আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ● মাঘ ১৭-ফাল্গুন ২, ১৪৩০

সমসাময়িক

বিরোধী রাজনীতির সংকট


২০২৪-এর লোকসভার নির্বাচন দোরগোড়ায়। সেই নির্বাচনকে সামনে রেখে অর্ধসমাপ্ত রামলালার মন্দিরে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। বোঝাই গেল, এই নির্বাচনে বিজেপি আবারও সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় আবেগ জাগ্রত করে ভোটের মাইলেজ পেতে একেবারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিয়েছে। সারা দেশে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা সরাসরি সম্প্রচার করে, বেছে বেছে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রের কৃতবিদ্যদের জড়ো করে বিজেপি আসলে চতুর দক্ষতায় নির্বাচনের প্রচার শুরু করল নির্বাচন ঘোষণার অনেক আগে। আমন্ত্রিতদের তালিকায় যেমন একদিকে ছিলেন বলিউড, ক্রীড়া, রাজনীতির ক্ষেত্রের খ্যাতনামারা; তেমনই ছিলেন দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিরা।

এই রামলালা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক (অসংসদীয়ভাবে) প্রাণপ্রতিষ্ঠা ও তার প্রচার করে বিজেপি কয়েক পা এগিয়ে গেল সংখ্যাগুরু জনমানসে তার প্রভাব বিস্তার করতে বকলমে দেশের মধ্যে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুদের মধ্যে এক আপাত সংঘর্ষের আবহাওয়া বজায় রাখতে। প্রতিদিন বিজেপির কোনও না কোনও মন্ত্রী হিন্দু ধর্মকেই ইস্যু হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। আর তার ফাঁদে পড়ছে বিরোধী কিছু দলের নেতৃত্বও।

অথচ এমনটা কিন্তু হবার কথা ছিল না। গতবছর যখন জোট তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হল, এবং ক্রমশ ২৪টি পার্টি একত্রিত হতে থাকল তখন বিজেপি ভয় পেয়েছিল। সেই সময়ে মনে হয়েছিল, ভারতের বিরোধীরা আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টিকে মোকাবেলা করার জন্য ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট তৈরি করার সক্রিয় প্রচেষ্টা শুরু করেছে। সংসদের বাজেট অধিবেশনে গত এপ্রিল মাসে অনন্য বিরোধী সংহতির মধ্য দিয়ে শেষ হয়।

তবে এই প্রচেষ্টাকে ক্রমাগত লড়াই করতে হবে কেন্দ্রে এমন একটি শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে যারা নির্বাচন কমিশন, বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, বিচার ব্যবস্থা - সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ এমনকি আগ্রাসন করতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিরোধীদের সঙ্গে বিজেপির রাজনৈতিক সংঘাত এই দলগুলোকে জোটবদ্ধ হওয়ার জন্য নতুনভাবে সমন্বয় সাধন করেছে। তারা তখন আক্রমণাত্মক মেজাজে ছিল। অন্য দিকে বিজেপির নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার মূল্যবৃদ্ধির মতো অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবিলা করতে এবং কর্ণাটকের মতো বিধানসভা নির্বাচনে ব্যর্থ হয়েছে। তখন থেকেই বিজেপি বিরোধী ঐক্য ভাঙতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল, তার উদাহরণ হল মহারাষ্ট্রে বিরোধী দলগুলোতে ভাঙন ধরাতে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হস্তক্ষেপ।

যদি এই রাজনৈতিক আবহাওয়া বজায় থাকে, তাহলে ২০২৪-এর নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ বিরোধীদের পক্ষ থেকে বিজেপিকে কঠিন লড়াই দেওয়া সম্ভব। এই ঐক্য বজায় রাখবার জন্য প্রয়োজন একত্রিত বিরোধী কর্মসূচি গ্রহণ ও সেই কর্মসূচির স্বপক্ষে ক্রমাগত আন্দোলন।

কিন্তু ক্রমশই দেখা গেল বিরোধী ঐক্যে বিরাট ফাটল ধরল। কিছু আঞ্চলিক দল কংগ্রেসকে খোলাখুলিভাবে শুধু সমালোচনা করতে শুরু করল না, তৃণমূল কংগ্রেস প্রকাশ্যেই বলে দিল কংগ্রেসের সঙ্গে কোনো নির্বাচনী ঐক্য পশ্চিমবঙ্গে হবে না। সঙ্গে সঙ্গে দিল্লিতে আপ ঘোষণা করল, পঞ্জাবে তারা একাই বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে যথেষ্ট। মনে হল কেজরিওয়াল ও মমতা ব্যানার্জি যেন কিছুটা শলা করেই কংগ্রেস বিরোধী অবস্থান প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন।আর সব শেষে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার, যিনি প্রথমে বিজেপি বিরোধী ঐক্যবদ্ধ জোট করতে প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন, সরাসরি এদিক থেকে ওদিকে গিয়ে বিজেপির সঙ্গে ঐক্য করে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী পদে থেকে গেলেন। পঞ্চমবার জোট পরিবর্তন করে, ক্রমাগত এদিক ও ওদিক গিয়ে নিজের কুরসী বাঁচিয়ে 'অসাম্প্রদায়িক সুশাসন বাবু' নতুন প্রজন্মকে কোন ভোরের ইঙ্গিত দিলেন!

বিরোধী ঐক্যের মূল সুর ছিল, বিজেপির বিরোধিতা। এই বিজেপি বিরোধিতার অর্থ, তাদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা, ফ্যাসিবাদী চরিত্রের বিরোধিতা, দেশের মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিরাষ্ট্রীয়করণ, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি মূল সমস্যাগুলি নিয়ে ক্রমশ চাপ সৃষ্টি করা।

অথচ ব্যক্তিগত ফায়দা তোলা যেন কিছু বিরোধী দলের নেতৃত্বের বিজেপি বিরোধিতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়াল। একথা সকলেই জানি যে, এত ক্ষয় সত্ত্বেও সারা ভারতে কংগ্রেসই এখনও বিজেপি বিরোধী প্রধান দল। এই মুহূর্তে তাকে আঘাত করে, তার শক্তিক্ষয় করে কোনো বিরোধী ঐক্য হতে পারে না।

বিজেপি বিরোধিতার মূল সুর হোক নীতির বিরোধিতা, ব্যক্তি স্বার্থের বিরোধিতা নয়। যারা একসময়ে বিজেপিপন্থী ছিলেন, তারা আজকে বিজেপি-আরএসএস-এর নীতির বিরোধিতা করুন কংগ্রেস ও বামপন্থীদের সঙ্গে, তবেই গণমানসে তাদের বিরোধিতার প্রভাব পড়বে।

নতুবা ২০২৪-এর পরে ভারতবর্ষের সংবিধানের মূল চরিত্র রক্ষার অক্ষমতার দায়ভাগ পুরোদমে তাদেরও নিতে হবে।