আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২৪ ● ১৯ ফাল্গুন - ২ চৈত্র, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

দুষ্কৃতিরাজ!


বর্তমানে রাজ্যের রাজনীতি সরগরম রয়েছে সন্দেশখালির ঘটনাকে ঘিরে। একদিকে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল তথা মুখ্যমন্ত্রী ব্যস্ত নিজেদের অপরাধ আড়াল করতে অন্যদিকে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি ব্যস্ত গোটা ঘটনার থেকে নিজেদের রাজনৈতিক লাভ খুঁজে নিতে। এমনকি এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে খানিক সাম্প্রদায়িক বিষ সমাজে ছড়িয়ে দিতে পারলেও তারা খুশি। অন্যদিকে রাজ্যের প্রধান বাম দল তথা সিপিআই(এম) এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন গড়ে তুলবার চেষ্টা করছে। তাদের দাবি সন্দেশখালির ঘটনার মূল কারিগর শাহজাহান-এর শাস্তিবিধান। প্রতিদিনের সংবাদপত্রের পাতায় এই বিস্তারিত বিবরণ পেশ হচ্ছে। মানুষ তা পড়ছেন, জানছেন। স্থানীয় নিপীড়িত মানুষ মুখ খুলছেন। কিন্তু যাদের কোন পরিবর্তন নেই তারা হল রাজ্য পুলিশ প্রশাসন। প্রতিদিন আদালত তাদের ভর্ৎসনা করছেন, মূল অপরাধী শাহজাহানকে খুঁজে আনতে বলছে। কিন্তু রাজ্য পুলিশ তাকে এরপরেও দীর্ঘদিন খুঁজে পায় না। তারপর হঠাৎ একদিন রাজ্য পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করল। কোন জাদুবলে এতদিন অধরা থাকার পরে হঠাৎ তিনি ধরা পড়লেন তা পাঠক আন্দাজ করতে পারেন।

গোটা ঘটনপ্রবাহ থেকে যে কথা উঠে এসেছে তা হল এই সন্দেশখালি অঞ্চলে বছরের পর বছর ধরে শাহজাহান নামক দুষ্কৃতি প্রায় একটা সমান্তরাল সাম্রাজ্য গঠন করে ফেলেছিল। সেখানে তার দলীয় বাহিনী একটা দখলদারি কায়েম করেছিল যার উৎকট প্রকাশ ছিল জোর করে সাধারণ মানুষের জমি দখল করে তাকে ভেড়ি বানিয়ে নিজের সাম্রাজ্য চালানোর অর্থ জোগাড় করা, যার ভাগ হয়ত শাসক দলের উচ্চস্তর অবধিও পৌঁছাত। নাহলে কেনই বা পুলিশ তাকে খুঁজে পায় না আর কীভাবেই বা সে এমন সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে পারে। আর তার এই আধিপত্যের ঘৃণ্যতম অংশ ছিল অঞ্চলের মহিলাদের ওপর দখলদারি কায়েম করা। যে কোনো সময় দলীয় আখড়ায় ডেকে পাঠিয়ে মহিলাদের বসিয়ে রাখা যে কোনো সৎ উদ্দেশ্যে নয় তা সবাই বোঝেন। এলাকার জমির মতো মহিলারাও যেন তার ও তার অনুচরদের সম্পত্তি। প্রশ্ন হল এতদিন এসব ঘটনা ঘটার পরেও এলাকার মহিলারা কিছু বলেননি কেন? আজকে রাজ্য প্রশাসন তথা পুলিশ ঠিক এই কুযুক্তিকেই দাঁড় করাতে চাইছে। কিন্তু কেন?

ইতিমধ্যেই খবরে প্রকাশিত যে আজকের বিজেপির বিধানসভার দলীয় নেতা তথা সাবেক তৃণমূল নেতা শুভেন্দু অধিকারীর সাথে একদা এই শাহজাহানের খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এমনকি জেলবন্দী তৃণমূল নেতা তথা রেশন কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত প্রাক্তন মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের অবৈধ টাকা এই শাহজাহানের কাছেই গচ্ছিত ছিল বলে অনুমান। রাজ্য প্রশাসনের স্নেহের হাত মাথায় না থাকলে কোন স্থানীয় লুম্পেনের যে এমন ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি হয়না তা কে না বোঝেন। তবুও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জী বলে চলেছেন যে এসব ছোটখাটো ঘটনা। ওনার ওর সাথে কোন যোগাযোগ নেই। একই কথা অবশ্য নারদ কেলেঙ্কারিতে যুক্তদের সম্পর্কেও তিনি বলেছিলেন। নিজেকে গোটা ঘটনার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে মমতা ব্যানার্জি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তাই গোড়া থেকেই পুলিশি তদন্তের গতিপ্রকৃতি ঠিক হয়ে যাচ্ছে।

প্রথমত এটা প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে যে এখানে নারীদের সাথে কোনও অপরাধ সংঘটিত হয়নি। তার জন্য প্রথমে পুলিশ এবং পরে রাজ্যের মহিলা কমিশন গিয়েও এই দাবি করতে থাকে যে মহিলাদের তোলা অভিযোগের কোনও সারবত্তা নেই। সবাই নাকি শোনা কথা বলছেন। কোনও মহিলা দাবি করেননি যে তাঁর সাথে কোনও অপরাধ করা হয়েছে। অতঃপর যখন একজন মহিলার গোপন জবানবন্দির ফলে শাহজাহানের দুই সাগরেদ গ্রেফতার হল তার অব্যবহিত পরেই সেই মহিলার বাড়িতে পুলিশ চড়াও হল। এখন রাজ্য পুলিশ দাবি করছে যে তারা নাকি মূল পান্ডা শাহজাহানকে খুঁজেই পাচ্ছে না। অথচ সে দিব্যি আদালতে মামলা করছে। সুতরাং গোটা চিত্রনাট্যই যে খোদ নবান্নের নির্দেশে পরিচালিত হচ্ছে তা আর বলে দিতে হয় না। আর ঠিক এই কারণেই রাজ্য পুলিশ ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে আছে। আদালতে নাক কান কাটা গেলেও তাদের কিছু করার নেই। বিশেষত সারদা কেলেঙ্কারিতে অন্যতম অভিযুক্ত যখন রাজ্য পুলিশের পরামর্শদাতা হিসাবে নিযুক্ত হন, তখনই রাজ্য পুলিশের চরিত্রটি নির্ধারিত হয়ে যায়। সন্দেশখালি সেই অপদর্থতারই সর্বশেষ উদাহরণ। তাই অন্তিম চেষ্টা চলছে যাতে এই ঘটনার সাথে মমতা ব্যানার্জির কোন যোগাযোগ প্রকাশিত না হয়। তাই হয়ত পুলিশি আতিথেয়তায় শাহজাহানের সাথে দর কষাকষি চলছে। তাই সাংবাদিক থেকে শুরু করে প্রাক্তন বাম বিধায়ক সবাইকেই তদন্তে জড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে।

প্রশ্ন জাগে এতকিছুর পরেও রাজ্যের শাসকদল এমন এক দুষ্কৃতিকে বাঁচাতে তৎপর কেন? কেন নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যতকে সঙ্কটে ফেলেও মমতা ব্যানার্জি লড়ে যাচ্ছেন শাহজাহানের পক্ষে। এর দুটি সম্ভাব্য কারণ আছে। এক, যে এখানে কোন পারস্পরিক স্বার্থ জড়িত। তাই নিজের গ্রহণযোগ্যতা বজায় রাখতে মমতা ব্যানার্জি লড়ে যাচ্ছেন। এ ব্যতীত একটি অন্য কারণ হয়, যা রাজনৈতিকভাবে আরও এক গভীর অসুখের নির্দেশ করে। তৃণমূল নেতৃত্ব মনে করছে যে এসব ঘটনা ক্ষণস্থায়ী এবং এর অভিঘাত আগামী নির্বাচনের আগেই প্রশমিত হয়ে যাবে। তাই তারা নিশ্চিন্ত যে এখন যতই হট্টগোল হোক মানুষের মনে এই ঘটনার ছাপ বেশীদিন থাকবে না। তাদের এই ধারণা নেহাত অমূলক নয়। ভগবানপুরে বা বগটুইতে ঘটনা ঘটার পরেও তা তৃণমূলের নির্বাচনী ফলে তেমন প্রভাব ফেলেনি। এ বাস্তব অস্বীকার করবে কে? রাজনৈতিক অপরাধের এমন সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৃণমূলের শাসনে যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা কি যথেষ্ট উদ্বেগের নয়? কীভাবে এত অপরাধ করার পরেও মানুষ এদেরকেই নির্বাচিত করছেন তা ভেবে দেখার দরকার।

রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা এর অন্যতম মূল চালিকাশক্তি। নেই রাজ্যে গ্রামাঞ্চলে বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে যেভাবে আজ সরকারি অনুদানের মুখাপেক্ষী থাকতে হচ্ছে তা অদৃষ্টপূর্ব। কিন্তু তার চাইতেও ভয়ানক হল তৃণমূলের কল্যাণে আজ গ্রামীণ অর্থনীতির চালিকাশক্তি হল স্থানীয় রাজনৈতিক মাস্তানরা। সন্দেশখালি এর এক আদর্শ নমুনা। শাহজাহান বা তার বাহিনী কোন ব্যক্তির জমি জোর করে দখল করে নেওয়ার পর সেই ব্যক্তিকে এদের কাছেই আসতে হয় কাজের জন্য কারণ রাজ্য প্রশাসন মানুষের বদলে দুষ্কৃতির পক্ষই নিয়ে থাকে। ফলে বাংলার মানুষ এক দুষ্টচক্রের ফাঁদে পড়ে গিয়েছেন। একদিকে যারা তাঁদের লুট করে অন্যদিকে তারাই সরকারি স্নেহ ভোগ করে সেই লুটের বখরার বিনিময়ে। ফলে মানুষ ক্ষোভ ব্যক্ত করার পরেও প্রশাসনের সাথে সমঝোতা করে ফেলেন। আর রাজ্যের বিরোধী রাজনৈতিক দল হয় নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন নয়ত অন্য কোনও রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করছে। ফলে মানুষ আজ উদ্ভ্রান্ত যে কাকে তারা বিশ্বাস করবে। বামপন্থীরা এখনও এই রাজনৈতিক ভারসাম্য পরিবর্তন করার মতন শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে মানুষ আজ দিশাহারা। ক্ষোভে তারা ফেটে পড়ছেন মাঝে মাঝে কিন্তু তাকে দিশা দেখানোর শক্তির আজ অভাব। আর এটাই তৃণমূলের আত্মবিশ্বাসের কারণ।

তবে এই আত্মবিশ্বাসেও চিড় ধরতে বাধ্য। এত কাণ্ডের পরেও শাহজাহানকে গ্রেপ্তার করতে নানা টালবাহানা করার পরেও, তাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়েছে মমতা সরকার। এর নেপথ্যে একদিকে যেমন রয়েছে হাইকোর্টের চাপ, অন্যদিকে রয়েছে মানুষের অসন্তোষ। এখন দেখার সন্দেশখালির বাসিন্দারা ন্যায় পান কি না!