আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২৪ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪৩০
সম্পাদকীয়
বাম ব্রিগেড এবং
বামপন্থীরা এক দশকের বেশি সময় রাজ্যে ক্ষমতার বাইরে। এই মুহূর্তে রাজ্যে তাদের বিধায়ক এবং সাংসদ সংখ্যা শূন্য। তবু, বিগত ৭ই জানুয়ারি কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে বাম যুব সংগঠনের ডাকে জমায়েতের আয়তন বামপন্থীদের বাড়তি মনোবল যোগাবে এই নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই কথা মানতেই হবে যে ব্রিগেডে আগত জনগণ কোনো কিছু পাওয়ার আশায় আসেননি। তাদের কোনো সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হবে অথবা ব্রিগেডে না গেলে তাদের কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে এই কথার ভিত্তিতে তারা ব্রিগেডে আসেননি। বরং শাসকদলের চোখরাঙানি এবং অত্যাচারের ঝুঁকি থাকলেও শুধুমাত্র বামপন্থী যুব সংগঠনের ডাকে বামপন্থার প্রতি ভালোবাসা এবং আস্থা জানাতেই তাঁরা ব্রিগেডে এসেছেন। সেই অর্থে এই ব্রিগেডের জনসমাগমকে আক্ষরিক অর্থেই একটি বামপন্থী জনসমাগমের আখ্যা দেওয়া চলে।
এই জনসমাগমের নেপথ্যে রয়েছে যুব সংগঠনের ৫০ দিন ধরে চলা ‘ইনসাফ যাত্রা’। গোটা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে এই যাত্রার মাধ্যমে বামকর্মী সমর্থকদের উজ্জীবিত করা গেছে, যার প্রতিফলন ঘটেছে ব্রিগেডের জনসমাগমে। এই যাত্রা এবং ব্রিগেড সমাবেশের নেপথ্যে রয়েছে চাকরি এবং রুটি-রুজির দাবি। দেশে তথা রাজ্যে বেকার যুবক এবং চাকরি প্রার্থীদের সাথে যেই অন্যায় হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে প্রগতিশীল মানুষ মাত্রেই সোচ্চার হবে। বাম যুব সংগঠন এই দাবিকে সামনে রেখে বিগত কয়েক মাস ধরে রাজ্যে যে প্রচার চালিয়েছে তা নিশ্চিতভাবেই বাম কর্মীদের মনে সাড়া ফেলেছে।
বর্তমান দেশ তথা রাজ্যের প্রেক্ষাপটে, যেখানে শাসক দলের রাজনীতি মানে হয় ধর্মের ব্যবসা নয়ত আর্থিক দুর্নীতি, সেখানে সাধারণ বেকার যুবদের দাবি নিয়ে দেড় মাসের বেশি রাস্তায় থেকে একটি বড় সমাবেশ গড়ে তোলার জন্য বাম যুব সংগঠনের সাধুবাদ প্রাপ্য।
তবু, রাজনৈতিকভাবে কিছু প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। প্রথমত, যেহেতু এই সমাবেশ ২০২৪ সালে সংগঠিত হচ্ছে তাই আসন্ন লোকসভা নির্বাচন যে এই সমাবেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সেই কথা না বললে সত্যের অপলাপ হবে। কিন্তু বামপন্থীদের ভাবতে হবে যে এর আগেও নির্বাচনী বছরে বড় ব্রিগেড সমাবেশ হয়েছে, যেমন ২০২১ সালের নির্বাচনের আগে। কিন্তু সেই বড় ব্রিগেড সমাবেশের পরে ভোটের হিসেবে বামপন্থীদের ক্ষয় রোধ করা যায়নি। অতএব, ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে যখন আবার একটি ব্রিগেড সমাবেশ হচ্ছে তখন এই প্রশ্ন তোলা অসংগত হবে না যে সমাবেশের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বামপন্থীদের ভোট কি ভোটবাক্সে প্রতিফলিত হবে? প্রশ্নটি যে অমূলক নয়, তার প্রমাণ সেদিন ব্রিগেডের মাঠে নেতাদের বক্তব্য, যেখানে সরাসরি ব্রিগেড থেকে ‘লড়াই’কে বুথে বুথে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে যে ধর্মের লড়াই অথবা জাতের লড়াইয়ের ঊর্ধ্বে উঠে বামপন্থীরা জনগণের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের কথা বলছেন, রুটি-রুজির কথা বলছেন, যা দেশ তথা রাজ্যকে বিজেপি-তৃণমূলের অন্ধকূপ থেকে উদ্ধার করবে। তাহলে, বলা চলে যে ব্রিগেডের ভাষ্য বুথে বুথে বিজেপি তথা তৃণমূলের বিরুদ্ধে নির্বাচনী লড়াইয়ের বার্তা বহন করছে।
কিন্তু প্রশ্ন হল যে ২০২৪ সালে বামপন্থীরা কোন কর্মসূচীর ভিত্তিতে সেই লড়াই লড়বেন? শুধু রুটি-রুজির লড়াই বা সব মানুষের কাজ চাই বললেই তা জনগণের কাছে গ্রহণীয় রাজনৈতিক কর্মসূচীর রূপ পায় না। কোন বিকল্প নীতির কথা বামপন্থীরা বলছেন, যার মাধ্যমে রুটি-রুজি নিশ্চিত করা যাবে? ব্রিগেডের জনসভায় সেই বিকল্প কর্মসূচীর আভাস আমরা পেলাম না।
অন্যদিকে, আসন্ন লোকসভা নির্বাচন দেশের ইতিহাসের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন বললে অত্যুক্তি হয় না। কারণ বিগত ১০ বছরে মোদী সরকার দেশটিকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রায় সব ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছে। আরও একবার ক্ষমতায় এলে তারা দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সংবিধান পরিবর্তন করে আইনত দেশটিকে 'হিন্দু রাষ্ট্র'-এ পরিণত করার চেষ্টা করবে এই নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই পরিস্থিতিতে গোটা দেশে যে বিজেপি বিরোধী লড়াই এবং তার গুরুত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট বক্তব্য ব্রিগেড শুনতে পেল কি? শুধু বিজেপিকে দাঙ্গাবাজ এবং তৃণমূলকে চোর বললেই কি বামপন্থীদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? দেশের সামনে যে সমূহ বিপদ ধেয়ে আসছে, তার সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা এবং তাদের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করাও বামপন্থীদেরই কাজ। স্লোগানের মতন করে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ের কথা মাঠে বলা হল ঠিকই, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে বিজেপির বিপদ সম্পর্কে মানুষকে কতটা সচেতন করার চেষ্টা করা হল, সেই প্রশ্ন তোলা জরুরি।
আসলে বামপন্থীদের থেকে প্রগতিশীল মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। বিজেপি এবং তৃণমূল দুটি দলই যে নর্দমার পাঁক, তা নিয়ে গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল মানুষের মনে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বর্তমান রাজ্য রাজনীতির অঙ্কে এই শ্রেণির মানুষ যে বিপুলভাবে সংখ্যালঘু তা ভোটের ফলাফলের দিকে নজর দিলেই বোঝা যায়। অতএব, সত্যিই যদি বিজেপি তথা তৃণমূলের ক্ষমতা খর্ব করে বামপন্থীদের সমর্থন বৃদ্ধি করতে হয়, তাহলে যারা বিগত নির্বাচনগুলিতে এই দুটি দলকে ভোট দিয়েছে তাদের বুঝিয়ে বামপন্থীদের দিকে আনতে হবে। সেই আকর্ষণের প্রশ্নে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, বিজেপি তথা তৃণমূলের সরকারের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের তীব্র আন্দোলন। দ্বিতীয়ত, একটি বিকল্প কর্মসূচীর ভিত্তিতে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস। আপাতত, সমাবেশ ভালো হলেও বামপন্থীদের এই দুটি প্রশ্নে অগ্রসর হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
অনেক সময় দেশের বিরোধী পরিসরে এবং বিশেষ করে বামপন্থী পরিসরে একটি চিন্তা স্থান পায়, যে মানুষ বিজেপি তথা রাজ্যের তৃণমূলের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিরোধীদের বা রাজ্যে বামপন্থীদের বেছে নেবে। এই চিন্তা ভ্রান্ত। রাজনীতিতে স্বতঃপ্রণোদিত বলে কিছু হয় না। রাজ্যে তৃণমূলের উপর বীতশ্রদ্ধ মানুষ আপাতত বিজেপিকে ভোট দিচ্ছে এবং বিজেপি-র উপর বীতশ্রদ্ধ মানুষ তৃণমূলকে ভোট দিচ্ছে। বামপন্থীরা প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হচ্ছে। অন্তত ২০২১ সালের নির্বাচনী ফলাফল সেই বার্তাই দিচ্ছে। এই অবস্থায় বামপন্থীদের একমাত্র হাতিয়ার গণআন্দোলন গড়ে তুলে রাজনৈতিক ভারসাম্যকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসা। ব্রিগেডের জনসমাবেশ কি সেই আন্দোলনের দিকে বামপন্থীদের নিয়ে যাবে? এই প্রশ্নের উত্তর আপাতত ভবিষ্যতের গর্ভে লুকিয়ে।