আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২৪ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

নেত্রী বনাম ক্যাপ্টেন

সুদীপ দত্ত


একটি দলের সক্রিয় সদস্যের নামে অভিযোগ কয়েক'শ কোটি টাকার বেআইনি ব্যবসার। অন্য একটি দলের মুখে স্লোগান কাজের, রুটি-রুজির, ধর্মনিরপেক্ষতার। চ্যাট-জিপিটি নামক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তিকে যদি দুটি দলের মধ্যে নির্বাচন করতে বলা হয়, কোনদিকে সে ঝুঁকবে সেটা সহজে অনুমেয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষতঃ গ্রামবাংলার মন, বোঝা বড় কঠিন। এক অখ্যাত স্কুলবাড়ির কোনো এক কোণে গিয়ে পর্দার আড়ালে ইভিএম-এ বোতাম টেপার সময় কোনদিকে সে ঝুঁকবে, প্রযুক্তি-সৃষ্ট কোনো স্নায়বীয় নকশায় তা আয়ত্ত করা অসম্ভব। বিশেষ করে যদি প্রথম দলটির শীর্ষে একজন জনবাদী নেত্রী থাকেন, যিনি হাওয়া'র দিক বুঝে কৌশল নির্ধারণ করতে সিদ্ধহস্ত। একে নিছক খামখেয়ালিপনা বা অস্থিরমনষ্কতা বলে হেয় করলে পরিণাম যে কি দাঁড়াতে পারে সেটি মোদী-অমিত শাহের চেয়ে বেশি আর কে জানে! অতএব দ্বিতীয় দলের পক্ষে সেই বাস্তবতার থেকে মুখ না ফিরিয়ে স্বীকার করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

নেত্রী যখন বলেছিলেন তেলেভাজা, বেগুনিও শিল্প, তাঁর মাথায় শাহজাহানের সাম্রাজ্য ছিল কিনা জানা নেই, কিন্তু আমরা শহুরে লোকেরা সচরাচর শিল্প হিসেবে যা বুঝি তা নিশ্চই ছিল না। তেলেভাজা-টা একটা প্রতীক - বিভিন্ন 'শ্রী' প্রকল্পের ওপর ভিত করে স্থ্যনীয় পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি এবং অর্থের সঞ্চলন, এটাই তাঁর জনবাদী অর্থনীতি। বুদ্ধবাবুর স্বপ্নের 'উইপ্রো' বা 'টাটা'র মতো টপ-ডাউন (top-down) বা বৃহৎ শিল্পের দ্বারা চালিত না। মুশকিল হলো - খুব অল্প সময়ে এই অনিয়ন্ত্রিত বটম্-আপ (bottom-up) অর্থনীতির সম্পদ বিন্দু-বিন্দু হয়ে শাহজাহান এবং অনুব্রতদের পকেটে সিন্ধুতে পরিণত হয়েছে, আর ক্ষমতার তাগিদে নেত্রী এই ব্যবস্থাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন, লালন করেছেন। নেত্রীর ভাইপো, যুবরাজ - তিনি শাহজাহান, জাহাঙ্গির বা শওকত মোল্লাদের ব্যাপারে আরও খুল্লাম-খুল্লা কারণ তাঁর অতীতে কোনো 'সততা'র ওজন নেই। মোদ্দা কথা - প্রবীণ এবং নবীন, উভয় গোষ্ঠীর-ই চালিকাশক্তি এই রবিনহুডরা, যদিও ইতিহাসে রবিনহুডের একাধিক প্রাসাদ এবং কয়েক'শ বিঘা জমি ছিল বলে জানা নেই। অন্য দলের প্রাক্তন সদস্য অনুজ পান্ডে বা মজিদ মাস্টারের সঙ্গে তুলনা না করে শাহজাহান-এর তুলনা বরং করা যাক মাইক্রোসফট-এর কর্ণধার সত্য নাদেলার সঙ্গে। নিন্দুকেরা বলছেন - তাঁর বার্ষিক আয় পাঁচশ কোটি টাকা অর্থাৎ ষাট মিলিয়ন ডলার যা সত্য'র সমতুল্য! তা সে সত্য হোক আর মিথ্যেই হোক, গ্রামের সহজ সরল মানুষের তাতে কি যায় আসে, যদি তাদের 'মসীহা' খাওয়া-পরার ব্যবস্থাটুকু করে দেন। উপরি পাওনা পাঁচ বছরে একবার 'চৌদবিন কা চাঁদ'-এর মতো সুন্দরী সাংসদ দর্শন, পুরো বিনিপয়সায়। দ্বিতীয় দলের ক্যাপ্টেন সেই সৌন্দর্য্যে যতই ঝলসানো রুটির গন্ধ পান না কেন, গ্রামবাংলার এই চরিত্র নেত্রী হাতের তালুর মতন চেনেন, আর সেখানেই তাঁর ইউএসপি (USP)।

নেত্রীর দ্বিতীয় ইউএসপি শহুরে বাঙালি মধ্যবিত্তকে চেনা। প্রতিটি রাষ্ট্রের এবং রাজ্যের একটি রাজনৈতিক ভরকেন্দ্র থাকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেমন রাইট-অফ-সেন্টার (right-of-center), আর তার মধ্যে ক্যালিফর্নিয়া'র লেফট-অফ-সেন্টার (left-of-center)। বাঙালি আদতে বাম-ঘেঁষা হলেও, সেই অনুরাগ ছোঁয়াতেই শেষ। ওই একটু বিদ্রোহী কবিতা, একটু প্রতিবাদী নাটক, একটু জীবনমুখী গান। একটু নেরুদা, একটু মানিকদা, একটু চমস্কি। কাফেতে কৃত্রিম বুদ্ধির কু-প্রভাব নিয়ে দাঁড়ি চোমড়ানো। রাজা রামমোহন-এর উত্তরসূরি আমরা, সতীদাহ বর্জন থেকে মন্দির-রাজনীতির প্রতি 'নো-ভোট' আমাদের গর্ব, এই লিবেরালিজম আমাদের অহংকার। ব্যাস ঐটুকুই। আগ বাড়িয়ে এটিকে কম্যুনিজম-এর প্রতি আস্থা ভাবলে ঘোরতর ভুল হবে; এ-হেন বাঙালি চা-এর পেয়ালায় ভিয়েতনাম, কিউবার ঝড় তুলতে চায়, কিন্তু আরেকটা ভিয়েতনাম হতে চায় না। চায় না জাপান বা নরওয়ের মতন সমজাতিক এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে। "মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান, তাই তা প্রশ্নের উর্দ্ধে" - ১৯৭০-এর সময়ের দাবিতে এবং জগতের অনুসরণে এরা এই তত্ত্ব পান করেছিল বটে, তারপর চৌত্রিশ বছর ধরে এদের জোর করে সেই পুকুরে এনে জল খাওয়ানোও গেছে, কিন্তু 'রেজিমেন্টেড' দলের শৃঙ্খলে পুনরায় বদ্ধ হতে এদের প্রবল অনীহা। এনারা 'খোকাবাবু' বা 'টুম্পাসোনা'তে নাক সিঁটকোতে পারেন, কিন্তু ওই খোলামেলা লিবারেল সাংস্কৃতিক পরিসরটা বর্জন করতে চান না। নেত্রী এই বাঙালিত্ব এবং তার গন্ডি হাড়ে-হাড়ে বোঝেন। এমনিতেই তাঁর সংস্কৃতিজ্ঞান টলিউডে সীমিত, তাই তাঁর চারপাশের 'বঙ্গশ্রী'দের তিনি পৃষ্ঠপোষকতায় ভরিয়ে দেন, আদর্শের কচকচিতে জড়ান না। দ্বিতীয় দলের ক্যাপ্টেন কিন্তু এখনও এই জায়গাটা রপ্ত করতে পারেননি, তাঁর কথাতে 'পার্টি-লাইন' এখনও সুস্পষ্ট। প্রতিটি বল মেপে খেলা। কোথাও যেন অদৃশ্য অনুশাসন। পলিটব্যুরো নজর রাখছে! 

রাজনীতিতে ক্যাপ্টেন এখনও নবীন। নেত্রীর মতো রাজনৈতিক-চাতুরী তাঁর নেই। নেই সর্বভারতীয় পরিচিতি। তাই সোজা ব্যাটে খেলা ছাড়া তাঁর গতি নেই। ভারতবর্ষের রাজনীতির ঘূর্ণি পিচে খেলতে খেলতে রিভার্স স্যুইপে অভ্যস্ত হতে অপেক্ষাটা শুধু সময়ের। কিন্তু তা করতে গিয়ে মূল ব্যাকরণটা যাতে ঘেঁটে না যায়, সেখানেই তাঁর অগ্নিপরীক্ষা। আর ঘূর্ণি পিচে ব্যাটিংয়ের মতোই পরীক্ষা ভারসাম্যের। ১৯৭৭ থেকে পৃথিবীটা আজ অনেক আলাদা, প্রতি মুহূর্তেই পাল্টাচ্ছে। চারিদিকে যখন সুদের হার বৃদ্ধির ফলে অর্থনৈতিক সংকোচন হচ্ছে, কাজের অধিকার-এর কথা বলা সহজ, কর্মসংস্থান করা কঠিন। পৃথিবীর কোথাও, এমনকি কিউবাতেও সরকারি কাজ বাড়ছে না। কারখানা হয়তো কিছু হচ্ছে, কিন্তু তার জন্য টেক্সাস থেকে ভিয়েতনাম থেকে চেন্নাই কামড়াকামড়ি করছে। এর ওপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার খাঁড়া তো মাথার ওপর ঝুলছেই। উল্টোদিকে মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা বাড়ছেই। সংস্থান আর চাহিদার এই অন্তর থেকেই জন্ম নিচ্ছে চৌর্যবৃত্তির, দুর্নীতির, ধর্মের নামে অসহিষ্ণুতার। ভারতে যা আরও প্রকট। সমাজের শুদ্ধিকরণ তো অনেক দূর অস্ত, এই পরিবেশে কমরেডদের সিধে রাখাই বিরাট চাপের ব্যাপার। এই পিচে যুঝতে হলে ক্যাপ্টেনকে বুঝতে হবে ধার্মিক মানেই ধর্মান্ধ না, উদার অর্থনীতি মানেই দুর্নীতি'র গণতন্ত্রীকরণ না, বা অকপট খোলামেলা আলোচনা মানেই রাকেশ রোশনের চন্দ্রাভিযান না। সেখানেই ভারসাম্য।

তবু এই মাৎস্যন্যায়ের আঁধারে ক্যাপ্টেনকে দরকার। কুলটি বা নন্দীগ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে বৃহত্তর পরিসরে। ন্যূনতমভাবে সংসদীয় বিরোধী হিসেবে। দরকার সেই কথাগুলো বলার জন্যই যেটা অন্যেরা বলছে না। তারা বলছে না যে পৃথিবীর বৃহত্তম অর্থনীতি হতে গিয়ে ভারতের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশ-এর কাছাকাছি। বলছে না টাকার নিম্নমুখী মূল্যের কথা। বলছে না মুদ্রাস্ফীতি'র কথা। বলছে না পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি সদ্যোজাত'র মাথার ওপর ষাট হাজার টাকার ঋণের কথা। ক্যাপ্টেনকে দরকার। দরকার - গীতাপাঠ আর চন্ডীপাঠের বাইনারি যাঁতাকলে পড়ে যে মানুষগুলো হাঁসফাঁস করছে, তাদের জন্য। আগামী প্রজন্মের কাছে 'শাহজাহান মার্কেট'-এর থেকে সম্ভাবনাময় চাকরির দিশা দেখানোর জন্য। সময়োপযোগী শিক্ষার অধিকার আর বিস্তারের জন্য। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য। বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতার জন্য। সর্বোপরি, জনবাদী রাজনীতির আবেশে আবিষ্ট হয়ে যাতে অচিরে আমরা একটা জিম্বাবোয়ে বা ভেনেজুয়েলা না হয়ে যাই, সেই পরিণতি থেকে বাঁচানোর জন্য।