আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ● মাঘ ১৭-ফাল্গুন ২, ১৪৩০

প্রবন্ধ

নবরামায়ণঃ রামনাম সত্যের রাজনীতি

শ্রীদীপ


ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নবরামায়ণ'-এ রামের যথেচ্ছ নিন্দে করে, ভরতকে বরং সাব্যস্ত করা হয়েছে 'চালু মাল' হিসেবে। রামের পাদুকা জোড়া সিংহাসনে বসিয়ে ভরতই রাজত্ব সামলান চোদ্দ বছর। 'চালু মাল'-এর বিভিন্ন মানে হতে পারেঃ চালাক, চলনসই, গ্রহণযোগ্য, চলন্ত। আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও অদৃশ্য রামকে কেন্দ্র করেই যখন ভারতের বাস্তবিক ও সাংকেতিক রাজপাঠ চলছে, তখন তাকে আর অচল বলি কি করে। রামই সবচেয়ে সচল মুদ্রা।

এক মাস আগে, সাত সকালে, কলিং বেল বাজলো। থাকি উত্তরপ্রদেশের বৃহত্তর নয়ডার এক বহুতল আবাসনে। খুলে দেখি বেশ কিছু বয়স্ক মহিলা। তাঁদের হাতে নিমন্ত্রণপত্র ও চাঁদার পুস্তিকা। জানা গেল রাম মন্দির আহ্বান নিয়ে তাঁরা আমার দ্বারস্থ হয়েছেন অবদান সংগ্রহ করতে। বললামঃ তা মন্দির তো হয়ে গেছে, আমার কি করণীয়? তাঁরা বিরক্ত হলেন। আমিও। সহ্য করা ছাড়া আর কীই বা করার আছে বলুন তো?

বাজারে, রাস্তার মোড়ে, চলমান গাড়িতে, বাড়ির বারান্দায় উড়ছে গেরুয়া ধ্বজা - গোটা রাজধানীজুড়ে। রাতভোর উচ্চস্বরে বেজে চলেছে রামনাম। একটা তিরিশ তলা বাড়ির নিচ থেকে ওপর অব্দি আলো দিয়ে লেখা হয়েছে 'জয় শ্রী রাম'। শুনলাম কর্পোরেট ভারত, রাম-কেক বিতরণ করছে কর্মীদের। দেশের গন্যমান্য ব্যক্তিরা অযোধ্যা পৌঁছে হুঙ্কার তুলছেন শ্রীরামের জয়ের। কেউ বলছেন পাঁচশো বছরের প্রতীক্ষার অবসান। কেউ বলছেন মন্দির প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে তাঁদের মনে হচ্ছে কোনো এক পৌরাণিক কালে তাঁরা প্রবেশ করেছেন। শুনে সংশয় জাগেঃ আধুনিকতার গতিপথ কি প্রগতির দিকে, না তা পশ্চাৎগামী! উপচে পড়ছে হিন্দু-ভাবাবেগ, হিন্দু-গর্ব, হিন্দু-উন্মাদনা, হিন্দু-উল্লাস - নাকি হিন্দু-ধর্মান্ধতা? নাকি গণতন্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতার অবসানের আনুষ্ঠানিক ধ্বংসধ্বনি এসব? মসদিজ ভেঙে মন্দির নির্মাণের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগকেই যদি মানুষ প্রগতির লক্ষণ মেনে রামের জয়গান করে, তখন আর নিজেদের শিক্ষিত ও সুশীল বলার অবকাশ থাকে না। আমাদের পরিশিষ্ট উদারমনস্কতা ও সহনশীলতা ধর্ষিত হয় ধর্মের নামে ক্ষেপে ওঠা আগ্রাসী মানুষের চিৎকারে, সমাবেশে ও যুদ্ধ উন্মাদনায়।

রাজনীতির সাথে ধর্মের এই অত্যধিক মিশ্রণ এখন আমাদের মজ্জায়। হোয়াটস্অ্যাপে এক বন্ধুর ছবিতে দেখলাম পেশীবহুল তীরন্দাজ রামের ছবির নিচে লেখা - 'দেশের ডিএনএ'। সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মাবেগ ব্যবহার করে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিভাজনের রণকৌশল এখন জলভাত। তাতে কোনো অন্যায় বা অবিচার আমাদের চোখে পড়ে না। ধার্মিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে আমরা বিধর্মীর ওপর বুলডোজার চালাতে পিছ-পা হই না। গো-রক্ষার অজুহাতে, আমরা বিধর্মীকে গণধোলাই দিয়ে, তাকে হেনস্তা করে, নিধন করতেও সক্ষম। তাদের জব্দ করে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার প্রয়াসের মধ্যেই আমাদের গৌরব, অহং ও আস্ফালন। রাজনীতির সর্বোচ্চ মঞ্চ, সংসদ-ভবন-উদ্বোধন উপলক্ষে, প্রধানমন্ত্রী দ্বিধাহীন প্রবেশ করেন সাধু দ্বারা পরিবৃত হয়ে। রাষ্ট্র, রাষ্ট্রনেতা, রাষ্ট্র পরিচালনা ও ধর্মের মধ্যে যে আর কোনো বিভেদ নেই, এমন বহু পরিচয় আমরা অজস্রবার পেয়েছি বিগত দশ বছরে। যে কারণে, যে কোনো ধরণের সমালোচনাই এখন রাষ্ট্র-বিরোধী ও হিন্দু-বিরোধী হিসেবে গণ্য। অর্থাৎ যাহা রাষ্ট্র, তাহাই ধর্ম, তাহাই রাষ্ট্রধর্ম ও রাজধর্ম। এই কঠিন সত্যটির প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হলো আরো একবার বাইশে জানুয়ারিতে। মানুষ যদি ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে ফারাক না করতে চায়, মানুষকে যদি রাজনীতি ও ধর্মের মিশ্রণে বুঁদ্ করে রাখা যায়, তাতেই যদি মানুষ মেতে থাকে, আর শাসকদল নির্বাচন যেতে, তাহলে আপনি আমি ধর্মনিরপেক্ষতার তাৎপর্য নিয়ে জ্ঞান দেওয়ার কে?

বাইশে জানুয়ারির অনুষ্ঠান, তার প্রচার ও তাকে কেন্দ্র করে সমাগম, উৎসাহ ও সমবেত সংখ্যাগরিষ্ঠের যা ঔদ্ধত্ব তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে? শাসকদলের বার্তা সেখানে পরিষ্কারঃ বাড়ি বসে ছুটি কাটান ও সরাসরি রাম-সম্প্রসারণ দেখুন। যারা আনন্দিত না হয়ে, আতঙ্কিত বোধ করছেন এই রাষ্ট্রীয় প্রদর্শনে - তাঁরা ঠিক রামরাজ্যের নাগরিক হওয়ার যোগ্য নন। বিশ্বস্ত, অনুগত, কর্তব্যনিষ্ঠ নন আপনারা, একেবারেই। সন্দেহের চোখে দেখা হোক আপনাদের। যে কোনো সময় রাষ্ট্র, মানুষ লেলিয়ে আপনাকে শাস্তি দিতে পারে ও শায়েস্তা করতে পারে। অযোধ্যার প্রসাদ আপনার প্রাপ্য নয়। এখনও সময় আছে - রাম রাজ্যের বাসিন্দা হতে গেলে মনে ভক্তি আনুন; নচেৎ নাগরিকত্ব ফলাতে আসবেন না।

এই হারেরেরে যুদ্ধোদ্যম ঠিক কার বিরুদ্ধে? কে এই কল্পিত ও নির্মিত শত্রুপক্ষ? রাম হারলো কার কাছে যে চেঁচিয়ে তার জয়জয়কার করাটা রাষ্ট্রীয় কর্তব্য হয়ে উঠলো বিগত এক দশকে? রাম বনবাস থেকে ফেরার পর গিয়েছিলেনটা কোথায় যে তাঁর প্রত্যাবর্তনের জরুরি-পরিস্থিতি তৈরী হলো? কিসের এতো নিরাপত্তার অভাববোধ? কেন সংখ্যাগরিষ্ঠের এই সংখ্যালঘু সুলভ আচরণ? নিজের ধার্মিক শ্রেষ্ঠত্বের জয়গান করতে গেলে কি অন্যকে নিচু না করলেই নয়? এসব প্রশ্ন এখন নিতান্তই অর্থহীন। কর্মহীনতা, মূল্যবৃদ্ধি, মানবকল্যাণ, সাংবাদিক বা সাংবিধানিক অধিকার - কোনো প্রসঙ্গই আর তেমন প্রাসঙ্গিক নয়। ধর্মীয় কট্টরবাদের সামনে সমস্তই বিলীন বা বুলডোজারের তলায় পিষেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পোষণ, উন্নয়ন, দারিদ্র দূরীকরণ, শ্রেণী ভেদ, জাতি ভেদ, লিঙ্গ ভেদ - সব সাত খুন মাফ। আগে রাম, আয়া রাম, রাহেগা রাম।

নোটবন্দি, আন্দোলনবন্দি, দেশবন্দি, দমবন্দি - এসবের সম্বলিত পীড়া, ভক্তির জেরে নিঃশেষিত। সম্মোহিত হয়ে আমরা থালা বাটি পিটিয়ে করোনা তাড়িয়েছি; দীপ জ্বালিয়েছি; ঘরে তেরঙ্গা পুঁতেছি; লাইনে দাঁড়িয়ে বাতিল নোট ফেরত দিয়েছি; বাধ্য হয়ে মাসের পর মাস ঘরে বন্দি হয়ে কর্মচ্যুত হয়ে দেশোদ্ধার করেছি; হাসপাতালে প্রাণ দিতে দেখেছি অক্সিজেনের অভাবে। এসব বেমালুম ভুলেও গেছি ভক্তির ঘোরে। বালাকোটের প্রত্যাক্রমে বহু জেহাদি শিবির ধ্বংস হয়েছে বলে মেনে নিয়েছি, প্রমাণ ছাড়াই। যুক্তি প্রমাণ দাবি করে; ভক্তি চায় বিশ্বাস। বিশ্বাসে মিলায়ে দেশ বা বিশ্বাসে মিলায়ে ধর্মীয় বিদ্বেষ; তর্কে বহু দূর।

মনে রাখতে হবে যে আপনার আমার বসবাস এক অলীক অমৃতকালে যেখানে ভক্ত আর ভক্তিই সব, যুক্তি গেছে বনবাসে। ভক্তির সেই খড়মজোড়াকে নমস্কার জানিয়ে বিশ্বগুরু বিভিন্ন মন্দিরে, সমুদ্রতটে, সেতুতে নমঃ নমঃ করে মাতিয়ে দিচ্ছেন। তিনিই বিগ্রহ। তিনিই মূর্তি। তিনিই প্রাণ। তাঁরই পুনঃ পুনঃ প্রতিষ্ঠা। আস্থা রাখুন। কল্পিত রাজার কল্পিত জন্মভূমি থেকে তিনি ব্যাখ্যান সাজিয়ে দিয়েছেন - এখন থেকে রামই নাকি আমাদের রাষ্ট্রচেতনা, আধার, বিচার, বিধান, প্রতিষ্ঠা, প্রতাপ, প্রভাব, নীতি, নিরন্তরতা ও আরও কতো কি! বিশ্বাস করুন।