আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২৪ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪৩০
প্রবন্ধ
'আদাব' থেকে 'দেখি নাই ফিরে' - পথ পরিক্রমায় সমরেশ বসু
অনিলেশ গোস্বামী
সৃজনশীলতার বিস্তৃত অঙ্গনে ১৯৪৬-এর ভয়াবহ দাঙ্গার পটভূমিকায় তাঁর প্রথম সাড়াজাগানো গল্প 'আদাব' স্বাতন্ত্রের দীপ্তিতে উদ্ভাসিত ছিল - এবিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। সাহিত্যের জগতে পরবর্তীকালে তাঁর আসন যে পাকা হতে চলেছে তার আভাস ঐ গল্পেই পাওয়া গিয়েছিল।
সেইখান থেকে শুরু করে বিয়াল্লিশ বছর ধরে একশোর ওপর উপন্যাস ও দুশোর বেশি গল্পের বিপুল সৃষ্টিতে আমরা দেখেছি মানুষের জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা খুঁটিনাটি বিষয়কে লক্ষ্য করার মতো তাঁর চোখ, লেখায় সহজ অথচ ব্যঞ্জিত বাকপ্রতিমার প্রাচুর্য, বিষয়বস্তুর মধ্যে মানুষের মন এবং তার বিপন্নতা নিয়ে দুঃসাহসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সেইসঙ্গে জীবনের প্রতি অনিঃশেষ অনুরাগমিশ্রিত অক্লান্ত কৌতুহল তাঁকে সাহিত্য জগতে সর্বকালের সেরা লেখকদের সাথে এক সারিতে বসিয়ে দিয়েছে। এত বৈচিত্র্যময় বিশাল মাপের সৃজনশীল রচনাসমূহের সামগ্রিকভাবে কোনো আলোচনা এই নিবন্ধের স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। এখানে তাঁর রচনাসম্ভারের কিছু কিছু অংশ নিয়ে সামান্য ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করা হবে।
আমরা জানি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর চারপাশে যাদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন, সেইসব মানুষদের তুলে এনেছেন তাঁর উপন্যাসে। বলা হয় "ব্রাত্য জীবনকে গভীর ও ঘনিষ্ঠভাবে দেখার পথ তিনিই খুলে দিয়েছেন, গতিশীল সামাজিক পরিবর্তনসমূহকে তিনিই স্বীকৃতি দিয়েছেন, স্বজাতি প্রীতি ও লোকসংস্কৃতির প্রতি অনুরাগের মাধ্যমে মানুষকে ভালবাসতে তিনিই শিখিয়েছেন।"
সেই ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়েই হয়তো অভিজাতদের বদলে দলিত ও অবহেলিত মানুষদের দৈনন্দিন জীবনের অনুপূঙ্খ লক্ষ্য করে সাহিত্যের অঙ্গনে তাদের কিঞ্চিৎ বেশি স্থান দিয়েছেন সমরেশ। সেই অর্থে তাঁকে হয়তো কিছু পরিমাণে তারাশঙ্করের উত্তরাধিকারী বললে খুব ভুল হবেনা। বিদগ্ধ সমালোচকরা বলেন যে সমরেশের কলমে তারাশঙ্করী ঘরানার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস 'গঙ্গা', যে কাহিনীর মূল চেতনা এক ধরনের মূল্যবোধ যা নদীর প্রতীকূলতার সঙ্গে জড়িত। স্ট্রাকচারের দিক থেকেও গঙ্গা অসাধারণ। বিষ্ণু দে বলেছিলেন "তোমাকে আমি সমুদ্রে দেখতে চাই"। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং বলেছিলেন - 'গঙ্গা' একটি আশ্চর্য ব্যাপার।
বিখ্যাত গবেষক অধ্যাপক ডঃ অরুণ মুখোপাধ্যায় সমরেশ বসুর উপন্যাসগুলির বিষয়ভিত্তিক শ্রেণীবিন্যাস করে মোট আটটি পর্বে এইভাবে সাজিয়ে দিয়েছেনঃ
১) গ্রামীণ শ্রমিক সমাজঃ
উত্তরঙ্গ (১৯৫১), নয়নপুরের মাটি (১৯৫২), বি. টি. রোডের ধারে (১৯৫২), সওদাগর (১৯৫৫), গঙ্গা (১৯৫৭), জগদ্দল (১৯৬৬), টানাপোড়েন (১৯৮০)।
২) পেটি বুর্জোয়া সমাজের অবক্ষয়ঃ
শ্রীমতী কাফে (১৯৫৩), বাঘিনী (১৯৬০)।
৩) মধ্যবিত্তের আশ্রয়হীনতা, অস্থিরতা, ক্রোধ, পাপবোধঃ
বিবর (১৯৫৫), প্রজাপতি (১৯৬৭), পাতক (১৯৬৯), বিশ্বাস (১৯৭১)।
৪) হৃত মূল্যবোধের সন্ধান ও বিচারঃ
স্বীকারোক্তি (১৯৬৭), মানুষ (১৯৭০), মানুষ শক্তির উৎস (১৯৭৪), অপদার্থ (১৯৭৫), মহাকালের রথের ঘোড়া (১৯৭৭)।
৫) প্রেমের অন্বেষণ, ব্যক্তির মূল্য সন্ধানঃ
ত্রিধারা (১৯৫৭), পুতুলের খেলা (১৯৫৮), দূরন্ত চড়াই (১৯৫৮), ফেরাই (১৯৬৪), শালঘেরির সীমানায় (১৯৬৪), যাত্রিক (১৯৭০), অবচেতন (১৯৭০), পরম রতন (১৯৭৩), প্রাচীন (১৯৭৪)।
৬) অস্থির তরুণের জীবনমূল্য সন্ধানঃ
ওদের বলতে দাও (১৯৭২), ছায়াঢাকা মন (১৯৭২), পথিক (১৯৭৩), বিজড়িত (১৯৭৫), সঙ্কট (১৯৭৬), গন্তব্য (১৯৭৮), বিজন বিভুঁই (১৯৮১)।
৭) নিঃসঙ্গ ব্যক্তি মানুষের একক সংগ্রামঃ
সুচাদের স্বদেশ যাত্রা (১৯৬৯), শাম্ব (১৯৭৮), বিপর্যস্ত (১৯৮০), পুর্নযাত্রা (১৯৮২)।
৮) সামগ্রিক যুগচিত্রঃ
যুগ যুগ জীয়ে (১৯৮১)।
এই তালিকাটি অবশ্যই অসম্পূর্ণ থেকে গেছে - এটি তিনি নিজেও মেনে নিয়েছেন।
সমরেশের বেশিরভাগ উপন্যাসে তাঁর মূল চরিত্রদের মনের মধ্যে যে নিমজ্জমান বিপন্ন অসহায়ত্ব, ব্যক্তিসত্তার বিষন্ন ধূসরতা ও জিজ্ঞাসা সেটা যেন তাঁর আত্ম-জিজ্ঞাসারই নামান্তর। ১৯৬৫-তে তিনি বহু-আলোচিত এবং মধ্যবিত্ত জনমানসে আলোড়ন সৃষ্টিকারী 'বিবর' উপন্যাস লিখেছিলেন।
উচ্চবিত্ত নাগরিক সমাজচেতনার অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে অবচেতনের তীব্র অভিঘাত ও তার সাথে প্রেম ও ঘৃণার পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া সঞ্জাত মনোবিকলন - তারই এক অসামান্য উদাহরণ এই উপন্যাসটির থিম।
আমরা দেখলাম চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে নাগরিকের অর্জিত উত্তরপুরুষের হাতে নষ্ট উত্তরাধিকারের রিক্ততা ও অসংগতি। নায়ক সমাজ ও শ্রেণী থেকে বিচ্ছিন্ন। শরীর সম্পর্কে সমস্ত সংস্কার সে ভেঙে ফেলছে তবুও সে কিন্তু বিবরবাসী হতে চায়না যেটা মাঝেমাঝে তার ইন্টার্নাল মনোলগের মধ্যে দিয়ে বারবার উঁকি দিয়ে গেছে। সে একটা জায়গায় বলছে - "আমরা যাদের ভদ্রলোক বলি, এই আমিই যেমন। আমি যখন আমার চাকরির স্থলে কিংবা অন্যান্য ক্ষেত্রে ভদ্রলোক সেজে থাকি তখন সব স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে হেসে কথা বলি। অন্তরের ভাষাটা যে কী কদর্য নিজের কানেই শোনা যায়না প্রায়। আমরা হয় মিথ্যাচার করি নয়তো যাচ্ছেতাই অভদ্র হয়ে উঠি।" অন্য আরেকটি জায়গায় সে আরও একটি প্রশ্ন করছে - "শরীরের পবিত্রতা কাকে বলে? এর না ডিসেন্ট্রি, লিভার খারাপ নয়, পিলে নেই, দাঁতে পাইওরিয়া নেই অর্থাৎ যেগুলো প্রায়ই থাকে অনেকের ক্রনিকের মতো, তাকেই কি শরীরের পবিত্রতা বলে? কি জানি, ওর মধ্যেই সতীত্ব-টতীত্ব ইত্যাদির ব্যাপারটাও আছে কিনা।"
আমরা যারা আজীবন বাঁধা গতে মধ্যবিত্ত মরালিটি ও কিছু ট্যাবু নিয়ে বেঁচে থাকতে অভ্যস্থ হয়ে গেছি - এই লাইনগুলি পড়ার পর সেই 'ইমপ্লোশান'-এর ধাক্কা সহ্য করে দর্পনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কঠিন হয়ে যেতে পারে। তাই কি তিনি অন্য একটি উপন্যাসে বলছেন - "জ্বলুক, জ্বলুক, পুড়ুক ও ধ্বংস হোক, সমস্ত কিছু তছনছ হয়ে যাক। সমস্ত বর্তমানটা পুড়ে ছাই হয়ে যাক, তারপর পূণ্যপবিত্র ভাগীরথীতে কতো জল আছে দেখা যাইবে।" (পাতক)
'বি. টি. রোডের ধারে'র পর মানবসমাজ সম্পর্কে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে সমরেশ পা রেখেছিলেন 'বিবর'-এ। শ্রেণী নিবিষ্ট মানব আলেখ্য থেকে এই উপন্যাসের থিমে রাখলেন অনন্বিত ব্যক্তির মানসিক সংঘাত ও বৈচিত্র্যময় বিতর্কিত জীবনযাপন। সমালোচক পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় 'বিবর' সম্পর্কে বলেছেন - "প্রচলিত সমাজ ও শ্রেণী থেকে বিচ্ছিন্ন যুবকটির প্রথম প্রতিক্রিয়া শরীর সম্পর্কে সব সংস্কার ভেঙে ফেলা অর্থাৎ শরীর নিয়ে সব ছুৎমার্গ থেকে বেরিয়ে আসা।" তিনি একথাও বলেছেন যে - " 'বিবর'-এর মতো এথিক্যাল উপন্যাস বাংলায় খুব কম এবং এরকম মরালিস্ট লেখকাও অত্যন্ত বিরল।"
তবে একথাও ঠিক যে এই উপন্যাসের অভিমুখ এবং বক্তব্য লেখকের মনে হঠাৎ উদয় হয়নি। জীবনের নানাঘাট পেরিয়ে 'বি. টি. রোডের ধারে' থেকে সমরেশ এসে পৌঁছেছিলেন যে মানসিক জগতে সেখানেই ঝলসে উঠেছিল 'বিবর'-এর মতো এক নতুন চিন্তন।
আবার নিমজ্জমান ভঙ্গুর বিকৃত মানসিকতা থেকেই উত্তরণের কাহিনী লিখেছেন - 'প্রজাপতি'। প্রজাপতির নায়কের নাম সুখেন। সে সমাজ ও প্রচলিত মূল্যবোধের বিরুদ্ধে দ্রোহ। পিতার কামুক স্বভাব, রাজনৈতিক নেতাদের শঠতার আবর্তে হারিয়ে যাওয়া একদা ছাত্র ইউনিয়নের আদর্শবাদী দাপুটে নেতা সুখেন, পরবর্তীকালে রাজনৈতিক অপরাধী মাস্তান সুখেন যার অন্তরজুড়ে শুধুই দ্রোহ। সেই আগুনে সে নিজে জ্বলে ও অন্যকেও জ্বালিয়ে দিতে চায়। সুখেনকে শেষ পর্যন্ত খুন করা হয়। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পড়তে প্রেমিকা শিখাকে সে দেখতে পায় দুহাত বাড়িয়ে তারই প্রতীক্ষায়। অসাধারণ এক অমৃতময় উত্তরণের এমন ছবি বোধহয় একমাত্র সমরেশের তুলিতেই আঁকা সম্ভব।
দ্রোহকেই কেন্দ্র করে তাঁর আরও একটি অসাধারণ লেখা - 'শিকল ছাড়া হাতের খোঁজে'। এক পয়সার আন্দোলনের ভূমিকা থেকে উঠে আসা আগাড়িয়া (লৌহ কর্মকার) পরবর্তীকালে নেতা ও সাংসদ। তার একদা বিপ্লবী সত্ত্বা একটু একটু করে হারিয়ে যায় রাজনীতির ঘোলা জলে। ভোগের স্রোতে ভাসতে ভাসতে, একদিন সে অনুভব করে ডুবন্ত নিমজ্জমান অনেকগুলি মুষ্টিবদ্ধ হাত যেন তাকেই ডাকছে। সবকিছু ছেড়ে সে তখন আবার বেরিয়ে পড়ে তার শিকড়ের সন্ধানে অর্থাৎ মানুষের মাঝখানে। এটাও তো দ্রোহ যা সমরেশ অন্বেষণ করেছেন জীবনভর - মানুষের মুক্তির পথ।
মূল্যবোধের সংকট ও দ্রোহ নিয়ে আরেকটি অসাধারণ লেখা 'ওদের বলতে দাও'। দর্শনশাস্ত্রের স্কলার শৌভিক বাঁশি বাজাতে ভীষণ ভালবাসে। সুর তার সহজাত, তার প্যাশন। ইদানিংকালের রাজনীতিতে সে রীতিমতো হতাশ। মানবাত্মার চিরন্তন বাণী, অনিকেত প্রেমের বাণী শুনতে পায় তার সুরসাধনার অন্তরালে। আপামর মানুষ মুগ্ধ হয়ে শোনে সেই বাণী। স্বার্থান্বেষী ও ভোগসর্বস্ব নেতারা বিপদের গন্ধ পায় ও শেষ পর্যন্ত খুন হতে হয় শৌভিককে। অবরূদ্ধ আগ্নেয়গিরির লাভা বুকে নিয়ে কিশোর-কিশোরী, যুবক ও যুবতীর দল শহরের রাস্তায় নির্বাক মিছিল বার করে। তাদের হাতের পোস্টারে লেখা "ওদের বলতে দাও"। এক অসামান্য উপন্যাস, দ্রোহের একটুকরো অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।
সমরেশ কিংবা 'ভ্রমর' অথবা 'কালকূট' - যে নামেই তিনি লিখুননা কেন, অসাধারণ বিষয় বৈচিত্র্যে, ব্যাপ্তির বিশালতায় ও সেইসঙ্গে জীবনবোধে সমৃদ্ধ গ্রামীন ও নাগরিক সমাজ, নিম্নবিত্ত শ্রমিক এবং একইসঙ্গে সর্বশ্রেণীর মানুষের অন্তর্মুখিতা ও বহির্মুখিতা ইত্যাদিকে নিয়ে এসেছেন তাঁর সৃষ্টির ক্ষেত্রে।
সমরেশের অধিকাংশ উপন্যাসে মূল কথাই হলো - ব্যক্তির বিপন্নতা। ব্যক্তি বনাম পার্টি, ব্যক্তি বনাম সমাজ, ব্যক্তি বনাম পরিবার অথবা ব্যক্তি বনাম ধর্ম। তিনি সর্বত্র দেখেছেন ব্যক্তির নিগূঢ় প্রশ্ন, তার অস্তিত্বের সংকট, তার স্বাধীনতা, তার নির্বাচনের অক্ষমতা। সে উপন্যাস 'বিবর' হোক বা 'পাতক' কিংবা 'প্রজাপতি'। আমরা নিশ্চিতভাবে এটাও লক্ষ্য করেছি ধনতন্ত্র, পুরাতন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণা ও মূল্যবোধের টানাপোড়েনে বিমূঢ় ও বিভ্রান্ত, ক্ষতবিক্ষত মানুষের সংকট নিয়ে 'বিজন বিভূঁই', 'মহাকালের রথের ঘোড়া', 'অভিজ্ঞান' বা 'শিকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে'র মতন উপন্যাসের অভিঘাতে একটা সময়ে অসংখ্য মননশীল পাঠক উদ্বেলিত হয়ে গিয়েছিলেন।
তাঁর সমস্ত লেখা মানুষকে মুগ্ধতার পাশাপাশি এত বেশি আলোড়িত করেছে, এত বেশি বৈচিত্র্যের স্বাদে ভরিয়ে দিয়েছে, ব্যক্তিজীবন ও মননকে এত বেশি বিস্ফোরক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যে তাঁর ব্যক্তিজীবন সম্বন্ধেই পাঠকের কৌতুহল ক্রমশ বেড়ে গিয়েছে। জীবনে প্রথম থেকেই শুধু বেঁচে থাকবার জন্যেই যাঁকে নানারকম কাজ করে যেতে হয়েছিল, তাঁর পক্ষে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অবকাশ কোথায় ছিল। কিন্তু এ বিষয়ে সন্দেহ নেই পরবর্তী জীবনে তিনি কাফ্কা, কাম্যু, জাঁ পল্ সাত্রে, টমাস ম্যান প্রভৃতির লেখা যে গভীর অভিনিবেশ সহকারে পড়েছিলেনই শুধু নয় সেগুলি রীতিমতো আত্মস্থ করেছিলেন যার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে তাঁর বিভিন্ন রচনার মধ্যে। নিজের জীবনের প্রথমদিকে নিরন্তর লড়াই করেছিলেন বলেই হয়তো চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অবহেলিত, নিপীড়িত, প্রান্তিক মানুষদের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা ও আকর্ষণ ছিল এবং বিভিন্ন লেখায় তারাই এসেছে মূখ্য ভূমিকায়। তাঁর উপন্যাসের মতো তাঁর লেখা অসংখ্য ছোটগল্পগুলিও বিষয়বৈচিত্রে, বহুমুখীনতায়, জীবনের জয়গানে মুখর ও সমৃদ্ধ।
ভ্রমণকাহিনীগুলি রচনায় তিনি 'কালকুট' ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। এখানে লেখক একজন পথিক, চলেছেন 'অমৃত কুম্ভের সন্ধানে'। পড়তে পড়তে চলার পথের ঐশ্বর্য ও এক অন্তহীন জীবনজিজ্ঞাসার আবেগ লেখকের সাথে সাথে আমাদেরও ভাসিয়ে নিয়ে যায় কোথায় কেমনভাবে জানিনা কিন্তু মুগ্ধতার একটা আবেশ থেকেই যায়। আমরা আপ্লুত হয়ে যাই যখন পড়ি - "ক্ষণিকের জন্য মন আমার আবেগে আপ্লুত। রুপমুগ্ধ হৃদয় বোবা হয়ে গেল। মানুষ খোঁজার ছলে খুঁজি মন। সেকথাটি মনে নেই। রুপসাগরে ডুবে দেখি তলিয়ে গিয়েছি হৃদিকুম্ভে। ওইটি কি মন?"
ঠিকই তো। হৃদিকুম্ভে ডুব দিয়ে আমরা ঠিক কী খুঁজি - নিজেকে না অন্য কিছু? তাই অমৃতকুম্ভের পথিকের সঙ্গে চলতে চলতে বলি - "না আর দেরি নয়। মন চলেছে আগে আগে, এবার পা চালিয়ে দিই। ডুব দেবো লক্ষ হৃদি-কুম্ভ সায়রে।" (অমৃত কুম্ভের সন্ধানে)
এই প্রসঙ্গে মনে এলো Somerset Mougham-এর বিখ্যাত উপন্যাস 'The Razor's Edge'। কোথাও একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বোমারু বিমানের পাইলট হিসেবে কাজ করার পর ট্রমায় বিদ্ধস্ত Larry Darrell সবকিছু ছেড়ে দিয়ে একা একা পথে বেরিয়ে পড়েছিল। বস্তুবাদ ও আধ্যাত্মিকতার dichotomy-তে জর্জরিত মানুষটি বলতো - "I am in search for the meaning of life." জীবনের মানে কী? জীবনধারণের কি সত্যিই কোনো উদ্দেশ্য থাকে? সমরেশের মতন সামারসেট মম নিজেও এই মানুষটিকে একেবারে প্রান্তিকের দলে রেখেছেন। তাঁর নিজের লেখাতেই আছেঃ "The man I am writing about is not famous. It may be that he never will be. It may be that when his life at last comes to an end he will leave no more trace of his sojourn on earth than a stone thrown into a river leaves on the surface of the water."
দু'চোখ ভরা তৃষ্ণা নিয়ে কীসের খোঁজে চলেছেন কালকুট? লিখছেন - "আজও তাই দেখি দু'চোখ ভরা তৃষ্ণা, তৃষ্ণা। কিন্তু কিসের খোঁজে, সেই অরূপের কী নাম, কে জানে। বেরিয়েছি অনেককাল, চলেছি কালান্তরে। এখন ভাবি এই মানুষ আর প্রকৃতির রূপের হাটে অরূপের নাম যদি দিই 'মনের মানুষ' তবে কেমন হয়।" (কোথায় পাবো তারে)
এই অরূপ অর্থাৎ কালকূটের 'মনের মানুষ'ই কি রবীন্দ্রনাথের 'জীবনদেবতা' যিনি গানের ওপারে দাঁড়িয়ে আছেন, যিনি নয়নে নয়নে রয়েছেন অথচ নয়ন তাকে দেখতে পায়না?
সারাজীবন ধরে তিনি শুধুই পথ চলেছেন। পথের ধারে ছড়িয়ে থাকা মনিমানিক্য সংগ্রহ করেছেন দু'হাত ভরে। এইভাবে চলতে চলতে তিনি পেয়ে গেলেন তাঁর বিষয় ও তাঁর বিস্ময় - রামকিঙ্করকে, যাঁকে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ডেকে বলেছিলেন, "শোন্, কাছে আয়। তুই তোর মুর্তি আর ভাস্কর্য দিয়ে আমাদের সবখানে ভরে দে। একটা শেষ করবি আর সামনে এগিয়ে যাবি - সামনে।" গুরুদেবের এই প্রত্যাদেশতুল্য উক্তিটি স্মরণ করে রামকিঙ্কর বলেন - "হ্যাঁ, আমিও আর ফিরে দেখি নাই।"
এই আক্ষেপ আমাদের কোনওদিন যাবে না যে সমরেশ তাঁর শেষ উপন্যাস 'দেখি নাই ফিরে' শেষ করে যেতে পারেননি। আমরা অবাক হয়ে যাই এই কথা শুনে যে রামকিঙ্কর সম্বন্ধে বিশদে জানার জন্য কী অসাধারণ পরিশ্রম আর নিষ্ঠা নিয়ে তিনি এই কাজটি করতে শুরু করেছিলেন। রামকিঙ্কর যে ভাষায় কথা বলতেন বাঁকুড়ার সেই আঞ্চলিক ভাষা, সেই ডায়ালেক্ট সবকিছুই রপ্ত করেছিলেন দিবারাত্রি মহড়া দিয়ে। ঘরে বা বাড়িতে এমনকি আড্ডার আসরেও ইচ্ছে করে অনর্গল কথা বলতেন সেই বাঁকুড়ার ভাষায়। এমনকি ঘরের দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখতেন সেখানকার শব্দমালা, সেখানকার মানচিত্র। সবকিছু নির্ভুল হতে হবে। কতজন লেখক এই ধরনের বায়োপিক উপন্যাস শুরু করার আগে এরকম তনিষ্ঠ গবেষণায় ডুবে থাকেন আমি জানিনা।
সমালোচক নরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের মতে - "এটিই বাংলা ভাষায় লেখা একজন শিল্পীর 'বিকামিং'-এর, তাঁর 'হয়ে ওঠার' প্রথম কাহিনী। প্রথমত্বই তার প্রধান গুণ নয়। এত সানুপুঙ্খ, এত গভীরতা, এত তথ্যসমৃদ্ধ - অথচ লেখকের দিক থেকে এত তাৎপর্যপূর্ণ লেখা বাংলা সাহিত্যে নেই। তাৎপর্যপূর্ণ বলছি এজন্য যে, রামকিঙ্করের সংগ্রামের ভিতর দিয়ে তিনি পেয়ে গিয়েছিলেন সেটাই, যা তিনি সারাজীবনে খুঁজেছিলেন - ব্যক্তির স্বাধীনতার সংগ্রামের যন্ত্রণার ক্লাসিক রূপক। ভাস্কর্যেই হোক আর কাগজ-কলমেই হোক, সেই যন্ত্রণার সামনে আমরা স্তব্ধ।"
সমরেশ বসুর মতো এমন একজন বিস্ময়কর প্রতিভার সামনে আমরাও স্তব্ধ হয়ে যাই ও এই প্রতিভাদীপ্ত সৃজনশীল সাহিত্যিকের উদ্দেশে আমদের মাথা নত করি।