আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ একবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২৪ ● ১৫-৩০ কার্তিক, ১৪৩১

প্রবন্ধ

বেহাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার খেসারত

অশোক সরকার


গত আড়াই মাসে ডাক্তারদের আন্দোলনের সূত্রে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠল। মূলত সেগুলি ডাক্তারদের দিক থেকে উঠে আসা প্রশ্ন। আসুন জনসাধারণের দিক থেকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার খোলনলচেটা একটু পরখ করে দেখি।তাহলে ডাক্তারদের আন্দোলনকে বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে বুঝতে সুবিধে হবে।

পশ্চিমবঙ্গে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাঠামোটা এই রকম। মানুষের একেবারে নিকটে থাকে সাব সেন্টার, প্রতি পাঁচ হাজার জনসংখ্যায় একটি সাব সেন্টার থাকার কথা, তেমনি প্রতি তিরিশ হাজার জনসংখ্যায় একটি প্রাইমারি হেলথ সেন্টার থাকার কথা, আর প্রতি এক লক্ষ কুড়ি হাজার জনসংখ্যায় থাকার কথা একটি কম্যুনিটি হেলথ সেন্টার। সেই হিসেবে গ্রামাঞ্চলে যেখানে ৬৩ ভাগ মানুষের বাস, সেখানে ১৩,১৭০টি সাব সেন্টার থাকার কথা, আছে ১২,৫০৬টি, প্রাইমারি হেলথ সেন্টার ২,১৬৭ থাকার কথা, আছে ৯১০টি, কম্যুনিটি হেলথ সেন্টার থাকার কথা ৫৪১টি আছে ৩৪৭টি। এই সাব সেন্টারগুলিতে ২১,৪৪১টি এ-এন-এম (Auxilliary Nurse Midwife) থাকার কথা, আছেন ১৮,১৭৬ জন, মানে ৩২৬৫টি পদ খালি। এমনকি ৪,৯৪৪টিতে মহিলা-পুরুষদের জন্য আলাদা টয়লেটই নেই! ৯১০টি প্রাইমারি হেলথ সেন্টারে একজন করে এ-এন-এমথাকার কথা, একজনও নেই। ১,৪০৫টি ডাক্তারের অনুমোদিত পদের মধ্যে ১৫৮টি পদ খালি আছে। ৯১০টি ল্যাব টেকনিশিয়ান থাকার কথা, ৭১০টি পদ খালি আছে। ৩৪৭টি কম্যুনিটি হেলথ সেন্টারে একজন করে সার্জন থাকার কথা একজনও নেই। এই সেন্টারগুলিতে একজন করে গাইনোকোলজিস্ট থাকার কথা, ৩৪৭ জনের জায়গায় আছেন মাত্র ৪৯ জন। ২,১৭০টি অনুমোদিত ডাক্তার পদের মধ্যে ৬৩২টি পদ খালি আছে। ৩৪৭ জন শিশু চিকিৎসক থাকার কথা, আছেন মাত্র ২৫ জন। এক্স-রে করেন যিনি সেই রেডিওগ্রাফারের ১৮৪টি পদ খালি আছে। একমাত্র আশার কথা, স্টাফ নার্স, প্রাইমারি এবং কম্যুনিটি হেলথ সেন্টার - দুটি জায়গাতেই পর্যাপ্ত পরিমাণে আছেন। জেলা হাসপাতালে ডাক্তারদের ৮৪৯টি অনুমোদিত পদের মধ্যে ১০৬টি পদ খালি, আর মহকুমা হাসপাতালে ২,৩৫২ জন ডাক্তারের জায়গায় ১০৯টি পদ খালি আছে। জেলা হাসপাতালগুলিতে প্যারা-মেডিকাল স্টাফদের ৪,৮১১টি আনুমোদিত পদের মধ্যে ১,১৮৪টি পদ এবং মহকুমা হাসপাতালে ৯,৬৩১টি অনুমোদিত পদের মধ্যে ১,৯৮১টি পদ খালি আছে।

আসুন মানব সম্পদ ছেড়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অন্যদিকগুলিতে তাকানো যাক। প্রাইমারি হেলথ সেন্টারগুলি রাতদিন সাতদিন চলার কথা, সেখানে প্রসূতিঘর থাকার কথা, অপারেশন থিয়েটার থাকার কথা, এবং কমপক্ষে ৪টি বেড থাকার কথা। পশ্চিমবঙ্গে ২০২৩-এর তথ্য অনুযায়ী ২৫ ভাগ প্রাইমারি হেলথ সেন্টার রাতদিন সাতদিন খোলা থাকে, ৩৭ ভাগ সেন্টারে প্রসূতি ঘর আছে, ১০ ভাগ সেন্টারে অপারেশন থিয়েটার আছে, আর ৩০ ভাগ সেন্টারে ৪টি বেড আছে। এমনকি ৩৪৭টি কম্যুনিটি হেলথ সেন্টারের মধ্যে ১১টিতে ল্যাবরেটরি নেই, ৩০টিতে অপারেশন থিয়েটার নেই, ১৩টিতে প্রসূতি ঘর নেই। সার্জন শিশু চিকিৎসক, গাইনোকোলজিস্ট, ও ফিজিসিয়ান মিলিয়ে চারজন করে সবকটি কম্যুনিটি হেলথ সেন্টারে থাকার কথা, এমন সেন্টার একটাও নেই। মাত্র ১৩৭টিতে এক্স-রে মেশিন কাজ করছে। ৩৪৭টির মধ্যে ২৬৯টিতে নিয়মমতো ৩০টি বেড আছে।

এবার একটু শহরাঞ্চলের দিকে তাকাই। সাড়ে তিন কোটির বেশি শহরবাসীর জন্য ৭৩৩টি প্রাইমারি হেলথ সেন্টার থাকার কথা আছে ৪৬৭টি, মানে ঘাটতি ২৬৬টি। মোট ২,৩৩৫ জন মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী থাকার কথা। আছেন মাত্র ৭৩৩ জন। ডাক্তারদের অনুমোদিত ৯৭৩টি পদের মধ্যে ৪১৩টি পদ খালি। শহরাঞ্চলে কম্যুনিটি হেলথ সেন্টার আছে মাত্র দুটি। কাজেই তার হিসেব ধর্তব্যের মধ্যে নয়।

সামগ্রিকভাবে দেখলে দেখব, নিয়মমতো পাঁচ হাজার জনসংখ্যাতেই একটি সাব সেন্টার আছে, কিছু প্রাইমারি হেলথ সেন্টার তিরিশ হাজার জনসংখ্যায় একটির জায়গায় আটষট্টি হাজার জন প্রতি একটি আছে, এবং কম্যুনিটি হেলথ সেন্টার এক লক্ষ কুড়ি হাজার জনসংখ্যার পরিবর্তে আছে এক লক্ষ আশি হাজার জনসংখ্যায় একটি। পরিকাঠামোর মধ্যে মাত্র কয়েকটি দিকই তুলে ধরা হল, 'ভারতীয় জনস্বাস্থ্য স্ট্যান্ডার্ড' অনুযায়ী সাব সেন্টার, প্রাইমারি ও কম্যুনিটি হেলথ সেন্টার এবং মহকুমা ও জেলা হাসপাতালে যন্ত্রপাতি, অত্যাবশ্যক ওষুধ, ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ের পরিস্থিতি তুলে ধরার সুযোগ এখানে নেই, সামগ্রিক তথ্যেরও অভাব আছে।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই হাল থেকে একটাই কথা বলা যায় যে বর্তমানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা একটা নিদারুণ অবহেলার মধ্যে দিয়ে চলেছে। যে চিকিৎসা সাব সেন্টারে হবার কথা, তার জন্য মানুষ ছুটছে প্রাইমারি হেলথ সেন্টারে, সেখানে যে চিকিৎসা হতে পারত তার জন্য মানুষ কম্যুনিটি হেলথ সেন্টার, মহকুমা হাসপাতালে বা জেলা হাসপাতালে ছুটছে, এবং যে চিকিৎসা মহকুমা হাসপাতালে হতে পারত তার জন্য মানুষ ছুটছে আর জি কর বা নীলরতনে এবং প্রাইভেট হাসপাতাল-নার্সিংহোমে। তাই কলকাতা, বর্ধমান, বাঁকুড়া বা শিলিগুড়িতে এত চিকিৎসার চাপ। অনেকেই এই ছোটাছুটি করতে পারছে না। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি করতে গেলে ওই সাব সেন্টার, প্রাইমারি হেলথ সেন্টার ও কম্যুনিটি হেলথ সেন্টারের সামগ্রিক ক্ষমতাকে ভারতীয় স্ট্যান্ডার্ডের কাছাকাছি আনতে হবে। স্বাস্থ্যসাথী দিয়ে এর সমাধান হবে না।