মোহে গুলিয়ে যায় কিংবা গুলিয়ে দেওয়া হয় সদর্থক বিজ্ঞানের অভিমুখ। অথচ, এই প্রাচীনতাও এক আপেক্ষিক সত্য। কিংবা বলা যায় উপর্যুপরি অসংখ্য কালখন্ডের সমাহার। এক নিঃশ্বাসে প্রাচীন ভারতবর্ষের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উচ্চারণে এসে যায় সিন্ধু সভ্যতা, বৈদিক গণিত, আত্রেয়-সুশ্রুত, আর্যভট্ট-বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত-ভাস্করাচার্য-র কাল। অথচ তাঁদের অন্তর্বর্তীকালের বিপুল ব্যবধান সত্বেও, হাজার পাঁচেক বছরের জটিল ঐতিহাসিক পরিসর ও তার অন্তর্নিহিত ভাববিশ্বের বিপুল ব্যবধান সত্বেও। দ্বিতীয়ত, সেই প্রাচীন ব্যক্তি-মেধার বিজ্ঞানের থেকে আজকের আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানের চলনের ধরণটাই ভিন্ন। রেনেসাঁ-উত্তর ইওরোপের আধুনিক বিজ্ঞানের সম্প্রসারিত জমিতেই লালিত হয়েছে আধুনিক ভারতের বিজ্ঞান, আর্যভট্ট-ব্রহ্মগুপ্তের প্রত্যক্ষ উত্তরসূরীতায় নয়। তথাপি এই মুহূর্তের বিজ্ঞান কংগ্রেসের প্রতি রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের অধোগামী মনোভঙ্গী ও পদক্ষেপের আলোচনায় ইতিহাস আমাকে টানে আরও অনেক পেছনে। যে উদ্দালক আরুণিকে ইতিহাসের অন্যতম প্রথম বিজ্ঞান-দার্শনিক হিসেবে উল্লেখ করেন তেল-আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের এমেরিটাস অধ্যাপক বেন-আমি শার্ফস্টাইন, প্রতিষ্ঠান যাঁকে মান দিয়ে দূরে রাখল, তাঁর সময়কাল খ্রীষ্টপূর্ব সপ্তম বা অষ্টম দশকে। গ্রেকো-রোমান বিজ্ঞানের অন্তর্জলির কালে ইওরোপে যখন নেমেছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ঘোর তমস, প্রাচ্য তখন বহন করে চলেছে বিজ্ঞানের উত্তরাধিকার।
খ্রিস্টীয় পঞ্চম-ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে এবং তার পরেও ভারতবর্ষ তখন আর্যভট্ট, বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত, ভাস্করাচার্যের মনীষায় বিশ্ববিজ্ঞানের প্রথম সারিতে। এত বড় বিজ্ঞানকেও আত্মসাৎ করল মিথ। জোসেফ নিডহ্যাম প্রমুখ বিদগ্ধজন সভ্যতার আদিতে সংঘবদ্ধ শ্রমজনিত কৌম ব্যবস্থায় ম্যাজিক ও বিজ্ঞানের যে অভিন্নতাকে বিশ্লেষণ করেছেন, ভারতবর্ষের মাটিতে তা ঐতিহাসিক সত্য। বিজ্ঞানের বিবর্তনের ধারা অনুসরণ করে বার্নাল বিজ্ঞানের অন্য নাম দেন র্যাশনালাইজড মাইথোলজি। কিন্তু সে তো হয়ে উঠল না আর্যভট্টের ধারাবাহিকতায়। ম্যাজিক থেকে র্যাশনালাইজড মাইথোলজি হিসেবে বিজ্ঞানে রূপান্তরের পরিবর্তে ইতিহাসের উল্টোরথযাত্রায় বিজ্ঞান থেকে মিথ। একদিন বরাহমিহির সূর্যগ্রহণের রাহুগ্রাসজনিত মিথকে অস্বীকার করে বিজ্ঞান-ঋদ্ধ ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। সাধারণ্যে তিনি নিজেই ইতিহাসের বদলে মিথ হয়ে গেলেন। আড়ালে চলে গেলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী বরাহমিহির। তাঁর ঐতিহাসিক নামকে বিশ্লিষ্ট করে উদ্ভব হল অনৈতিহাসিক চরিত্রসমূহ - বরাহ নামে এক গণৎকার ও তাঁর পুত্র মিহির, পুত্রবধূ খনা - যাঁর জিহ্বাকর্তন ও টিকটিকির গল্পই প্রাধান্য পেল। ভাষাবিশারদদের মতে খনার বচনের সময়কাল আজ থেকে সাড়ে চারশ’ বছরের আগে নয়, অথচ বরাহমিহিরের যাপনকাল ষষ্ঠ শতকে। শকযুগের অর্থাৎ দ্বাদশ শতকের ভাস্করাচার্যকে ছাড়িয়ে গেলেন রূপসী লীলাবতী, যাকে গবেষকরা বলেন তাঁর মানসসঙ্গী, বাস্তব সত্তা নন - যাঁকে ভাস্কর তাঁর গাণিতিক উপপাদ্যগুলি উদ্দিষ্ট করেছিলেন। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা, আর্যভট্ট থেকে ভাস্করাচার্য এই ধারাপথটি আধুনিককালে এসে পৌঁছল না। কোন মরুপথে হারাল ধারা? এখানেই এসে যায় সেই ভারতবর্ষের ভিতর-বাইরের কারণগুলি।
ভিতর অঙ্গনে উত্তর-পালযুগের মন্বন্তর বা মহামারী ছাড়াও ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র, হিন্দু-বৌদ্ধ সংঘাত এবং বহিরাঙ্গনে তুর্কি বিজয় এবং ইংরেজ উপনিবেশ সামগ্রিকভাবে বাঙালির ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় হাজার বছরের বিচ্ছেদ রচনা করেছে।অন্তরঙ্গের কারণ নিয়ে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যার ধারাটি আমরা যতখানি মনে-মরমে নিয়েছি বেদ-উপনিষদ-পুরাণের কালে, হাজার বছর আগে তুর্কি বিজয়-জনিত বহিরঙ্গের বিষয়টি নিয়ে প্রায়শ কিছুটা রাখঢাক লক্ষ্যণীয় মেধা-মহলে। এই একদেশদর্শিতায় সেক্যুলার সত্তার সত্যবদ্ধতা কতটা রক্ষিত হয় জানিনা, তবে প্রাচীন বিজ্ঞানের শর্তহীন ঢক্কানিনাদ প্রশ্রয়ই পেয়ে থাকে। হাজার বছর আগে গজনীর সুলতান মামুদের সঙ্গে ভারতবর্ষে এসেছিলেন আলবেরুনী। তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ ভারত-তত্ত্ব আমার প্রিয় একখানি বই। মূল আরবী থেকে অনুদিত ঢাকার বাংলা একাডেমীর প্রকাশিত বইখানি আমার দীর্ঘকালের সঙ্গী। সুলতান মামুদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারেননি আল-বেরুনী। তাঁর সুবৃহৎ ইতিহাসটির প্রস্তাবনায় লেখেন - "...সবুক্তগীন ধর্মযুদ্ধের পথ অবলম্বন করলেন এবং গাজী উপাধি গ্রহণ করে ভারতবর্ষের সীমান্ত ভেদ করার উদ্দেশ্যে স্বীয় উত্তরাধিকারের জন্য রাস্তা তৈরি করলেন, যে রাস্তা ধরে ইয়ামিনুদ্দৌলাহমামুদ (উভয়কে আল্লা ক্ষমা করুন) তিরিশ বৎসরের ঊর্ধ্বকাল ধরে অভিযান চালিয়ে হিন্দুদের শস্যশ্যামল অঞ্চলগুলোকে মরুভূমিতে পরিণত করে দিলেন।... বস্তুতঃ এই জন্যই ওদের জ্ঞান-বিজ্ঞান বিজিত অঞ্চল থেকে সরে গিয়ে কাশ্মীর ও বারাণসীর মতন এমন সব স্থানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে যেখানে আমাদের হাত পৌঁছায় না..."। [৪]
বহিরঙ্গের বিশ্লেষণে ইংরাজ উপনিবেশের বিষয়টিও কম জটিল নয়। এটা ঠিক ইওরোপের উত্তর-রেনেসাঁ কালের আধুনিক বিজ্ঞানের কাঠামোটিই ভারতবর্ষে গৃহীত হয় উনিশ শতকের অন্তে। তারই ধারায় রামন-সাহা-বোস-রামানুজম। তারই ধারায় ভারতের আজ বিজ্ঞান বিকাশের দীপ্তি। তাই স্বদেশী বিজ্ঞান বলতে যদি বুঝি আর্যভট্ট-ভাস্করাচার্যের উত্তরাধিকার, সেটি ঐতিহাসিকভাবেই সম্ভব ছিল না। আবার এও ঠিক - উত্তর-ঔপনিবেশিক চর্চায় যা উঠে এসেছে - পশ্চিমের আধুনিক বিজ্ঞান ও ঔপনিবেশিক স্বার্থ পরস্পরের অঙ্গাঙ্গী। আধুনিকতার মুখোশে স্বদেশের লোকাচার ও লোক-সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত প্রভূত বৈজ্ঞানিক সত্য প্রান্তিক ও উপহাসাস্পদ হয়ে গেছে। জলে-জঙ্গলে বিভিন্ন জনজাতি যুগ-যুগান্তর ধরে অরণ্য-সম্পদের ওপর নির্ভরশীল থেকেও পরিবেশ সংরক্ষণ করে এসেছে অত্যন্ত সদর্থকভাবে। আজ রাষ্ট্র ও কর্পোরেট পুঁজির উন্নয়নের দাপটে সেই পরিবেশ-বিপন্নতা মানবিক সংবেদকে বিষণ্ণতায় বেঁধেছে। কিন্তু তাই বলে ঔপনিবেশিক বিজ্ঞানের স্বার্থকেন্দ্রিকতার প্রতি অভিমানে তো পুষ্পক রথ হয়ে যায় না হেলিকপ্টার। হতে বাধা নেই, কিন্তু তার প্রমাণ প্রয়োজন। বিজ্ঞান দাবির উপরে চলে না, চলে প্রমাণের ভিত্তিতে। [৫]
আজ তালাবন্ধ বিজ্ঞান কংগ্রেসের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যখন এতসব ইতিহাসের তত্ত্ব-তালাস করতে থাকি, তখন মনে আসতেই পারে সদ্য অতীতে আমাদের রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিতে কী ধরণের পরিবর্তন ঘটেছিল যার পরবর্তীতে এই অচলায়তনের দিকে এগিয়ে যাওয়া? পরিবর্তনের আগে কীরকম পরিস্থিতি ছিল দেশের বিজ্ঞান-পরিস্থিতিতে? 'দেশ' পত্রিকায় সাম্প্রতিক একটি অনবদ্য প্রবন্ধে পদার্থবিজ্ঞানী পলাশ বরন পাল দেখিয়েছেন মূলত ১৯৯০-এর দশকে ব্যক্তিগত কম্পিউটার, বৈদ্যুতিন ডাক এবং আন্তর্জালের যুগান্তকারী উদ্ভাবনা ও প্রসারণে ভারতীয় বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে বহির্বিশ্বের বিশেষত ইওরোপ ও আমেরিকার বিজ্ঞানমহলের দ্রুততম যোগাযোগের সুবিধার ফলশ্রুতিতে বিচ্ছিন্নতার ভাব কাটিয়ে এদেশের বিজ্ঞানে এসেছিল এক ‘স্বর্ণযুগ’ - ১৯৯০-এর দশক থেকে ২০০০-এর দশকের পরিসরে। এসেছিল, চলেও গেছে সেই যুগ। [৬] স্থানাভাবে তাঁর ন্যারেটিভের দীর্ঘ উদ্ধৃতি থেকে বিরত থাকলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল বিজ্ঞান কংগ্রেসের বন্ধ হয়ে যাওয়ার সাম্প্রতিক প্রেক্ষিতের সঙ্গে সদ্য-বিগত অন্তত এক-দেড় দশকের রাষ্ট্রীয়-আমলাতান্ত্রিক মনোবিকারের যোগসূত্রটির অনুসন্ধান। ধরে নেওয়া যায় অধ্যাপক পালের রচনাটি অক্টোবর ২০২৩-এর পরে নয়, তখনও পূর্বঘোষণা অনুযায়ী প্রত্যাশা ছিল শতাব্দী-উত্তর ঐতিহ্যের বিজ্ঞান কংগ্রেস হতে চলেছে ৫ ডিসেম্বর থেকে। উদ্দালক আরুণির কাল থেকে, আত্রেয়-সুশ্রুত-জীবক-চরকের কাল থেকে, আর্যভট্ট-বরাহমিহিরের কাল থেকে, ব্রহ্মগুপ্ত-ভাস্করের কাল থেকে বারেবারেই ক্ষমতাসীন অসহিষ্ণুতার গ্রাসে ছেদ পড়ে এসেছে বিজ্ঞান-চর্যার। ইতিহাস আর কতবার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে! 'সাতটি তারার তিমির'-এর কবি-র কণ্ঠস্বরগহনদ্বারে কান না পেতেও শুনতে পাচ্ছি -
অনেক বিদ্যার দান উত্তরাধিকারে পেয়ে তবু/ আমাদের এই শতকের/ বিজ্ঞান তো সংকলিত জিনিসের ভিড় শুধু - বেড়ে যায় শুধু;/ তবুও কোথাও তার প্রাণ নেই ব’লে অর্থময়/ জ্ঞান নেই আজ এই পৃথিবীতে; জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই।
উৎস-উল্লেখঃ
১) Science and Society in Ancient India; Debiprasad Chattopadhyaya; 1977; Research India Publications, Calcutta.
২) Obituary - Debiprasad Chattopadhyaya; The Statesman; 9.5.1993.
৩) Opportune Pause: On an opportunity to consider the relevance of the Indian Science Congress; The Hindu; 25.12.2023.
৪) আল-বেরুনীর ভারততত্ত্ব; আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ; বাংলা একাডেমী, ঢাকা; জুন, ১৯৭৪।
৫) রাজনীতির গ্রাসে লৌকিক জ্ঞান; আদিত্য ঘোষ; আনন্দবাজার পত্রিকা, উত্তর-সম্পাদকীয়; ৫.২.২০২৪।
৬) ভারতীয় বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ; পলাশ বরন পাল; দেশ; ১৭.২.২০২৩।