আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২৪ ● ১৯ ফাল্গুন - ২ চৈত্র, ১৪৩০

প্রবন্ধ

ভারতে জনগণনার প্রয়োজন কি ফুরিয়েছে?

অর্ধেন্দু সেন


ইংল্যান্ডে জনগণনা শুরু হয় ১৮০১ সালে। তার আগে জনগণনা হয়েছে ১৭৯০-৯১ সালে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ইউরোপের কিছু দেশেও সম্পন্ন হয়েছে সেন্সাসের কাজ। ১৭৯৮ সালে ম্যালথাস প্রকাশ করেছেন তাঁর বিখ্যাত বই 'An Essay on the Principles of Population'। শিল্প বিপ্লবের ফলে এই দেশগুলির অর্থনীতি তখন সচ্ছল। জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। সরকার কি এই বৃদ্ধির কথা জানে? এর তাৎপর্য বোঝে? সমাজের সবচেয়ে বড় সম্পদ তখনও চাষের জমি। তাও বাড়ছে। তবে ধীরে। ম্যালথাস দেখালেন শীঘ্রই একটা কিছু না করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। দুর্ভিক্ষ আর মহামারি ঠেকানো যাবেনা।

ধরে নেওয়া যায় এই সময়ে উন্নত দেশগুলিতে জনগণনা ছিল সাধারণ মানুষ যাতে বিপদে না পড়ে তার জন্য আগাম প্রস্তুতি। ভারতেও কি একই উদ্দেশ্যে চালু হয় সেন্সাস? তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে বলতে হয় তা ছিল চূড়ান্ত ব্যর্থ কারণ উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ ভারতে বারেবারেই মানুষ পড়েছে দুর্ভিক্ষের কবলে। ভারতে জনগণনার আসল কারণ বুঝতে হলে দেখতে হয় কোন সময়ে তা হয়েছিল। সিপাই বিদ্রোহের পরে ভারতের প্রশাসন কোম্পানির হাতে থাকে না। ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ সরকার নিজেই সে দায়িত্ব গ্রহণ করে। প্রশাসন চালাতে গিয়ে সরকার দেখে এ দেশটা ইংল্যান্ডের মতো নয়। সরকার তখন লাগে দেশটাকে বোঝার কাজে। শুরু হয় ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ। দেশের নদ নদী অরণ্য পর্বত সম্বন্ধে সম্যক ধারণা হয়েছে একের পর এক যুদ্ধ করে। এবার বুঝতে হবে ইতিহাস। ধর্ম। সামাজিক রীতিনীতি। একদিকে শুরু হয় গেজেটিয়ার লেখার কাজ। দ্বিতীয়ত শুরু হয় সেন্সাস।

প্রথম সেন্সাস হবার কথা ছিল ১৮৬১ সালে। বিভিন্ন কারণে এ কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়। শেষে তা ধরা হয় ১৮৮১ সালে। সেই সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি সর্বত্র একসঙ্গে গণনা শুরু হয়। ১৮৭২ সালেও এক রাউন্ড গণনা হয়েছিল কিন্তু বিভিন্ন অঞ্চলে গণনা হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে। ১৮৮১ সালের পর জনগণনা চলতে থাকে প্রতি দশকের প্রথম বছরে। বিশ্বযুদ্ধের সময়েও তা বন্ধ হয়নি। সেন্সাসে শুধু জনসংখ্যা নয় ভারতবাসীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার অনেক খুঁটিনাটি উঠে আসে। কোনও রাজ্যের কোনও জেলার কোনও গ্রামে কত মানুষ পাকা বাড়িতে থাকে? কতজন মাটির ঘরে? কত যুবক চাকরি খুঁজছে? কতজন কাজের খোঁজে ভিনরাজ্যে বাসা বেঁধেছে? কতজন বিশেষভাবে সক্ষম? কত মা এখনও কাঠের উনুনে রান্না করেন? কত বাড়িতে পরিস্রুত জলের সাপ্লাই আছে? এইসব প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজা হয় সেন্সাসে। সহজেই বোঝা যায় ভারতের মতো বিশাল এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশে এই গণনার কাজ সংগঠিত করা চারটিখানি কথা নয়। সত্যিই এ এক গর্বের ব্যাপার।

১৮৬২ সালে আইসিএস-এর বেঙ্গল ক্যাডারে যোগ দেন ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার। পোস্টিং পান বীরভূমে। কিছুদিনের মধ্যেই একাধিক বই লিখে ফেলেন বাংলার উপরে। তাঁর লেখা 'Annals of Rural Bengal' এবং 'A Statistical Account of Bengal' এখনও অবশ্য পাঠ্য। ভাইসরয় লর্ড মিন্টো তখন 'গেজেটিয়ার' লেখার প্রস্তুতি শুরু করেছেন। হান্টার নিজের আগ্রহে সেই কাজে লেগে গেলেন। তাঁর ইচ্ছা সাধারণ মানুষের ইতিহাস লিখবেন। ১৮৮১ সালে 'গেজেটিয়ার' প্রকাশিত হল নয় খণ্ডে। হান্টারের সম্পাদনায় তা বেড়ে দাঁড়াল ২৬ খণ্ডে। 'ইম্পিরিয়াল গেজেটিয়ার'-এর এই এডিশন এখন হান্টারের গেজেটিয়ার নামে পরিচিত।

অন্যদিকে ১৯০১ সালে তৃতীয় সেন্সাসের দায়িত্ব পেলেন বেঙ্গল ক্যাডারের অন্য এক অফিসার রিসলি। 'Castes and Tribes of Bengal' বইয়ের লেখক রিসলি ছিলেন উপজাতি জনজাতি বিষয়ে পণ্ডিত। তাই এই বিষয়ে জোর পড়ল সেন্সাসে। যেহেতু ইংল্যান্ডে ইউরোপে 'কাস্ট' বলে কিছু নেই সাহেবরা ঠিক করলেন কাস্টের ব্যাপারটা বুঝতেই হবে। কিছুটা নিশ্চয়ই বুঝলেন। যেটুকু বুঝলেন না নিজের মতো করে তৈরি করে নিলেন। তার ফল সুবিধার হল না। তাই ১৯৪১-এর সেন্সাস থেকে কাস্টের হিসাব বাদ পড়ল। শুধু তফসিলি জাতি ও উপজাতির হিসাব রাখা হল।

ভারত স্বাধীন হলে নেহেরু এবং তাঁর সহকর্মীবৃন্দ চাইলেন এক আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ করতে। সেন্সাস তখন ফিরে এল তার স্বমহিমায়। সংবিধান গৃহীত হবার আগেই দেশে সেন্সাস আইন পাশ হল এবং ১৯৫১ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম সেন্সাস অনুষ্ঠিত হল। দেশের জনসংখ্যা তখন ৩৬ কোটি। সেন্সাসের দায়িত্ব নিলেন দেশের সেন্সাস কমিশনার। ২০১১ সালের সেন্সাসে ২৫ লক্ষ 'এনুমারেটর' প্রত্যেক বাড়িতে যান তথ্য সংগ্রহ করতে। খরচ হয় আনুমানিক দশ হাজার কোটি টাকা।

১৯৫১ সালেই শুরু হয় প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। রূপায়নের দায়িত্ব পায় 'প্ল্যানিং কমিশন'। নেহরু প্ল্যানিং কমিশনের দায়িত্ব দেন তাঁর আস্থভাজন পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশকে। ১৯৩০-এর দশকে মহালনবিশ গোড়াপত্তন করেন 'ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট'-এর। তাঁর নেতৃত্বে কিছুদিনের মধ্যেই আইএসআই বিশ্বের অগ্রগণ্য সংস্থাদের মধ্যে স্থান পায়। সেন্সাস দশ বছরে একবারই হয়। পরিসংখ্যানবিদের কাজ সেন্সাসের ভিত্তিতে নমুনা সমীক্ষা চালিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য জোগাড় করা। এই তথ্য ছাড়া সরকারি প্রকল্পের সফল রূপায়ন অসম্ভব। মহলানবিশ দেখালেন কীভাবে এই নমুনা সমীক্ষা চালানো যায়। শুধু ভারত নয় তিনি তৃতীয় বিশ্বের জন্য একটা মডেল স্থাপন করলেন। এতে সেন্সাসের উপযোগিতা বেড়ে গেল অনেক গুণ।

সেটা ছিল গণতন্ত্রের অমৃতকাল। এখন রাম আছেন অযোধ্যা আছে কিন্তু গণতন্ত্র নেই। সেন্সাসই হোক বা নমুনা সমীক্ষা তাদের চাহিদা এখন কমেছে। দেশ চালাবার জন্য তথ্য আর তত্ত্ব দুইই সোজা চলে আসছে ভগবানের কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে। এমতাবস্থায় শাসকের সঙ্গে পরিসংখ্যানের সংঘাত অবধারিত। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ঠিক আগে মনমোহন সিংহের তদারকিতে দেশের অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব বৃদ্ধি হয়। বৃদ্ধির হার দশ পারসেন্ট ছুঁয়ে যায়। মোদী তা ধরে রাখতে অসমর্থ হন। হিন্দুত্ববাদী পরিসংখ্যানবিদ দেখেন চটজলদি কিছু করতে হলে জিডিপির হিসাবে বদল আনতে হবে। কিন্তু প্রাথমিক বদলে কাজ হয়না। মোদী জমানার বৃদ্ধির হার বাড়ে বটে কিন্তু মনমোহনের সময়কার বৃদ্ধির হার আরও বেড়ে যায়। তখন এমন দাওয়াই দেওয়া হয় যে একটা বাড়ে অন্যটা বাড়েনা। ভক্তের হৃদয়ে মোদীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয় কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতীয় পরিসংখ্যানের যে সুনাম ছিল যে প্রেস্টিজ ছিল তা জলাঞ্জলি যায়।

ফলস্বরূপ দেখা যায় শুধু জিডিপি নয় মতের অমিল হচ্ছে অন্যত্রও। প্রথমে ধরা যাক বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের ব্যাপারটা। ২০২২ সালে এই সূচক অনুযায়ী ভারতের অবস্থান ছিল ১২৫টি দেশের মধ্যে ১০৭। ২০২৩ সালে তা আরও নেমে দাঁড়ায় ১১১-তে। মোদীর বড় সমালোচকও কথাটা বিশ্বাস করার আগে দুবার ভাববে। দেশের মানুষ এতো ক্ষুধার্ত অথচ রাস্তাঘাট রেলের স্টেশনে ভিখারি দেখা যায়না? অসম্ভব। কিন্তু সরকারিভাবে কী বলা হল? স্বীকার করা হল যে বয়সের তুলনায় দেশের ছেলেমেয়েদের উচ্চতা এবং ওজন দুইই কম। কিন্তু বলা হল তা ক্ষুধার পরিমাপ হতে পারেনা। কিন্তু কম কেন তার ব্যাখ্যা তো দরকার! কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া গেলনা।

খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়লেই গরিব মানুষের পাতে খাবারের পরিমাণ বাড়ে না। তাই হলে চাকরির জন্য হাহাকার হতো না। মনরেগার চাহিদা বাড়ত না। আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা বাড়ত না। বোঝাই যায় যে এই জটিল পরিস্থিতিতে সরকার যা বলবেন তার পিছনে যুক্তি এবং তথ্য থাকতে হবে। সে পথে না গিয়ে সরকার একটাই যুক্তি খাড়া করেছেন যা সব পরিস্থিতিতেই কাজে লাগছে। মোদীর নেতৃত্বে হিন্দুদের অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতিতে বিশ্ব শঙ্কিত এবং ঈর্ষান্বিত। সব সমালোচনাই এই ঈর্ষার বহিঃপ্রকাশ।

দ্বিতীয়ত দেখা যেতে পারে ভারতে অতিমারিতে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে মতবিরোধ। ভারত সরকারের মতে ২০১৯ এবং ২০২০ সালে কোভিডে মৃত্যু হয়েছে ৫ লক্ষ ব্যক্তির। ডব্লিউএচও-র হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা ৪০ লক্ষ। এই আলোচনায় আমরা এই দুই সংখ্যার মধ্যে কোনটা ঠিক কোনটা ভুল সে প্রশ্নে যাচ্ছিনা। আমাদের উৎকণ্ঠার কারণ এই যে চার বছর অতিক্রান্ত কিন্তু ডব্লিউ.এইচ.ও. এখনও আমাদের হিসেব মেনে নেয়নি। মহলানবিশ থাকলে এটা হতো? প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে ভারতের জনগণনায় একবারমাত্র জনসংখ্যা কমেছে। ১৯২১-এ। স্প্যানিশ ফ্লু-র অতিমারির পরে। সরকার কি সেই ভয়ে আদমশুমারি পিছিয়ে দিলেন? এমনটা ভাবাও পাপ।

বাজেট বক্তৃতার পরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বললেন সরকারি পরিসংখ্যান যাতে নিখুঁত এবং গ্রহণযোগ্য হয় তার জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী যদি স্বীকার করেন সরকারি পরিসংখ্যান গ্রহণযোগ্য নয় তাহলে আর বাকি থাকে কী? অন্য সূত্র থেকে আমরা এও জানি যে এই বিশেষ কমিটি এখনও কাজ শুরু করেনি। কমিটির চেয়ারম্যান একথাও বলেছেন যে ২০২১-এর জনগণনা শেষ না হলে কোনও স্যাম্পল সমীক্ষায় সঠিক তথ্য পাওয়া যাবেনা। কারণ সমীক্ষার জন্য যে ফ্রেম দরকার তা আসে সেন্সাসের থেকে। যতদিন না ২০২১-এর জনগণনা শেষ হচ্ছে ততদিন ২০১১ সালের ফ্রেম ব্যবহার করতে হবে এবং অবশ্যই ভুলের পরিমাণ বাড়বে।

সেন্সাসের কাজ মুলতুবি করা আছে কেন? সংবাদে প্রকাশ শুধু সেন্সাস নয়। ১৭টি সমীক্ষার ফল চেপে দেওয়া হয়েছে। সরকার প্রতি পাঁচ বছরে একবার সমীক্ষা করে দেখে উপভোক্তাদের মোট ব্যয় কতোটা বাড়ল। এই গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষার ইংরেজি নাম 'কনসিউমার এক্সপেন্ডিচার সার্ভে'। ২০১৭-১৮ সালের সমীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশ করা হয়নি কারণ তা জিডিপি বৃদ্ধির সরকারি হিসাবের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ ছিল না। অতি সম্প্রতি তা এক নতুন সার্ভের ফল হিসাবে প্রকাশিত হয়েছে। শেষরক্ষা হয়েছে কিনা বলা কঠিন।