আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ● মাঘ ১৭-ফাল্গুন ২, ১৪৩০

প্রবন্ধ

সলিল চৌধুরীর আধুনিক গানঃ জীবন চেতনা

কঙ্কণ ভট্টাচার্য


বাংলা গানের আধুনিক অবয়বকে যারা গড়ে তুলেছেন তাদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য নামটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার পাশাপাশি উচ্চারিত হয় নজরুল, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল ও রজনীকান্তের নাম। রবীন্দ্র পরবর্তী সময়ে যাঁরা এই কাজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রধান নামটি অবশ্যই সলিল চৌধুরী। সলিল চৌধুরীর পূর্বে তাঁর অন্যতম মন্ত্রগুরু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারকে বহন করে বাংলা গানকে নতুন দিশা দেখান। তিনি মূলত গণসঙ্গীত সৃষ্টির মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন যার প্রমাণ আমরা পাই 'নবজীবনের গান' সহ তাঁর অন্যান্য সৃষ্টিতে।

সলিল চৌধুরী ১৯৪০-৪১ সাল থেকেই গণসঙ্গীত রচনা শুরু করলেও ১৯৪৪ সালে গণনাট্য সংঘে যোগ দেন। শুরু হয় তাঁর সৃষ্টিশীলতার প্রথম পর্যায়। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫১ অবধি প্রায় প্রতি আন্দোলনে তিনি 'গণনাট্য সংঘ'-র জন্য গান সৃষ্টি করেন যার সংখ্যা আনুমানিক ৫০-৬০টি। ১৯৫২ সালে তিনি মুম্বাই গণনাট্য সংঘের আমন্ত্রণে বিমল রায় পরিচালিত 'দো বিঘা জমিন' ছবির কাজে মুম্বাই যাত্রা করেন। এরপর তিনি গণনাট্য সংঘ ছাড়াও মুম্বাই চলচ্চিত্র শিল্পে নানা ছবিতে সঙ্গীতসৃষ্টি ও পরিচালনার কাজে জড়িয়ে পড়েন। একই সঙ্গে চলতে থাকে গণসঙ্গীত তথা গণনাট্য সংঘ ও ছবির কাজ। এ সময়ে তাঁর গণসঙ্গীতে কোরাল পরীক্ষানিরীক্ষা নতুনভাবে শুরু হয়। নানা হারমনি, পলিফনি ও যন্ত্রানুষঙ্গের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে এক নতুন ধরনের গণসঙ্গীত জন্ম নিতে থাকে যার সংখা প্রায় ২০টি। তার ফলশ্রুতিতেই ১৯৫৮ সালে আমরা পাই 'বোম্বে ইয়ুথ কয়্যার'। বাংলা আধুনিক গানেও আমরা পাই সম্পূর্ণ নতুন কলেবরের এক গান যা বাণী, সুর এবং যন্ত্রানুষঙ্গে অশ্রুতপূর্ব। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৮ সময়টিকে তাঁর সৃষ্টির দ্বিতীয় পর্যায় বলা যেতে পারে। এই সময়ের পর থেকেই ভারতে কমিউনিষ্ট আন্দোলনে চিন্তার বিভেদের ছাপ সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও প্রতিভাত হয়। তার ফলে গণনাট্য আন্দোলনেও ভাটার ছায়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে কমিউনিষ্ট পার্টি দুটি ভিন্ন মেরুতে ভাগ হয়ে যায়। গণনাট্য সংঘে কাজের পরিসর ১৯৬০ সাল থেকেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কমিউনিষ্ট আন্দোলনের বিভেদ অধিকাংশ গণনাট্য শিল্পীদের অত্যন্ত হতাশ করে দেয়। বেশীরভাগ শিল্পী গণনাট্য আন্দোলনের কাজের আর কোনও জায়গা খুঁজে পাননা। অনেকেই আধুনিক বাংলা গানের স্রষ্টা বা শিল্পী হিসাবে জীবিকার কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন। সলিল চৌধুরীও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। ইতিপূর্বেই তিনি মুম্বাই প্রবাসী হয়েছিলেন। ওখান থেকেই তিনি মুম্বাই সহ দেশের বিভিন্ন জায়গার চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার কাজ করতে থাকেন। একই সঙ্গে চলতে থাকে তাঁর বাংলা গান সৃষ্টি। লতা মঙ্গেশকর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সবিতা চৌধুরী, আশা ভোসলে, মান্না দে, সুবীর সেন, শ্যামল মিত্র সহ নানা শিল্পীর কন্ঠে প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর বহু কালজয়ী সৃষ্টি। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০-কে তাঁর সৃষ্টির তৃতীয় পর্যায় বলা যাতে পারে।

১৯৮০ সালে সলিল চৌধুরী আবার পশ্চিমবঙ্গে ফিরে আসেন। ইতিপূর্বে ১৯৬৭ সালে তৃতীয় রাজ্য সম্মেলনের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আবার নতুন করে 'গণনাট্য সংঘ' গড়ে উঠেছিল। ১৯৮০ সালের এপ্রিলে নেতাজী ইনডোর ষ্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত দুদিন ব্যাপী গণনাট্য সংঘের সেকাল একাল উৎসবে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। গণনাট্য সংঘের সঙ্গে আবার তাঁর যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ১৯৮০ থেকে ১৯৯৫ সালে প্রয়াণ অবধি বাংলা আধুনিক গানের সঙ্গে তিনি বেশ কয়েকটি গণসঙ্গীত সৃষ্টি করেন। এই সময়টিকে তাঁর সৃষ্টির চতুর্থ পর্যায় বলা যেতে পারে।

বাংলা গণসঙ্গীতে প্রায় ১০০টি গান সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সলিল চৌধুরী যে অবদান রেখেছেন তা গণনাট্য সংঘের প্রথম যুগের আর কোনো স্রষ্টার সঙ্গেই তুলনীয় নয়। বিষয়বস্তু, সুর বৈচিত্র্য ও আঙ্গিক বৈচিত্রে গণসঙ্গীতে তিনি যে মাত্রা যোগ করেছেন তা আজও দিকচিহ্ন হয়ে আছে। কিন্তু তাঁর সৃষ্ট আধুনিক বাংলা গানের দিকে একটু মনোযোগ দিলে দেখা যাবে সেখানেও বহুক্ষেত্রে তিনি তাঁর গণচেতনাকে এক স্বতন্ত্র ও ভিন্ন মাত্রায় প্রকাশ করেছেন এবং তার ফলে এই গানগুলি হয়ে উঠেছে অনন্য। প্রায় কৈশোর থেকে শুরু করে মানুষের নানা আন্দোলনে অংশ নিতে নিতে বেড়ে ওঠা সলিলের মনে ও চেতনায় বিদ্রোহ এবং মুক্তি জীবনের মূল মন্ত্র হয়ে উঠেছিল। এটা তিনি কোনোদিনই ভুলতে পারেননি। কিন্তু লক্ষনীয় বিষয় হল এটা তিনি কখনও গোপন করবার বা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেননি, এমনকি বাংলা আধুনিক গান রচনাতেও। নইলে আমরা কোনোদিনও পেতাম নাঃ

আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা
আমি কাঁদলাম বহু হাসলাম
এই জীবন জোয়ারে ভাসলাম
আমি বন্যার কাছে ঘূর্ণির কাছে রাখলাম নিশানা।

গানটির বাণীর মধ্য দিয়ে কলমের মালিককে চিনতে একটুও অসুবিধা হয়না। 'একদিন রাত্রে' ছবির গানে আমরা পাইঃ

জাগো -
অলস শয়ন ছাড়ো
সংকোচ সংহারো
নবারুণ রঙে রাঙো
প্রভাত আলোর ডমরু যে বাজে।
জাগরে জাগরে জাগ্ জাগ্ নবমন্ত্রে
প্রভাত সূর্যের গম্ভীর মন্ত্রে
জাগরে জাগরে জাগরে -
জাগরে জাগরে জাগ্ জাগ্।

হঠাৎ শুনলে মনে হয় কোনো গণসঙ্গীত শুনছি। কিন্তু আসলে তা চলচ্চিত্রের এক বিশেষ দৃশ্যের জন্য সৃষ্ট গান। যখন আমরা চলচ্চিত্রটি দেখি তখন গানটি এমনভাবে দৃশ্যের সঙ্গে মিশে থাকে যে আলাদা করে চেনা যায়না। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে পৃথিবী এবং সমাজ সম্পর্কে তাঁর সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়না। চলচ্চিত্রের গান ছাড়া তাঁর বাংলা আধুনিক গানের দিকে তাকালে তা আরও পরিষ্কার বোঝা যাবে। বহু প্রথিতযশা শিল্পীর জন্য সলিল গান লিখেছেন। কিন্তু তাঁর একটি গানও শুধুমাত্র 'তুমি-আমি'র মধ্যে আটকে থাকেনি। লতা মঙ্গেশকরের জন্য লেখা তাঁর এই গানটি এর উৎকৃষ্ট উদাহরণঃ

আজ নয় গুন গুন গুঞ্জন প্রেমের
চাঁদ ফুল জোছনার গান আর নয়
ওগো প্রিয় মোর, খোলো বাহুডোর
পৃথিবী তোমারে যে চায়।
আর নয় নিস্ফল এ ক্রন্দন
শুধু নিজেরই স্বার্থের বন্ধন
খুলে দাও জানালা আসুক
সারা বিশ্বের বেদনার স্পন্দন।

সলিল চৌধুরীর জীবনের সৃষ্টির প্রথম পর্ব ও গণনাট্য সংঘের কথা উঠলেই তিনি খুশীতে উদ্বেল হয়ে উঠতেন। আড্ডার মেজাজে থাকলে সেই সময়ের অনেক কথা মজা করে নান রসিকতা মিশিয়ে বলতেন। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও অনল চট্টোপাধ্যায়ের মুখে শুনেছি যে তিনি আড্ডায় এলে তার চেহারাই পালটে যেত। তখন সেখানে সলিলদাই চালক। বর্তমান লেখকেরও নানাসময়ে সুযোগ হয়েছে তাঁর গল্প শোনার। গল্প শুরু হলেই তিনি প্রথম যুগের গণনাট্য সংঘ সম্পর্কে হাসি ঠাট্টা রসিকতা মিশিয়ে অনেক কথা বলতেন। তা থেকে তাঁর গণনাট্য-জীবন সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারনা পাওয়া যায়। আমার স্থির বিশ্বাস তিনি তাঁর জীবনের এই পর্যায়টিকেই সবচেয়ে বেশী উপভোগ করেছিলেন। তিনি মুম্বাই থাকার সময়ে ১৯৫৯-৬০ সালে গণনাট্য সংঘ ভেঙ্গে যায়। তার অনেক আগে থেকেই তিনি মুম্বাই-এর সঙ্গীত জগতে নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে খ্যাতির শিখরে বিরাজ করছেন। কিন্তু গণনাট্য সংঘ ভেঙ্গে যাওয়ায় সলিল যে আঘাত পেয়েছিলেন সে ব্যথা তিনি কখনও ভুলতে পারেননি। আশ্চর্যজনকভাবে তাঁর এই যন্ত্রণার কথা উঠে এসেছে আধুনিক গানের বাণীতেও। অত্যন্ত শিল্পীত রূপে তাঁর বেদনা প্রকাশ পেয়েছে শিল্পী উৎপলা সেন-এর জন্য তৈরি গানেঃ

প্রান্তরের গান আমার, মেঠো সুরের গান আমার
হারিয়ে গেল কোন বেলায়, আকাশে আগুন জ্বালায়,
মেঘলা দিনের স্বপন আমার
ফসলবিহীন মন কাঁদায়।

সলিল চৌধুরী জীবনচেতনায় আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু তবু একইসঙ্গে পথ হারানো এবং পথ খোঁজা, নীড় হারানো এবং নীড় খোঁজা তাঁর সৃষ্টিতে নানাভাবে আসতো। একই সঙ্গে পথ বা নীড় হারানোর ব্যথা এবং এগিয়ে যাওয়ার আশাবাদ পরস্পরের পরিপূরক হিসাবে তাঁর গানে ফিরে ফিরে আসতো। একজন স্রষ্টার সততা ও আত্মানুসন্ধানের এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কীই বা হতে পারেঃ

আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা
আর কতকাল আমি রব দিশাহারা
জবাব কিছুই তার দিতে পারি নাই শুধু
পথ খুঁজে কেটে গেল এ জীবনসারা।

ব্যবসায়িক সঙ্গীত জগতে অনেক ফরমায়েসী গান লেখা হয়। স্রষ্টা যা নিয়ে ভাবিত নন ফরমায়েসের তাগিদে হয়ত তা নিয়েই তাকে কৃত্রিম প্রকাশ ঘটাতে হয়। কিন্তু সলিল চৌধুরী যখন ফরমাস মতো গান লিখছেন তখনও নিজের অনুভবকে প্রকাশ করেছেন বিশ্বাসের সঙ্গে। লতা মঙ্গেশকরের জন্য লেখা এই গানটিতে তাই সলিল চৌধুরীর সেই আত্মানুসন্ধান ধরা পড়ে। গণনাট্য সংঘ সবে ভেঙ্গে গেছে, ১৯৬০ সালে লেখা তাঁর এই গানঃ

ও বাঁশি হায়!
বাঁশি কেন গায় আমারে কাঁদায়,
কি গেছে হারায়ে স্মরণের বেদনায়
কেন মনে এনে দেয়-হায়।

সমকাল এবং তার সঙ্গে নিজের অনুভব সচরাচর এভাবে প্রকাশ করা যায়না। ১৯৫৮ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্য লেখা তাঁর এই গানটিতে পাই মানসিক দোলাচলের অভিব্যক্তি। একদিকে তাঁর মোহমুক্তি আর তার সঙ্গে নতুন পথ খোঁজার প্রয়াসঃ

পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি
সোজা পথের ধাঁধায় আমি অনেক ধেঁধেছি।
নিষেধের পাহারাতে ছিলেম রেখে ঢেকে
সে কখন গেছে ফিরে আমায় ডেকে ডেকে,
নয়ন মেলে পাবার আশায় অনেক কেঁদেছি
এই নয়নে পাব বলে নয়ন মুদেছি।

সলিল চৌধুরীর একটি গানও সময়ের সঙ্গে তাঁর নিজের অনুভব নিরপেক্ষ নয়। ১৯৫৮ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্য লেখা তাঁর অন্য একটি গানে একই ভাবনার প্রকাশ। স্রষ্টা তখন কতটা ধোঁয়াশার মধ্যে ছিলেন এই গানে তা বোঝা যাবেঃ

দুরন্ত ঘূর্ণির এই লেগেছে পাক
এই দুনিয়া ঘোরে বন বন বন বন
ছন্দে ছন্দে কত রঙ বদলায়, রঙ বদলায়।
কখন পিঙ্গল কখন সবুজ
কখন বুঝি আর কখন অবুঝ
হৃদয় দিলে যার হৃদয় মেলে
হৃদয় যাবে সে কাল পথে ফেলে।

বলতে দ্বিধা নেই বিগত পাঁচ দশকের আধুনিক গানে যুগের প্রায় কোনো ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়না। একমাত্র ব্যতিক্রম সলিল চৌধুরী ও তাঁর সাহচর্য পাওয়া অনল চট্টোপাধ্যায়, প্রবীর মজুমদার, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুধীন দাশগুপ্তের কিছু গান। ১৯৮০ সালে কলকাতা ফিরে এসে তিনি প্রথমেই লিখলেন গণসঙ্গীত 'অধিকার কে কাকে দেয়'। তারপর ১৯৮২ সাল থেকে আমরা আবার ওকে বাংলা আধুনিক গানে পেলাম। ঐ বছরেই তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্য লিখলেনঃ

একটা কথা মনে রেখো পরিষ্কার
যতই পাও না কেন ফুলভার, মনিহার
সাধারণ মানুষের মনে ঠাঁই পাওয়া,
তার ভালোবাসা পাওয়া
তার চেয়ে বড় কোনো নেইতো পুরষ্কার।

আগেই বলেছি সলিল চৌধুরীর কাছে ভালোবাসা মানে শুধু একজন নর ও নারীর সম্পর্ক নয়। তাঁর ভালোবাসার গানে বিশ্বভূবন উপস্থিত থেকেছে মানুষের স্বপ্নকে বুকে নিয়ে। ১৯৮৩ সালে হৈমন্তী শুক্লার জন্য গান লিখলেন। তাতে আবার আমরা ফিরে পাই মানুষের প্রতি বিশ্বাস আর ভালোবাসাঃ

এইবার স্বপ্নের বন্ধন খুললাম
আর নেই দুরু দুরু বক্ষের স্পন্দন
আশা নিরাশার ক্রন্দন (আহা)
আর নেই সন্ধ্যায় বাতায়নে চেয়ে নিঃশ্বাস
তারা ভেঙ্গে দেবে বিশ্বাস
তাই সব সন্দ দ্বন্দ্বকে ভুললাম (আহা)
আর পিছে মোরে পিছু ডেকো না গো।

১৯৮২ সালেই শিল্পী অরুন্ধতী হোমচৌধুরীর জন্য যে বাণী রচনা করলেন বাংলা আধুনিক গানে তা আশা করা যায়নাঃ

কেন ঘুম আসেনা?
সারা রাত জেগে জেগে বসে শুনি
পৃথিবীর কোলাহল,
কত অসহায় শিশু নারীদের
আর্তনাদ যেন
ভেঙে ভেঙে খান খান, করে বাসনা।

আগেই বলেছি সলিল ১৯৮০ সালে স্থায়ীভাবে বাস করবার জন্য কলকাতায় ফিরে এলেন। কথায় কথায় বলতেন কলকাতা ছাড়া আর কোথাও চিরদিন থাকা যায় নাকি। ফিরে এসে প্রথমে গোলপার্ক অঞ্চলে সি. এম. আর. (সেন্টার অফ মিউজিক রিসার্চ) নামে একটি রেকর্ডিং কোম্পানি খুললেন। সেখান থেকে প্রথমেই প্রকাশ করলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গণসঙ্গীত। কয়েক বছর বাদে বেহালায় একটি অত্যাধুনিক স্টুডিও স্থাপন করলেন। কলকাতায় ফেরার মূলে তাঁর অনেক স্বপ্ন ছিল। বলতেন প্রযোজকের গোলামী আর ফরমায়েসের কাজ করতে করতে নিজের স্বকীয়তাই হারিয়ে যেতে বসে। এখন নিজে যা চাইবো তাই করবো। তাঁর এই স্বপ্নের কথা ধরা পরেছে ১৯৮২ সালে বনশ্রী সেনগুপ্তের জন্য লেখা গানেঃ

এই তো ফের এলাম, ফের ফিরে পেলাম
দেখো তো এখনো দু'চোখে স্বপ্ন জড়ানো
সাজানো আছে কিনা, সেই মনোবীণা
তোমার পরশে সরস হরষে
ফের বাজে কিনা,
তাই মন দিলাম।

সলিলের গানে নিজের কথা কেবল নিজের থাকতো না, তা সকলের হয়ে যেত। সেই কারনেই সেই গান শুনলে সবার মনে হতো এ তো আমারই কথা। তিনি যে রবীন্দ্রনাথকে কতটা আত্মস্থ করেছিলেন তা বোঝা যায়। সময় এগিয়ে যাবে কিন্তু গান রয়ে যাবে কারণ সে তো শুধু সময়ের কথা বলেনি, সে বলেছে জীবনের কিছু সত্যের কথা যা চিরকালীন।

প্রায় এই কথাই আমরা অন্যভাবে পাই সবিতা চৌধুরীর জন্য লেখা একটি গানেঃ

এই তো আমি আবার এসেছি
ভুলে গেছি দূরে দূরে কখনো ছিলাম
এইবার আমি তোমারই হলাম।
বেসুরে বাঁধা সেতারে সুরের সাধনায়,
কত না জনম গেছে কী যে বেদনায়।

পরীক্ষানিরীক্ষায় সলিল চৌধুরীর কোনওদিন ক্লান্তি ছিলনা। সুরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নানা ধরনের বাণী রচনাতেও তাঁর কোনো দ্বিধা ছিলনা। ১৯৭৮ সালে রক সঙ্গীতের সুর ভঙ্গীমায় তিনি একটি গান তৈরি করেন। তাঁর বাণী ছিল একেবারে অন্য ধরনের। কিন্তু গানটির মধ্য দিয়ে পৃথিবী সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে অসুবিধা হয়না। পরীক্ষামূলক এই গানটিতে তিনি নিজেই কন্ঠদান করেছিলেনঃ

এই রোকো, পৃথিবীর গাড়িটা থামাও।
আমি নেমে যাব।
আমার টিকিট কাটা অনেক দূরের
এ গাড়ি যাবেনা, আমি অন্য গাড়ি নেব।

সলিল আর তাঁর গানের বাণী - কখনওই আলাদা করা যায়না। মানুষটি যেমন, কথা বলেন যেমন, গানের বাণীও যেন ঠিক তেমন।

কথা প্রসঙ্গে দেশের সুবিধাবাদী স্বার্থান্বেষী রাজনীতিকদের ব্যঙ্গ করে খুবই মজা পেতেন। গণসঙ্গীত হিসাবে জনপ্রিয় 'নাকের বদলে নরুন পেলুম', কিংবা 'ও ভাইরে ভাই মোর মতো আর দেশপ্রেমিক নাই' বা তাঁর লেখা 'কানের কবিতা' যারাই শুনেছেন তারাই তা অনুভব করতে পারবেন। ১৯৮২ সালে তিনি 'ওহে নন্দলাল' নামে একটি দীর্ঘ গান রচনা করেছিলেন কার্তিককুমার ও বসন্তকুমার-এর জন্য। গানটি দীর্ঘ বলে এখানে শুধু উল্লেখ করলাম। উৎসাহী পাঠক শ্রোতাদের গানটি শুনতে অনুরোধ করছি।

সলিল চৌধুরীর আধুনিক গান সম্পর্কে যেটুকু আলোচনা করা সম্ভব হল আশা করি তাতে তাঁর জীবন দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে অসুবিধা হবেনা। তাঁর গানের মধ্যেই স্রষ্টা সলিল ও মানুষ সলিল মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছেন। পেশাগত কারণে তাঁকে প্রয়োজন অনুযায়ী নানা ধরনের ও রকমের গান লিখতে হয়েছে কিন্তু সেখানেও তিনি নিজের সঙ্গে সমঝোতা করেননি। এই আলোচনা শেষ করি ১৯৮০ সালে তাঁর রচিত একটি গান দিয়েঃ

এই জীবন এমনি করে আর তো সয় না,
যাই হারিয়ে মিলেমিশে এবার
হই আবার জনসমুদ্রের একজনা।