আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২৪ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১

সমসাময়িক

'বুলডোজার রাজ'-এর অবসান?


১৩ই নভেম্বর ২০২৪। অবশেষে দেশের সুপ্রিম কোর্ট অভিযুক্তদের বাড়িঘর সম্পত্তি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়ার বিপক্ষে একটি রায় দিয়েছেন যা অবশ্যই সন্ত্রস্ত মানুষদের জন্য একটি স্বস্তির হাওয়া বয়ে এনেছে। কেন্দ্রে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর উত্তর ভারতে, বিশেষত উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যে যেখানে তথাকথিত ডবল ইঞ্জিন সরকার হয়েছে সেখানেই রাজ্যের প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা জনিত যে কোনও অভিযোগেই অভিযুক্তদের বাড়ি বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে দিয়েছে। বুলডোজার চালানোই যেন আইনশৃঙ্খলা সমস্যা সমাধানের দস্তুর হয়ে উঠেছে বিজেপির শাসনে। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় এই প্রবণতায় একটু লাগাম পড়াবে। যদিও দেখার বিষয় এই রায় প্রশাসনের আদালত বহির্ভূত কার্যকলাপে কতটা পরিবর্তন আনতে পারে।

সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে বলেছে যে কেবল একজন ব্যক্তি অভিযুক্ত হলেই প্রশাসন তার বাড়ি ভেঙে দিতে পারে না। আদালত বলছে কর্তৃপক্ষ বিচারক নয় এবং বাড়ি ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতার অধিকারী নয়। বুলডোজার একটি বাড়ি ভেঙে দিচ্ছে এরকম ভয়ঙ্কর দৃশ্য আইনের শাসনের বিপরীতে জোর যার মুলুক তার, এই ধারণাকেই আরও স্পষ্ট করে। বস্তুত এযাবৎ প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাজ্য প্রশাসন বাড়ি ভাঙার অজুহাত হিসেবে বেআইনি নির্মাণকে দায়ী করেছে। যদিও নির্বাচনী প্রচার থেকে সাক্ষাৎকার সব জায়গাতেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা একে আইনশৃঙ্খলা রাখার দাওয়াই হিসেবেই তুলে ধরেছিল। তারা এগুলোকে প্রায় তাৎক্ষণিক ন্যায় দেওয়ার এক হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরেছিল। মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তো নিজেকে ‘বুলডোজার মামা’ নামে পরিচয় দিতেই গর্বিত হতেন।

এহেন আদালত বহির্ভূত ন্যায়ের ধারণা অবশ্য বিজেপি শাসনে দিকে দিকেই পছন্দসই হয়ে উঠেছে। এ রাজ্যের প্রশাসকরাও তার ব্যতিক্রম নন। আর জি কর কাণ্ডের পর অভিষেক ব্যানার্জি থেকে কুনাল ঘোষ সবাই দোষীর বিচার হওয়ার আগেই এনকাউন্টার করার দাবি করছিল। অন্যদিকে লোকসভা ভোটে শহরাঞ্চলে ভোট কমার প্রতিক্রিয়ায় রাজ্য সরকার হঠাৎ বুলডোজার নিয়ে হকার উচ্ছেদে নেমে পড়ে। সেখানেও যুক্তি ছিল বেআইনি নির্মাণের। দেখা যাচ্ছে সব ক্ষেত্রেই রাজ্য প্রশাসন তাদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বজায় রাখতে বিরুদ্ধপক্ষের বাড়িঘর বা রুজিরুটিকে উচ্ছেদ করার আদিমতম পন্থাকেই হাতিয়ার করেছেন। বুলডোজার চালানো কেবল একটা উপায় মাত্র। বিজেপি শাসিত রাজ্যে বুলডোজার চলছে মূলত সংখ্যালঘু মানুষের ওপরে আর এ রাজ্যে চলছে বিরুদ্ধ রাজনীতির সম্ভাব্য ভোটারদের উপরে। এমনকি ২০২২ সালে কংগ্রেস শাসিত রাজস্থানেও বুলডোজার চলেছে। তবে বিজেপি শাসিত রাজ্যে এর ব্যাপকতা এবং অভিমুখ তীব্র।

এমতাবস্থায় শীর্ষ আদালত, তার রায়ে, সংবিধানের ১৪২তম অনুচ্ছেদের অধীনে সরকারী কর্মকর্তাদের জবাবদিহি জোরদার করার জন্য বেশ কয়েকটি 'বাধ্যতামূলক নির্দেশ' জারি করার জন্য বিশেষ ক্ষমতার আহ্বান জানিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দখলকারীদের ধ্বংসের ১৫ দিনের পূর্ব নোটিশ; নোটিশে অবশ্যই অননুমোদিত নির্মাণের প্রকৃতি, নির্দিষ্ট লঙ্ঘন এবং ধ্বংসের পরোয়ানাযুক্ত ভিত্তির বিবরণ দিতে হবে। মালিক বা দখলদার যারা রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপের বিরুদ্ধতা করতে চান তাদের অবশ্যই মনোনীত কর্তৃপক্ষ দ্বারা একটি ন্যায্য সুযোগ দিতে হবে। কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত আদেশ অবশ্যই যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত হতে হবে। ভাঙার সময়ের ভিডিও করা আবশ্যক ইত্যাদি। আদালত নির্দেশ দিয়েছে যে এই নির্দেশাবলী লঙ্ঘন করলে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং সর্বোপরি ভেঙে দেওয়া সম্পত্তির পুনরুদ্ধারের জন্য তারা ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকবে। যদিও সরকারী সম্পত্তি বেদখল করার ক্ষেত্রে বা আদালত কর্তৃক ধ্বংসের নির্দেশ দেওয়া হলে নির্দেশাবলী প্রযোজ্য হবে না।

এই রায়ের প্রেক্ষিতে গোটা দেশজুড়ে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ হয়ত আদালতে আসবেন তাদের প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিকার চাইবে। দেখতে হবে আদালত তাদের যথাযত ন্যায় দেয় কিনা। হয়ত এভাবে বিরোধী জনগোষ্ঠীর ওপর নির্বিচারে বুলডোজার চালানোয় সরকারগুলো সংযত হবে। কিন্তু যে মূলগত প্রশ্নগুলো থেকেই যায় সেগুলো নিয়ে কিছু কথা বলা উচিত। প্রথমত, ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিবেশ কিভাবে অগণতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে তার জ্বলন্ত প্রমাণ এই রায়। এই দেশে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী আজকে এতটাই বেপরোয়া যে, মানুষের বাড়িঘর, দোকান অর্থাৎ সংবিধানের মৌলিক অধিকার বাসস্থান ও কাজের অধিকারকে নস্যাৎ করে পলকেই মানুষকে কপর্দকহীন করতে তার রুচিতে বাধেনা। দ্বিতীয়ত, আদালত তার পর্যবেক্ষণে যে কথাটি বলেছেন, আইনের শাসনের বদলে ক্ষমতার জোরই আজ প্রশাসনের মূলমন্ত্র। সুষ্ঠু আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার বদলে চটকদারী ক্ষমতার আস্ফালনই আজকের শাসকদের কাছে পছন্দসই। এরকম দায়হীন রাজনৈতিক প্রশাসক ভারতীয় রাজনীতিতে আগে আসেনি। নরেন্দ্র মোদির শাসনকালেই এই মডেলটির উৎপত্তি। যেখানে প্রশাসনিক প্রধান প্রশ্নের ঊর্ধ্বে বসে থাকবেন। তার দিকে প্রশ্ন এলেই প্রশ্নকারীকে সরকারি ক্ষমতার দ্বারা হয়রান হতে হবে। এক অর্থে সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া যে নিজের বাসস্থান ও রুজি রক্ষা করতে গেলে সরকারকে প্রশ্ন করা চলবে না। সর্বোপরি যে কথাটি না বললেই নয় তা হল সংবিধানের নামে শপথ নিয়ে সংবিধানকেই এভাবে দলিত করার উদাহরণ স্বাধীন ভারতে আগে কখনো ঘটেনি।

নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে আজ ভারতীয় রাজনীতিতে ক্ষমতার আধিপত্যবাদের উপাদানটি যুক্ত হয়েছে। এটি বিজেপির প্রথম দফার রাজনীতির থেকে আলাদা। বাজপেয়ী সরকারের আমলেও সংসদে যে বিতর্কমূলক, অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির পরিবেশ বজায় ছিল তা ২০১৪ থেকেই অনুপস্থিত। একদিকে সরকারপক্ষ সংসদকে এড়িয়ে আইন প্রণয়ন করতে সর্বদা উদ্যোগী। প্রধানমন্ত্রী সংসদের বিতর্কে অংশ নেননা। অধিবেশন থেকে বিরোধী সাংসদদের নিলম্বিত করা, সভা মুলতুবি করে দেওয়া সেই রাজনীতিরই ফল। যেভাবে প্রধানমন্ত্রী আজ অবধি তার কোনো পদক্ষেপের দায় নেননি, নোটবাতিল থেকে ভ্রান্ত বিদেশনীতি, একইভাবে তার দলের মুখ্যমন্ত্রীরাও তাদের প্রশাসনিক দায় স্বীকার করেনা। এভাবেই ভারতীয় রাজনীতির পরিসর থেকে গণতান্ত্রিক আবহাওয়াটাই আজ লুপ্ত হতে বসেছে। এহেন সন্ধিক্ষণে কেবলমাত্র বিচার বিভাগের ভরসায় থাকলে যে এই পরিবেশের পরিবর্তন ঘটবে না, সাম্প্রতিক ঘটনাবলী তারই সাক্ষী। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি যতদিন না রাস্তায় নেমে এক ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছেন যা দেশের রাজনীতিতে মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার বিকাশ ঘটাবে, ততদিন বুলডোজার রাজনীতিকে প্রতিহত করা যাবে না।