আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২৪ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪৩০
সমসাময়িক
বিলকিস বানো ন্যায় পেলেন
স্থান - গুজরাট, কাল - ৩ মার্চ, ২০০২। বিলকিস বানো তখন ৫ মাসের গর্ভবতী। সেই তমসা আবৃত দিনে আহমেদাবাদের কাছে রাধিকাপুর গ্রামে তিনি ধর্ষিত হন এবং ওই একই সময়ে তাঁর পরিবারের ১৪ জন সদস্য দাঙ্গাকারীদের হাতে নিহত হন। পরের দিন বিলকিস থানায় গিয়ে এফআইআর নথিভুক্ত করেন, কিন্তু তাকে যে ধর্ষণ করা হয়েছিল তা বলা হয়নি। ১২ জন অভিযুক্তকে তিনি চিহ্নিত করলেও তাদের নাম এফআইআর-এ উল্লেখ করা হয়নি।
৫ই মার্চ বিলকিসের বক্তব্য ম্যাজিস্ট্রেট রেকর্ড করেন। ওই সময় কেশরপুরের জঙ্গলে তাঁর পরিবারের সাত সদস্যের মৃতদেহ পাওয়া যায়। ৮ মাস পরে পুলিশ বলে, মামলাটি সত্য হলেও অপরাধীদের শনাক্ত করা যায়নি, দোষীদের খুঁজেও পাওয়া যায়নি। পুলিশ মামলা বন্ধের আবেদন করে। তবে আদালত ক্লোজার রিপোর্ট গ্রহণ না করে তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। কয়েক মাস পরে পুলিশ আবারও ওই ক্লোজার রিপোর্ট পেশ করে, এবার আদালত তা গ্রহণও করে। তখন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এই মামলার তদন্তভার নেয় সিবিআই। সিবিআই চার্জশিট দেয় ৬ জন পুলিশ, দু’জন ডাক্তার সহ মোট ২০ জনের বিরুদ্ধে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এই মামলা মুম্বাই কোর্টে গেলে, ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে কোর্ট ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। এর মধ্যে আবার দোষীরা মুক্তির জন্য আপিল করে, আপিল বরখাস্তও হয়ে যায়।
গত বছর স্বাধীনতা দিবসে গুজরাট সরকার ওই ১১ জন দোষীর শাস্তি মকুব করে জেল থেকে মুক্তি দেয়। এর বিরুদ্ধে সেপ্টেম্বর মাসে বিলকিস বানো সুপ্রিম কোর্টের কাছে রিট পিটিশন দাখিল করেন। এই মাসের ৮ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট গুজরাট সরকারের ১১ দোষীর শাস্তি মকুব করার সিদ্ধান্ত বাতিল করে।
খুব সংক্ষেপে এই হল বিগত ২১ বছর ধরে চলা বিলকিস বানো মামলার রোজনামচা।
রোজনামচার বাইরে কিছু কথা -
২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার সময়ে বিলকিস বানোর বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর এবং তিনি তার দ্বিতীয় সন্তানের আকাঙ্ক্ষায় গর্ভাবস্থায় ছিলেন। দাঙ্গার সময় খুন হওয়া সাতজন আত্মীয়ের মধ্যে তাঁর তিন বছরের শিশু মেয়েটিও ছিল। তাঁর আক্রমণকারীরা ছিল তাঁর প্রতিবেশী যাদের তিনি প্রতিদিন দেখতেন। ওই সময়ে গোধরায় ট্রেনে আগুন লেগে ৬০ জন তীর্থযাত্রী মারা যাবার পরে দাঙ্গা শুরু হয়, দাঙ্গায় মারা যায় হাজারের ওপরে মানুষ, যাদের অধিকাংশই মুসলমান।
তখন গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি অবশ্য আগাগোড়া তার সরকারের কোনো অন্যায় স্বীকার করেননি এবং দাঙ্গায় যা ঘটেছে তার জন্য ক্ষমাও চাননি। গুজরাট সরকার গতবছর ওই ১১ জনকে ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, অমিত শাহ-এর কাছে অনুমতি চায়, এবং সেই অনুমতি অমিত শাহের নেতৃত্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক মঞ্জুরও করে।দোষীরা গোধরায় জেল থেকে বেরোবার সময় তাদের বীরের স্বাগত জানানো হয়, মিষ্টি বিলি করে তাদের পা স্পর্শ করে সম্মান দেখানো হয়।
মামলা চলার সময় কিছু পুলিশ এবং কর্মকর্তারা তাঁকে ক্রমাগত ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছিল, হুমকি দেওয়া হয়, অধিকাংশ প্রমাণ ধ্বংস করা হয় এবং মৃতদের ময়না তদন্ত ছাড়াই কবর দেওয়া হয়। যে ডাক্তাররা বিলকিস বানোকে পরীক্ষা করেছিলেন তারা বলেছিলেন যে, তাঁকে ধর্ষণ করা হয়নি।
শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে বিলকিস বানো বিচার পেলেন। দেশের বিচার ব্যবস্থার ওপরে মানুষের ভরসা ক্রমক্ষীয়মান। কোথায় গেলে বিচার পাবে দেশের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর? এই জুলুমের শেষ কোথায়?
এই সময় অন্তত বিলকিস বানোর ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের তৎপরতা দেখে আশা জাগে তিস্তা শেতলবাদ, অন্যান্য সমাজকর্মী, সাংবাদিক, সংগঠকদের ক্ষেত্রেও হয়তো সুবিচার দিতে সুপ্রিম কোর্ট বিশেষ ভূমিকা নেবে।