আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২৪ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্য এবং কলকাতা শহরের মাঝারি বিচার

মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়


মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় চলে গিয়েছেন মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে - এই ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে, স্বাধীনতার ৯ বছর পরে।

যখন নিজের শরীরকে বুঝি বুঝি ভেবেও বুঝে উঠতে পারি না, সেই কিশোরীকালে বুকে ধকধকে শব্দ নিয়ে পড়েছিলাম - “শরীর! শরীর! তোমার মন নাই, কুসুম?”

ঊনপঞ্চাশ বছরে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, আটান্ন বছরে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্ট্যোপাধ্যায়, আর ছাপ্পান্ন বছর বয়সে মারা গেলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

আহা, সে কি ভোলা যায়? পাঠ ভবন স্কুলে আসন্ন সন্ধ্যার রশ্মিতে অজয়দার উদাত্ত কণ্ঠ ছোট্ট ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হয় -

"সূর্যের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, একটা বিরাট অগ্নিকুণ্ড - ক্যালসিয়াম পুড়িতেছে, হাইড্রোজেন পুড়িতেছে, লোহা পুড়িতেছে... তারই ধূ-ধূ আগুনের ঢেউ অসীম শূন্যের ইথারের স্তর ভেদ করিয়া ফুলকিয়া বইহার ও লোধাইটোলার তৃণভূমিতে বিস্তীর্ণ অরণ্যে আসিয়া লাগিয়া প্রতি তৃণপত্রের শিরা উপশিরায় সব রসটুকু শুকাইয়া ঝামা করিয়া, দিগদিগন্ত ঝলসাইয়া পুড়াইয়া শুরু করিয়াছে ধ্বংসের এক তাণ্ডবলীলা।” পরিবেশ, জঙ্গল, মুনাফা, মুনাফাবাজের অভিসন্ধি, জঙ্গলের ধ্বংস ও সেই ধ্বংসের কারণে অরণ্য মানুষের উৎখাত - এই নিয়ে হল 'আরণ্যক'। যেকোনো মাপেই সে উপন্যাসের বৃহত্তর পৃথিবীর পুরস্কার পাওয়ার কথা - অথচ তা আর হল কই!

অবশ্য কবি নজরুল ইসলামেরও কবিতা নিস্তব্ধ হয়েছে, বিদ্রোহ প্রশমিত হয়েছে তাঁর ৪৩ বছর বয়সে। তারপরে তিনি তো জীবন্মৃত।

মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সে কলকাতার ট্রামপথে জীবনানন্দ দাশের রক্তাক্ত লাশ আমাদের স্মরণে আনে সেই অমোঘ বার্তা -
"আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত-ক্লান্ত করে;
লাশকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।"

আবোল তাবোল, হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি, পাগলা দাশুর স্রষ্টা অপ্রতিদ্বন্দী বাঙালি শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায় মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে শিশু সত্যজিৎ ও সুপ্রভা রায়কে রেখে চলে গেছেন। সুকুমার রায় শুধুমাত্র বাংলায় লিখেছেন বলে তাঁর নাম পৃথিবী জানল না, তবে এ তাদেরই লোকসান।

"আমাদের স্কুলের যত ছাত্র তাহার মধ্যে এমন কেহই ছিল না, যে পাগলা দাশুকে না চিনে। সেবার একজন নূতন দারোয়ান আসিল, একেবারে আনকোরা পাড়াগেঁয়ে লোক, কিন্তু প্রথম যখন সে পাগলা দাশুর নাম শুনিল, তখনই সে আন্দাজে ঠিক ধরিয়া লইল যে, এই ব্যক্তিই পাগলা দাশু।" জীবনে দু'একজন পাগলা দাশুর সঙ্গে মিলিত হয়েছি, সকলেই, সারাজীবন তারা থেকে গেছে মনের মণিকোঠায়।

অন্যতম শ্রেষ্ট বাঙালি ঔপন্যাসিক সতীনাথ ভাদুড়ী ঊনষাট বছর বয়সে মারা গেলেন। তার আগে লিখে গেলেন বাংলা সাহিত্যের কিছু কালজয়ী উপন্যাস।

"ঢোঁড়াইরা ঢোঁড়া সাপের জাত। যতই কামড়াক, ছোবল মারুক, তড়পাক - এক মরলে যদি ওদের বিষদাঁত গজায়।" বুড়ো এতোয়ারী এই কথা বলেছিল ঢোঁড়াই সম্পর্কে। ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ কথাসাহিত্যিক সতীনাথ ভাদুড়ীর এক উপন্যাস। উপন্যাসের পটভূমি বিহারের জিরনিয়া শহরের অদূরে তাৎমাটুলি। রাজনীতি ও সমাজ পরিবর্তন, সমাজের অন্ত্যজ মানুষের বিশ্বস্ত রূপায়ণ এবং রামচরিতমানসের সঙ্গে আধুনিক কাহিনীর আন্তঃসম্পর্ক - এই নিয়ে হল বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলোর অন্যতম, 'ঢোঁড়াই চরিত মানস'। পরিত্যক্ত অনাথ বালক ঢোঁড়াই এই উপন্যাসের নায়ক - ঢোঁড়াইদের অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তারা ঢোঁড়া সাপের মতোই ব্যবহৃত হয় রাষ্ট্রের হাতে।

সমরেশ বসু চৌষট্টি বছর বয়সে, এক সময়ে তরুণ হৃদয়ে দোল লাগানো কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য একুশ বছরে, ওদিকের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ চৌষট্টি বছর বয়সে, আর প্রিয় লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছাপ্পান্ন বছর বয়সে - কলুষিত তবুও অতীব আকর্ষণীয় - এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ, তিনি তো, সবেতেই ব্যতিক্রম। দীর্ঘ আশি বছর ধরে নিরন্তর তাঁর কলম চলেছে।

তবে ব্যতিক্রম যে নিয়মকেই প্রমাণ করে।

বাংলার সেরা সাহিত্যিকদের মহৎ এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ মারা গেছেন পরিণত বয়সের আগে। অবশ্য পঞ্চাশের দশকে ভারতের মানুষের গড় জীবনকাল ছিল মাত্র ৩৪ বছর, ষাটের দশকে ৪০ বছর। আজকে অবশ্য দেশের মানুষের গড় আয়ু, ৭০ বছর।

বাঙালি সাহিত্যিকদের এই মৃত্যু মিছিলের কিছু প্যাটার্ন আছে।

অনেকে জীবিতাবস্থায় যশ অর্জন করেছেন, মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন, তবে পরিণতির আগেই ঝরে গেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী, সমরেশ বসু, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস - দুঃখ হয় পূর্ণকাল থাকলে হয়তো এদের থেকে আরও কিছু চিরায়ত সাহিত্য পাওয়া যেত। তবু এ দুঃখ সহনীয়।

অপরদিকে দেখুন, দেশভাগের যন্ত্রণায় জর্জরিত, চাকরি থেকে লেইড অফ (ধর্মের অন্যায্যতায়), আর্থিকভাবে নিঃস্ব জীবনানন্দ দাশকে একটা চাকরির আশায় শহর কলকাতার পথে পথে ঘুরে কলকাতার অভিজাত সাহিত্যিকদের উপহাসের পাত্র হতে হয়। বিভূতিভূষণ সারাজীবন গৃহশিক্ষক বা স্কুল শিক্ষকের চাকরি রক্ষা করে গ্রাসাচ্ছাদন করেন। এদের সাহিত্য রচনার চিরসঙ্গী, নিদারুণ দারিদ্র্য এবং কিছু সূক্ষ্ম অবহেলা, কিছু চতুর তাচ্ছিল্য।

এবার আসি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়। দুজনেই বাংলা সাহিত্য নিয়ে মৌলিক কাজ করেছেন।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত এক অজানা, দৃপ্ত, সুললিত ভাষায় তৎকালীন সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সাহিত্য রচনা করেন। দেহাতি, গেঁয়ো বাংলা পদ্যকে পায়ের ওপরে দাঁড় করালেন তিনি। প্রথম আধুনিক বাঙালি কবি লিখলেন রামায়ণের এক অংশ, সেখানে ইন্দ্রজিৎ নায়ক, লক্ষ্মণ প্রতিনায়ক। রাম সেই দুর্জনের পর্দার আড়ালের মদতদাতা। মাইকেল রামায়ণকে প্রিজমের উল্টো দিক থেকে বাঙালিকে দেখালেন।

“এতক্ষণে - অরিন্দম কহিলা বিষাদে
জানিনু কেমনে আসি লক্ষণ পশিল
রক্ষঃপুরে; হায়, তাত, উচিত কি তব
এ কাজ, নিকষা সতী তোমার জননী,
সহোদর রক্ষঃশ্রেষ্ঠ? শূলীশম্ভুনিভ
কুম্ভকর্ণ? ভ্রাতৃপুত্র বাসববিজয়ী
নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে?"

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা উপন্যাসের জনক। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, "বঙ্কিম বঙ্গসাহিত্যে প্রভাতের সূর্যোদয় বিকাশ করিলেন"। তাঁর রচনা একাল ও সেকালের সকল লেখককে পড়তেই হবে, তবুও তিনি যেন সকলের নন। তিনি যেন বহু সংস্কারে আবদ্ধ হয়ে রইলেন। তাঁর পরবর্তীকালের রচনাগুলোতে তাঁকে দেশপ্রেমিক, গর্বিত হিন্দু এবং হিন্দু জনগণের পুনর্জাগরণের অন্যতম কাণ্ডারি মনে হয়।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগে বাংলা ভাষায় আধুনিক উপন্যাস কি লেখা হয়েছে? রবীন্দ্রনাথ যে এই একটা সাহিত্য ধারায় কোনোরকমে পাস মার্ক পেয়েছেন। তিনি কবিগুরু, আমাদের ফিলোজফার - তাঁর আর ঔপন্যাসিক হয়ে ওঠা হল না।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পুতুল নাচের ইতিকথা', 'পদ্মা নদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য' বাংলা উপন্যাসের টেক্টোনিক শিফ্ট। মনে করুন, 'প্রাগৈতিহাসিক' গল্প। ভিখু নায়ক না প্রতিনায়ক! মানিক সাদা-কালোর ধরাবাঁধা ধাঁচাটাই ভেঙে দিয়েছেন। পুরুষ-নারীর জটিল সম্পর্কে আনলেন একাধিক পরত।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনজনেই মারা গেছেন নিঃস্ব অসহায় অবস্থায়, আমাদের এই গর্বের শহর কলকাতাতে। সমাজ আধিপতিদের দ্বারা ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষিত - এঁরা সকলেই।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরে মানুষের ভিড় দেখে (কলকাতা বুঝুক না বুঝুক হুজুগ জমাতে সিদ্ধহস্ত) কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছেন - "না থাক। সে বড়ো ক্লিশে হয়ে গেছে"। অথবা এটাই হয়তো আমাদের মতো মাঝারি মানুষের মাঝারি বিচারের পরিনাম। ভ্যান গগ, কাফকা বা কীটস্ অথবা গ্যালিলিও, মেন্ডেল বা বাখ, সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা রেবেলদের তালিকায় আরও এক সংযোজন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।

ডিসেম্বর মাস, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্মরণের মাস।

অন্য অনেক বিষয়ের মতো সাহিত্যেও কোনো ব্যক্তির দীর্ঘদিনের বিশেষ অবদানের সামাজিক স্বীকৃতির ঘোষিত রূপ হল রাষ্ট্রীয় সম্মান। সম্মানিতকে সমাদর করে রাষ্ট্র নিজে সম্মানিত বোধ করে। আক্ষেপ, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা মানিক কখনও রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাননি, সাহিত্য সম্মান বা পারিতোষিক, কিছুই জোটেনি।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রাষ্ট্রসম্মান বঞ্চিত।

হয়তো কলকাতার উদাসীন মানুষের মাঝারি বিচার - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়দের খোঁজ পায় না। হয়তো মাঝারি মাপের মানুষের বৌদ্ধিক অনুদারতায় অর্থাভাবে মৃত্যু হয় বাংলার জোতিষ্করদের। অবশ্য তাঁদের মৃত্যুর পরে জোটে হুজুগে ভিড়, পাথরসম ফুলমালা।