আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ● ৩-১৮ ফাল্গুন, ১৪৩০

প্রবন্ধ

মহার্ঘ্য ওষুধ দিশেহারা মানুষ

প্রতীশ ভৌমিক


দেশের রাষ্ট্রায়ত্ব ওষুধের কোম্পানিগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলোর উৎপাদনও প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে বললেই চলে। সে কারণে আজ বেসরকারি ও বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর দাপাদাপি বেড়েছে এবং ওষুধ মৌল বা এ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস্ ইনগ্রেডিয়েন্ট (এ.পি.আই.) বিদেশ থেকেই কিনতে বাধ্য হচ্ছে। ফলত দাম বেশি হবে সেটাই স্বাভাবিক। একথা অনেকেই জানেন যে এই ওষুধের এ.পি.আই. কিলোগ্রামের হিসেবে কিনে তা থেকে কোম্পানিগুলো লক্ষ লক্ষ ট্যাবলেট/ক্যাপসুল তৈরি করে মিলিগ্রামের হিসেবে অনেক বেশি দামে বিক্রি করে।

মূল্য নির্ধারণ ও ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে 'Drug Price Control Order (DPCO)' প্রথম প্রবর্তন করা হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারের এসেন্সিয়াল কমোডিটিস এ্যাক্ট ১৯৫৫-র (৩)এ-র ধারায় ১৯৭০ সালে। পরে ১৯৭৯, ১৯৮৭, ১৯৯৫, ২০১৩, ২০২৩ সালে ক্রমে ক্রমে তা পরিবর্তিত হয় সময়ের সঙ্গে বিভিন্ন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারেই। অতএব মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে সরকারি নিয়মের মধ্যেই। DPCO-র দায়িত্ব শুধু মূল্য নির্ধারণ, নিয়ন্ত্রণ ও পদ্ধতি নির্ধারণই নয় বরঞ্চ নিয়ন্ত্রিত ওষুধের তালিকা তৈরি করা, সস্তায় ওষুধ ও ওষুধের সহজলভ্যতা বৃদ্ধি করতে পরিকাঠামো গড়ে তোলা। এছাড়াও নিয়ম লঙ্ঘনে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব পালন করা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এদেশে DPCO-র নিয়ম লঙ্ঘনে সরকার অনেক ক্ষেত্রেই উদাসীন।

১৯৭৪ সালে DPCO তালিকাভুক্ত ওষুধের সংখ্যা ছিল ৩৪৭ এবং ১৯৯৫ সালে সেই সংখ্যা নেমে দাঁড়ায় ৭৪টিতে। এই তালিকায় ওষুধের সংখ্যা যত কমে ততই বাড়ে তালিকার বাইরে থাকা ওষুধের দাম। একইভাবে মেডিক্যাল ডিভাইসও ২০১৮ সালে নিয়ন্ত্রণভুক্ত হলেও সরকারি উদাসীনতার কারণে দাম বাড়তে থাকে।

DPCO-র পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকার 'ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যালস প্রাইসিং অথোরিটি (NPPA)' গড়ে তোলে ১৯৯৭ সালে। কেন্দ্রীয় সরকারের কেমিক্যাল ও ফার্টিলাইজার মন্ত্রকের অধীনস্থ ড্রাগ কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের নিয়ন্ত্রণাধীন NPPA মারফত মনিটরিং করা হয়ে থাকে। ২০১১ সালে ন্যাশনাল লিস্ট অফ এসেন্সিয়াল মেডিসিন গঠন করে ২০১৩ সালে ৬৮০টি ওষুধের তালিকা করা হয়। পরবর্তীতে ২০২২-এ এই ওষুধের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৭২টি। বলা হয়েছে এই সমস্ত ওষুধের ক্ষেত্রে সিলিং প্রাইস নির্ধারিত হবে প্রতি বছর এপ্রিল মাসের শুরুতে এবং ১০% শতাংশ হারে ওষুধের দাম বাড়বে। যেভাবে এই ওষুধের মূল্য নির্ধারণ হয়েছে তা হল বাজারে বিক্রিত একটি ওষুধের ক্ষেত্রে ন্যূনতম এক শতাংশ দখলে থাকা সেইসব ওষুধের গড় দামই হবে ওষুধটির মৌল বা মৌল মূল্য। যদিও এই পদ্ধতিতে নির্ধারণ হলে ওষুধের দাম অনেক বেশি বেড়ে যায় কারণ, ঐ সংগৃহীত ওষুধের কোনো একটির দাম যদি বেশি হয় তাহলেই মৌলটির গড় দাম বেড়ে যায়।

যদিও আগের পদ্ধতি ছিল অনেক সহজ, তাতে বলা হতো ওষুধটির উৎপাদন মুল্যর সঙ্গে ১০০-১৫০% শতাংশ লাভ যুক্ত করে মূল্য নির্ধারণ করার কথা। সেখানে বছর বছর মৌলটির ১০% দাম বাড়ানোর কথাও বলা ছিল না। আগের পদ্ধতিতে ব্যবসায়ীরা তাদের উৎপাদন খরচ প্রকাশ করতে বাধ্য হতেন, এছাড়া লাভের পরিমাণও অতিরিক্ত বেশি ছিল না। বিভিন্ন মহলের চাপে পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন পদ্ধতি চালু হয়। শিডিউল ড্রাগের ক্ষেত্রে কন্ট্রোল মার্জিন ১৬% কিন্তু হাজার হাজার নন শিডিউল ড্রাগের ক্ষেত্রে সরকার কোম্পানিগুলোকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয় তাদের ওষুধের প্রফিট মার্জিন নির্ধারণ করতে।

SEZ অঞ্চলে তৈরি ওষুধের ক্ষেত্রে আইনের সমস্ত নিয়মের ব্যতিক্রম হয়ে থাকে। ট্যাক্সছাড় থেকে শুরু করে প্রফিট মার্জিন বাড়ানোর সমস্ত সুযোগই দেওয়া হয়। প্রথম পাঁচ বছর ১০০% ট্যাক্স ছাড়, পরের পাঁচ বছর ৫০% ছাড়। একই কোম্পানির বিভিন্ন শাখা এই পাঁচ বছর করে সুবিধা নিয়ে ওষুধের দাম বাড়ায় এবং ডিসকাউন্ট দেয়। বড়ো বড়ো কোম্পানির ওষুধও এই SEZ অঞ্চলে তৈরি হয়। বর্তমান সময়ে SEZ অঞ্চলে ওষুধ তৈরি করে অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিয়ে বাজারে বিক্রি করছে এবং মাত্রাতিরিক্ত লাভ রেখেই বাজারজাত করছে। সেই কারণেই ওষুধের ২০০% দাম বাড়িয়ে ৫০% থেকে ৭৫% শতাংশ ডিসকাউন্ট দেয় ফেয়ার প্রাইস থেকে শুরু করে বিভিন্ন ওষুধের দোকান।

করোনাকালে বিভিন্ন ওষুধের দাম বেড়েছে ৩০-৫০% শতাংশ। ক্রাইসিস তৈরি করে ওষুধের দাম বাড়ায় মালিক পক্ষ। এই বিষয়ে সরকারি আমলারা কিছু জানেন না তা জোর দিয়ে বলা যাবে না। এমনিতেই ওষুধের দাম আকাশছোঁয়া এরপরে ওষুধের দামের উপর ১২% থেকে ১৮% শতাংশ জিএসটি যুক্ত করে ওষুধ হয় আরও মহার্ঘ‍্য। জীবনদায়ী ওষুধের উপর GST সরকারকে একটি কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়। সরকার কখনওই জনগনের প্রতি অমানবিক হতে পারে না, জনস্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে ওষুধ GST-মুক্ত রাখাই বাঞ্ছনীয়।

সরকারি হাসপাতাল ও প্রাথমিক ক্লিনিকগুলোতে বিনামূল্যের ওষুধ প্রায় নেই বললেই চলে। সাধারণ মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ওষুধ হল চিকিৎসার একটা প্রয়োজনীয় অস্ত্র যা ক্রমশ পণ্যে পরিণত হয়েছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে অসহায় মানুষ বাঁচার প্রয়োজনের শেষ সম্বলটুকুও ওষুধের জন্য খরচ করতে বাধ্য হচ্ছে।