আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ● ৩-১৮ ফাল্গুন, ১৪৩০

প্রবন্ধ

সকল কাজের কাজি

প্রবুদ্ধ বাগচী


যেদিন থেকে আমাদের দেশটা নিজের পায়ে চলতে শিখেছে সেই সাড়ে সাত দশক আগেই পরিকল্পনা নীতিকাররা একটা বুনিয়াদি বিষয় বুঝেছিলেন, এই ভূখণ্ডের সাতভাগের একভাগ মানুষ গ্রামে বাস করেন - তাই দেশের সত্যি সত্যি উন্নতি করতে গেলে গ্রামীন জনতার আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়ন সব থেকে আগে করা দরকার। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ভালো-মন্দ নিয়ে আজ এত বছর পরে সমালোচনা-বিতর্ক চলতেই পারে - তবে যতদিন অবধি পরিকল্পনা কমিশন ও পাঁচশালা-নীতি চালু ছিল ততদিন এই প্রায়োরিটি বা অগ্রাধিকার বারবার স্বীকৃত হয়েছে। আর গ্রামীন দারিদ্র দূর করতে গেলে নিচের তলার মানুষের হাতে যে কাজ দেওয়া দরকার, এটা বিলক্ষন বুঝেছিলেন নীতি-কর্তারা - ওই কাজের উপার্জন থেকেই তাঁদের আয়-ব্যয়-সঞ্চয়। যেহেতু দেশের কৃষিক্ষেত্র অনেকটাই প্রকৃতি-নির্ভর তাই সারাবছর সেখানে কাজ পাওয়া দুষ্কর, এই মরশুমি বেরোজগারি আটকাতে বছরভর কাজের জোগান থাকা একান্ত দরকার। গ্রামীন মানুষের কাজের ব্যবস্থা করতে কোনো-না-কোনো পরিকল্পনার কথা প্রতিটি বাজেটেই ঘোষণা করা হয়ে এসেছে। জরুরি অবস্থা জারি করার পর শ্রীমতী গান্ধির বহুনিন্দিত 'বিশদফা কর্মসূচি'তে যে 'গরিবি হটাও'-এর ডাক দেওয়া হয়েছিল তার মধ্যেও প্রথম কথাটাই ছিল গ্রামীণ এলাকায় কাজের ব্যবস্থা করে দারিদ্রের মুক্তি। তার সদর্থক মূল্যায়ন কী কতদূর হয়েছে সেই প্রশ্নে আমরা যাব না। কেবল খেয়াল রাখব গ্রামীণ মানুষের দিকে আমাদের সরকার ও রাষ্ট্র ঠিক কীভাবে তাকিয়েছে এতকাল।

নব্বইয়ের দশকে নতুন বিশ্বায়ন ব্যবস্থা ও খোলাবাজারি অর্থনীতির আওতায় কিছু কিছু ইতিবাচক সংস্কারের ঘটনা ঘটলেও মূলত তা ছিল সারা বিশ্বের দেশি-বিদেশি পুঁজিকে অবাধ মৃগয়ার ক্ষেত্র খুলে দেওয়া। আর এই বাজার-ব্যবস্থায় পণ্য বা পরিষেবার ক্রেতা তৈরির জন্যও কিছু অর্থনৈতিক উদ্যোগ দরকার হয়, তাই মানুষের হাতে বাড়তি টাকার সংস্থান করাও সরকারের দায়ের মধ্যে পড়ে। কিন্তু একই সঙ্গে উন্মুক্ত বাজারি অর্থনীতির মূল কান্ডারি যেহেতু বৃহৎ পুঁজি ফলে তার ধাক্কাটা সরাসরি গরিব মানুষের ওপর পড়তে বাধ্য। তাই একদিকে বাজার অর্থনীতির আক্রমণে বিপন্ন গ্রামীণ গরিব মানুষ অন্যদিকে এই ধাক্কা সামলানোর জন্য কিছু রিলিফের ব্যবস্থা - নব্বই দশকের ভারতীয় অর্থনীতি প্রধানত এই টানাপোড়েনে সংক্ষুব্ধ। একই সঙ্গে সার্বিকভাবে এক দশকের বিশ্বায়িত অর্থব্যবস্থা সারা দেশেই এক ধরনের অধিকার রাজনীতির জন্ম দিতে থাকে, এটা মনে রাখা দরকার। এই বিকল্প রাজনীতির পাঠ থেকেই নতুনভাবে দেখা হতে থাকে কর্মসংস্থানের বিষয়টিও।

গত শতকের প্রথম দশকে ইউপিএ সরকারের আমলে এই প্রশ্নটি জোরালোভাবে সামনে আসে। কাজের সংস্থানের পরিবর্তে কাজের অধিকারে বদলে যেতে থাকে ফোকাস। একই সঙ্গে শিক্ষার অধিকার, তথ্যের অধিকার প্রতিটি বিষয়ই সংসদের বিবেচনার মধ্যে ঢুকে পড়ে। এই আবহেই দেশের মানুষের কাজ পাওয়ার বিষয়টাও সুযোগের থেকে অধিকারের পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এই পটবদলে ইউপিএ সরকারের প্রধান স্তম্ভ হিসেবে বামপন্থী সংসদদের ব্লক কিছুটা নিজেদের সাফল্য দাবি করেন। তাঁদের উপস্থিতি বিনা সরকারকে এই অভিমুখে চালিত করা যেত না বলেই তাঁদের বিশ্বাস ও দাবি। এর সারবত্তা এককথায় মেনে নেওয়া যাবে কি না সেটা তর্কসাপেক্ষ। কারণ, ওই সময়কালে সারা দেশব্যাপী যে সামাজিক অস্থিরতা তার অনিবার্য টোটকা হিসেবে নানা সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচিতে সরকারকে জড়িয়ে নেওয়া ছিল সময়ের দাবি। তবে এই বিষয়ে বামপন্থী ব্লক তাঁদের রাজনীতিগত বাধ্যতা থেকেই বাড়তি উদ্যোগী হয়েছিলেন, এটা অসত্য নয়। যদিও কেন্দ্রীয়স্তরে নিও-লিবারাল অর্থনীতিকে সমালোচনা করলেও তাঁদের পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলিতে যে সেই নীতির বাইরে গিয়ে বিশেষ কিছু করার চেষ্টা হয়েছিল, এমন নয়। 

মোটামুটি এমন এক বাস্তবতায় পরিকল্পনা কমিশন গ্রামীণ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কীরকম প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে তার জন্য সারা দেশজোড়া এক সমীক্ষা করেন, যার নেতৃত্বে ছিলেন একদল বাছাই করা অর্থনীতিবিদ। তাঁদেরই অন্যতম খ্যাত অর্থনীতিক শ্রী অমিত ভাদুড়ি কলকাতায় একটি আলোচনা সভায় বলেছিলেন (ডিসেম্বর, ২০০৮), গ্রামীণ মানুষের হাতে অর্থ জোগান দিতে গেলে কার্যত তাদের বছরে অন্তত তিনশো দিনের কাজ দেওয়া দরকার। ইউপিএ চেয়ারপার্সন সনিয়া গান্ধির কাছে তাঁদের আর্জি ছিল, তিনশো দিন না পারলেও অন্তত দুশো দিনের কাজের গ্যারান্টি সরকার দিক। সমীক্ষার অন্তর্বস্তু আর সরকারি সিদ্ধান্তের মধ্যে ফারাক হয়ে যাওয়া কোনো নতুন কথা নয়, হলও তাই। অর্থের সংস্থান বিষয়ে সবুজ সঙ্কেত না পাওয়ায় কার্যত তা থমকে যায়। বছরে একশো দিনের কাজে - গোড়া থেকেই এই প্রকল্পটি যে খুব চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, তা নয়। তবে এই প্রথম কাজের ক্ষেত্রে অধিকারের মাত্রা যুক্ত হওয়ায় 'মহাত্মা গান্ধি জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনা' নাম বদলে হল 'মহাত্মা গান্ধি জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান আইন'। সংসদে পাশ-হওয়া আইনবলে এবার কর্মপ্রার্থীদের কাজ চাইবার অধিকার থাকবে, জব কার্ড পাওয়ার পরে সেই প্রার্থীকে উপযুক্ত কাজ দিতে না পারলে তাঁকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সংস্থানও রইল ওই আইনে। সন্দেহ নেই, ব্যাপারটা দেখতে শুনতে খুব ভাল।

বিক্ষিপ্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি বা ইতিউতি দুর্নীতির প্রকোপ থাকলেও মোটামুটি আমাদের রাজ্যে এই 'একশো দিনের কাজ' আইন রূপায়নে বামপন্থী সরকার মনোযোগী ছিলেন। সব ক্ষেত্রেই যে একশো দিন কাজ দেওয়া যেত তা নয়, তবে মানুষ উপকৃত হচ্ছিলেন নিশ্চয়ই। তৎকালীন বিরোধী দল এগুলো নিয়ে হইচই করতেন বটে কিন্তু সেটা বড় একটা জনগ্রাহ্য হতে পারত না। আর ওই সময়কালেই দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী লোকসভার বিরোধী বেঞ্চে বসে ফুট কাটতেন এই একশো দিনের কাজের আইন নিয়ে - স্বাধীনতার এত বছর পরেও পুকুর কাটার জন্য (গন্ডা খোড়নে কে লিয়ে) টাকা দেওয়া হলে সেটা তাঁর মনে হতো অপব্যয়। কার্যত এটা গ্রামীণ মানুষকে অপমান করার সামিল - অবশ্য অমন তো তিনি কতই করে থাকেন!

তবে দশ বছর আগে ক্ষমতায় এসে 'গণ্ডা খোঁড়ার' কাজ তিনি বন্ধ করতে পারেননি। বরং তাঁর সরকার যেহেতু দেশশুদ্ধু মানুষকে 'চোর' বলে অবিশ্বাস করে তাই গরিব মানুষের টাকা পাওয়ার ক্ষেত্রেও আধার লিঙ্ক, ব্যাঙ্ক আকাউন্ট লিঙ্ক এই ধরনের বহুবিধ বিষয়ে যথারীতি অতিরিক্ত কড়াকড়ি করে গ্রামের মানুষের অসুবিধাটাই করলেন বেশি। রাজ্যস্তরে এই বিষয়ে খুব ইতিবাচক প্রতিবাদ হয়েছে, এমন নয়। বরং গত দশ বছরে প্রতিটি রাজ্যের সরকারকে কেন্দ্রের সরকার তাঁদের অনুগত প্রজা হিসেবে বিবেচনা করে নানা ফরমান জারি করার যে রীতি চালু করেছেন, এই বিশেষ ক্ষেত্রটিও তার ব্যতিক্রম নয়।

কিন্তু আমাদের উদ্বেগের জায়গাটি স্বতন্ত্র। বস্তুত একশো দিনের কাজের প্রাপ্য অর্থ নিয়ে গত প্রায় এক বছর ধরে যে দুই সরকারের নজিরবিহীন বিরোধ চলছে তার থেকেও বড় হল মূল আইনটির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। একশো দিন কাজ পেলেও যে গ্রামের মানুষের খুব সুরাহা হয় তা নয়, তাঁদের দরকার আরও বেশি কাজ। এই আইন চালু হওয়ায় পরের সময়কালে খোলাবাজারি অর্থনীতির খারাপ প্রতিক্রিয়া আরও খারাপ হয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে সারের ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়া, মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসের বিষয়ে সুরাহা না হওয়ায় ক্রমশ কৃষির সঙ্কট বেড়েছে যার উত্তুংগ প্রকাশ ঘটেছে কৃষক আন্দোলনে। 'কৃষকবন্ধু' জাতীয় স্কিম বা কৃষিবীমা ইত্যাদির প্রচলন বুঝিয়ে দেয় কৃষকরা ভাল নেই। তথ্য চেপে গেলেও ঋণের দায়ে আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা সারা দেশেই বাড়ছে, এই রাজ্যেও। বাড়ছে গ্রামে গ্রামে বেকারি, যার পরিণতিতে ভিন রাজ্যে কাজের খোঁজে চলে যাওয়া শ্রমিকদের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে - এঁরা প্রধানত অসংগঠিত কৃষি-শ্রমিক বা নির্মাণশিল্পে যুক্ত। মাঝখানে ঘটে গেছে লকডাউন ও আর্থিক বিপর্যয়। আরও কাজ কমেছে। উত্তরবঙ্গের চা-বাগান এলাকার শিশু-কিশোরদের পর্যন্ত শ্রমিক হিসেবে বেআইনি পাচারের কথা আমরা সংবাদপত্রে পড়েছি (আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন ১২/২/২৪) এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় বঞ্চনা যদি সত্যিই বিশ্বাস্যভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায় তা প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়ে যেতে পারত গ্রামের মানুষের রুটিরুজির লড়াইয়ের সঙ্গে। আশির দশকে বামপন্থী সরকার কেন্দ্র-রাজ্য বিরোধকে তাত্ত্বিকভাবে সর্বভারতীয় স্তরে তুলে আনতে পেরেছিল - যার সঙ্গে যুক্ত ছিল সরকারি বরাদ্দ ও ব্যায়ের স্বচ্ছ তথ্য, নানা প্রতিবেদন - যা পাবলিক ডোমেইনে এনে ফেললে তার প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠা পায়। আজকের যুগে তথ্য ও হিসেবনিকেশ যখন প্রায় পুরোটাই ডিজিটাইজড তাকে জনপরিসরে নিয়ে আসা আরও সহজ। এক্ষেত্রে তা কিন্তু আসেনি।

যুযুধান দুইপক্ষ একেক রকম তথ্য দিয়ে আসছেন নানান ভিন্ন সময়ে। অথচ 'শ্বেতপত্র' প্রকাশ করে রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার নিজেদের দাবির যাথার্থ্য প্রমাণ করতেই পারতেন, সাংবিধানিকভাবে এই ক্ষমতা তাঁদের আছে। এর বাইরে পুরো বিতর্কটাকেই নিয়ে যাওয়া হল এক ধরনের গ্রাম্য অশীলিত ঝগড়ার স্তরে - দুপক্ষের কেউই এ বিষয়ে কম যান না। একদল যদি কলকাতার রাজপথে ধর্না দেন তবে আরেকপক্ষ গিয়ে কেন্দ্রের গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রীর কানে মন্ত্রণা দেন, তাঁরা যেন রাজ্যের অর্থ মঞ্জুর না করেন। রাজ্যপালকেও মাঝে আসরে নামতে দেখা গেল, যার এই বিষয়ে কণামাত্র ক্ষমতাই নেই। কখনো ঝগড়াঝাটি, ধুন্দুমার, বিবৃতির উত্তপ্ত লড়াই নয়াদিল্লির রাজঘাট থেকে অবান্তরভাবে গড়িয়ে এল কলকাতার রাজভবনে। কিন্তু টাকার কী হল?

এর কোনো সদুত্তর আজ অবধি নেই। কেন্দ্রীয় প্রকল্পে আর্থিক দুর্নীতির প্রসঙ্গ নতুন নয়। আমাদের স্মরণে আসতে পারে, পূর্বতন বাম সরকারের আমলে নানা কেন্দ্রীয় প্রকল্পে রাজ্যের বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি জানালে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী দিল্লিতে গিয়ে দরবার করতেন, যাতে রাজ্যের দাবিকে আমল না দিয়ে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ আটকে দেওয়া যায় - কারণ অর্থ দিলেই সরকার সব 'চুরি করে নেবে'! ২০০০ সালের রাজ্যব্যাপী নজিরবিহীন বন্যায় কেন্দ্রীয় সাহায্য আটকানোর জন্য তিনি 'ম্যানমেড বন্যা'-র তত্ত্ব আমদানি করেছিলেন। আজকে প্রায় ব্যাপারটা ব্যুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এইসব নাট্যরঙ্গের থেকেও মূল প্রশ্ন গ্রামীন মানুষের কাজ পাওয়ার অধিকার ও উপযুক্ত কাজ পাওয়া। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অর্থে যদি দুর্নীতি হয়ে থাকে তাকে প্রতিরোধ করার সুনির্দিষ্ট উপায় আছে। সরকারি প্রকল্প রূপায়ন করেন সরকারি আধিকারিকরা, জনগণের অর্থ নয়ছয় করলে আইনমাফিক তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। রাজ্যস্তরে কোন কোন আধিকারিক এই তছরুপের সঙ্গে যুক্ত তার কোনো প্রামাণ্য তথ্য আজ পর্যন্ত প্রকাশ্যে আসেনি - অথচ এটা চিহ্নিত করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। অন্তত রাজ্যের বর্তমান বিরোধী দলনেতা যিনি দাবি করেন সরকারের সব গোপন তথ্যই নাকি সবসময় তার পকেটে থাকে তিনিও কোনো দুর্নীতিগ্রস্ত আধিকারিকের তালিকা প্রকাশ করে সরকারকে পালটা চাপে ফেলার কৌশল নেননি। তাছাড়া কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সামাজিক অডিট করানোর জন্য প্রকল্পভিত্তিক এনজিও এজেন্সি থাকে - একশো দিনের কাজের ক্ষেত্রেও আছে। তাঁদের মূল্যায়ন কী, তাও আমরা জানি না। জনশ্রুতি হল, এইসব এনজিও-রা বেশিটাই নাকি বকলমে সংঘ পরিবারের ঘনিষ্ঠ, ঘটনাচক্রে তাঁরাও মুখে কুলুপ এঁটেছেন।

এখন যদি ধরেও নিই, রাজ্যের সরকার বা শাসকদল তাঁদের স্বার্থে 'দুর্নীতিগ্রস্তদের' আড়াল করতে চাইছেন - তাতেও কি শেষরক্ষা হওয়া সম্ভব? কারণ, রাজ্যের অধিকাংশ জেলাশাসক বা জেলার বিভিন্ন প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্তরা বেশিরভাগই কেন্দ্রীয় ক্যাডারের আধিকারিক, রাজ্যের গ্রামোন্নয়ন বা পঞ্চায়েত দফতরের মুখ্যসচিব বা সচিবরাও সকলেও একই গোত্রে পড়েন - তাঁদের চাকরির পদোন্নতিসহ সমস্ত সুবিধা পেতে গেলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতরের অনুমোদন লাগে। বহুবার একশো দিনের কাজের প্রকল্পের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী দল সাড়ম্বরে রাজ্যে ঘুরে গেছেন, কেন্দ্রীয় তদন্তসংস্থাগুলি প্রতিদিনই এখানে ওখানে হানা দিচ্ছেন - তাঁরাও কি কেন্দ্রীয় সার্ভিস ক্যাডারের একজন জেলাশাসক বা প্রধান সচিব পদমর্যাদার একজন আধিকারিককেও চিহ্নিত করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তাঁর শাস্তির জন্য অনুমোদন করেছেন? তাহলে বিষয়টা কী? অথচ আমফান ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রধানমন্ত্রীর ডাকা সভা থেকে জরুরি প্রয়োজনে আগে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যসচিবকে শোকজ করা হয়েছিল ও পরে তাঁর অবসরকালীন সুবিধাগুলি পর্যন্ত আটকে দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের 'অর্থ তছরুপ'-এর জন্য এমন একজন উচ্চপদাধিকারীকেও দিল্লীশ্বর খুঁজে বার করতে পারলেন না? তাহলে দুর্নীতিটা হল কোন স্তরে, কাদের হাতে? গ্রামীন মানুষের কর্মসংস্থানের অর্থ বছরের পর বছর আটকে রাখার মূল সূত্রটা কোথায়? তার ভিত্তিটাই বা কী? পুরো প্রসঙ্গটার সবথেকে অন্ধকার অংশ এইটাই। আর দুর্ভাগ্যজনক হল এমন একটা আবছায়া বিষয়কে সামনে রেখে গরিব মানুষের প্রাপ্য আটকে রাখা হচ্ছে।

এটা খাঁটি যুক্তি যে, মুষ্টিমেয় বা তারও বেশি কিছু অংশের দুর্নীতির জন্য সমস্ত প্রার্থীর ন্যায্য পাওনা আটকে রাখা যায় না। একটি অফিসের শতকরা পঁচিশভাগ কর্মী দুর্নীতিতে যুক্ত এই অভিযোগে সমস্ত কর্মী আধিকারিকের বেতন আটকে রাখার মতোই এটা অনৈতিক। তার ওপর আর পাঁচটা কেন্দ্রীয় প্রকল্পের থেকে এমএনরেগা (একশো দিনের কাজ আইন) আলাদা - কারণ এটা সংসদে পাস হওয়া একটা আইন ও বিষয়টা নাগরিকের আইনি অধিকারের। আসলে এই বঞ্চনা কর্মপ্রার্থীদের সাংবিধানিক অধিকারের ওপর নজিরবিহীন আঘাত। কিন্তু তার ব্যখ্যা ও বিস্তার ঘটে চলেছে একেবারে ভিন্ন পথে ও মতে। যার সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত হল রাজ্য বাজেটে 'কর্মশ্রী' নামক একটি ধোঁয়াটে প্রকল্পের ঘোষণায়। একটি প্রতিষ্ঠিত আইনি অধিকারের অনাচারকে কি পাল্টা সীমিত সুবিধে দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা যায়? তাই অনেক প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে এই প্রকল্পের সূচনা ও তার রূপায়ন ঘিরে।

'সীমিত বিকল্প'-র ধারনাটি শুনতে যত ভাল আদপে তার কার্যকারিতা নিয়ে অনেকগুলো সংশয় আছে। কেন্দ্রীয় সরকার অনুমোদন দিচ্ছেন না বলে একসময় রাজ্যের বামপন্থী ছাত্রযুবরা 'রক্তদান কর্মসূচি করে' হলদিয়া ও বক্রেশ্বর শিল্পকারখানা গড়ার শপথ নিয়েছিলেন, সারা রাজ্যজুড়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল অজস্র রক্তদান শিবির - সেই সঞ্চিত রক্তের পরিণতি কী হয়েছিল আমরা সকলেই জানি। আর রক্ত বিক্রি করে যে আদপে ওই দুই কারখানা গড়ে ওঠেনি এটাও বাস্তব সত্য। গোড়ার দিকে বেকার যুবকদের ভাতা চালু করেছিলেন প্রথম বামফ্রন্টের সরকার, তার সংস্থান করতেই লাগু হয়েছিল বৃত্তিকর বা প্রফেসনাল ট্যাক্স - কালক্রমে বেকারভাতার অবলুপ্তি ঘটেছে, কিন্তু বৃত্তিকরের হার পাল্টে পাল্টে বেড়ে গেছে - সীমিত ক্ষমতার বিকল্প বেশিদিন স্থায়ী হয় না। কিন্তু গ্রামের মানুষের ন্যায্য কাজ পাওয়ার দাবিকে সামনে রেখে দুটি সাংবিধানিক সরকারের বৈধ আলাপ আলোচনা এড়িয়ে যেভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচির আওতায় নানা কিসিমের 'আন্দোলন'-এর উত্থান বিকাশ ও প্রায়-অবলুপ্তি আমরা এক্ষেত্রে দেখলাম তার সঙ্গে বঞ্চিত গ্রামীন (ও শহরেরও) কাজ-চাওয়া মানুষের প্রকৃত সংযোগ ছিল কতটুকু?

তথাকথিত দুর্নীতির তথ্য নিয়ে প্রভূত বাগাড়ম্বর হলেও আদপে আমরা না-জানতে পারলাম দুর্নীতির পরিমাণ, না-বুঝতে পারলাম রাজ্যের শাসকদল দাবিপূরণের ক্ষেত্রে কতদূর আন্তরিক। যে দাবি তাঁরা প্রকাশ্যে করলেন, যে দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী অবধি দরবার করা হল তা নিরসনের আগেই হঠাৎ এই ঘোষণার তাৎপর্য কী? আর একশো দিনের কাজের বকেয়া অর্থ নিয়ে দেশের রাজধানীতে মাত্র কয়েকমাস আগেই যে সমাবেশ হল তার সংস্থান যদি রাজ্যের হাতেই থাকে তাহলে তার নৈতিক ভিত্তিই বা কতদূর বাস্তব ছিল? এই নানা জিজ্ঞাসার মধ্যেই ঢাকঢোল পেটানো 'কর্মশ্রী' - যাতে অনধিক মাত্র পঞ্চাশ দিনের কাজ পাওয়ার সংস্থান থাকবে - তাও তার অর্থ কোন ক্ষেত্র থেকে কীভাবে আসবে তা এখনও অস্পষ্ট। এখানে আরেকবার মনে করে নিতে হবে, বছরে একশোদিন কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা আদপে মানুষের প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ আগেও ছিল না, এখনও নয়। কার্যত এটা একটা অস্থায়ী সমাধান, আসল দরকার তিনশো দিনের কাজ।এই চাহিদা প্রাসঙ্গিক ছিল বলেই কিন্তু গত বিধানসভা নির্বাচনে (২০২১) কোনো কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনী ইস্তাহারে কমপক্ষে দেড়শ দিনের কাজ নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, অন্যান্য রাজ্যেও এই দাবি উঠেছিল। সেদিক দিয়ে কেন্দ্রীয় আইন মেনে একশো দিনের কাজের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি রাজ্য যদি নিজের ক্ষমতায় আরও পঞ্চাশ দিনের কাজের প্রতিশ্রুতি দিত- তাহলে যাকে ইংরিজিতে বলা হয় নাথিং লাইক ইট। অন্যান্য ক্ষেত্রে যে এমন হয় না তা কিন্তু নয়। গত বছর (২০২৩) পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে চার মাসের জন্য রাজ্যের তহবিল থেকে মিড-ডে মিলে পড়ুয়াদের বাড়তি পুষ্টির জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল - অবশ্য ভোট মিটে যাওয়ার পরে তা আবার প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রেও আসলে হল বিপরীত। যে মানুষের একশো দিনের কাজ পাওয়ার অধিকার ছিল কোন এক দুর্বিপাকে তা স্থগিত হয়ে যাওয়ায় সেই কাজের সীমানা নেমে এল অনধিক পঞ্চাশে। এখানে অনধিক শব্দটা খেয়াল করতে হবে। কারণ আইনে বছরে কমপক্ষে একশো দিনের কাজের সংস্থান রাখা হলেও সত্যি সত্যি কেউ একশো দিনের কাজ পেতেন না - এটা মেরে কেটে সবথেকে বেশি সত্তর/ আশি গড় দিনের মধ্যেই থাকত, নীচের দিকে হয়তো সংখ্যাটা চল্লিশ। মানে বাস্তবে একজন সাকুল্যে বছরে তিনমাসও কাজ পাচ্ছিলেন না। 'কর্মশ্রী' তে গড়ে পঞ্চাশ দিনের সীমা ঠিক করা হলেও বাস্তবে ওই সর্বোচ্চ সীমা অর্জন করা যাবে এমন নয়। সুতরাং একশো দিনের কাজের বিকল্প খুঁজতে গিয়ে একজন কর্মপ্রার্থীর মৌলিক চাহিদাটাই জোর করে নামিয়ে দেওয়া হল - এতে গর্বিত হওয়ার উপাদান কোথায় বা কতটুকু?

একদম শেষে দুটো প্রসঙ্গের রেশ না টেনে উপায় নেই। একশো দিনের কাজের আইন দেশের সংসদে পাশ হওয়া যা মানুষকে কাজের অধিকার দেয় ও সরকারকে আইনি বাধ্যতার মধ্যে রাখে। একালে অবশ্য 'নাগরিক অধিকার'কে সুকৌশলে 'কর্তব্যের' মোড়কে পাল্টে দেওয়ার একটা ফন্দি চলেছে - দেশের রাজধানীর প্রধান সড়কের নাম এখন 'কর্তব্যপথ'। তবু একদা দেশের আইনসভায় পাশ হওয়া আইনটি এখনো তামাদি করে দেওয়া হয়নি। 'কর্মশ্রী'র পেছনে এমন কোনও আইনি রক্ষাকবচ নেই - এক্ষেত্রে জব কার্ড দেওয়া হবে কিনা বা দিলে সেখানে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকবে কিনা - এসব প্রসঙ্গ পুরোটাই অনুচ্চারিত। 'দুর্নীতি' নামক একটা ধোঁয়াশাকে সামনে রেখে একশো দিনের কাজকে সঙ্কুচিত করে তার অর্ধেকে নামিয়ে আনা হল কি না - এই প্রশ্ন ওঠা উচিত। পরের কথা হল, সামাজিক প্রকল্পগুলিকে দিল্লির সরকার খুব সুনজরে দেখে এমন নয়। কিছুদিন আগেও 'রেউড়ি কালচার' নামক একটা শব্দবন্ধে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, এগুলো নিতান্তই মানুষকে ভিক্ষা দেওয়ার কাজ। যদিও তাঁরা বিলক্ষন জানেন, বর্তমান আর্থ-সামাজিক পটভূমিতে এইগুলি থেকে একেবারে মুখ ঘুরিয়ে থাকা সম্ভব নয়। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের তাঁরা নিজেরাও রকমারি 'ডোল' প্রকল্প সামনে রেখে ঢোল বাজাচ্ছেন - যদিও এগুলির গুরুত্ব তাঁরা কতটা বিশ্বাস করেন এটা নিয়ে সংশয় থাকে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে একশো দিনের কাজের মতো একটি মহতী প্রকল্পের সঙ্গে দুর্নীতি বা রাজনৈতিক বিরোধকে জুড়ে একটা অব্যর্থ চাঁদমারি হতে পারে, আসলে এইসব প্রকল্পে মানুষ বিশেষ উপকৃত হন না, প্রকল্প রূপায়নে নানা কারচুপি হয় - তার থেকে এগুলি বন্ধ করে দেওয়াই বিধেয়। এইখানে আশঙ্কার মেঘ জড়ো হয় আমাদের গরিব মানুষগুলির জীবনে। একটু মনে করে দেখা যেতে পারে, দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলিতে যখন বেসরকারিকরণের রোলার চালানো হয়েছিল, তার আগে একটা কৌশলী প্রচার ছিল - এইসব সরকারি সংস্থাগুলি আদপে অপদার্থ, এখানে কর্মী আধিকারিকরা কাজ করেন না, চুরি করেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তার থেকে ঢের ভাল এগুলিকে বেচে দেওয়া বা হস্তান্তরিত করা - এটা আসলে নিজেদের আগ্রাসী নীতিকে এক ধরনের জনগ্রাহ্যতা বা পাব্লিক লেজিটিমেসি দেওয়া। একশো দিনের কাজের ক্ষেত্রেও মূল আইনের বাইরে গিয়ে বিকল্পের বয়ান প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আদপে তার সমূহ সর্বনাশের চারা রোপণ করা হল না তো?