আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ একবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২৪ ● ১৫-৩০ কার্তিক, ১৪৩১
প্রবন্ধ
অর্থনীতিতে নোবেল, উন্নয়নের এক নতুন দিশা
গৌতম সরকার
২০২৪ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন তুরস্ক বংশোদ্ভূত ড্যারন অ্যাসেমোগলু, ইংল্যান্ডের সাইমন জনসন এবং আমেরিকার জেমস এ. রবিনসন। বর্তমানে তিনজনই আমেরিকার নাগরিক। গত দুই দশক ধরে এই অর্থনীতিবিদদের গবেষণার বিষয় ছিল, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি কীভাবে তৈরি হয় এবং সেগুলি সমৃদ্ধিকে কীভাবে প্রভাবিত করে, সেই বিষয় নিয়েই তাঁরা গবেষণা করেছেন। তাঁদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, একটি দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান সে দেশের সাফল্য বা ব্যর্থতার নির্ধারক। যে সমাজে আইনের শাসন দুর্বল এবং এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে যা জনগণকে শোষণ করে, সেই সমাজ সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠতে পারেনা বা উন্নতির জন্য (নিজেকে) পরিবর্তন করতে পারবে না। নোবেল কমিটির (অর্থনীতি) চেয়ারম্যান জেকবস্ সভেনসন জানিয়েছেন, "দুই দেশের মধ্যে আয়ের পার্থক্য কমানো এই সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই তিন অর্থনীতিবিদ দেখিয়েছেন, সেই অসাম্য দূর করতে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যে সব দেশের সামাজিক রীতিনীতিগুলি শোষণমূলক, সেই সব দেশ বিশেষ সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠতে পারে না, উন্নয়নের জন্য দরকার ইনক্লুসিভ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো। গবেষণার মধ্যে দিয়ে এই অভিমত প্রকাশ করেছেন তিন বিজ্ঞানী”।
পরিচয়
ড্যারন অ্যাসেমোগলু ১৯৬৭ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯১ সালে ‘লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স’ থেকে পিএইচডি করেন। বর্তমানে তিনি ‘ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি’তে অধ্যাপনায় নিয়োজিত। এই তুর্কি-আমেরিকান অর্থনীতিবিদের ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’ এবং ‘উন্নয়ন অর্থনীতি’র উপর সুদূরপ্রসারী কাজ আছে।
সাইমন জনসন ইংল্যান্ডের শেফিল্ড শহরে ১৯৬৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের 'কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়' থেকে ডক্টরেট করেন। বর্তমানে তিনি 'এমআইটি'তে অ্যাসেমোগলুর সহকর্মী। তাঁর গবেষণার মূল ক্ষেত্র হল, অর্থনৈতিক সংকটের বিশ্লেষণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা সম্পর্কিত অর্থনৈতিক তত্ত্ব।
জেমস এ. রবিনসন জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬০ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের 'ইয়েল ইউনিভার্সিটি' থেকে ১৯৯৩ সালে পিএইচডি সম্পূর্ণ করেন। বর্তমানে 'ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো'তে অধ্যাপনায় নিয়োজিত। এই অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দারিদ্র, সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের পিছনের অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলোর বিশ্লেষণমূলক গবেষণায় নিয়োজিত আছেন।
ইউরোপীয়রা যখন পৃথিবীজুড়ে উপনিবেশ স্থাপন করছিল, তখন নিজেদের সুবিধার জন্য সেইসব দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোয় পরিবর্তন আনে। তিন অর্থনীতিবিদ তথ্যপ্রমাণসহ দেখিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানিক পরিকাঠামোর পার্থক্যের কারণে যে উপনিবেশগুলি সেইসময় সমৃদ্ধ ছিল সেগুলি এখন দরিদ্র, আর যে উপনিবেশগুলি সেইসময় দরিদ্র ছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা এখন সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক বনাম শোষণমূলক প্রতিষ্ঠান
ইউরোপীয়রা উপনিবেশগুলিতে মূলত দুই ধরনের প্রতিষ্ঠান স্থাপনা করেছিল। প্রতিষ্ঠান বলতে এখানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক রীতি ও আচরণবিধির কথা বলা হয়েছে, যেমন আইনের শাসন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, বাক-স্বাধীনতা, নাগরিকদের স্বাধীন মতামতদান, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা, সরকারের কার্যকারিতা প্রভৃতিকে বোঝায়। একটি দেশের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের জন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান অপরিসীম। মানবিকভাবে তৈরি করা এই নিয়মবিধি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিকাঠামোর সঠিক স্থাপন ও চালনার মধ্যে দিয়ে শাসকের সাথে জনগণের মিথস্ক্রিয়া তৈরি করে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান হল সেই সমস্ত ব্যবস্থা যেগুলি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা, সম্পত্তির অধিকার, এবং প্রতিটি মানুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করে। এই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অর্থ হল, রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার সুনিশ্চিত করা। সমাজের সব পেশার লোকের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করা। এই ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষ বিনিয়োগ ও নির্মাণে উৎসাহিত হবে, উদ্ভাবনা কাজে অংশগ্রহণ করবে কারণ এই বিশ্বাস তৈরি হবে যে তাদের অর্থ, পরিশ্রম, আবিষ্কার, সম্পত্তি সুরক্ষিত থাকবে।
অন্যদিকে শোষণমূলক প্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় আইনশৃঙ্খলার সঠিক প্রয়োগ ঘটে না, মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটে। ফলস্বরূপ শাসনব্যবস্থা স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে। সম্পত্তির অধিকার রক্ষা বড় প্রশ্নের মুখে পড়ে। সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ ও উদ্ভাবনের ইচ্ছে নষ্ট হয়ে যায়। এই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে সমাজের অভিজাত শ্রেণিকে আরও অভিজাত বানায়। এতে একশ্রেণির মানুষের সমৃদ্ধি ঘটলেও সমাজের একটা বড় অংশ শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়ে দরিদ্র থেকে যায়।
তিন অর্থনীতিবিদ ষোড়শ শতাব্দী থেকে সমস্ত ইউরোপীয় উপনিবেশগুলির ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহ করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, উপনিবেশগুলোর প্রকৃতি, গৃহীত নীতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামোর গতি-প্রকৃতি ইত্যাদি। বিভিন্ন উপনিবেশের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনায় তাঁরা দেখিয়েছেন কীভাবে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রকৃতিগত পার্থক্য দীর্ঘকালীন উন্নয়নে ভিন্ন ভিন্ন ফল দেখায়। যে সমস্ত অঞ্চলে বিভিন্ন কারণে মৃত্যুহার বেশি ছিল, সেখানে উপনিবেশকারীরা শোষণমূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সম্পদ লুণ্ঠনে মনোনিবেশ করে। এর ফলে সেই দেশটি প্রাকৃতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পদ খুইয়ে দিনে দিনে দরিদ্র হয়ে পড়ে। আবার যে সমস্ত উপনিবেশে তারা দীর্ঘমেয়াদী সুবিধার সন্ধান পেয়েছিল, সেখানে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করেছিল। নোবেল বিজয়ীরা তাঁদের গবেষণার মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন, বিশ্বজুড়ে যে আর্থিক বৈষম্য পরিলক্ষিত হয় তার অন্যতম প্রধান কারণ হল এইসব প্রতিষ্ঠানের রকমভেদ, যেগুলি ঔপনিবেশিক শাসনকালে চালু হয়েছিল। সেই সমস্ত দেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয় যেগুলো সেই সময় দরিদ্র ছিল কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদ এবং শ্রমিক সরবরাহে ধনী ছিল। কালক্রমে সেই উপনিবেশগুলো দিনে দিনে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা সৃষ্টি করলেও ক্ষমতায় থাকা মানুষদের জন্য স্বল্পমেয়াদি লাভের সন্ধান দেয়। তবে এই ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় শাসকের শত প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও মানুষ বিনিয়োগ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাধনায় সম্পূর্ণরূপে মনোনিবেশ করতে পারেন না, ফলে উন্নয়ন অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
তাঁরা তাঁদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, কোনও দেশের সমৃদ্ধির পিছনে ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক কারণের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা নোগালের কথা উত্থাপন করেছেন। এটি একটি দ্বিবিভক্ত অঞ্চল, যার একদিক আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং অপরদিক মেক্সিকোর অন্তর্ভুক্ত। অর্থনীতবিদরা দেখেছেন, আমেরিকার দিকের অংশে মেক্সিকোর তুলনায় অনেক বেশি অর্থনেতিক সুবিধা এবং রাজনৈতিক অধিকার বিদ্যমান, যেটি যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামোর ফল। সেই কারণে আমেরিকার দিকের মানুষেরা অপরদিকের তুলনায় উন্নত জীবনযাপন করে। নোবেল বিজয়ীরা দেখিয়েছেন, আমেরিকান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নোগালের উত্তর দিকের অধিবাসীদের উন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এবং কর্মসংস্থানের আশ্বাস দেয়। যেহেতু সেই অঞ্চলের মানুষেরা আমেরিকার রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশ হয়ে ওঠে, তারা অনেক বেশি রাজনৈতিক অধিকার পালন করতে পারে। অন্যদিকে সীমান্তের দক্ষিণ অংশের মানুষজন একটা আলাদা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে সংকুচিত রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার নিয়ে দিনাতিপাত করে। এর কারণ মেক্সিকো অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপনার মধ্যে দিয়ে দীর্ঘকালীন উন্নয়নের উদ্যোগ সেভাবে গ্রহণ করতে পারেনি।
একইসাথে তাঁদের গবেষণায় উঠে এসেছে উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার প্রসঙ্গ। দুই দেশের ইতিহাস, ভূগোল, সংস্কৃতি একইরকম হলেও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে বিস্তর ফারাক। দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশের স্তরে উন্নীত হতে পারলেও উত্তর কোরিয়া অনুন্নত দেশের ব্র্যাকেটে পড়ে রয়েছে। তিন অর্থনীতিবিদের মতে এই ফারাকের পিছনে রয়েছে দুই দেশের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক পরিকাঠামোর বিভিন্নতা।
আলোচনায় আরেকটি দেশের উল্লেখ খুব প্রাসঙ্গিক। সেটি হল দক্ষিণ আফ্রিকার ছোট দেশ বৎসোয়ানা। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত দেশটি ছিল ব্রিটিশদের কলোনী। স্বাধীনতা লাভের কয়েক বছরের মধ্যেই এটি একটি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। এর পিছনেও আছে অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক পরিকাঠামোর কেরামতি।
নোবেল জয়ীদের তত্ত্ব ও ভারতের অবস্থান
পৃথিবীর এক বৃহত্তর অংশে ইউরোপীয়রা তাদের উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, সেই সময়কালের সমস্ত খুঁটিনাটি তথ্য বিশ্লেষণ করে তিন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ২০০১ সালে ‘দ্য আমেরিকান ইকোনমিক রিভিউ’ জার্নালে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন, ‘দ্য কলোনিয়াল অরিজিনস্ অফ কম্পারেটিভ ডেভেলপমেন্টঃ অ্যান এমপিরিকাল ইনভেস্টিগেশন’। সেই প্রবন্ধে তাঁরা দেখিয়েছেন উপনিবেশের সময় স্থাপিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের গঠনগত ও কার্যগত তফাতের কারণে পরবর্তীতে ধনী ও দরিদ্র দেশের সৃষ্টি হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ভারতের নাম উঠে এসেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগেও ভারত শিল্পজাত দ্রব্য উৎপাদনে আমেরিকাকে পিছনে ফেলেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে চিত্রটা বদলাতে শুরু করে, এর জন্য দায়ী ভিন্নধর্মী প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা। সেই সময় প্রযুক্তিগত বিবর্তনের সুফল সেইসব অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল যেখানে সেগুলি ব্যবহারের উপযুক্ত পরিকাঠামো ছিল, ব্রিটিশদের অধীনে ভারতের সেই সুযোগ ছিলনা।
বর্তমানে ভারত একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। এর একটি স্বীকৃত সংবিধান আছে। এই দেশে গণতান্ত্রিক শর্ত মেনে নিয়মিত নির্বাচন হয় এবং এখানে একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থা এবং মূলধারার এবং সামাজিক শক্তিশালী প্রচারমাধ্যম আছে। ২০১৩ সালে অ্যাসেমোগলু এবং রবিনসন যৌথভাবে একটি বই প্রকাশ করেন, ‘হোয়াই নেশনস ফেইলঃ দ্য অরিজিন অফ পাওয়ার, প্রসপারিটি অ্যান্ড পভার্টি’। বইটি প্রকাশের পর ভারতের সাবেক ‘প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা’ অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যম একটি আর্টিকেলে লেখেন, তাঁদের এই তত্ত্ব ভারত এবং চিনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন চিন কোনওরকম অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠানের সাহায্য না নিয়েই উন্নয়নের হারের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটিয়ে জাতীয় এবং মাথাপিছু উৎপাদনে ভারতকে অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে। তবে সুব্রহ্মণ্যম একথা স্বীকার করেছেন, এটাও হতে পারে যে চিন গত তিন দশক উন্নয়নের শিখরে ছিল, ভারত হয়তো সামনের তিন দশকে একইভাবে উন্নয়নের পথে হাঁটবে আর অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠানের অভাবে চিনের অগ্রগতির রথ থেমে যাবে। তবে মনে রাখতে হবে এর সবটাই অনুমান।
সাইমন জনসন এবং ড্যারন অ্যাসেমোগলু দুজনেই 'এমআইটি'-এর প্রফেসর। তাঁদের দুজনের যৌথভাবে লিখিত একটি বই হল, ‘পাওয়ার অ্যান্ড প্রগ্রেসঃ আওয়ার থাউজ্যান্ড ইয়ার স্ট্রাগল ওভার টেকনোলজি অ্যান্ড প্রসপারিটি’। সাইমন জনসনের মতে, বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দারিদ্র্যের অন্যতম প্রধান কারণ হল অনুপযুক্ত ও অদক্ষ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা যেটা তাদের দীর্ঘকালীন উন্নয়নের পরিপন্থী হয়েছে। অ্যাসেমোগলু জানিয়েছেন, তাদের সামগ্রিক কাজ গণতন্ত্রের পক্ষে সওয়াল করে এসেছে। যে সমস্ত দেশ সময়ের সঙ্গে অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিত্যাগ করে গণতন্ত্রের পথে হেঁটেছে, তারা মাত্র ৭-৮ বছরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাক্ষী থেকেছে। তিনি এটাও সতর্ক করে দিয়েছেন, গণতন্ত্র কোনও সর্বরোগহর বটিকা নয়, এটি স্থাপনার সাথে দক্ষ পরিচালনাই একমাত্র কাঙ্ক্ষিত ফল আনতে পারে। নোবেল পুরস্কার জেতার পর তাঁকে আমেরিকার প্রাতিষ্ঠানিক সংগঠনের সাথে অবশিষ্ট বিশ্বের তফাতের কথা জিজ্ঞাসা করলে সরাসরি উত্তরে না গিয়ে তিনি বলেন, “আমরা যদি আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন, ফ্রিডম হাউস, ভি-ডেম (ভ্যারাইটিস অফ ডেমোক্রেসি) এবং অন্যান্যদের সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাবো, গোটা বিশ্বেই তথাকথিত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে উঠছে। এই মুহূর্তে দুনিয়াজুড়ে সার্বিক গণতন্ত্রের দৈন্যদশা চলছে, দেশে দেশে স্বৈরতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, তাই বর্তমান সময়টা খুব চ্যালেঞ্জের। এই মুহূর্তে যেটা জরুরি সেটা হল, দেশের সরকারকে পরিচ্ছন্ন শাসনব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে আরও বেশি বেশি সংখ্যক মানুষের গণতান্ত্রিক দাবি ও অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি পালন করতে হবে”।
পুরস্কার বিজয়ী তৃতীয় অর্থনীতিবিদ, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর গবেষক রবিনসন একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তিনি মনে করেন না চিন আগামী দিনে তার অর্থনেতিক উন্নয়নের এই নক্ষত্রগতি ধরে রাখতে পারবে। তাঁর মতে চিন অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার তোয়াক্কা না করে দমনমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে উন্নয়নের যে নকশা তৈরি করেছে সেটি শীঘ্রই চূড়ান্ত ধাক্কা খাবে। এই ধরনের উন্নয়ন পঞ্চাশ-ষাট বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে, তার অধিক নয়। উদাহরণ হিসেবে রবিনসন সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা উল্লেখ করেছেন।
তবে তিন নোবেলজয়ীর দেওয়া তত্ত্ব সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। ‘হোয়াই নেশনস্ ফেইল’ বইটিতে অ্যাসেমোগলু ও রবিনসন সাত-আটশো বছরের পুরনো তথ্য বিশ্লেষণে করে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। যেখানে একই ধরনের আলোচনা জারেদ ডায়মণ্ডের বই, ‘গানস, জার্মস অ্যান্ড স্টিল’ গত পনের হাজার বছরের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে, এবং ইয়ান মরিস-এর ‘হোয়াই দ্য ওয়েস্ট রুলস ফর নাউ’ বইয়ে ১০ লক্ষ বছর আগেকার তথ্যের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাস চিত্রায়িত করা হয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই অ্যাসেমোগলুদের আলোচনায় মানব ইতিহাসের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যেমন, বিবর্তনবাদ, জীবাশ্মকাল, জেনেটিক্স এবং প্রত্নতত্ত্ব যুগের হিসেবনিকেশ বাদ চলে গেছে। আমেরিকান বিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিক জারেদ ডায়মণ্ড সরাসরি বলেছেন, ভৌগোলিক এবং সংস্কৃতিগত প্রভাব অগ্রাহ্য করে উন্নয়নের এই ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ। তাঁর মতে বিভিন্ন সমাজ বা দেশের মধ্যে শক্তি এবং প্রযুক্তিগত ফারাক তৈরি হয় পরিবেশগত তফাতের কারণে। যখন সাংস্কৃতিক বা জেনেটিক্স পার্থক্যকে তৎকালীন ইউরেশিয়ার আধিপত্যের প্রধান কারণ হিসেবে দেখানো হয়, জারেদের মতে এই প্রাধান্য তারা ভৌগোলিক ও কালচারাল সুবিধার কারণে অর্জন করেছিল। তাঁর মৌলিক তত্ত্ব হল, ভৌগোলিক সুবিধার কারণেই কিছু দেশ অন্যদের তুলনায় দ্রুত বিকাশ লাভ করে এবং বিশ্বের অনেক অংশে প্রসারিত হতে ও জয় করতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে আমেরিকান অর্থনীতিবিদ, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির প্রফেসর জেফ্রি স্যাক্স মনে করেন, এঁদের উন্নয়নের বিশ্লেষণে দেশের আভ্যন্তরীণ শর্তগুলির উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বৈশ্বিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, প্রযুক্তির বিবর্তন, আর্থিক সংস্কার, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ইত্যাদির মতো বাহ্যিক বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। প্রফেসর স্যাক্স ‘টেকসই উন্নয়ন’ এবং ‘অর্থনৈতিক উন্নয়ন’-এর উপর যুগান্তকারী কাজ করেছেন। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক উইলিয়াম ইস্টারলে’র মতে তিন অর্থনীতিবিদ তাঁদের গবেষণায় ভেনিস নিয়ে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটি সঠিক নয়। নোবেলজয়ীদের মতে ভেনিসের পতনের মূল কারণ ছিল সামাজিক অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর ধীরে ধীরে কমজোরি হয়ে পড়া। ইস্টারলে এবং অন্যান্য অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, সেই সময়কার নৌ-বাণিজ্যের অভিমুখ ভূমধ্যসাগর থেকে আটলান্টিকের দিকে ঘুরে যাওয়ার ফলেই ভেনিসের অর্থনেতিক সমৃদ্ধি ধাক্কা খায়। এছাড়াও এশিয়ার কিছু দেশ, যেমন সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ানের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান ছাড়াই ঘটে চলেছে। এটিও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদদের তত্ত্বকে সমর্থন করে না।
এ জগতে কোনও কিছুই পরম এবং ত্রুটিশূন্য নয়। তাই সমালোচনা ও বিরোধিতা থাকলেও তিন অর্থনীতিবিদদের দেওয়া তত্ত্ব বহুলগ্রাহ্য হয়েছে। অর্থনীতির নোবেল কমিটির মতে, তাঁদের গবেষণা অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক নতুন দিশা দেখিয়েছে। এখন নীতি নির্ধারকগণ সংশ্লিষ্ট দেশের আগামী উন্নয়নের দিক নির্ধারণে তাঁদের তত্ত্ব থেকে অনেক বেশি সাহায্য পাবে।
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।