আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২৪ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪৩০
প্রবন্ধ
মফস্বলির কলকাতা ২
অমিয় দেব
একান্ন সালে যারা কলকাতার কোনো কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয় তাদের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এ./বি.এসসি./বি.কম. শেষ করে বেরোনোর কথা পঞ্চান্ন সালে। আমার ক্ষেত্রে তা ঘটল ছাপ্পানোয়। কারণ আমি ইন্টারমিডিয়েট করে একবছর পড়িনি। শিলং-এ ছিলাম, মুখ্যত আমার যশোর জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে মেরুদণ্ডে লাঠি খাওয়া দাদার চিকিৎসাকালীন সাহায্যের জন্য। (অবশ্য সেই কর্মে ওই বিস্তর চড়াই-উৎরাই ভাঙার এক ফাঁকে একটু ছাত্র রাজনীতিও করে ফেলেছিলাম সেখানে।) তাই এই মফস্বলিকে আবার একটু নতুন করে কলকাতা চিনতে হল। এবার আর চাঁদপুর-গোয়ালন্দ হয়ে শিয়ালদা পৌঁছনো নয়, বাসে গৌহাটি (তখন তাই বলতাম, এখন গুয়াহাটি বলি) গিয়ে আসাম লিংক ধরা। ব্রহ্মপুত্র ব্রিজ তখনও হয়নি; পাণ্ডু এসে ফেরিতে ব্রহ্মপুত্র পেরোতে হতো। রেলে ওঠা আমিনগাঁওতে। দীর্ঘ যাত্রা। উত্তর-পশ্চিম আসাম পেরিয়ে উত্তরবঙ্গের উত্তর প্রান্ত দিয়ে বিহারে ঢুকে কাটিহার হয়ে মণিহারিঘাট পৌঁছনো। সেখানে গঙ্গার উত্তরপাড়ে স্টীমারে উঠে খানিক এগিয়ে গিয়ে গঙ্গার দক্ষিণপাড়ে সকড়িগলি ঘাটে এসে নামা। নেমে ট্রেন নেওয়া। মণিহারি ঘাট পর্যন্ত (তখন) মিটারগেজ, সকড়িগলি ঘাট থেকে ব্রডগেজ। এবং কিঞ্চিৎ বড়ো মাপের এই ট্রেনে বিহার থেকে ফের পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে বীরভূ্ম-বর্ধমান-হুগলি পেরিয়ে অবশেষে হাওড়া। দেশের দুই বৃহৎ নদী অতিক্রম করতে হয় এই রেলযাত্রায়। হাওড়া স্টেশনে নেমে হাওড়া ব্রিজ পেরোনোও এবার ঘটল। অর্থাৎ যে-গঙ্গা অতিক্রম করে এলাম, ফের তারই এক প্রধান ধারা পেরিয়ে মহানগরীতে প্রবেশ করলাম।
তিন-বছর আগে যে - প্রফুল্লচন্দ্র ছাত্রাবাসে এসে উঠেছিলাম এবারও সেখানেই। তবে এবার আর অস্থায়ী অতিথি নয়, অচিরেই আবাসিক। বি.এ.-তে গোড়ায় প্রেসিডেন্সিতে জায়গা না পেয়ে ভর্তি হলাম হাঁটা পথের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। অঙ্কে অনার্স নিয়ে। বাংলা-ইংরেজি ছাড়া আর যে-দুই বিষয় ‘পাস’ হিসেবে পড়তে নিলাম তা অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান। অঙ্কে সেন্ট জেভিয়ার্সের গরিমা ফাদার গোরোকে নিয়ে। তিনি ক্লাস নিতেন সকাল ন-টায়, বস্তুত আটটা ঊনষাটে। কারণ তখন তিনি দরজাটা ভেজিয়ে দিতেন আর ছিটকিনি তুলে বন্ধ করে দিতেন কাঁটায় কাঁটায় ন-টায়। তারপর কেউ এলে, এমনকী ন-টা এক-এও, দরজা খুলত না। গুপী-বাঘার চলচ্চিত্রকার হয়তো বলতেন, কী দাপট। তবে দাপট মানায়, কারণ পড়াতেন আশ্চর্য; আমার মতো সাহিত্যঘেঁষা অঙ্কহীনকেও ক্যালকুলাসে দীক্ষা দিচ্ছিলেন। (সেই ফাদার গোরোকে আটের দশকের গোড়ায় সেন্ট জেভিয়ার্স ইনফার্মারিতে দেখেছিলাম রুগ্ণ, স্নেহপ্রত্যাশী, মরণাপন্ন ফাদার আঁতোয়ানের প্রতিবেশী।) কিন্তু অঙ্কের আরেক মাস্টারমশাই একদিন বোর্ডজোড়া এক মস্ত ইকোয়েশন-শেষে অনাবিল সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন ০ = ০; তাতে তাঁর নিজেরও বিস্ময়ের অবধি ছিল না। বাংলার ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে ভালো লেগেছিল। পরে শুনেছিলাম তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির মার্জিত মৃদুভাষী শিক্ষক দেবব্রতবাবুর পিতা। ইংরেজি বোধহয় ফাদার প্রিফেক্ট (প্রিন্সিপালকে তা-ই বলা হতো ওখানে) নিজেই পড়াতেন, খুব একটা দাগ কাটেননি। সেন্ট জেভিয়ার্সে মাসখানেকের বেশি থাকা হয়নি - প্রেসিডেন্সিতে দ্বিতীয় তালিকায় জায়গা পেয়ে সেখানেই চলে এলাম। টানটা যেমন কলেজের (প্রেসিডেন্সির গাড়িবারান্দার চাতালে বসে ঊধ্বারোহী ওই সমূহ সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে যে মাঝে মাঝে কী রোমাঞ্চ হতো তা বলবার নয়) তেমনি বইপাড়ারও। কলেজ স্ট্রীট কফিহাউসের তো বটেই।
অঙ্কের ক্লাসঘর ছিল দোতলার একপাশে, মূল অট্টালিকার সঙ্গে বোধহয় পরে যোগ হয়। আমি যখন এলাম তখন বিভাগীয় প্রধান নন্দলাল বসু, একটু রাশভারী। তুলনায় মুরারিবাবু নিরভিমান। ফর্সা দেখতে আরেক মাস্টারমশাইকে মনে পড়ছে, কিন্তু তাঁর নাম ভুলে গেছি। তেতলায় একটা অবজার্ভেটরি ছিল, তার দায়িত্ব অঙ্ক বিভাগেরই। একটা টেলিস্কোপ ছিল তাতে, যাতে চোখ রেখে রাতের আকাশ দেখা যেত। সেই অভিজ্ঞতা একবার হয়েছিল। বৃহস্পতি দেখেছিলাম মনে আছে, তার চারটি মুখ্য উপগ্রহসুদ্ধ। এই উত্তেজনা সত্ত্বেও অঙ্কে মন দিতে পারিনি। ভালো ছাত্র ছিল হৃষীকেশ, ইডেন হস্টেলে থাকত। তার কাছে কখনও কখনও পড়া বুঝতে যেতাম। ক্লাসনোট দিয়ে সাহায্য করেছিল আরেক সহপাঠী, থাকত বোধহয় চেতলায় - নাম মনে নেই। কীভাবে জানি না আমি অনার্স পেয়ে গেলাম, কিন্তু সে পায়নি। পেলাম অবশ্য টায়েটুয়ে। বস্তুত, টেস্ট পরীক্ষায় এত কম নম্বর পেয়েছিলাম যে নন্দলাল বসুর ঘরে ডাক পড়ল। এত কম কেন? আমি তো আদ্ধেকের উত্তর করেছিলাম, সেই হিসেবে বোধহয় খুব কম নয়। কিন্তু আদ্ধেকের উত্তরই বা করবে কেন, পুরোর নয় কেন? কোনো জবাব আমার দেবার ছিল না। দু-বছর পড়ে এসে কি এখন বলা চলে, অঙ্ক আমার বিষয়ই নয়?
তবে বিষয় কী হতে পারত? বাংলা? না, ইংরেজি? আবশ্যিক বাংলায় ক্লাস করেছি জনার্দন চক্রবর্তীর, দেবীপদ ভট্টাচার্যের। ইন্টারমিডিয়েটে বাংলা পড়ে-আসা সব অনার্সের ছাত্রদের ওই পাঠ নিতে হতো। সেকশনে বিভক্ত ছিলাম কিনা মনে নেই। তবে জনার্দনবাবুর ক্লাসে কেউ কেউ একটু গোলমাল করত। গোলমাল মানে ফিসফাস। যেন এমনতর ক্লাসে এসে সময় নষ্ট হচ্ছে। জনার্দনবাবু রেগে যেতেন। মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা! এমনিতেই, মধুসূদনকে মাইকেল বললে তিনি মনঃক্ষুণ্ণ হতেন। তার উপর এই! রেগে গিয়ে কখনও কখনও একটু বক্তৃতা করতেন। বাংলা অনার্স ক্লাসে নিশ্চয়ই জনার্দনবাবু-দেবীপদবাবুদের প্রতি ছাত্রদের অব্যাহত মনোযোগ ছিল; তবে ততদিনে আমার বন্ধু হয়ে ওঠা মানবকে (মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, যাকে তার পরবর্তী জীবনে শিশিরকুমার দাশ ‘অনুবাদেন্দ্র’ বিশেষণে ভূষিত করেছিলেন) দেখে মনে হতো ক্লাসের বাইরেও ঢের শিক্ষার অবকাশ ছিল।
আবশ্যিক ইংরেজিতে ক্লাস করেছি সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, টি.পি.এম. ও অমল ভট্টাচার্যের কাছে। তারকনাথ সেন আবশ্যিকীদের ক্লাস নিতেন না। সুবোধবাবুর ক্লাস তেমন ভালো লাগত না। আমরা উদ্দিষ্ট হবার যোগ্য নয় ভেবেই কিনা জানি না, খুব কিছু বলতেন না। তার উপর বসে পড়াতেন। বস্তুত, তাঁর ক্লাসে আমি পেছনের বেঞ্চিতে বসে, তিনি যাঁর উপর বই লিখেছিলেন বা লিখতে যাচ্ছেন সেই বার্নার্ড শ’র নাটক পড়েছি। কলেজ স্ট্রীট ফুটপাত থেকে শস্তায় কেনা। অমলবাবু দাঁড়িয়ে পড়াতেন। শুধু সেইজন্য নয়, তিনি যে-ভাবে পড়াতেন, যে-পদ্ধতিতে, তার জন্যও, তাঁর পড়ানো খুব ভালো লাগত। কীট্স তাঁর পাঠে, ভাষ্যে, ভাষণে জীবন্ত হয়ে উঠতেন। আমার কাছে তখন এক আদর্শ শিক্ষকের উপমান ছিলেন অমল ভট্টাচার্য। অন্যদিকে, যিনি আমাদের শেক্সপিয়ার পড়াতেন - টি.পি.এম., তারাপদ মুখোপাধ্যায় - তাঁর ‘Was Prospero Shakespeare?’-এর আবেগ কিছুটা মনে আছে। সেন্ট জেভিয়ার্সে অঙ্কের গরিমা যেমন ফাদার গোরোকে নিয়ে, তেমনি প্রেসিডেন্সিতে ইংরেজির গরিমা তারকনাথ সেনকে নিয়ে। তাঁর পড়ানোর গল্প শুনতাম ইংরেজি অনার্সের ছাত্রদের কাছে। তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে আমার বন্ধুতা হয়। নাম প্রদ্যুম্ন মিত্র। হাওড়ার শালখেতে থাকত। কবিতা লিখত। বিষ্ণু দে-র ভক্ত। ইংরেজির সুহাসের সঙ্গেও আলাপ হয়। আমরা তিনজন কখনও কখনও বেকার ল্যাবরেটরির সন্নিকট লনে বসে আড্ডা দিতাম। (তখনও নতুন বাড়ি হয়নি।) যে-নিরুপম চট্টোপাধ্যায় সেইসময় বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় “রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দঃ দুজন অসবর্ণ কবি” লিখেছিলেন এবং যা পড়ে প্রদ্যুম্ন মুগ্ধ, তাঁকে কলেজ স্ট্রীট দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে বলেছিল, আশ্চর্য ঢ্যাঙ্গা তো! প্রদ্যুম্ন আমার মতোই বেঁটে। তবে ধুতি পরত; আমি প্যান্ট পরতাম। কথা ও-ই বলত বেশি।
অর্থনীতি পড়েছি ধীরেশ ভট্টাচার্য ও তাপস মজুমদারের কাছে। ধীরেশবাবুর চোখে বোধহয় একটু কম পলক পড়ত, তাই তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা শুনতে অসুবিধে হতো। অথচ পড়াতেন ভালো। শান্ত মানুষ। পরিচ্ছন্ন বাচনভঙ্গি। অঙ্ক শেখানোর মতো করে এগোতেন। তুলনায় তাপসবাবু ঈষৎ উচ্ছল। সদ্য বিদেশ প্রত্যাগত। বয়সও কম। তবে সাড়া জাগাতে পারতেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ইউ. এন. ঘোষালের নামডাক ছিল, কিন্তু ‘পাস’-এর ছাত্রদের প্রতি বোধকরি কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্যই তাঁর প্রকাশ পেত। অন্তত কোনো উদ্দীপনা দেখা যেত না। উল্টোদিকে রমেশচন্দ্র ঘোষের ছিল অদ্ভুত উদ্দীপনা। আমাদের মধ্যে তা চারিয়েও দিতে পারতেন। তাছাড়া তিনি শুধু একটা বিষয় তুলে ধরতেন না, তা নিয়ে তাঁর নিজের মতামতও জ্ঞাপন করতেন। এক ধরণের দৃপ্তি ছিল তাঁর হেঁটে হেঁটে পড়ানোর ভেতর। কখনও কখনও একটু পাগলাটেও লাগত। সদর্থে।
বেকার ল্যাবরেটরির গ্যালারিতে মাঝে মাঝে ডিবেট হত। সুধাংশু দাশগুপ্ত নামেই বোধহয় একজন নামী ডিবেটারও আসতেন। আর একদিন, যতদূর মনে পড়ছে এক হাফপ্যান্ট পরা, ছোটোখাটো ডিবেটারকে দেখলাম, নাম শুনলাম জ্যোতির্ময় দত্ত। তার তীক্ষ্ণ বাচনভঙ্গি। এই জ্যোতির্ময় দত্তের সঙ্গেই যে পরে আমার গভীর বন্ধুতা হবে তা কি তখন জানতাম? জীবন যে কত গল্প বানাতে পারে, আশ্চর্য!
প্রেসিডেন্সি আমার ও আমি প্রেসিডেন্সির - এই বোধ আমার ওই দুবছরে ঠিক হয়নি। আবার এমন নয় যে আমি কফিহাউসের এক বিপুল আড্ডাধারী হয়ে উঠেছিলাম। যেতাম বটে কফিহাউসে, আড্ডাও দিতাম, কিন্তু এক পেয়ালা কফি ও এক গ্লাস জল নিয়ে দু-ঘন্টা কাটিয়ে দেবার নৈতিক মুরোদ আমার ছিল না। ভিড় বাড়ছে ও টেবিলের টান পড়ছে দেখলেই উঠে বেরিয়ে আসতাম। কাছেই একটা ফ্রী রীডিং রুম ছিল - যিনি চালাতেন সেই বিখ্যাত একদা-বিপ্লবীর নাম এক্ষুনি মনে পড়ছে না - সেখানেও মাঝেমধ্যে যেতাম, হয়তো ক্লাস পালিয়েই, তবে খুব যে কিছু পড়তাম তা নয়। বইয়ের দোকানগুলোতে উঁকি মারার সাহসও হয়নি, যদি জিজ্ঞেস করে ফেলে কী বই চাই! 'সিগনেট'-এর ছিমছাম দোকান দূরে দাঁড়িয়েই দেখতাম। কফিহাউসের বাড়িতে 'রূপা'-র দোকানে গেছি দু-একবার - দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বইয়ের গন্ধ শুঁকতে মানা ছিল না সেখানে। তাছাড়া চেহারা তখনও বেশ মফস্বলিই ছিল, বই হাতাবার মতো স্মার্টনেস অর্জিত হয়নি। তবে বইপাড়ায় বেশি ঘুরতাম ফুটপাতের দোকানগুলোতে। উবু হয়ে বসে ব্যবহৃত, উপর্যুপরি ব্যবহৃত, বই দেখতে ভালো লাগত। হাতে নিলে দোকানি সবসময় বকতও না। একবার অমনি এক বই - বুদ্ধদেব বসুর ‘বন্দীর বন্দনা’-ই বোধকরি - খুলে অবাক হয়েছিলাম দেখে (আগে এ-গল্প বলেওছি এখানে-ওখানে), বইটা বুদ্ধদেব বসু (উপহার) দিয়েছিলেন নীহাররঞ্জন রায়কে। তার এই গতি? নীহাররঞ্জন রায় বই ধার দিতেন কিনা জানি না, দিলেও নিশ্চয়ই খুব বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিকে দিতেন। তাহলে হয়তো চৌর্য। আবার, কেউ ধার নিয়ে থাকলে চৌর্য সেখানেও হয়ে থাকতে পারে। নীহাররঞ্জন রায়ের পুত্র প্রণবরঞ্জনকে এ-গল্প বোধহয় করিনি।
ক্লাস যে পালাতাম তার প্রমাণ তো নন-কলেজিয়েট হওয়া যার জন্য ফাইনালে বসবার আগে জরিমানা দিতে হয়েছিল। অনার্সের ক্লাস পালানো শক্ত ছিল, কারণ ছাত্র আমরা বেশি ছিলাম না। বাংলা-ইংরেজি আর অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্লাস পালালে ধরা পড়ে যাবার ভয় কম ছিল। প্রক্সির ব্যবস্থা? না, তেমন বন্ধুবান্ধব খুব জোটেনি। বলা বাহুল্য, ইংরেজিতে অমলবাবুর ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রমেশবাবুর ক্লাস কখনও পালাতাম না। অন্য ক্লাসও হয়তো পালাতাম না, যদি প্রেসিডেন্সিতে আমার পুরো মন বসত, যেমন বসেছিল, ধরা যাক, আমাদের সহপাঠী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনার্সের ছাত্র অমলের (সম্প্রতি প্রয়াত অমল মুখোপাধ্যায়ের)। তবে অমলের উদাহরণ হয়তো বিশেষ, কিন্তু ঢের প্রাক্তনীর কথা বলা যেতে পারে যাদের স্মৃতিতে আজও প্রেসিডেন্সি উজ্জ্বল। অনেক পরে আমার বন্ধুস্থানীয় জ্যোতির্ময় পালচৌধুরীর আমন্ত্রণে এক প্রাক্তনী সংসদ আয়োজিত স্টীমার পার্টিতে গিয়ে আমার সেই ধারণা হয়েছিল। (বস্তুত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে অনুকূল হতে পারে এবং বিদ্যার্জন আনন্দদায়ক, সেই অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল প্রেসিডেন্সির পরে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. পড়তে এসে।)
প্রফুল্ল ছাত্রাবাস নিয়ে এক আলাদা নিবন্ধ আছে আমার, এখানে নতুন করে তার ধরণধারণ বিষয়ে কিছু বলব না। কিন্তু ১৯৫৪-র অক্টোবর পেরিয়ে তার ছাতে দু-একজনের গলায় 'বনলতা সেন' শোনা যেতে লাগল, বা ‘হায় চিল, সোনালি ডানার চিল’। মরে গিয়ে জীবনানন্দ অমরতার পথে পা দিলেন। তবে ওই নভেম্বর-ডিসেম্বরে তো জানতাম না যে ২০০০ সাল পেরিয়ে একদা প্রায় প্রতিবেশী ভূমেন্দ্র গুহ আমার বন্ধু হয়ে উঠবেন (কালীকৃষ্ণ গুহই তাঁকে আমাদের বাড়ি নিয়ে এসেছিলেন) এবং কেবলই এক ট্রাঙ্কের গল্প শুনব তাঁর কাছে, এমনকী দু-একটা খাতাও দেখে ফেলব তাঁর দৌলতে - জীবনানন্দের দিনলিপি, এক নিভৃত অভিমানের সাক্ষী। আর, এও তখন জানতাম না যে ২০২৩-এর অক্টোবরে শাহাদুজ্জামানের ‘একজন কমলালেবু’ পড়ে ডেকে ডেকে সবাইকে ওই জীবনী-উপন্যাস পড়তে বলব। সময় কি এভাবেই খেলা করে আমাদের নিয়ে? প্রেসিডেন্সি কলেজ হয়ে যায় আপতিক, যেন গন্তব্যের আগেই এক স্টেশনে নেমে পড়া।
আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না, সামাল দিতে হতো টিউশনি করে। এলাম, দেখলাম, জয় করলাম-এর মতো কিছু ঘটবার ছিল না এ-মফস্বলির। কলকাতা চিনতে হয়েছে একটু একটু করে। যেমন ট্রামে-বাসে তেমনি পায়ে হেঁটেও। তবে গতিবিধি এই দ্বিতীয় দফায় অনেক বেড়েছে। টিউশনি করতে গিয়ে একাধিক নতুন পাড়ায় যাতায়াত ঘটেছে। দু-একটি গলিঘুঁজিরও হদিশ পেয়েছি। গড়ের মাঠে প্রাতঃভ্রমণ না করতে গেলেও ফুটবল খেলা দেখতে গেছি। মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গল। র্যাম্পার্টে বসে হঠাৎ শুনি - এক ইস্টবেঙ্গল সমর্থকের কাতর চীৎকার - "ধনরাজ, অ ধনরাজ, একখান গোল দিয়া দে, তোর লগে আমার মাইয়ার বিয়া দিমু।" মেওয়ালালের ‘ব্যাকভলি’র কথা শুনেছিলাম, তবে দেখা হয়নি। তখন জনসভা সাধারণত হতো অক্টারলনি মনুমেন্টের পাদদেশে। এমনকী একবার পণ্ডিত ওঙ্কারনাথের ‘যোগী মৎ যা’ ওখানে শুনেছিলাম। ময়দানের আকাশ কেঁপে উঠেছিল। তবে বড়ে গোলাম আলির গান প্রথম শুনি এক ঘরোয়া আসরে। পাথুরেঘাটার ঘোষেদের বাড়ির এক ছেলে আমাদের সহপাঠী ছিল প্রেসিডেন্সিতে। একদিন সে মানবকে ও আমাকে বলল, বড়ে গোলামের গান শুনবি তোরা? চলে আয় আমাদের নাটমন্দিরে, আজ গাইছেন। মানব জনপ্রিয়, মানবকে বলার মানে আছে, কিন্তু আমার মতো মুখচোরাকে? সঙ্গগুণ নিশ্চয়ই। গিয়েছিলাম। অত কাছে বসে অমন ওস্তাদের গান শোনা! বুঁদ হয়ে যেতে হয়। প্রফুল্ল ছাত্রাবাসের কাউকে কাউকে ওই ঈর্ষণীয় সৌভাগ্যের কথা বলতে কশুর করিনি। তবে প্রফুল্ল ছাত্রাবাসের কোনো অনুষ্ঠানেই কি প্রথম শম্ভু মিত্রের আবৃত্তি শুনি? ঠিক মনে পড়ছে না - স্মৃতি তালগোল পাকিয়ে আছে। তবে ওঁর রবীন্দ্রনাটক ‘রক্তকরবী’ যে প্রথম দেখেছিলাম নিউ এম্পায়ারের টঙে চড়ে তা মনে পড়ছে। উৎপল দত্তকে কি প্রথম দেখেছিলাম সেন্ট জেভিয়ার্সের অডিটোরিয়ামে, শেক্সপিয়ারের কোনো অংশ অভিনয় করে শোনাচ্ছিলেন? নাকি তখনকার ওয়েলিংটন এখনকার সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে, রবীন্দ্রনাটক মঞ্চায়নে? সেই ‘অচলায়তন’ দেখার অভিজ্ঞতা অন্যত্র শুনিয়েছি।
এমনি নানান সুতোয় কি মফস্বলিকে কলকাতা বাঁধছিল? বন্ধু মানবও মফস্বলি, কিন্তু তার পিছুটান আগেই ঘুচেছে। প্রেসিডেন্সিতে থাকাকালীনই ও অনুবাদে হাত পাকাচ্ছে। আমাকেও 'অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দির'-এর জন্য একটা বই অনুবাদের কথা পেড়েছিল। বই? ওরে বাবা! অত সাহস আমার নেই। থাকলে হয়তো আগেই একটা দাঁড়া পেয়ে যেতাম। যাদবপুরে দুবছর তুলনামূলক সাহিত্য পড়বার জন্য অপেক্ষা করতে হতো না। সেখানেও মানব, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার পথপ্রদর্শক। সেই গল্পও কি আগে করিনি? নিবন্ধপাঠক, আমার পুনরাবৃত্তি প্রবণতার জন্য মার্জনা চাইছি।
কৃতজ্ঞতাঃ রাধারমণ চক্রবর্তী