আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২১ ● ১৬-২৯ ফাল্গুন, ১৪২৭

পুনঃপাঠ

ক্যারিবিয়া, আহা!

গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস্


(গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস্ ৬ই মার্চ ১৯২৭-এ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে পড়ে নেওয়া যাক তাঁরই রচিত একটি সংবাদ প্রতিবেদন। তরজমা করেছেন শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়)

হয়তো অনেকে নাম শোনেননি, সুরিনাম হল ক্যারিবীয় সাগরের বুকে এক স্বাধীন রাষ্ট্র, কিছুদিন আগেও যা ওলন্দাজদের উপনিবেশ ছিল। ৬৪,০০০ বর্গ মাইলের এই দেশের বাসিন্দা নানান বংশোদ্ভূত ৩৮৪,০০০ জনঃ ভারত থেকে আসা, স্থানীয় ইন্ডিয়ানরা, ইন্দোনেশীয়, আফ্রিকার, চীনা এবং ইয়োরোপীয়। সুরিনামের রাজধানী প্যারামারিবো, যার শেষ থেকে তৃতীয় অক্ষরে ঝোঁক দিয়ে ওরা উচ্চারণ করে, হৈ-হল্লা ভরা কিন্তু উদাসীন এক শহর। মেজাজে ঠিক দক্ষিণ আমেরিকার মতো নয়, বরং অনেকটা এশীয়। গোটা দেশে চারটি ভাষা এবং অসংখ্য স্থানীয় উপভাষা, আর সরকারি ভাষা ডাচ। ধর্মের দিক দিয়ে দেখলে আছেঃ হিন্দু, রোমান ক্যাথোলিক, ইসলাম, মোরাভিয়ান, ডাচ সংস্কারবাদী, এবং লুথারপন্থী। এই মুহূর্তে সেদেশ শাসন করছে কিছু কমবয়সী ফৌজি কর্তা। এইসব ফৌজি যুবকদের সম্পর্কে প্রতিবেশী দেশে বসেও সামান্যই জানা যায়। অবশ্য ওদেশের কথা আমরা ভুলেই থাকতাম যদি না হপ্তায় একটা ডাচ বিমান সরাসরি আমস্টারডাম থেকে কারাকাস্ আসার পথে একবার ওদেশে না থামত।

আমি কিন্তু বেশ অল্পবয়সেই সুরিনামের কথা শুনেছিলাম, তখন অবিশ্যি সুরিনাম বলা হত না, বলত - ডাচ গায়ানা। ফ্রেঞ্চ গায়ানার প্রতিবেশী দেশ। যে-ফ্রেঞ্চ গায়ানার রাজধানী কেইয়েন শহর এই কিছুদিন আগেও ছিল ফরাসি বন্দীশিবির। জীবনে-মরণে শয়তানের রাজধানী। ওই নরককুণ্ড থেকে সামান্য যে-ক'জন পালাতে পারত, তারা হিংস্র অপরাধী হোক বা রাজনৈতিক আদর্শবাদী, ছড়িয়ে যেত অসংখ্য ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের কোনো একটিতে। যতক্ষণ না আবার ফিরতে পারে ইয়োরোপে। নিদেনপক্ষে ভেনেজুয়েলা নয়তো কলম্বিয়ার ক্যারিবীয় উপকূলে নিজেদের নতুন করে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এদের মধ্যে সবথেকে আলোচিত হচ্ছে প্যাপিঅঁ-র লেখক অঁরি শারিয়েরার ঘটনাটা। উনি কারাকাসে রেস্তরাঁ এবং তুলনায় কিছু অস্পষ্ট উদ্যোগে বেশ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। ক্ষণজন্মা সাহিত্যিকের মর্যাদাও পেয়েছিলেন, যা তাঁর প্রাপ্য ছিল না বলাই বাহুল্য। ওটা বাস্তবিক প্রাপ্য ছিল আরেক অপরাধীর। ফরাসি লেখক হিসেবে যাঁর যোগ্যতা আর একটু বেশি ছিল, যিনি প্যাপিঅঁ-র অনেক আগেই ওই শয়তানের রাজধানী ডেভিলস আইল্যান্ডের বিভীষিকা বর্ণনা করেছেন। যদিও তাঁকে আজকের সাহিত্যের কোনো গলিঘুঁজিতেও খুঁজে পাবেন না, কোনো এনসাইক্লোপিডিয়াতেও না। তিনি রেনে বেলবনোয়া। ডেভিলস আইল্যান্ডে আসার আগে ছিলেন ফ্রান্সের এক সাংবাদিক। যদিও ঠিক কী কারণে তাঁর যাবজ্জীবন হয়েছিল তা আজ আর কোনো সাংবাদিকই মনে করতে পারেন না। পরে তিনি আমেরিকায় আশ্রয় পেয়ে ফের সাংবাদিকতা করেন। ওখানেই পরিণত বার্ধক্যে তাঁর মৃত্যু হয়।

এইরকম কিছু কিছু পলাতক অপরাধীকে দেখা যেত ক্যারিবীয় কলম্বিয়ার সেই শহরে, যেখানে আমি জন্মেছিলাম। আমি সেই সময়ের কথা বলছি যখন কলার ঝড় চলছে সেখানে, লোকে দেশলাই দিয়ে চুরুট না ধরিয়ে পাঁচ পেসোর নোট জ্বালিয়ে ধরায়। ওই পলাতক অপরাধীদের অনেকেই সমাজে বেশ মিলেমিশে গিয়েছিল, কেউ কেউ হয়ে উঠেছিল বেশ সম্মানিত নাগরিক। অবশ্য তাদের মুখের ভাষা বোঝা কঠিন ছিল, আর অতীত ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। আরেকজন, রজার শান্তাল, যে অবশ না-করেই দাঁত তুলতে পারত, আমাদের শহরে এসে রাতারাতি লাখোপতি হয়ে গিয়েছিল। লাট সাহেবের মতো পার্টি দিত। যদিও আমাদের সেই অকল্পনীয় শহরে লাট-বেলাট হতে কারুর বিন্দুমাত্র আপত্তি ছিল না। লোকটা আকণ্ঠ মদ গিলে খুশির বেদনায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ফরাসিতে বলত - ‘আমিই এই দুনিয়ার সবথেকে বড়োলোক’। এইসব ডিলিরিয়ামের মাঝে ও নিজেকে দাতাকর্ণ ভাবতে ভালোবাসত। আমাদের শহরের চার্চকে সে একটা পূর্ণাবয়ব সন্তমূর্তি দিয়েছিল যেটা চার্চে অধিষ্ঠিত করতে পাক্কা তিনদিন বেশ হুল্লোড়ে কেটেছিল। শহরের লোক আগে এসব দেখেনি। এক সাদামাটা মঙ্গলবারে সকাল এগারোটার ট্রেনে তিনজন গোয়েন্দা পুলিশ এসে সোজা তার বাড়িতে গিয়েছিল। শান্তাল বাড়িতে ছিল না, গোয়েন্দারা তার দেশীয় স্ত্রীর সামনে গোটা বাড়িতে আগাগোড়া চিরুনি তল্লাশি চালায়। শোবার ঘরের বিশাল ওয়ার্ডরোবটা খুলতে চেষ্টা করার আগে পর্যন্ত তার স্ত্রী কোনো প্রতিরোধই করতে পারেননি। তারপর ওই গোয়েন্দারা বাড়ির আয়নাটা ভেঙে কাচ আর কাঠের ফ্রেমের মধ্যে থেকে দশ লক্ষ ডলার আবিষ্কার করে। সেই থেকে রজার শান্তাল সম্পর্কে আর কিছু শোনা যায়নি। অনেক পরে এই গুজবটা কিছুদিন সারা শহরের বাতাস ভারী করে রাখল যে ওই সন্তমূর্তির পেটের মধ্যে ভরে না কি লাখো জাল ডলার এ দেশে ঢোকানো হয়েছিল, যদিও শুল্ক বিভাগের কোনো অধিকর্তা এর সত্যতা নির্ণয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাননি।

১৯৫৭-র বড়োদিনের কিছু আগে প্যারামারিবো বিমানবন্দরে ক্ষণিকের যাত্রাবিরতিতে একটা ঝাঁকুনি খাওয়ার মতো আমার হঠাৎ পুরোনো সব কথা মনে পড়েছিল। তখন বিমানবন্দর মানে সমতল রানওয়ে আর তালপাতায় ছাওয়া একটা ঘর। সে-ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা টেলিফোন, দেখলেই বুঝতে পারবেন সেই কাউবয়-মার্কা সিনেমায় যেমন টেলিফোন দেখা যায়, যার বাঁকা হাতলটা বহুকষ্টে ও বহুবার তুলে চেষ্টা চালাতে হবে ওপারের আওয়াজ পাওয়ার জন্য। সেদিন ছিল প্রচণ্ড গরম, দমচাপা বাতাস ভর্তি ধুলো, গন্ধটা যেন ঘুমন্ত কুমীরের মতো, যা নাকে এলেই অন্য দুনিয়ার লোকেরা বুঝতে পারেন ক্যারিবিয়ায় পৌঁছে গেছি। টেলিফোনের খুঁটির পাশে একটা টুলে বসে আছে পরমা সুন্দরী এক মেয়ে। কালো, তন্বী মেয়েটির মাথায় বহুবর্ণের পাগড়ি, ঠিক যেমনটা আফ্রিকার কোনো কোনো দেশের মেয়েরা মাথায় বাঁধে। মেয়েটি গর্ভবতী ছিল, আসন্নপ্রসবা। কিন্তু সে এমন ভঙ্গিতে চুরুট টানছিল যা ক্যারিবিয়ার বাইরে কোত্থাও দেখিনি। চুরুটের জ্বলন্ত দিকটা মুখে নিয়ে অন্য দিকটা দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছিল। যেন গাধা বোটের চোঙা। গোটা এয়ারপোর্টে মেয়েটি ছাড়া আর কোনো মানুষ ছিল না।

এক ঘণ্টার এক চতুর্থাংশ কেটে যাওয়ার পর এক জরাজীর্ণ জিপ এসে হাজির হল শরীরের চারপাশে গরম ধুলোর মেঘ জড়িয়ে। জিপ থেকে হাফপ্যান্ট আর কর্কের শিরস্ত্রাণ পরা এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক নেমে এল বিমান ছাড়ার অনুমতিপত্র নিয়ে। এখানে এসে যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সমাধা করতে সে টেলিফোনে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাচ ভাষায় কথা বলে গেল। ঠিক বারো ঘণ্টা আগে আমি লিসবোয়ার (লিসবন) সমুদ্রের ধারের একটা ছোট্ট খোলা ছাতে বসে, সুবিপুল পর্তুগিজ সমুদ্রের শোভা উপভোগ করছিলাম। দেখছিলাম ঠাণ্ডা উত্তুরে হাওয়া এড়াতে পালিয়ে আসা শঙ্খচিলগুলো কেমন করে বন্দরের সাজানো-গোছানো কামরায় ঢুকে পড়ছে। ইউরোপ তখন জরাগ্রস্ত, মাটি ঢেকে গেছে বরফে, দিনের আলো পাঁচ ঘণ্টার বেশি থাকে না। আর এখানে এসে থেকেই যেমন মালুম হচ্ছিল গরম, আর পচা পেয়ারার গন্ধ, সেখানে বসে এসব কথা কল্পনাও করা যায় না। যদিও সেদিনের একমাত্র যে ছবিটি আমার মাথায় চিরস্থায়ী হয়ে আছে তা হল সেই উদাসীন কালো মেয়েটির, যে কোলে একঝুড়ি টাটকা আদা নিয়ে বসেছিল যাত্রীদের কাছে বিক্রি করবার জন্য।

এখন, আবার লিসবোয়া থেকে কারাকাস্ যাওয়ার পথে আবার যখন থেমেছি প্যারামারিবোতে, প্রথমেই আমার মনে হল বুঝি-বা কোনো ভুল শহরে এসে গেছি। এখনকার এয়ারপোর্ট টার্মিনাল একখানা পেল্লাই বাড়ি, বড়ো বড়ো কাচের জানলা, খুব হালকা করে বাতানুকূল যন্ত্র চলছে, গন্ধটা যেন বাচ্চাদের ওষুধের মতো। আর নিদারুণ ভাবে সেইসব বাজনা বেজে চলেছে, যেমন বৈশিষ্ট্যহীন বাজনা আজকাল গোটা দুনিয়ার যেকোনো ভিড়ে শোনা যায়। দোকানও আছে নিঃশুল্ক বিলাসদ্রব্যের, যেমনটা থরে থরে সাজানো থাকে জাপানে। একটা ক্যাফেটেরিয়া আছে ভিড়ে ভিড়াক্কার, সেখানে ওদেশের সাতটি জাতি, ছ-টা ধর্ম, আর অসংখ্য ভাষা একেবারে সেদ্ধ হয়ে দুমড়ে মুচড়ে ঘেঁটে গেছে।

অধ্যাপক হুয়ান বশ, যিনি অনেক বইপত্রের সঙ্গে ক্যারিবিয়ার ইতিহাসও লিখেছেন, একবার আমাকে গোপনে বলেছিলেন আমাদের ক্যারিবিয়ার জাদুটা হচ্ছে সেই অপরাজেয় উদ্ভিদের মতো, যে সিমেন্টের ঢালাইয়ের নীচে চাপা পড়েও মরে না, বরং আবার ওই একই জায়গায় ঢালাই ফাটিয়ে ফের ফুল ফোটায়। অধ্যাপক হুয়ান বশের কথাটা আরও ভালো ভাবে বুঝলাম যখন প্যারামারিবো বিমানবন্দরের এক অভাবিত দরজা দিয়ে বাইরে এসে দেখলাম সার দিয়ে বুড়িরা বসে নিরাসক্ত ভঙ্গিতে চুরুট ফুঁকছে সেই উলটো করে, জ্বলন্ত দিকটা মুখের ভেতর নিয়ে। প্রত্যেকেই কৃষ্ণাঙ্গ, মাথায় রঙিন পাগড়ি বাঁধা। ওরা স্থানীয় ফলমূল, হস্তশিল্পের জিনিসপত্তর বিক্রি করছিল, কিন্তু কাউকে মাল গছানোয় তাদের আদৌ কোনো আগ্রহ ছিল না। ওদের মধ্যে একজন, সে অবশ্য সবথেকে বুড়ি নয়, আদা বিক্রি করছিল। আমি তাকে একঝলক দেখেই চিনতে পারলাম। কীভাবে শুরু করব, আর কী বা বলব ঠিক করতে না পেরে তার থেকে একমুঠো আদা কিনলাম। আদা কিনতে কিনতে তাকে সেই প্রথমবার যে-অবস্থায় দেখেছিলাম সেটা ভেবে বেমক্কা জিজ্ঞেস করলাম, ছেলে কেমন আছে। সে আমার দিকে না-তাকিয়েই বলল, ‘ছেলে না, মেয়ে হয়েছিল। এখন সে বাইশ, কিছুদিন আগে তার একটা বাচ্চা হয়েছে।’


জানুয়ারি ৬, ১৯৮১, এল পাইস, মাদ্রিদ