আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২৪ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

মনের খবর জানলি না রে মন

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী


উত্তর কলকাতার অন্যতম ব্যস্ত মেট্রোরেল স্টেশন দমদম। দিনকয়েক আগে সকাল ৯টায় মেট্রো ধরতে গিয়ে দেখি থিকথিক করছে ভিড়। শুনলাম, রবীন্দ্র সদন স্টেশনে দমদমমুখী মেট্রোর সামনে ঝাঁপ দিয়েছেন কেউ। পঁচিশের কাছাকাছি বয়স। ঘটনাটা ঘটার পরে জন-অরণ্য থেকে যে কথাগুলো উড়ে আসছিল হড়পা বানের মতো, তা ছিল অনেকটা এরকম -

"মরার আর সময় পেল না, ফালতু মাল মাইরি।"

"মরবি তো রোববার দুপুরবেলা ঝাঁপালেই পারতিস। আরামসে আনন্দে মরতে পারতিস, ফাঁকা স্টেশনে।"

"অফিস টাইমেই এদের যত ন্যাকামি করার সময় হয়।"

"আমি যদি ড্রাইভার হতাম, বডির উপর দিয়েই সব ট্রেন চালিয়ে দিতাম। সার্ভিস বন্ধ করতাম না এসব ননসেন্স-মরার জন্য।"

"লোকটা মরার পরেও লাখ-লাখ লোকের গালি খাচ্ছে। এত লোকের গালি খেয়ে নরকেও ঠাঁই হবে তো?"

"এত অপশন থাকতে মেট্রোর উপরে এত পিরীত হলো কেন রে ভাই? হাওড়া ব্রিজ ছিল, ঘুমের ওষুধ ছিল, নাটা মল্লিকের রেকমেন্ড করা বটগাছের ঝুরির মতো দড়ি ছিল। অ্যাট লিস্ট নিজের ঘরেও তো ঝুলে পড়তে পারতিস।"

"এদের জন্ম দিয়েছিল কে? কিসের জন্য? জঞ্জাল কোথাকার।"

আত্মহত্যার ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে সেদিনের শোনা কথার তালিকা অন্তহীন। বলাই বাহুল্য, এর অধিকাংশ বাক্যেরই সামনে পিছনে ‘আলো’ করেছিল দু' অক্ষর এবং চার অক্ষরের খিস্তি খেউড়। আশি ছুঁইছুঁই এক বৃদ্ধ টানা এসব কথা শোনার পরে চিৎকার করে বলেছিলেন, "কোন পরিস্থিতিতে একটা তরতাজা ছেলে এমন সিদ্ধান্ত নেয় তা নিয়ে একবারও ভাবতে ইচ্ছে করে না আপনাদের? ক্রমাগত অফিস টাইম অফিস টাইম করে চলেছেন! ছেলেটাকে এই সমাজ বাঁচাতে পারল না কেন তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোনো প্রশ্ন নেই?" সম্মিলিত বক্রোক্তির খাত বদল হল এবারে, চকিতে। শব্দবান ছোঁড়া শুরু হল ওই বৃদ্ধের দিকে। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম, ক্রমাগত ব্যঙ্গের (তার অধিকাংশই ভদ্রলোকের বয়সজনিত) ভার সইতে না পেরে স্টেশন থেকে বেরনোর সিঁড়িতে পা রাখলেন উনি। ওঁর হাতে একটা লাঠি ছিল। ওয়াকিং স্টিক। শুনতে পেলাম, "হরিবোল বলা ট্রাকটায় এই লাঠিকেও নিয়ে যেও, দাদু। কোথাকার কোন রামমোহন রায় উদয় হয়েছিল এই সকালে!" স্টেশন থেকে প্রস্থানপথে বৃদ্ধ মানুষটির মাথা নুইয়ে পড়ছিল ক্রমশ।

পরের দিন এমন খবর যখন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, তার সঙ্গে কয়েকলাইন জুড়ে দেওয়া হয় সাংবাদিকের সঙ্গে কোনো মনোবিদের কথোপকখনের নির্যাস। এই নির্যাস আমাদের খুব চেনা। তাঁরা বলেন, "সম্ভবত চূড়ান্ত মানসিক অবসাদ থেকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন ওই ব্যক্তি।" শহরের কোনো অভিজাত অঞ্চল কিংবা কোনো নাম না শোনা বস্তি, আত্মহত্যার পরে যখন দেহ উদ্ধার করা হয়, মনোবিদদের কথার সারবত্তার বদল হয় না। আমাদের দেশে মানসিক অবসাদে কত মানুষ ভুগছেন, তা নিয়ে পরিসংখ্যানের অভাব নেই আন্তর্জালে। ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন, অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতবর্ষে অন্তত ৫ কোটি ৬০ লক্ষ লোক মানসিক অবসাদের শিকার। এটি দেশের জনসংখ্যার ৪.৫ শতাংশ। আরও ৩.৫ শতাংশ মানুষ অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারে ভুগছেন। জীবনের চলার পথে নিজেই নিজেকে লাল কার্ড দেখানোর জন্য দ্বিতীয় কারণটির ভূমিকাও কম নয়। লজ্জার কথা হল, এদেশের বিপুল জনসংখ্যাকে যদি এই সম্মিলিত শতাংশ দিয়ে গুণ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে, আমাদের দেশে মানসিক অবসাদ এবং অবসাদজনিত নানা রোগে ভোগা মানুষের সংখ্যা পৃথিবীর বহু দেশের মোট জনসংখ্যার থেকে বেশি। শুধু বেশি নয়, অনেকটাই বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পাশাপাশি আরও বহু সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাধারণ মানুষের সার্বিক মানসিক সুস্থতার (কিংবা, অসুস্থতা) উপরে সমীক্ষা চালায়। ওদের বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, অবসাদগ্রস্ত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা কিংবা শতাংশ, উল্লিখিত সংখ্যা কিংবা শতাংশের চেয়ে আরও অনেক বেশি। প্রতি বছরই নয়া সমীক্ষা হয়। আন্তর্জালের গর্ভ ক্রমাগত ভরে ওঠে নতুন রিপোর্টে। আমরা দেখি, দেখেই চলি। পরিস্থিতির কোনো বদল হয় না।

গুমরে থাকা আমাদের সমাজকে প্রতিদিন তলিয়ে যেতে দেখে বিশ্বের নানা প্রান্তে চিকিৎসক এবং মনোবিদেরা একজোট হচ্ছেন। শারীরিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে মানসিকভাবেও ভাল থাকার জন্য কী কী করণীয়, তা নিয়ে তাঁরা আমাদের নানা উপদেশ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। দেশের আনাচে কানাচে এমন সম্মেলন হলে তার তথ্য খবরের কাগজে পড়ি, টেলিভিশন চ্যানেলে দেখি। বুঝতে পারি, তাঁরা রীতিমতো হাত জোড় করছেন আমাদের সামনে। বলছেন, ‘মনের মধ্যে ক্রমশ গড়ে ওঠা আলকাতরা রঙের পাথরটাকে আর বড়ো হতে দেবেন না।’ বলছেন, ‘শত অসুবিধা হলেও অন্দরের-অন্তরের সত্ত্বাটায় সবুজ রংটা মাখিয়ে দেওয়া জরুরি, প্রতিদিন, নিয়ম করে। তার থেকেও অনেক বেশি প্রয়োজনীয় গুমরে না থাকার মানসিকতা।’ প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, অমুক ডে কিংবা তমুক দিবসের মতো বছরের একটি দিনের গায়েও তকমা লাগিয়ে রাখা আছে ‘বিশ্ব আত্মহত্যা বিরোধী দিবস’ হিসেবে। দিনটি ১০ই সেপ্টেম্বর। আত্মহত্যা প্রতিরোধের আন্তর্জাতিক সংগঠন (ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন) ২০০৩ সাল থেকে এই দিনটির গায়ে এমন তকমা বসায়। পরিসংখ্যান বলেছিল, দুনিয়াজুড়ে বছরে ৭ লক্ষেরও বেশি মানুষ এই চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিকে পা বাড়ান। এই পরিসংখ্যান তুমুল অস্বস্তিকর। নড়েচড়ে বসেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। একটি দিনের এমন নামকরণ করার প্রস্তাবে সায় দিয়েছিল তারাও।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে, প্রতি বছর ১০ই সেপ্টেম্বর এলে খবরের কাগজে প্রকাশিত হতো আত্মহত্যাকে ঠেকানোর জন্য নানা প্রতিবেদন। সে দিনের টিভি চ্যানেলের সান্ধ্য বিতর্কে ঠাঁই নিত আত্মহত্যাকেন্দ্রিক নানা বিষয়। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টেছে যত, মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বুঝেছেন, এমন আলোচনা শুধুমাত্র বছরের একটি দিনকে কেন্দ্র করেই যদি সীমিত থাকে, তাহলে সমাজের কোনো আশু সমাধান সম্ভব নয়। তাঁরা চাইছেন, প্রতিদিনের জীবনচর্যায় এই আলোচনা উঠে আসুক। তাঁদের ইচ্ছে, সর্দি-কাশি-জ্বরের মতো মনের অসুখও যে দিনের শেষে কেবলমাত্র একটা অসুখই, সেটা সাধারণ মানুষ বুঝুন। ডাক্তারবাবুদের বিভিন্ন আলোচনা শুনে জেনেছি, মনের বিষাদকে ফেলে রাখলে বহু ক্ষেত্রেই তা পার্থেনিয়ামের মতো ছেয়ে ফেলে আমাদের অন্তঃস্থল। চূড়ান্ত পর্যায়ে কর্কটরোগ ধরা পড়লে চিকিৎসকের জবাব পেয়ে যেমন দিন গোনা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না, তেমনভাবেই ঠিক সময়ে বিষাদবৃক্ষের ডালপালা ছাঁটতে না পারলে তা অনেকক্ষেত্রেই আত্মহননের দিকে মানুষকে ঠেলে নিয়ে যায়। তাই, এমন প্রসঙ্গ নিয়ে নিয়মিত আলোচনা জরুরি।

সচেতনতা বাড়ানোর দায়িত্ব যাদের উপরে বর্তায়, তারা চুপচাপ বসে আছে বললে ভুল হবে বিলকুল। ছোটবেলায় যা দেখিনি কখনও, দিব্যি দেখছি আজ। সর্বভারতীয় বেশ কয়েকটি খবরের কাগজ সপ্তাহে একদিন, একটি পাতার প্রায় অর্দ্ধেক বরাদ্দ করছে মানুষের মনের খবর নিতে। ওই বিভাগের শেষে লেখা থাকে, মনের যে কোনো সমস্যা হলে নির্দ্বিধায় জানান আমাদের। ইমেল করুন, চিঠি লিখুন। প্রতি সপ্তাহে আট-দশটা চিঠি ছাপা হয়। দেশের নামজাদা মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা পাঠকদের মন-বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা এবং প্রকাশ পাওয়া বেশ কিছু চিঠির কথা মনে পড়ছে, যা পড়ার পরে শিউরে উঠেছিলাম। বহু চিঠিতে পড়েছি দাম্পত্য বিষিয়ে যাওয়ার কথা। বেটার হাফ-এর প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে, শুধুমাত্র সন্তানের মুখ চেয়ে বহু মানুষ জীবনটাকে টানতে চাইছেন কোনওমতে। কিন্তু তাঁদের আলিঙ্গন করে হাইরাইজের ছাদ। দূর থেকে ছুটে আসা ট্রেন তাঁদের দু'হাত বাড়িয়ে ডাকে। আপাত ঘুমিয়ে থাকা রেললাইন বলে, জেগে উঠব এক্ষুণি। মাথা নত করো। চল্লিশোর্ধ্ব এক মানুষ লিখেছিলেন, "আমার বাবা নেই, মা নেই, বিয়ে করিনি, চাকরি নেই। আমি নির্বান্ধব। গত পাঁচ বছরে কোনো লোকের সঙ্গে কথা বলেছি কিনা মনে পড়ে না। আমি কারও সঙ্গে মিশতে পারি না, কথা বলতে পারি না। এই সমাজকে আমার কিছু দেওয়ার নেই। সমাজের থেকে কিছু পাওয়ারও নেই। তিন বার আত্মহত্যার চেষ্টা করে বিফল হয়েছি। চতুর্থবার আর ফেল করতে চাই না। ডাক্তারবাবু, আমায় বাঁচান।" ওঁর ‘বাঁচা’-র মানে কী ছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বমি উগরে আসে। সাইক্রিয়াট্রিস্ট-সাইকোলজিস্টরা তাঁদের সাধ্যমতো ওই প্রশ্নমালার উত্তর দিয়েছেন। তাঁদের কাজ তাঁরা করেছেন, দায়িত্ব সহকারে। কিন্তু যে মানুষদের মনের মধ্যে এমন প্রলয় চলছিল এতকাল ধরে, কয়েকমাস পরে তাঁদের মধ্যে কজন চলার পথের সঠিক দিশা খুঁজে পেয়েছিলেন তা জানতে বড়ো ইচ্ছে হয়। চিঠিতে লেখা সমস্যার ধরণ ইতিমধ্যেই আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়েছে বুঝলে মনোবিদরা স্পষ্ট লিখে দেন, ‘অবিলম্বে কোনো ডাক্তারবাবুকে দেখান। আপনার ক্লিনিকাল ইন্টারভেনশন জরুরি।’ কার্যক্ষেত্রে কতজন মানুষ চিঠির উত্তরে পাওয়া পরামর্শ মেনে চিকিৎসকের চেম্বারের খোঁজে নেন, তার কোনো পরিসংখ্যান মেলে না। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এমন বিভাগের শেষে উল্লেখ করা থাকে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থার ফোন নম্বর। মনের মধ্যে তুমুল দোলাচলের সময় আমরা সেই সংস্থার প্রতিনিধিদের শরণাপন্ন হতে পারি। এমনই এক সংস্থার নম্বরে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "দিনে কটা ফোন পান, ম্যাডাম?" ওদিক থেকে উত্তর এসেছিল, "হাতে গোনা।" এরপরে কানে এসেছিল এক প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস। উনি বলছিলেন, "বিপদের সময় পাশে যে কারও হাত ধরা যেতে পারে এটাই মানুষ বুঝতে চাইল না এখনও। প্রিয়জনের হার্ট অ্যাটাক হলে তীব্র চেঁচিয়ে পড়শি ডাকে। অথচ, নিজে তুমুল অবসাদে ভুগে বহুতল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগের মুহূর্তেও কারও সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করে না। কী অদ্ভুত না?"

বিশেষজ্ঞদের মতে, বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ করার পরেও আদতে লাভের লাভ হয়নি কিছু। অন্তত, সংখ্যাতত্ত্বের হিসেব সে কথা বলে না। মাঝের বিক্ষিপ্ত তিন-চার বছর বাদ দিলে দেখা যাবে, এই শতাব্দীর প্রতিটি বছর, তার আগের বছরকে আত্মহত্যার ঘটনায় হেলায় হারিয়েছে। তবে এমন ঘটনার বৃদ্ধির হার গত পাঁচ বছরে আকাশ ছুঁয়েছে বলা চলে। ২০১৯-এ নিজেকে শেষ করে দিয়েছিলেন এ দেশের ১.৩৯ লক্ষ মানুষ। আগের বছরের থেকে ৩.৪ শতাংশ বেশি। পরের বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালে এই সংখ্যাটা দাঁড়ায় দেড় লক্ষে। বৃদ্ধি, আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ। ২০২১-এ আত্মহত্যার ঘটনায় মারা যান ১.৬৪ লক্ষ মানুষ। বৃদ্ধি - আগের বছরের তুলনায় ৭.২ শতাংশ। ২০২২-এ আত্মহত্যা করেন ১.৭১ লক্ষ মানুষ। বৃদ্ধি - ৪.২ শতাংশ। করোনা-মাখা বছরগুলোতে আত্মহত্যার বাড়বাড়ন্ত দেখে কিছু মানুষ দাবি করেছিলেন, লোকের হাতে কাজ নেই। তাই তো এমন পরিণতি। করোনাকালের অবসান হয়েছে। গত দু'বছরের পরিসংখ্যান ভুল প্রমাণিত করেছে তাঁদেরও।

দেশের জনসংখ্যা বাড়লে পাল্লা দিয়ে বাড়বে বাৎসরিক আত্মহত্যার সংখ্যা - এমন ভাবলে ভুল হবে। 'ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো'র পরিসংখ্যান বলছে, বছর পাঁচেক আগেও যে দেশে আত্মাহুতির হার ছিল প্রতি ১ লক্ষ জনসংখ্যায় ১০.২ জন, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রতি লক্ষে ১২.৪ জনে। সমস্ত দেশের জনসংখ্যাকে এই হার দিয়ে গুণ করলে যে সংখ্যাটা আমরা খুঁজে পাই, তা কপালে ভাঁজ ফেলার পক্ষে যথেষ্ট। চোখে আঙুল দিয়ে তা প্রমাণ করে, মানসিক ব্যাধির প্রতিকারে এই বাহারি আয়োজনই সার। লাভ হয়নি কিছুই।

সচেতনতা বৃদ্ধির এই প্রয়াস পাউডারের গুঁড়োর মতো আমাদের সারা শরীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে না পড়তে পারলে যাবতীয় চেষ্টা ব্যর্থ হয়। আমরা বছরে একবার নিয়ম করে রক্তের সুগার-ইউরিয়া-ক্রিয়েটিনিনের খোঁজ নিতে পারি, হৃদস্পন্দন গ্রাফ পেপারে প্রিন্ট করে, ইসিজি রিপোর্ট নিয়ে চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হতে পারি, বিভিন্ন ডায়গস্টিক সেন্টারের ফুল বডি চেক-আপের ডিসকাউন্ট কুপন, সানন্দে পেস্ট করতে পারি সেন্টারের বাহারি অ্যাপে। সব পারি, শুধু নিজের মনের খবরটা নিতে পারি না। মন আবার কোনো বিষয় নাকি? এই সম্মিলিত উদাসীনতার কারণেই হয়তো জানতে ইচ্ছে করে না আমাদের বন্ধুদের, পরিচিতদের মনের খবরও। দুনিয়াজুড়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুব বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগে এই জানার ইচ্ছেটা জরুরি। আর, কে না জানে, ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়।

তুমুল রেজাল্ট করে আমেরিকা-ইওরোপে থিতু হয়ে যাওয়া বেশ কয়েকজন স্কুলজীবনের বন্ধুর থেকে শুনেছিলাম ওদের মন ভাল রাখার ‘ম্যান্ডেটরি অ্যাসাইনমেন্ট’-এর কথা। জানতে পেরেছিলাম, যে সংস্থায় কাজ করে ওরা, সেখান থেকেই একটা মোটা অর্থের বরাদ্দ করা হয় প্রতি ছ'মাস অন্তর, শুধুমাত্র মনোবিদ দেখানোর জন্য। বাধ্যতামূলকভাবে ডাক্তারবাবুর অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়। প্রেসক্রিপশন জমা দিতে হয় অফিসে। একজন বলছিল, “মনের কোনো অসুখ থাকাটা বড়ো কথা নয়। চিকিৎসা যে চলছে এবং আমি ডাক্তারবাবুর পরামর্শে ভাল থাকার চেষ্টা করছি, এটাই বড়ো কথা।” এ দেশের এইচ.আর. ম্যানেজাররা এসব নিয়ে ভাবতে শুরু করবেন কবে?

ভাল মন আমাদের সারা অঙ্গে অদৃশ্য জরির ঝালরের মতো লেপে থাকে। মন ভাল থাকলে অন্তঃস্থল থেকে কাশফুলের মতো আনন্দ দোলে। আমরা বুঝিনা হয়তো। কিন্তু, আমাদের শরীরের ভাষা সে কথা বলে। বলেই চলে। মনের গভীরে অস্বস্তির যে বুদবুদগুলোর জন্ম হয় মাঝেমধ্যে, তাদেরকে ভাল করে দেখে নিয়ে সজোরে ‘ফুঃ’ বলাটা আমাদের শিখতে হবে। অনেক পিছিয়ে থাকলেও মনের চিকিৎসার জন্য যতটুকু পরিকাঠামো আছে এ দেশে, অন্তত এখনও পর্যন্ত, তার সিকিভাগও আমরা ব্যবহার করি না, আমাদের সার্বিক অজ্ঞতা কিংবা অজ্ঞানতার জন্য। তার সদ্ব্যবহার করা জরুরি।

মনের কথা ভেবে সার্বিক শুভবোধকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টায় এমন লেখা এখন লেখা হচ্ছে অনেক। আমিও লিখেছি আগে। এ লেখা নতুন কিছু নয়।

এক পরিচিত সমাজতাত্ত্বিক বলছিলেন, “মন ভাল রাখার রিমাইন্ডারটা আসা উচিত প্রতিদিন সকালে উঠে দাঁত মাজার অভ্যেসের মতো। পুরোনো অভ্যেস। কিন্তু রোজ নতুন করে শুরু করতে হয়।”

আসুন, আমরা আমাদের মনকে ভালবাসতে শিখি, প্লিজ। মন নিয়ে সচেতনতাবোধ শ্রাবণের ধারার মতো নেমে আসুক। নতুন বছর এই শুভ ভাবনা দিয়ে তো শুরু করতেই পারি।