আরেক রকম ● নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২১ ● ১৬-৩০ পৌষ, ১৪২৭
পুনঃপাঠ
লালন-সন্ধান
সুধীর চক্রবর্তী
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির মতিগতি বোঝা কঠিন। তার চরিত্রগঠনের দেশজ উপাদানের সঙ্গে বহুকাল ধরে মিলেমিশে আছে ঔপনিবেশিক সাহেবি কেতাকানুন ও আধিপত্যবোধের দম্ভ। তার ফলে নিজের দেশ ও গ্রামিক পরিসরে স্বতোৎসারিত যেসব লোকজ শিল্প সংস্কৃতি নানা দিকে মাটির গভীরে রয়ে গেছে, সেসব ভাবময় উদ্ভাস আমরা যথাযথ মরমি দৃষ্টিকোণ থেকে আবিষ্কার করতে পারি না বরং নানারকম উদ্ভট কাণ্ডকারখানা করে বসি। আঠারো-উনিশ শতকের অসামান্য মানবিক চেতনা সম্পন্ন এক গৌণধর্মী সাধক ও গীতিকার লালন ফকির সম্পর্কে আমাদের খোঁজপাতি বা গবেষণার তাই তেমন কোনো যুক্তিবাদী ঝোঁক নেই। শহুরে উচ্চশিক্ষিত মন ও মনন সে ব্যাপারে প্রকৃত দিশা দেখাতে পারে কিনা সন্দেহ। তার চেয়ে অনেক সহজ লালনের জীবনকাহিনি নিয়ে অলস ও মধুর কল্পনাবয়ন কিংবা যে ব্যাপারে তাঁর কিছুমাত্র উৎসাহ ছিল না সেই তাঁর ধর্মগত পরিচয় সম্পর্কে ভ্রমপ্রতিষ্ঠার সচেতন প্রয়াস। ১৮৯০ সালে তিনি প্রয়াত হয়েছেন, অথচ লালনের গানের টেক্সট এখনও সঠিক পরিপ্রেক্ষিতে এবং তাঁর নিজস্ব ধর্মনির্লিপ্ত অবস্থান থেকে বিচার করে দেখিনি আমরা। তার অনেক আগেই ছেঁউরিয়ার দীনাতিদীন মোমিন কারিগরদের পাড়ায় তাঁর ভূতলশায়ী শরীর-সমাধিকে বহু অর্থব্যয়ে ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দিল্লির শ্বেতশুভ্র মক্বরার আদলে সৌধরূপ দিয়ে, মাজার বানিয়ে, ট্যুরিস্টদের টানার চেষ্টার তৎপরতায় আমরা সক্রিয়। দুই বাংলায় বেরিয়েছে লালনস্ট্যাম্প, তাঁর নামে বাংলাদেশে একটা সেতু উৎসর্গ করা হয়েছে। সেখানকার এক মোবাইল ফোন কোম্পানির লোগোতে মুদ্রিত হয়েছে লালন প্রতিকৃতি।
সব প্রয়াস অবশ্য এমন পরিণামরমণীয় নয়। কেননা সচরাচর যেসব খবর সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয় না তেমন ঘটনাও ঘটে। যেমন বাংলাদেশের গ্রামে-গ্রামান্তরে মৌলবাদীরা লালনপন্থী নিরীহ ফকিরদের দাড়িগোঁফঝুঁটি ছেঁটে, একতারা ও আখড়া ভেঙে তাঁদের ‘তৌবা’ করাতে বাধ্য করে। আরো জমাটি খবর আছে। ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে যখন লালন ফকিরের আদলে গড়া একটা বাউল মূর্তি ইসলামি মৌলবাদীরা শক্তি প্রদর্শন করে উপড়ে ফেলল, তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রশক্তি পরাজয় মেনে নিল এবং মূর্তিটা পুনঃস্থাপনের আর সাহস দেখায়নি’ - জানাচ্ছেন তানভীর মোকাম্মেল। এসব নানা বিচিত্র কীর্তিকলাপের পাশ কাটিয়ে গত কয়েক দশক ধরে দিব্যি বার হয়ে চলেছে নানা লালনের এক-একখানি মালা এবং তাঁর রহস্যময় আবৃত জীবনকথা নিয়ে ডকুমেন্টারি ও ফিচার ফিল্ম, যাতে কল্পনার অত্যন্ত রঞ্জনে গড়া লালনের মোহনরূপের প্রেমে আমরা মত্ত হয়ে পড়েছি। যদিও বাস্তবের বখেরা মেটাবারও নানা উপকরণ লালন তাঁর অজান্তে রেখে গেছেন। ফলে তাঁর অলীক জীবনকথা নিয়ে জাল পুঁথি প্রচার করা হয়েছে। অনেক অনির্ভরযোগ্য লালনগীতের সংকলন বাজারে কাটছে। তাঁর নাটকীয় জীবনকাহিনির রগরগে টানাপোড়েনে বোনা বাজারি সম্ভাবনাপূর্ণ পুতুলনাচের দল গড়া হয়েছে। নিজের জন্ম ও জাতিপরিচয় জ্ঞাপনে একেবারেই অনুৎসাহী লালনকে কেউ বলেছেন তিনি হিন্দু থেকে মুসলমান, অন্য দল বলছেন তিনি মূলে মুসলমান। দু-দলের দাখিল করা তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে লালনের দু-দুটো পিতৃপরিচয় রয়েছে। অথচ একটি মুদ্রিত দলিলে দেখি তিনি জানাচ্ছেন গুরু সিরাজ সাঁই তাঁর পিতা। লালনের এই দ্বিধাহীন কবুলতি থেকে বোঝা যাচ্ছে তাঁর দ্বিতীয় জন্ম অর্থাৎ ফকিরালি পরিচয়ই মুখ্য, যে অর্থে সিরাজ তাঁর দীক্ষা ও শিক্ষাগুরু তথা পিতৃপ্রতিম। যদিও সিরাজের কোনো হালহদিশ কেউ বলতে পারেননি। তাঁর লেখা কোনো গান পাওয়া যায়নি। তিনি বেঁচে আছেন লালনের গানের ভণিতায় শুধু। এর মধ্যে কোনো চেষ্টিত আবরণ টানা বা ‘বাতুন’ তথা গোপনতার খেলা নেই তো, যা স্রষ্টা লালনেরই আরেক রহস্য বা ভেদ? কেউ এমন সন্দেহ করেছেন যে লালনপূর্ব বাঙালি সমাজে (অবশ্যই বুঝতে হবে গ্রাম সমাজে) লালন নামটাই চালু ছিল না। এ নাম কি তবে তাঁর নিজেরই প্রণয়ন?
এতসব ভজকট ব্যাপারের প্রসঙ্গ উঠে এল সম্প্রতি কলকাতার অ্যাকাডেমি মঞ্চে ২৬ মার্চ ও ৫ এপ্রিল উপস্থাপিত একটি ইংরিজি ভাষার নাটক দেখে, যা অনেকটা দ্বিভাষিকও বটে, কেননা নাটক ও কথনের ফাঁকে আছে তিরিশটার মতো বাংলা গান, যার প্রধান অংশ লালন গীতি। কলকাতার মঞ্চে Man of the Heart নামের এই মঞ্চ-প্রযোজনা আগেও হয়েছে, বিদেশী মঞ্চেও হয়েছে কয়েকবার। কয়েক বছর ধরে মঞ্চস্থ হতে হতে এর আকার আকৃতি আর অভিমুখ পালটে পালটে গেছে। তবে সম্প্রতি উপস্থাপিত প্রযোজনাটির উপ-শিরোনাম হল ‘‘The Life and Times of Lalon Phakir’’ এবং এটি হল India 2013 Version অর্থাৎ সর্বাধুনিক ভাষ্যরূপ। ভবিষ্যতে এর মঞ্চরূপ পরিবর্ধিত বা পরিবর্তিত হতে পারে। ম্যান অফ দ্য হার্ট-এর পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়। একক অভিনয় গান ও কথন সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁর সঙ্গে চারজন দোহারকি ও বাদক মিলে খুবই আকর্ষণীয় আর চমকপ্রদ প্রযোজনাটি হাজির করেছেন ‘তৃতীয় সূত্র’। ৫ এপ্রিল তারিখের পুরো প্রেক্ষাগৃহে ছিল দর্শকসমাকুল। অভিনয় শেষে বিনত কুশীলবদের সংবর্ধনা সূচক অকুন্ঠ ও বিপুল করতালিধ্বনি জানান দিচ্ছিল যে, আয়োজনটি খুবই চিত্তাকর্ষক তথা সফল। নিঃসন্দেহে বলা যায়, এ রকম দীর্ঘ প্রস্তুতিসম্পন্ন এত উন্নত মানের উপস্থাপন যেমন অভিনব তেমনই শিক্ষণীয়।
শিক্ষণীয় কথাটা উঠল এই জন্য যে সমগ্র রূপায়ণের মধ্য দিয়ে খুব আন্তরিকভাবে ফুটে উঠেছে লালন ফকিরের জীবনকথা আর তাঁর দেশকাল। সানুপুঙ্খ গবেষণার সচেষ্ট উদ্যমে এই শিল্পরূপটি বেশ বিমিশ্র অথচ অখণ্ড চেহারা নিয়েছে। সুমন ও সুদীপ্ত একটা বড়ো সুযোগ পেয়ে গেছেন, কেননা তাঁদের যৌথ প্রয়াসের আগে দুই বাংলার মঞ্চে ও পর্দায় লালনকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা হয়েছে। তা ছাড়া লেখা হয়েছে উপন্যাস আর অন্তত গোটা দশ গবেষণা-সন্দর্ভ ও লালনজীবনী। লালনজীবনের অনুদ্ঘাটিত অধ্যায় নিয়ে গড়ে উঠেছে নানা ইতিকথা বা থিম, যা রুপালি পর্দায় বেশির ভাগ পাতি দর্শকদের টানার পক্ষে ভারি জমজমাট। সত্যি বলতে কী, ‘মনের মানুষ’ শব্দবন্ধটিও কত মোহময় ও মনোরম। গগন হরকরার উচ্চারিত এই মনের মানুষকে সন্ধানের আর্তিটুকুও তার সুরসমেত এতটাই রঞ্জকধর্মী যে কবিগুরু থেকে সবস্তরের বাঙালি বহুদিন তাতে মজে আছ[ন। যদিও গুরুদেব থেকে সকল মনের মানুষপ্রেমী এটা খেয়াল করেননি যে, মূলভাবনা ও ফকিরি তত্ত্ববিশ্বে ‘মনের মানুষ’ বলতে একটা যৌনযৌগিক সাধনগত তাৎপর্য আছে, যা পাবিলিকের বোধের বাইরে। অথচ সাধকের পক্ষে গোপ্য সংকেতে আচরণীয়।
এখানে প্রকাশ থাক যে সুমন আর সুদীপ্ত সমবয়সী বন্ধু এবং নাটকপাগল। তাঁদের দুজনের লালন-অনুসন্ধানের সূচনা ঘটে ১৯৯৬-৯৭ নাগাদ, দুরূহের দারুণ আকর্ষণে। তাঁদের সেই যুগলবন্দী সন্ধানপর্বে আমার লেখা ‘ব্রাত্য লোকায়ত লালন’ বইটা কিছুটা অনুঘটকের কাজ করেছে, কারণ নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক বিভাগে পঠনরত সুদীপ্তকে ভারত থেকে গিয়ে সুমন বইটি উপহার দেন। বইটি আদ্যন্ত পড়ে তাঁদের যুগলবন্দী নাট্যচেতনায় স্পন্দন জাগে এবং তাঁরা সংকল্প করেন একটি অভিনব মঞ্চায়নের। ১৯৯৭ সালে সুদীপ্ত চলে যান আমেরিকা থেকে বাংলাদেশের খোদ লালনভূমি ছেঁউরিয়া। সরেজমিনে দেখে নেন লোকায়ত সংস্কৃতির অবতলের পরিসরে কীভাবে ভদ্রলোকদের লালন-মাজার ঘিরে কর্তৃত্বকামিতা গড়ে উঠছে, জেগে উঠছে রাজনৈতিক আবর্ত তথা ধর্ম-ব্যবসায়ীদের দেখনদারি। অথচ লালনের জীবনদর্শন ছিল নিভৃতচারী আর তাঁর আচরিত মগ্ন উপাসনায় ছিল শাসিত ও সংযত আবৃত মুখমায়া। গানে গানে গাঁথা তাঁর আলেখের প্রতি আর্ত অনুসন্ধানের বৃত্তে কোনো দুনিয়াদারির কাঙ্ক্ষা ছিল না। নির্দ্বন্দ্ব নিস্পৃহ তাঁর সত্তা শব্দের চেয়ে নিঃশব্দের ক্রোড়ে অবলীন হতে চেয়েছিল। অথচ তাঁর ভাগ্য ও ভবিতব্যের খেলা এমনই কাকতালীয় যে ছেঁউরিয়া অঞ্চলটি ছিল কলকাতার ঠাকুরপরিবারের জমিদারির অন্তর্গত, ফলে তাঁর জীবনকালেই ঠাকুরদের সঙ্গে লালনের দেখাসাক্ষাৎ হয়। তাঁর মৃত্যুপরবর্তী কালে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সংগ্রহ করেন তাঁর গানের খাতা এবং সোচ্ছ্বাস আবিষ্কারের আনন্দে লালনগীতির বেশ কটি নমুনা প্রকাশ করেন তখনকার কলকাতার এলিটিস্টদের পত্রিকায়, বিশেষ এক ভাষণের সূত্রে টেনে আনেন লালনের গানের অন্তর্গত অতীন্দ্রিয়তার বার্তা। এমনকী ‘বীণাবাদিনী’ পত্রিকায় ইন্দিরা দেবীচৌধুরাণী মুদ্রিত করেন লালনের গানের স্বরলিপি। আমাদের গ্রামজীবিত কোনো লোকায়ত গীতিকারের গান এমন শুশ্রূষা ও প্রচার পায়নি। আশ্চর্য যে তাঁর মুখের চেহারা ও অবয়বের সঠিক কাঠামো আর বেশবাসের সবচেয়ে প্রামাণিক ও বাস্তব একমাত্র পোট্রেটখানিও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্কেচবুক থেকে পাওয়া গেছে। লালন ফকিরের অস্তিত্ব আরেকবার নড়েচড়ে ওঠে যখন তাঁর প্রয়াণের ৫৭ বছর পরে ১৯৪৭ সালে ছেঁউরিয়ার পর্ণকুটির দেশভাগের কল্যাণে পড়ে পাকিস্তান অংশে। এবারে শুরু হয় তাঁর সম্পর্কে নানা অপপ্রচারের কথাকল্প আর তাঁর ধর্মগত পরিচয় উদ্ঘাটনের দ্রুত সাধিত বহুতর কৌশল। ক্রমে ক্রমে গ্রামপ্রান্তে স্বনির্বাসী লালন মানুষটাকে আমরা টেনে এনেছি শহুরেপনার মোচ্ছবে আর খুব কুটবুদ্ধির প্যাঁচে তাঁকে বানিয়ে তুলেছি এক মহান ও অনন্য Icon।
সুদীপ্ত আর সুমনের সামনে ছিল বহুধরনের জালজঞ্জাল ও ধূসর প্রান্তর। ছিল এক অনতিক্রমণীয় নাটুকে গল্পের মোহ, যাতে ঝাঁপ দিয়ে লালনের চরিত্রকে অনেক লোভনীয় পরিবেশে টেনে তাঁকে নারীসংসর্গে লগ্ন করে রুপোলি পর্দার মায়াবী বাণিজ্যে মুখ পুড়িয়েছেন একাধিক পরিচালক। লালন চরিত্রকে সর্বজনগ্রহণীয় তথা জনাদৃত করবার জন্য রজতপটের বহুবল্লভ এক অভিনেতাকে ব্যবহার করে তাঁকে দিয়ে নাচনকোঁদনও করানো হয়েছে। মনের মানুষ তত্ত্ব তাতে কায়েম করা যায়নি। লালনের সাধক সত্তার প্রতিষ্ঠা না করে তাঁকে নায়কোচিত অভিনেতারূপে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে।
১৯৯৭ থেকে লালনসরণিতে সুদীপ্ত বারেবারে পা রেখে এগিয়েছেন লক্ষ্যের অভিমুখে। প্রাসঙ্গিক পুঁথিপুস্তক পাঠ, নানা প্রাস্তব্য সাবুদ ঘাঁটা এবং লালনপন্থী বৃদ্ধ সাধক বাদের শাহ-র বাচনিক অবলোকন ফিল্মে ধরে রাখা ছাড়াও ছেঁউরিয়ায় অনুষ্ঠিত বাৎসরিক লালনমেলার সমবেত ফকিরদের সমাবেশদৃশ্য ক্যামেরায় তুলে রাখেন। ছেঁউরিয়া ১৯৯৭-তে যেমন ছিল এখন তো সেরকম নেই। মানুষের পালটানো মতিগতি, প্রাতিষ্ঠানিক সাজানো গানবাজনার কসরত, আখড়া থেকে ফকিরদের ক্রমাপসরণ সবই তাঁর দেখা। কাজেই সিদ্ধান্ত করতে বাধা নেই যে সুদীপ্ত যথেষ্ট সতর্ক ভাবে সব কিছু জেনে বুঝে দেখে ম্যান অফ দ্য হার্ট নির্মাণে ব্রতী হয়েছেন, তাঁর প্রস্তুতিপর্ব খুব দীর্ঘ এবং পদে পদে জিজ্ঞাসাবহুল।
আমার মতো লালনসন্ধানী আলাদাভাবে এই প্রযোজনাকে মর্যাদা দেবে এইজন্য যে নাটকটি যাঁরা দেখবেন বা দেখলেন তাঁদের কাছে লালন ফকির ও তাঁর দেশকাল পরতে পরতে খুলে উপস্থিত করেছেন পরিচালক ও একক অভিনেতা। সেই কাজে এটাও তাঁরা দ্যোতনা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে লালন সম্পর্কে শিক্ষিত ভদ্রসমাজ আগে কতটাই প্রতিকূল ধারণা পোষণ করতেন অথচ হঠাৎ মত পালটে রাতারাতি কতজন যে লালন-অনুরাগী হয়ে উঠলেন! তাঁর জীবন নিয়ে ডকুমেন্টারি ও ফিচার ফিল্ম যাঁরা তৈরি করেছেন তাঁদের চেয়ে এই দুই বন্ধু অনেকটাই এগিয়ে আছেন এই অর্থে যে লালনের মিথকে পাশে সরিয়ে রেখে এঁরা লালনতত্ত্বকে বোঝাতে চেয়েছেন নানা রূপগত প্রযুক্তি প্রয়োগ করে, প্রসেনিয়ামের বদ্ধতা ভেঙে, মঞ্চকে আলোছায়ায় এনে। সবচেয়ে যেটা আমাকে চমৎকৃত করেছে তা হল একটা একতারাকে লালনের প্রতীকরূপে সামনে রেখে কাহিনি বা তথ্যগত কাঠামোকে সাজানোর মৌলিক দৃষ্টিকোণ। একইভাবে চমকপ্রদ লম্বা এক শুভ্র বস্ত্রখণ্ডকে মঞ্চে নানা ভাবে হেলিয়ে দুলিয়ে কাঁপিয়ে কখনো নদী, কখনো নৌকার মধ্যে নদী, কখনো আবহায়াৎ, কখনো উচ্ছ্বিত জীবনলহরের ব্যঞ্জনা ফোটানো অতি উন্নত কল্পনাশক্তির পরিচয়বাহী। সেই বস্ত্রখণ্ডে নদীর স্বরূপ এনে ছায়াবাজির সাহায্যে হাতের তালুর নিপুণ কারসাজিতে কখনো ভাসমান মীন দেখানো আবার পরক্ষণে তালু ও আঙুলের অন্যতর বিন্যাসে সেই মীনের পাখি হয়ে উড়ে যাবার ইঙ্গিত ফোটানো অসামান্য শিল্প কুশলতায় অপরূপ। আর সেইসঙ্গে প্রযুক্ত হয়েছে প্রতীকী নানা ধরনের মারফতি গান। গানের এমন সুষম প্রয়োগ থকে স্পষ্ট হয় এই সত্য যে লালনগীতির আয়নামহলে এই নাটকজীবী বন্ধু দু-জন প্রবেশ করতে পেরেছেন। বস্তুত অনেক ধরনের লালনগানের অবিরল ব্যবহার এবং সুদীপ্তর কন্ঠবদনের উন্নত ধ্বনি আর গানের বিভঙ্গে উচাটন শরীরী ভাষা দেখে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল যেন কোনো বিশেষ ‘মিউজিকাল’ উপভোগ করছি। সুদীপ্ত আর তার সহযোগীদের গানের বৈভব শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল এটা বোধহয় ইংরেজি ভাষার শৃঙ্খল ভেঙে বিস্তীর্ণ লোকায়তে নিজেকে প্রোথিত করে তুলছে। শেষ পর্যন্ত নাটকটা দেখার পর লালন ও তাঁর দেশকাল পেরিয়ে জেগে থাকে গানের বিচিত্র অভিভব। লালন জাতিতে যা-ই হোন, তাঁর গানের সমর্থ সৃজন ও মনন অনেক বেশি অমরতা দাবি করে।
আধুনিক নাট্যপ্রযোজনায় যেমন হয়, এখানেও তেমনই টেকনিকের বহুরকম ব্যবহার ও উপস্থাপনের বুদ্ধিমত্তা চোখে পড়ে। একক অভিনয়ের আঙ্গিক ও গানের ধারা থামিয়ে সুদীপ্ত মাঝে মাঝে কথকের ভূমিকা নেন এবং তখন তাঁর ক্রিটিক রূপটা লালন ফকিরের অন্যান্য দিককে দেখাতে চায়। যেমন কথকের জবানিতে শোনা গেলঃ Lalon Phakir has become a musical resource to launch careers of contemporary singers and groups, in both Bengals. Not only contemporary music, Lalon Phakir’s songs have launched the career of several ‘folk’ singers on both sides of Bengal border. Lalon Phakir is a bridge.
কথকের এমনতর তির্যকভাষা প্রযোজনাকে সমকালস্পর্শী করে তোলে এবং হয়তো বোঝায় যে সংস্কৃতির একটা প্রধান ঝোঁক হল ‘unintended comsequences’-এর অভিমুখে যাওয়া। লালনের ভাবপ্রতিমা আর সাধনপথ যে আমাদের ব্যাণিজ্যিকতার অমোঘ টানে ভিন্নপথে চলে জনপ্রিয় প্রমোদ উপকরণে আবিল হয়ে পড়েছে তার বাস্তবতা বড়ো নির্মম।
সুমন-সুদীপ্তকে অন্য একটা কারণে বলিহারি দিতে হবে। সমগ্র প্রযোজনায় তথা মঞ্চায়নে বাউলের গেরুবাস তাঁরা আমদানি করেননি। বস্তুত লালন তো বাউল ছিলেন না যদিও লালনগীতি এখন বাউলরাই গান। লালন ঘোষিত ভাবে ছিলেন ডোরকৌপীনধারী ভেক খিলাফতে দীক্ষিত আঁচলাঝোলাসম্বল ফকির। গ্রামসমাজের অবতল স্তরে সবার অধম দীনের হতে দীন খেটে খাওয়া মানুষদের সঙ্গী আর মুর্শেদ। তাঁর পরনে থাকত ‘জিন্দাদেহে মরার বসন’ যা দাফনের সঙ্গে সংলগ্ন। জীবনাতীত এক বোধে পৌছেও তাঁর মধ্যে প্রধান ছিল ইহ আর দেহ। নাটকের এক পর্যায়ে খুব সূক্ষ্ম ইঙ্গিতে সেই কাম থেকে প্রেমে উত্তরণের দেহগত অভিনয় মুগ্ধ করে দেয়, যা সুদীপ্ত-র শরীরী বিক্ষেপে ও সামর্থ্যে অভিভূত করে। এসব প্রয়াস থেকে বোঝা যায় ম্যান অফ দ্য হার্ট কোনোভাবেই রোমান্টিক ভাবময়তায় আচ্ছন্ন হতে চায়নি, বরং ‘বর্তমান’ সাধনার অঙ্গীকারে ফোটাতে চেয়েছে আর্ত অন্বেষণের কান্না আর অচরিতার্থ জীবনের অসম্পূর্ণতাজনিত খেদ। এর থেকে আমরা অনুভব করতে পারি, লালনের মতো সাধক ও গীতিকার মর্ত্যজীবনের ঢেউয়ে লুটোপুটি খেয়ে, জীবনের ঘট ভরে নিয়েও অন্য কোনো গভীরতর সন্তাপে আক্রান্ত ছিলেন। জীবন-পরিক্রমার অন্তে পৌঁছে গিয়েও দেহখাঁচার মধ্যে প্রাণের ছটফটানি আর নিষ্ক্রমণের পথ খোঁজার মহারহস্য তাঁর কাছে অসমাধিত থেকে যায়। শুনে ভালো লাগল অন্য সব অসতর্ক গায়কদের মতো ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ ‘কেম্নে আসে যায়’ না উচ্চারণ করে ‘কম্নে আসে যায়’ উচ্চারিত হয়েছে এখানে। তত্ত্বগতভাবে জানা চাই যে, ‘কেমনে’ মানে কীভাবে আর ‘কমনে’ মানে কোথা দিয়ে অর্থাৎ দেহের নবদ্বারের কোন রন্ধ্রপথে প্রাণের আসাযাওয়ার পথ। তা ধরতে পারা বা জানতে পারাই দেহতত্ত্বের মূল কথা। শ্বাসনিয়ন্ত্রর্ণের গূঢ় শরীরী প্রযুক্তি আয়ত্তে আনাই লালনতত্ত্বের মর্মবাণী। ম্যান অফ দ্য হার্ট হয়তো এটাও বোঝাতে চায় যে মনের মানুষ কোনো অলীক ভাবনা বা অতীন্দ্রিয় অনুভব নয়। নয় রম্য বা দর্শনসম্পৃক্ত। এখানে মনের মানুষ স্পষ্টতই দেহগত সাধনগম্য এক অভিমুখ - যাকে লাগে নরনারীর যুগ্ম সম্মেলনে।
এতক্ষণ বলা হয়নি, ম্যান অফ দ্য হার্ট আয়োজনের সম্ভারে ও উপস্থাপনের মুনশিয়ানায় যথেষ্ট ব্যতিক্রমী প্রযোজনা। কলকাতার মঞ্চে এত সমৃদ্ধ নাট্যোদ্যোগ আগে দেখা যায়নি। আসলে এর ব্যাপ্তি আর খুঁটিনাটি বিন্যাস, শব্দপ্রয়োগ, আলোকসম্পাতের কারিগরি ও গানের পরিসর আন্তর্জাতিক স্তরে কতটা গ্রহণযোগ্য বা বোধগম্য হবে তা ভাবা দরকার, কেননা এ তো ঠিক নাটক নয়, বরং বহুধরনের রূপাঙ্গিকের নিরীক্ষাবহুল উদ্ভাস। এর প্রাণভোমরা হল গান এবং বাংলা ভাষার গান। সেদিকটা বাঙালি দর্শকদের মাতিয়ে দেয়। বিশেষত সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের গায়নসামর্থ্য প্রথম শ্রেণির। তার সঙ্গে তাল রেখে উঁচু মানে গান গেয়েছেন দামিনী বসু ও সাত্যকি ভট্টাচার্য। কুষ্টিয়া থেকে আনা একজন ফকিরও ভালোই সাথসঙ্গত করে গেছেন। মৃদঙ্গে ও ঢোলে মৃগনাভি চট্টোপাধ্যায়ের মগ্ন বাজনা রীতিমত দক্ষতাসম্পন্ন। সমগ্র অনুষ্ঠানটি যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টিকারী। তবে সন্দেহ হয়, এত সব সমন্বয় ও শিল্পীসমাবেশে এই প্রযোজনা ঘন ঘন করা যাবে কি?
আপাতত আমরা চেয়ে থাকব ২ জুন তারিখের দিকে। ওইদিন ম্যান অফ দ্যা হার্ট আবার দেখা যাবে অ্যাকাডেমি মঞ্চে। আশা করব, বাংলা গ্রুপ থিয়েটারের প্রধান মুখগুলিকে সেদিন দর্শকদের সারিতে দেখা যাবে। এবারে তাঁদের কোনো অজ্ঞাত কারণে দেখতে পাইনি। লালন ফকিরের জীবনতত্ত্ব, আত্মভাষ্য, চাপা কৌতুক আর তাঁকে নিয়ে আমাদের বেহিসেবি ক্রিয়াকলাপের ব্যাপারে যথাযথ জ্ঞাপনের স্পষ্ট তৎপরতা এই প্রচেষ্টার রীতিমতো দিগদর্শী। নিছক ভাবাবেগ পেরিয়ে আর তাঁকে নিয়ে অলীক পুরাণ রচনায় ক্ষান্তি দিয়ে আমাদের সময় এসেছে লোকায়ত জীবনবিষয়ে প্রকৃত অন্বেষার। জন্মপরিচয়হীন নির্জন একক একজন ব্যক্তি কেমন করে আপন পরিসরে গড়ে তুলেছিলেন প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠান, সে-কথার নেপথ্য ঘটনা আমাদের জানা দরকার। তবে ম্যান অফ দ্য হার্ট সেই অজানা ইতিহাস জানাতে পারেনি যে প্রবৃদ্ধ ৮৩ বছর বয়স থেকে ছেঁউরিয়াবাসী লালন ফকিরের আগের জীবনটা কোথায় বা কেমন করে কেটেছে।
______________________________
সুধীর চক্রবর্তী রচিত এই প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘আরেক রকম’ প্রথম বর্ষ, অষ্টম সংখ্যায় (১৬-৩০ এপ্রিল, ২০১৩)। সুধীর চক্রবর্তীর মতন বিরল গবেষক, শিক্ষক ও লেখক ‘আরেক রকম’-কে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা এই প্রবন্ধ পুনর্মুদ্রিত করলাম।