আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ ● ১৬-৩০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১

প্রবন্ধ

জনসংখ্যা ও ভারতের লোকসভা আসনঃ একটি আলোচনা

শাশ্বত ঘোষ


লোকসভা ও বিধানসভার সীমানা নির্ধারণ ও তার সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির আঞ্চলিক ভারসাম্যহীনতা এখন জাতীয় সংবাদমাধ্যমে আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও এই আলোচনাটা 'উত্তর ভারত বনাম দক্ষিণ ভারতের দ্বন্দ্ব' হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে যেন ভারতের রাজনীতিতে বা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে পূর্ব বা পশ্চিমের রাজ্যগুলির কোনো ভূমিকা নেই। এই নিবন্ধে আমরা এই সীমানা নির্ধারণ, তার সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির আঞ্চলিক ভারসাম্যহীনতার কেমন সম্পর্ক, এই ভারসাম্যহীনতার ফলে ভবিষ্যতে বড় রাজ্যগুলোতে লোকসভার আসনের বিন্যাস কেমন হতে চলেছে, এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাব্য উপায়গুলি কী কী হতে পারে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে একটা সামগ্রিক আলোচনা করব। আমরা আলোচনাটি দেশের বড় রাজ্যগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখব কারণ এই লোকসভার ৯৩ শতাংশ আসনই এবং জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশ এই রাজ্যগুলির অন্তর্ভুক্ত।

সীমানা নির্ধারণ কি ও কেন?

সীমানা নির্ধারণ-এর অর্থ হল লোকসভা এবং বিধানসভার জন্য প্রতিটি রাজ্যে আসন সংখ্যা এবং আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণের প্রক্রিয়া। এর মধ্যে তফসিলি জাতি এবং তপশিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত আসন নির্ধারণ করাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সংবিধানের ৮২ এবং ১৭০ (৩) অনুচ্ছেদে বিধান আছে যে লোকসভা এবং রাজ্য বিধানসভার আসন সংখ্যার পাশাপাশি আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকায় এর বিভাজন প্রতিটি জনশুমারির পরে পুনর্বিন্যাস করা হবে। এই 'সীমানা নির্ধারণ প্রক্রিয়া' সংসদের একটি আইনের অধীনে গঠিত 'সীমানা নির্ধারণ কমিশন' দ্বারা পরিচালিত হয়। ১৯৫১, ১৯৬১ এবং ১৯৭১ সালের জনশুমারির পরে এই ধরনের অনুশীলন করা হয়েছিল।

সাংবিধানিক চাহিদাটি ঠিক কী?

আমরা জানি যে ভারতরবর্ষ একটি 'গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র'। 'গণতন্ত্র' মানে 'জনগণের দ্বারা শাসিত একটি সরকার'। এই নীতি অনুযায়ী 'এক নাগরিক-এক ভোট-এক মূল্য' এবং যার ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের ভোট দ্বারা সরকার নির্বাচিত হয়।

স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের জন্য, জনপ্রতিনিধিত্ব আইন (১৯৫০)-এর অধীনে নির্বাচনী এলাকাগুলি ভারতের নির্বাচন কমিশন দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। যেহেতু অনুশীলনটিতে প্রক্রিয়াগত ত্রুটি ছিল, নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রীয় সরকারকে ভবিষ্যতে সীমানা নির্ধারণের জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের পরামর্শ দেয়। এর পরে, 'সীমানা নির্ধারণ কমিশন আইন' ১৯৫২ সালে প্রণীত হয়।

প্রথম সীমানা নির্ধারণ কমিশন ১৯৫১ সালের জনশুমারির পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে নির্বাচনী সীমানা পুনর্নির্মাণ করে। দ্বিতীয় সীমানা নির্ধারণ কমিশন ১৯৬২ সালে গঠিত হয়েছিল, এবং এটি ১৯৬১ সালের জনশুমারির ভিত্তিতে নির্বাচনী সীমানা পুনর্বিন্যাস এবং আসন পুনর্বন্টন করে। তৃতীয় সীমানা নির্ধারণ কমিশন ১৯৭২ সালে গঠিত হয়েছিল, যেটি ১৯৭১ সালের জনশুমারির ভিত্তিতে সীমানা পুনর্বিন্যাস এবং আসন পুনর্বন্টন করে। এইভাবে, সংবিধান মোতাবেক প্রতি ১০ বছর অন্তর প্রথম তিন দফা সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭২ সালের পর এই 'সীমানা নির্ধারণ কমিশন' আর তৈরী হল না কেন? এর কারণ একদিকে যেমন জনসংখ্যার গতিপ্রকৃতিতে আঞ্চলিক তারতম্য অন্যদিকে এটা খেয়াল রাখা যে উচ্চ জনসংখ্যা বৃদ্ধির রাজ্যগুলির প্রতিনিধিত্ব সংসদে যেন বেড়ে না যায়। অন্যভাবে বলতে গেলে, ১৯৭২-পরবর্তী সময়ে 'সীমানা নির্ধারণ কমিশন' আর গঠন করা হয়নি, যাতে দেশের সব রাজ্যগুলিতে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং সংসদীয় প্রতিনিধিত্বে দেশের অঞ্চলগুলির একটা সাযুজ্য থাকে। তাই ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণ কমিশন গঠন ২০০০ সাল পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়েছিল এবং ৮৪তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে এটি ২০২৬ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছিল। তাই যদিও ২০০১ সালের জনশুমারীর ভিত্তিতে সংসদীয় আসন সংখ্যা পরিবর্তন না করে আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছিল তপশীলি জাতি ও তপশীলি উপজাতিদের জন্য, কিন্তু সংসদীয় আসন সংখ্যার পুনর্বিন্যাস করা হবে ২০২৬-পরবর্তী নির্বাচনে। নিয়মমাফিক এই পুনর্বিন্যাস হওয়া উচিত ছিল ২০৩১ জানশুমারীর ভিত্তিতে। কিন্তু যেহেতু ২০২১ সালের জনশুমারী হয়নি এবং একাধিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী এই জনশুমারী ২০২৬ সালে হবে, তাই আসন পুনর্বিন্যাসও এই জনশুমারীর পরিপ্রেক্ষিতেই হবে।

জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের গতিপ্রকৃতি

সারণী ১-এ জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ১৯৪১ সাল থেকে প্রতি দশকে ২০৩১ সাল (অভিক্ষিপ্ত) পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। সারণী ১-এর দিকে ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সামগ্রিকভাবে ১৯৬১-১৯৮১ পর্যন্ত জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি ছিল। তারপর ১৯৯১-২০০১ দশক থেকে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার হ্রাস পেতে শুরু করে এবং এই বৃদ্ধির হারের হ্রাস পাওয়া গতি পায় ২০০১-পরবর্তী সময়ে। কেন্দ্রীয় সরকারের অভিক্ষেপ রিপোর্ট অনুযায়ী পরবর্তী দশকগুলিতে এই হ্রাস পাওয়ার গতি আরও তীব্রতর হয়েছে। এই সারণী অনুযায়ী, রাজ্যগুলির মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন, দক্ষিণের রাজ্যগুলির মধ্যে কেরালা ও তামিলনাড়ুতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস হবার প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল ১৯৭১-পরবর্তী সময়ে, সেখানে কর্নাটকে ১৯৮১-পরবর্তী সময়ে এবং অন্ধ্রপ্রদেশে ১৯৯১-পরবর্তী সময়ে। অর্থাৎ, দক্ষিণের রাজ্যগুলির মধ্যেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হ্রাসের হারের মধ্যে তারতম্য আছে। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশা, অসম ও মহারাষ্ট্রে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হ্রাস পাওয়া শুরু করে ১৯৯১-পরবর্তী সময়ে আর পাঞ্জাবে ১৯৮১-পরবর্তী সময়ে। অন্যদিকে, হিন্দিবলয়ের রাজ্যগুলি যেমন উত্তরপ্রদেশ (উত্তরাখন্ড সহ), বিহার (ঝাড়খন্ড সহ), মধ্যপ্রদেশ (ছত্তিসগড় সহ), হরিয়ানা এবং রাজস্থানে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার কমতে থাকে ২০০১-পরবর্তী সময়ে। পশ্চিম ভারতের গুজরাতেও জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার একমুখীভাবে কমতে থাকে ২০০১-পরবর্তী সময়ে। এইভাবে বিভিন্ন সময়ে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার একমুখীভাবে কমতে থাকার রাজ্যওয়ারী তারতম্যের কারণেই উত্তর ভারতের মোট জনসংখ্যা এবং ভারতের জনসংখ্যায় তাদের অনুপাত দক্ষিণ, পূর্ব বা খানিকটা পশ্চিম ভারতের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে। ২০২১-২০৩১ সাল পর্যন্ত অভিক্ষেপ অনুযায়ী দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার কমে গড়ে দশকে ৩-৪ শতাংশ হয়ে যাবে, সেখানে উত্তরের রাজ্যগুলিতে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার দশকে ১১-১২ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করবে। যেমন, ২০৩১ সালের অভিক্ষিপ্ত জনসংখ্যা অনুসারে, বিহার ও উত্তরপ্রদেশের মোট জনসংখ্যা হবে আনুমানিক ৩৫.৪ কোটি, আর সেখানে দক্ষিণের সব রাজ্যগুলির সম্মিলিত জনসংখ্যা হবে আনুমানিক ২৬.৯ কোটি। অর্থাৎ, জনসংখ্যার আঞ্চলিক ভারসাম্যহীনতা আগামী কয়েক দশক জারি থাকবে।

এখানে উল্লেখ্য যে ভারতীয় পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি, ১৯৫২ সালে যদিও শুরু হয়েছিল উন্নয়নমূলক ও নারীকল্যাণের লক্ষ্যকে সামনে রেখে, বিভিন্ন সময় এই কর্মসূচির অভিমুখ পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন জরুরি অবস্থার সময় দ্রুত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে বলপূর্বক পুরুষদের নির্বীজ করানো, ১৯৯৪ সালে আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করে অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা সামনে রাখা ইত্যাদি। ১৯৯৮-পরবর্তী সময়ে নারী ও শিশু স্বাস্থ্য এবং মাতৃকালীন ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসের লক্ষ্য নিয়ে এগোনোটা - অর্থাৎ 'পরিবার পরিকল্পনা' নীতি থেকে 'পরিবার কল্যাণ'-এর নীতিতে বদল আনাটা ভারতের পক্ষে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে লাভদায়ক বলে পরিগণিত হয়েছে। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, উত্তর ভারতে যেখানে জরুরি অবস্থার সময় বলপূর্বক পুরুষদের নির্বীজ করানোর প্রচেষ্টা হয়েছিল, সেখানেই ২০০১ পর্যন্ত কার্যত জনবিস্ফোরণ হয়েছে।

বিভিন্ন বড় রাজ্যে লোকসভাতে প্রতি আসন অনুযায়ী জনসংখ্যার অনুপাত তৃতীয় সীমানা নির্ধারণ কমিশন অনুযায়ী কী ছিল ও বর্তমানে কত?

সারণী ২-তে তৃতীয় সীমানা নির্ধারণ কমিশন দ্বারা প্রতি আসন অনুযায়ী জনসংখ্যার অনুপাত দেওয়া আছে। ভারতের গড় তখন ছিল ১০.০৯ লক্ষ প্রতি একজন লোকসভার প্রতিনিধি। এই অনুপাত সর্বনিম্ন ছিল হরিয়ানাতে - ১০.০৩ প্রতি একজন প্রতিনিধি আর সর্বোচ্চ ছিল কেরালাতে ১০.৬৭ লক্ষ প্রতি একজন। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তখন তামিলনাডু বা পশ্চিমবঙ্গের আসনপিছু জনসংখ্যা বিহার বা উত্তরপ্রদেশের চেয়ে বেশি ছিল। সারণী ৩-এ ২০১১ সালের জনশুমারীর নিরিখে এবং ২০২৬ সালের অভিক্ষেপ রিপোর্ট অনুসারে লোকসভার আসনপিছু জনসংখ্যা দেওয়া হয়েছে। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যেটা সারণী ২-এর বিপরীতধর্মী। উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে, যেমন বিহার, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লি-সংলগ্ন রাজধানী অঞ্চল এবং রাজস্থানে আসনপিছু জনসংখ্যা জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেকখানি বেশি। অন্যদিকে, কেরালা, তামিলনাডু, হিমাচল প্রদেশ বা ওডিশাতে এই গড় জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেকটাই কম। একইসঙ্গে, দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের রাজ্যগুলির নগরায়নের হার উত্তরের রাজ্যগুলির চেয়ে অনেক বেশি।

দীর্ঘ সময়ের জন্য লোকসভা আসনের সীমানা নির্ধারণ স্থগিত করার ফলে দুটি নেতিবাচক পরিণতি হয়েছে। প্রথমত, এটি রাজ্যগুলির মধ্যে, একটি নিৰ্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকার মধ্যে একটি বিশাল জনসংখ্যার বৈষম্য তৈরি করেছে এবং গ্রামীণ নির্বাচনী এলাকাগুলির তুলনায় শহুরে নির্বাচনী এলাকাগুলি অনেক বড় হয়েছে, বিশেষত দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে। দ্বিতীয়ত, উত্তরের রাজ্যগুলি দক্ষিণের রাজ্যগুলির তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি হওয়ার কারণে জনসংখ্যার আঞ্চলিক ভারসাম্যহীনতা ক্রমাগত বেড়েছে ও আগামী আরও কয়েক দশক সেটা বজায় থাকবে। যেসব রাজ্যে জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে, সেখানে রাজ্য সরকারগুলির পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়নে একটা ভূমিকা থাকলেও সেটাই সব নয়। এক্ষেত্রে, নারী শিক্ষার প্রসার, গণমাধ্যমের প্রভাব, পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নতি, নারীদের বাড়ির বাইরে কাজে যোগদান এবং তাদের ক্ষমতায়ন এর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এগুলো আরও তরান্বিত হয়েছে শিশুমৃত্যু, মাতৃকালীন মৃত্যুর হার কমে যাওয়া ও একই সঙ্গে গর্ভনিরোধক পদ্ধতির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে। অন্যদিকে, কৃষিভিত্তিক সমাজ-অর্থনীতি, পুত্রসন্তানের বেশি চাহিদা, নারীশিক্ষা ও বাড়ির বাইরে তাদের কাজে যোগ দেবার সামাজিক পরিসর না থাকা, পরিবারে ও সামাজিক ক্ষেত্রে মহিলাদের ক্ষমতায়নের অপ্রতুলতা, শিশু ও মাতৃকালীন মৃত্যুর হার অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় বেশি থাকা ইত্যাদি উত্তরের রাজ্যগুলির জনসংখ্যা বৃদ্ধির মূল কারণ।

যদি লোকসভাতে আসন সংখ্যা এক রেখে সীমানা নির্ধারণ করা হয় বা প্রস্তাবমতো বাড়িয়ে ৮৪৮ করা হয় তাহলে কোন রাজ্যের লাভ আর কোন রাজ্যের ক্ষতি?

সারণী ৩-এ দেশের বড় রাজ্যগুলির এই লাভ-ক্ষতির হিসাবটা দেওয়া আছে। আসন সংখ্যা যদি ৫৪৩ থাকতে পারে বা প্রস্তাবমতো ৮৪৮ করা হতে পারে (১৬.৭৯ লক্ষ প্রতি আসন)। ৫৪৩টি আসনই যদি থাকে তাহলে পঞ্চম কলাম অনুযায়ী লোকসভায় সবচেয়ে বেশি আসন হারাবে তামিলনাডু (৯টা)। দক্ষিণের সব রাজ্যগুলি সম্মিলিতভাবে ২৪টি আসন হারাবে। এছাড়া, পূর্বের রাজ্যের মধ্যে ওডিশা ও পশ্চিমবঙ্গ ৪টি করে আসন হারাবে। এছাড়াও পাঞ্জাব ও হিমাচল প্রদেশ ও ১টি করে আসন হারাবে। অন্যদিকে, উত্তরপ্রদেশ লাভ করবে ১৩টি আসন এবং বিহার লাভ করবে ১০টি আসন। সামগ্রিকভাবে উত্তর ভারতের রাজ্যগুলি সামগ্রিকভাবে ৪২টি আসন লাভ করবে। অন্যদিকে, সপ্তম কলাম অনুযায়ী, যদি সমগ্র আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ৮৪৮ করা হয়, তাহলেও উত্তর ভারতের রাজ্যগুলির লাভ - তারা মোট ১৭১টি আসন বেশি পাবে, আর সেখানে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি আসন সংখ্যা বাড়বে মাত্র ৩৫টি আসন। এছাড়া, গুজরাট ও পশ্চিমবঙ্গের বাড়বে ১৮টি করে আর মহারাষ্ট্রের বাড়বে ২৯টি আসন। সুতরাং, কেবলমাত্র জনসংখ্যার উপর ভিত্তি করে আসন বাড়ালে বা পুনর্বণ্টন হলে, উভয়ক্ষেত্রেই উত্তর ভারতের প্রতিনিধিত্ব লোকসভায় বাড়বে আর দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের প্রতিনিধিত্ব কমবে। পশ্চিম ভারতের প্রতিনিধিত্ব বাড়লেও সেটা হিন্দিবলয়ের রাজ্যগুলির তুলনায় নগন্য।

কীভাবে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে?

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে এই সমস্যা সমাধানের বিষয়ে যথেষ্ট মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এই মতামতগুলো সম্পূর্ণরূপে বিপরীতধর্মী। একপক্ষ মনে করেন যে রাজ্যগুলির জনসংখ্যা অনুযায়ীই কেবলমাত্র আসন সংখ্যা নির্ধারণ করা উচিত এবং তাহলেই সংবিধানকে মান্যতা দিয়ে 'একটি ভোট-একটি মূল্য'-কে প্রাধান্য দেওয়া হবে। অন্যপক্ষ মনে করেন যে রাজ্যগুলির মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমবেশি এক না হওয়া পর্যন্ত স্থিতাবস্থা বজায় রাখা। এর পিছনে যুক্তি হল যে সমান জনসংখ্যার নীতি ছোট রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিতে প্রযোজ্য নয় - অনেকক্ষেত্রেই তাদের প্রতিনিধিত্ব বেশি। তাই সেখানে যদি 'একটি ভোট-একটি মূল্য'-কে প্রাধান্য না দেওয়া হয় তাহলে বড় রাজ্যগুলিতে সেই প্রাধান্য দিতেই বা হবে কেন?

এই দুই চরমপন্থার মধ্যে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে অক্ষুন্ন রেখে একটি মধ্যবর্তী পন্থা অবলম্বন করতে হবে, যাতে লোকসভায় আসন বন্টনের ক্ষেত্রে সব বড় রাজ্যগুলির ধ্বনি প্রতিফলিত হয়। সমস্যাটি জটিল তাই তার সমাধান অনেক ভেবেচিন্তে করতে হবে।

সারণী ১: সারা ভারতে ও ভারতের বড় রাজ্যগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার

States 1941-51 1951-61 1961-71 1971-81 1981-91 1991-2001 2001-11 2011-2021 2021-2031
Andhra Pradesh (including Telengana) 14.0 15.7 20.9 23.1 24.2 14.6 11.0 7.0 3.2
Assam 19.9 35.0 35.0 23.4 24.2 18.9 17.1 12.3 9.0
Bihar 10.6 19.8 20.9 24.2 23.4 28.6 25.4 18.2 14.6
Chhattisgarh 9.4 22.8 27.1 20.4 25.7 18.3 22.6 15.5 10.9
Gujarat 18.7 26.9 29.4 27.7 21.2 22.6 19.3 15.5 11.7
Haryana 7.6 33.8 32.2 28.8 27.4 28.4 19.9 16.3 11.8
Karnataka 19.4 21.6 24.2 26.8 21.1 17.5 15.6 9.4 5.7
Jharkhand 9.4 19.7 22.6 23.8 24.0 23.4 22.4 16.6 12.3
Kerala 22.8 24.8 26.3 19.2 14.3 9.4 4.9 6.2 3.4
Madhya Pradesh 8.4 24.7 29.3 27.2 27.2 24.3 20.4 16.4 11.3
Maharashtra 19.3 23.6 27.5 24.5 25.7 22.7 16.0 10.7 7.2
Odisha 6.4 19.8 25.1 20.2 20.1 16.3 14.1 4.9 2.2
Punjab -4.6 21.6 21.7 23.9 20.8 20.1 13.9 9.4 7.6
Rajasthan 15.2 26.2 27.8 33.0 28.4 28.4 21.3 15.7 10.0
Tamil Nadu 14.7 11.9 22.3 17.5 15.4 11.7 15.6 5.9 2.2
Uttar Pradesh 11.8 16.4 19.5 25.4 25.6 25.9 20.2 15.6 9.1
West Bengal 13.2 32.8 26.9 23.2 24.7 17.8 13.8 7.5 4.1
India 13.3 21.5 24.8 24.7 23.9 21.5 17.7 12.4 8.4

বিঃ দ্রঃ ২০১১-২০২১ এবং ২০২১-২০৩১ সালের বৃদ্ধির হার আনুমানিক।

সারণী ২: ১৯৭১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী এবং তৃতীয় সীমানা নির্ধারণ কমিশনের হিসেবে প্রতি লোকসভা আসনে গড় জনসংখ্যা

States Population in 1971 census (in lakh) Number of seats allocated Ratio of population per seat in 1971 census
Andhra Pradesh 4,35,02,708 42 10,35,779
Assam 1,46,25,152 14 10,44,654
Bihar 5,63,53,369 54 10,43,581
Gujarat 2,66,97,475 26 10,26,826
Haryana 1,00,36,431 10 10,03,643
Karnataka 2,92,99,014 28 10,46,393
Kerala 2,13,47,375 20 10,67,369
Madhya Pradesh 4,16,54,119 40 10,41,353
Maharashtra 5,04,12,235 48 10,50,255
Odisha 2,19,44,615 21 10,44,982
Punjab 1,35,51,060 13 10,42,389
Rajasthan 2,57,65,806 25 10,30,632
Tamil Nadu 4,11,99,168 39 10,56,389
Uttar Pradesh 8,83,41,521 85 10,39,312
West Bengal 4,43,12,011 42 10,55,048
India 54,81,59,652 543 10,09,502

সারণী ৩: বড়ো রাজ্যগুলির লোকসভা আসনের সম্ভাব্য সংখ্যা ২০২৬-এর জনসংখ্যার অভিক্ষেপের নিরিখে

States Present number of Lok Sabha seats Total projected population in 2026 Proportional seats Gain/Loss If total number of seats increased to 848 Gain/Loss
Andhra Pradesh* 25 53709000 20 -5 32 7
Assam 14 36717000 14 0 22 8
Bihar 40 132265000 50 10 79 39
Chhattisgarh 11 31211000 12 1 19 8
Gujarat 26 31211000 28 2 44 18
Haryana 10 31299000 12 2 19 9
Himachal Pradesh 4 7579000 3 -1 5 1
Jharkhand 14 40958000 16 2 24 10
Karnataka 28 68962000 26 -2 41 13
Kerala 20 36207000 14 -6 22 2
Madhya Pradesh 29 89673000 34 5 53 24
Maharashtra 48 129308000 49 1 77 29
NCT of Delhi 7 22540000 9 2 13 6
Odisha 21 44677000 17 -4 27 6
Punjab 13 31318000 12 -1 19 6
Rajasthan 25 83642000 32 7 50 25
Tamil Nadu 39 77546000 30 -9 46 7
Telangana* 17 38636000 15 -2 23 6
Uttar Pradesh 80 242859000 93 13 145 65
Uttarakhand 5 11993000 5 0 7 2
West Bengal 42 100522000 38 -4 60 18
India 543 1423435000 NA NA 848 NA