আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ একবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২৪ ● ১৫-৩০ কার্তিক, ১৪৩১
প্রবন্ধ
ফের প্রতিবাদ, ব্রেক কে বাদ
অম্লানকুসুম চক্রবর্তী
- একটু চেপে দাঁড়াতে পারছেন না?
- না। পারছি না। জায়গা আছে? চোখে কি ঠুলি পরে এসেছেন?
- পোষায় না যখন মেট্রোতে উঠতে গেলেন কেন? গাড়ি করে ঘোরার মুরোদ নেই?
- তার জবাবদিহি আপনাকে করতে হবে নাকি? রাস্কেল কোথাকার।
- অ্যাই। চোপ শালা। মেরে মুখ ফাটিয়ে দেব। ভাসানের দিনে তোমারও ভাসান হয়ে যাবে। হাঃ হাঃ।
- মুখ সামলে কথা বলুন। ইতর কোথাকার। আমি আমার অধিকার চাইছি। আই ওয়ান্ট জাস্টিস।
- কত মদ গিলে এসেছেন? টলছেন কেন?
- কথা তো জড়িয়ে যাচ্ছে আপনারও। ধোয়া তুলসীপাতা নাকি? এতক্ষণ মোবাইলে কি দেখছিলেন? পেট দোলানো নাচের রিল তো। দেখেছি সব।
- আপনার মোবাইলের ওয়ালপেপারও তো দেখলাম। মোমবাতি লাগানো। নীচে আবার লেখা, 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস'। পেগ ঢালতে ঢালতেও এটা আওড়ান নাকি?
- কষে থাবড়া মারব একটা। আমি কোথায় কীকী প্রতিবাদ মিছিলে দাঁড়িয়েছি আপনি জানেন?
- আমি প্রতিবাদ করিনি নাকি? চার দিনের একটা ব্রেক নিয়েছি। আবার করব।
- আমি করব না নাকি? টায়ার্ড লাগছিল। আমিও তাই পুজোর একটা ব্রেক নিয়ে নিলাম।
দুই বিবাদমান লোক এবারে খিলখিল করে হেসে উঠলেন। হাত মেলালেন। হাসার সময় একজনের ঠোঁটের পাশ দিয়ে ওয়াশার খুলে যাওয়া কলের মতো বেরিয়ে পড়ল লালামিশ্রিত লাল রস। অন্যজন ওঁর কাঁধে হাত রেখে বললেন, “বস্, সামলে। টিস্যু আছে। দেবো?”
এবারের পুজোয় আলকাতরা চোবানো এমন খন্ডচিত্রের ম্যামথ কোলাজ বানানো যেতে পারে অনায়াসে। সেন্ট্রাল স্টেশনে দাঁড়িয়েছিলাম মহাষষ্ঠীর অপরাহ্নে। দরজা বন্ধ হতে না পারা দক্ষিণ থেকে উত্তরমুখী মেট্রোরেলের এক চালক বলছিলেন, “জনসমুদ্র বললেও কম বলা হয়। দ্বিতীয়া তৃতীয়া থেকেই এত মানুষের ঢল, আরও বড় কথা হল এমন উচ্ছৃঙ্খল মানুষের ঢল বহু বছর চোখে পড়েনি। এ বছর দেখছি, হেঁচকি ওঠার মতো কিছুক্ষণ অন্তর ওরা শুধু 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস' বলে ওঠে, কার্যকারণ ছাড়াই। অপপ্রয়োগে শব্দগুলোকে লঘু করে দিয়েছে একদম। এত বড় একটা ঘটনা ঘটার পরেও আনন্দের কিছু কমতি দেখলাম না।”
মূল ঘটনার পরে মিছিলের পরে মিছিল দেখে ভেবেছিলাম, মানুষের মনের আকাশ পুজোয় আংশিক মেঘলা থাকবে। ফেসবুকে দেখা অজস্র ছবি, প্রতিবাদমাখা পোস্টের কথা মনে পড়ে। উৎসবকে ‘উৎ-শব’ আখ্যা দিয়েছিলেন বহু মানুষ। বেরঙিন আজকালে পুজোকে আড়ম্বরহীন করার ইচ্ছের কথা উঠে এসেছিল সামাজিক মাধ্যমের দেওয়ালে। প্রতিবাদের মশালের আগুন লেলিহান শিখা নিয়ে গর্জে উঠেছিল যখন, মনে হয়েছিল আমাদের মেনে না নেওয়ার সমস্বরের কাছে এবারে ঈষৎ ম্লান হবে বছরের শ্রেষ্ঠ উৎসব। মনে হয়েছিল, এই ম্লান হওয়াটাই কালো সময়ে যুঝতে থাকার লড়াইয়ে সব চেয়ে দামি প্রার্থনা হয়ে উঠবে। কম রঙিন হলে শারদাঞ্জলির মর্ম লঘু হয়ে যায় না। কারও বাইনারি দেওয়ালে পড়েছিলাম, "মনের ভিতরে পুঁজরক্তমাখা দগদগে ঘা কি শোকায় এত সহজে?" উৎসবে ফেরার সরকারি আহ্বানের পরে গর্জে উঠেছিল গ্রাম-গঞ্জ-মফস্বল। একটা অন্যরকম পুজো দেখার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছিলাম আমরা সবাই মিলে। ডিজেবাক্সের মতো ঢাকের বাদ্যি শুনে সমাজবিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন, “নিজেদের মনের আগুনের কাছে গো-হারা হেরে গেলাম আমরা। এবং হেরে সার্বিকভাবে প্রমাণ করলাম, অধিকার পূরণের জন্য চিৎকার নয়, দিনের শেষে জেগে থাকে আয়েসের কোলাহল।” পুজোর তিন চারদিন এটাই প্রমাণ করে দিল, চোখে আঙুল রেখে।
পুজো শুরু হতে তখন বাকি মাত্র সপ্তাহখানেক। শহরের বড় বড় পুজোকর্তাদের কপালে ঈষৎ ভাঁজ পড়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। ওই পুজোগুলোর সঙ্গে যে ব্র্যান্ডের বিরাট গেট কিংবা আকাশঢাকা হোর্ডিং-ব্যানার প্রায় সমার্থক হয়ে পড়েছিল বেশ কিছু বছর যাবৎ, জানতে পেরেছিলাম, তাদের মধ্যে কিছু ব্র্যান্ড নাকি হাত তুলে দিতে চেয়েছিল এবারে। ব্র্যান্ডের কাছে অর্থাভাব ছিল না। যা ছিল, তা হল ভয়। এই অস্থির সময়ে প্রকান্ড বিজ্ঞাপন দিয়ে সামাজিকভাবে ট্রোলড্ হওয়ার ভয়। মার্কেটিং ম্যানেজমেন্টের এক অধ্যাপক আজ ফোনে বলছিলেন, “গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি ওই ব্র্যান্ডের আধিকারিকরা আজ আঙুল কামড়াচ্ছেন। যে জায়গা তাঁরা ছেড়ে দিয়েছিলেন, তা মুহূর্তে দখল করে নিয়েছে অন্য কোনও প্রতিযোগী সংস্থা, হয়তো আরও বেশি পয়সা খরচ করে। কয়েক লক্ষ লোকের ভিজিবিলিটি তাঁরা মিস করে গেলেন, সমাজের কথা ভেবে! ব্যবসা হারালেন। সংস্থার ব্যালেন্স শিটে তো প্রতিবাদ এন্ট্রি করার কোনও জায়গা থাকে না। মানুষ চিনতে ভুল করেছিলেন তাঁরা। হায় রে!”
আমার এক কবিবন্ধু তাঁর ডায়েরির পাতায় লিখেছিল, "পুজোর মুখে খবরের কাগজ দ্রৌপদীর মতো কড়া নাড়ে আমার দুয়ারে। রোজ সকালে বস্ত্রহরণ করে প্রতিবাদের খবর হাতড়াই"। ছ' পাতা জ্যাকেট বিজ্ঞাপনের শেষে লুকিয়ে থাকা খবরের প্রসঙ্গে এই লাইনগুলো লিখেছিল ও। অবাক বিস্ময়ে দেখেছি, পুজোর দিন যত এগিয়েছে, তত মোটা হয়েছে সংবাদপত্র। অনেকের মতো আমারও মনে হয়েছিল, এ বছর তুলনামূলকভাবে বিজ্ঞাপনে কম পৃথুল হবে খবরের কাগজ। মনে প্রতিবাদ রেখে, হতাশাকে লালন করে আর যাই হোক, পুজোর বাজার করা যায় না। মনে কাশফুল না দুললে ফেস্টিভ শপিংয়ে খাদ থেকে যায়। ভুল ভেবেছিলাম। বিজ্ঞাপন ছাপানোর আগে, কয়েক লক্ষ থেকে কোটি টাকা বিসর্জন দেওয়ার আগে বাজারের হাল হকিকত নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করে যে কোনও সংস্থার মার্কেটিং রিসার্চ টিম। আমাদের পুঁজিবাদী বেঁচে থাকার ক্ষুধার্ত চোখে ‘ডিমান্ড’ না দেখতে পেলে কোনও সংস্থাই বিজ্ঞাপনের জন্য একটি পয়সাও খরচ করত না। সেখানেও হার মানতে বাধ্য হয়েছে আমাদের প্রতিবাদী স্বর। অধিকাংশ মিডিয়া হাউসের বিপনন বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা খুশি এ বছরে আসা বিজ্ঞাপনের বাহারে। বেজায় হাসছেন রেস্তোরাঁর মালিকরাও। প্রাক-পুজোর দিনগুলিতেই উপচে পড়া বিলের অঙ্ক দেখে তাঁরা বুঝে গিয়েছিলেন, সুদিন এসে গিয়েছে। আমাদের পুজোর খাওয়াদাওয়া পুরোনো বহু বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে কলার তুলে। শপিং মল কর্তৃপক্ষ রিক্লাইনিং চেয়ারটা আরও বেশ কয়েক ডিগ্রি হেলিয়ে দিয়ে আরাম করে আধ শোয়া হয়ে বলছেন, “জিও পাব্লিক, জিও।” দুর্গাপুজোর পরে এবারে তাঁদের পাখির চোখ দিওয়ালি।
কয়েক বছর আগেও ঠাকুর দেখতে আসা পিলপিল করা লোকের সংখ্যা ফলাও করে প্রকাশ করত বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র। শহরের কয়েকটি সাড়াজাগানো পুজোর প্যান্ডেলের প্রতিমার ছবি দিয়ে নীচে ছাপিয়ে দেওয়া হতো বেশ কয়েকটি ঘড়ির আইকন। জানা যেত, আগের দিন রাত আটটা, দশটা কিংবা বারোটা পর্যন্ত কত মানুষ প্রতিমা দর্শন করলেন। সংখ্যা লক্ষ ছাড়াতো। অজানা কারণে সেটি আর দেখিনা আজকাল। তবে বিশ্বস্ত সূত্র থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী, জমকালো গত বছরকে টেক্কা দিয়ে ফেলেছে প্রতিবাদী এ বছর, জনসংখ্যার নিরিখে। ঘরোয়া আড্ডায় এক পুজোকর্তাকে নাকি বলতে শোনা গিয়েছে, “কে বলে এবারের দুর্গাপুজোর ফ্রেম সাদাকালো? কে বলে এ বছর অস্থির? কে বলে লোকের মনে দোলাচল, টেনশন? এ সব ফালতু শব্দ নির্বাসনে চলে গিয়েছে সেলুলার জেলে। ডবল এক্স এল আনন্দধারা বহিছে ভুবনে। বুঝলেন?” উনি আরও বলেছিলেন, “অত দরদ থাকলে সেরা পুজোর গুচ্ছ গুচ্ছ কম্পিটিশনই বাতিল হয়ে যেত। হয়েছে?”
জানি, মনমরা হয়ে বসে রয়েছেন কিছু মানুষ। আমার পাড়া, আপনার পাড়া, এ শহর, ও শহর, বিশ্বচরাচরে। এ সুসময়, ঢাকের বাদ্যি, ‘আজ সন্ধ্যের নায়িকা আপনিই’ লেখা কিয়স্ক, দু' পিস ক্রিস্পি চিকেন ওয়ান নাইন্টি নাইন ওনলি, পাশ দিয়ে হুশ করে চলে যাওয়া ডিওডোরেন্টের উগ্র গন্ধ তাঁদের স্পর্শ করার স্পর্ধা পায়নি এখনও। তাঁরা পুজো কাটালেন নিভৃতে। দিনগুলো পার করলেন মহত্তর কোনও সংকল্প নিয়ে। চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া শারদ ফ্লাডলাইটের থেকে দূরে তাঁরা সময় কাটালেন কোনও প্রতিবাদী মঞ্চে। উৎসবে মত্ত সিংহভাগ লোকই সেই মঞ্চ এড়িয়ে গেলেন, গা পুড়ে যাওয়ার ভয়ে। পাশে থাকতে না পারলেও মননে প্রতিবাদী মানুষগুলোকে সঙ্গ দিলেন আমাদেরই কিছু সহনাগরিক। তাঁদের পুজোয় ঢাক বাজেনি। কিন্তু অশুভ শক্তির সঙ্গে লড়াইয়ে তাঁরা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন আরও কয়েক কদম। তাঁরা জানেন, এ লড়াই শুধু চারদিনের নয়। ক্যালেন্ডারে যত দিন থাকে, তত দিনের।
সমাজের এসএলআর ক্যামেরার লম্বা জুম লেন্সটির এবছর সামান্য অনাড়ম্বরকে কাছে টেনে নেওয়ার কথা ছিল। রুপকথা সত্যি হতো। হল না। অন্তত আমার চোখে। জানি, আমি একলা নয়।
মেলায় বিক্রি হওয়া বাবল্ মেশিনে ফুঁ দেওয়ার মতো উৎসবের দিন তৈরি হবে এখন। আনন্দের অনন্ত দিবস ভনভন করছে মাছির মতো। ‘ফের প্রতিবাদ, ব্রেক কে বাদ’ জপতে জপতে আমাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সাহসী আমিগুলো শীতঘুমে চলে না যায়!