আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২৪ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

লোকাল নয় এক্সপ্রেস

শুভময় মৈত্র


কলকাতা বইমেলা ময়দান, বাইপাস হয়ে আপাতত বিধাননগরে থিতু হয়েছে। যদিও সময় চলমান - আর সেখানে ছাপানো বইয়ের গতি কমেছে অনেকটা, তবু একথা বলতেই হয় যে নতুন ছাপা বইয়ের গন্ধ এখনও বোঁটকা হয়ে যায়নি। এ কলকাতায় যেমন বর্ষা শুরুর বৃষ্টির গন্ধ এখনও নতুন করে নাকে আসে, তেমনই আসে বইমেলায় গাছের নির্যাস থেকে। এবার নাকি আবার কলকাতায় শীত কম, ফলে দুপুর ঘাম আর ফিস ফ্রাইয়ের গন্ধ বেশি করে নাকে এলে আমি নাচার। তবে পেশাদার লেখক যখন দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুতি নেন তাঁর প্রথম বই ছাপানোর জন্যে, তখন সে বই মাটিতে থাকে থাকে সাজানোই হোক, কিংবা বইমেলার অস্থায়ী স্টলের তাকে - গন্ধবিচারের পর তার অক্ষর বিচার, শব্দ বিহার এবং বাক্য অবগাহনের দায় পাঠকের। গৌরচন্দ্রিকার বাড়াবাড়ি সাঙ্গ করে এবার কাজের কথায় আসা যাক। 'রাজধানী লোকাল' নির্মাল্য নাগের প্রথম বই। একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সংস্থায় খবর লিখছেন বহু বছর ধরে। চাকরি জীবনের একেবারে শুরুতে ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ১৯৯৭-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি কাজের সূত্রে দিল্লিতে ছিলেন। আর সেই রাজধানী বাসের অভিজ্ঞতাই লোকাল ট্রেনে দুলুনি মাখা রম্যরচনার ঢঙে তিনি তুলে এনেছেন এই বইতে। তবে একবার পড়তে শুরু করলে ছাড়া শক্ত, পাতা ওল্টানোর বেগ এক্সপ্রেস ট্রেনকে হারিয়ে দিলেও অবাক হওয়ার কারণ নেই। এক লহমায় দুশো পাতা অতিক্রম করার মত সুলিখিত এই বইয়ের দাম ২৭৫ টাকা। 'গুরুচণ্ডা৯' ওয়েব ম্যাগাজিনে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল এই রচনাটি। ফলে বই না কিনলেও অন্তত সেখান থেকে পড়ে ফেলাটা জরুরি। আর কিছুটা এগিয়ে যদি মনে হয় মুঠোফোনে নয়, শীতের কাঁথা গায়ে চাপিয়ে চা মুড়ি সহযোগে নব্বুইয়ের দশকে ফিরবেন - সেক্ষেত্রে না হয় একবার করুণাময়ীতে ঘুরেই এলেন।

আপনি যদি একেবারে নবীন না হন, এই বই আপনাকে চেপে ধরবেই। নব্বই দশক তার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চালচিত্র মেলে ধরেছে এই লেখায়। তবে তা কখনই গুরুগম্ভীর প্রাবন্ধিকের কলমের মত নয়, বরং মিষ্টি মজায়, আলগা দুঃখে - অনেকটা তিরতিরে পাহাড়ি নদীর মতো, যার জলের নিচে রংবেরঙের নুড়ি নির্দ্বিধায় চোখে চাখা যায়। কলকাতার দৃষ্টিতে দিল্লির নানা জায়গার ইতিহাস গল্পের ছলে মেলানো হয়েছে এই লেখায়। সরস বর্ণনার পাশাপাশি বেদনার বেহালাও তার টানে মাঝে মাঝে। সেই তানে ফিরে ফিরে আসে কিছু অদ্ভুত মানুষের কথা - গরীব রাশিয়ান চা বিক্রেতা, ফুটপাথ দাপানো ধনী বিহারী দোকানদার কিংবা শিলিগুড়ির সনাতন। এ লেখায় এমন অনেক মানুষ আসেন যারা সত্যিই সত্যি, 'গল্প হলেও সত্যি' নন। এদের ভোলা কঠিন। রাশিয়া ছেড়ে যিনি এসেছেন তাঁর অগাধ আস্থা ‘টিচারের’ প্রতি, আদতে যিনি ঈশ্বর। ফুটপাথের যে দোকানদার, তিনি হয়ত কলকাতার কোন সাংবাদিকের থেকে (এখানে লেখক বোঝানো হচ্ছে) অনেক বেশি ধনবান - আর এই তথ্য যেভাবে পেঁয়াজের খোসার মত একটু একটু করে খোলসা হল তা দারুণ উপভোগ্য।

সরস বর্ণনার পাশাপাশি বেদনার আবছায়াও জেগে ওঠে মাঝে মাঝে। দুঃখবিলাস নয়, বরং চোখে জল আনা। "চায়ের দাম আর স্বপ্নভঙ্গের বেদনা মাখা মুখ নিয়ে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল সনাতন। আমরা তিন জন বসে রইলাম। আমাদের থেকে সামান্য দূরে ঝাঁ-চকচকে আন্ডারগ্রাউন্ড বাজারের আলো ঝলমল করা খোলা মুখটা দেখা যাচ্ছিল, সেখানে নানা মনোহারি জিনিস বিক্রি হয়।" আর একজন হলেন লেখকের সহকর্মী সুকুমারন বা সুকুদা, যিনি এইমস হাসপাতালে মারা যান। “সুকুদার মা আর স্ত্রী এসেছিলেন দিন দুই আগে। খুবই সাধারণ পরিবার। সুকুমারন মারা যাওয়ার পর ওনার বিধবা মা পাথরের মত নীরব হয়ে গেলেন, আর স্ত্রী-র হাহাকার এইমসের ইট কাঠ আর দেওয়ালগুলোয় ধাক্কা খেতে খেতে দিল্লির আকাশে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছিল।“

এসব দুঃখের কথা থাক। বরং এটা মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে দিল্লির নানা জায়গার ইতিহাস গল্পের ছলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে এই লেখায়। সফদরজং-এর নাম সারা দিল্লি জুড়ে; কিন্তু কে ছিলেন তিনি? একইভাবে রয়েছেন অনেক সরাই - ইউসুফ সরাই, শেখ সরাই, সরাই কালে খান। এত সরাই কীভাবে এল? দিল্লি কি তাহলে সরাইখানা? রিজার্ভ ব্যাংকের যক্ষ আর যক্ষিণীর মূর্তি আসার পিছনে কোন গল্প আছে? বেঙ্গলি মার্কেট ঠিক কতটা বাঙালি? গল্পের কি শেষ হয় এত সহজে? জায়গার ইতিহাস পেরিয়ে হানা দেয় মানুষের কথা। এইমসে তামিলনাড়ুর সুকুদার মৃত্যু তাই ভুলে যাওয়া কঠিন। আবার এই সূত্রেই আমরা জেনে যাই এইমস গড়ে ওঠার কাহিনী।

তবে শুধুই কি দিল্লির ইতিহাস? বৈঠকী মেজাজে ঘুরে ঘুরে আসে সারা পৃথিবীর নানা তথ্য - কত রকমের অদ্ভুত মিউজিয়ামের গল্প, টেলিফোনের ইতিবৃত্ত, নানা খাবারের, চেনা জানা শব্দের পিছনের গল্প। এসেছে বেশ কিছু অল্প জানা শব্দ - ডিম্বকা, কন্টকপত্র, কাষ্টকোষ, পিন্ডিকা। এসেছে নানা মজাদার নতুন শব্দও। অফিসে ‘সি. এল.’ কী জিনিস তো সবাই জানে, বলুন তো ‘ডি. এল.’ কাকে বলে? আর এ লেখা শুধু গদ্য নয়। গল্প বলতে গিয়ে লেখক মাঝে মাঝেই নিয়ে এসেছেন কবিতার লাইন। রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, শঙ্খ ঘোষ থেকে সাহসী সাংবাদিকের স্বরচিত নানা কবিতাও এসেছে। গদ্যহীনতা বেশ কিছু জায়গায় এ লেখায় ভিন্ন স্বাদ নিয়ে এসেছে, আর একই সাথে সাহায্য করেছে গোটা কাহিনীকে তরতর করে এগিয়ে নিয়ে যেতে।

যে কোনো মনোগ্রাহী লেখার একটা বৈশিষ্ট্য হল সময়কে ধরা। নব্বুই দশকের মাঝখানটাকে দিল্লির স্থানমাহাত্ম্য অতিক্রম করে ধরে ফেলেছেন লেখক। যারা সেই সময় সদ্য কলেজ পাস করেছেন, যাচ্ছেন কলকাতা ছেড়ে অন্য শহরে, তাঁদের সবটুকু সময় ধরা আছে এই লেখায়। পড়তে শুরু করলে ছাড়া অসম্ভব। আমার মতো যাঁরা ওই সময়টা প্রত্যক্ষ করেছেন, লেখকের বর্ণনা তাঁদের জাবরকাটার তৃপ্তি দেবে। আর যাঁরা দেখেননি, সেই ‘জেন যেড’ প্রজন্ম আদৌ যদি পাতা ওলটান, সেক্ষেত্রে জানতে পারবেন কেমন ছিল তাঁদের বাবা-মায়ের আমল। সেই হিসেবে 'রাজধানী লোকাল' যেন আক্ষরিক অর্থেই সময়ের রেলগাড়ি। নতুন নতুন স্টেশনে গাড়ি দাঁড়াচ্ছে, উঠছে নতুন মানুষ, তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরের স্টেশনেই নেমে যাচ্ছে, কেউ বা আবার লেখকের দীর্ঘ যাত্রার শরিক। আর তারই মাঝে ঝালমুড়ির মত অবিমিশ্র স্বাদ নিয়ে জীবনের সুখ-দুঃখ খেলা করছে অভিজ্ঞ সাংবাদিকের অক্ষরমালায়। সত্যিই পড়ে মজা আছে। ঠিক যেমন ফিরে ফিরে পড়ি নবনীতা দেবসেন কিংবা সৈয়দ মুজতবা আলি, তেমনই এই বই আবার যদি কয়েক বছর পর চাখতে বসি তাহলে হয়ত মন্দ লাগবে না। আর সবশেষে আমরা তো ফিরি কলকাতাতেই। যতই বাইরে যাই না কেন, এ তো ছোটবেলা থেকেই আমার শহর। বইমেলা হাঁটা শেষ হলে একটু দূরে যেখানে বিধাননগরের আলো আঁধারি, সেখানে কোনো এক হলুদ টিমটিমে বাতির নীচে একদণ্ড দাঁড়িয়ে উল্টে ফেলুন বইয়ের শেষ পাতা।

"এতদিন পরে সত্যিই এবার ফিরে যাচ্ছি কলকাতা। বেশ কিছুদিনের অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপ থেকে মুক্তি পেয়ে। রাজধানী এক্সপ্রেস ছেড়ে এল দেশের বর্তমান রাজধানী, ছুটে চলেছে তার পূর্বতন রাজধানীর দিকে। আমি আর তথা একসাথে এসেছিলাম, ফিরেও তাই যাচ্ছি, এখন অমিতাভও আছে। আরও তেরো জন আগেই মুম্বাই ফিরে গেছে, যেখানে তাদের যাওয়ার ছিল। শ্রীকান্ত আর জর্জও শিগগিরই চলে যাবে চেন্নাই। রয়ে গেল কেবল সুকুদা - তার আর ফেরা হল না।"

আর কার কার বাকি রয়ে গেল নিজের শহরে ফেরা? আর কোথায় এক্সপ্রেস খুঁজে না পেয়ে ভবিতব্য হয়ে রইলো 'রাজধানী লোকাল'?



বইয়ের নামঃ রাজধানী লোকাল
লেখকঃ নির্মাল্য নাগ
প্রকাশকের নামঃ ধূর্জটি প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশকঃ প্রকৃতি ভালোপাহাড়
ঠিকানাঃ এ/৮১, নিউ রায়পুর রোড, কলকাতা-৭০০০৮৪
মুদ্রিত মূল্যঃ ২৭৫ টাকা