আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪৩১
প্রবন্ধ
ডোমকাহিনি
সৃজা মণ্ডল
'ভিটার উপর পাতাহীন মৃতপ্রায় গাছগুলি বিকলাঙ্গ কুষ্ঠীর মতো দাঁড়াইয়া আছে। এখানে ওখানে ছড়ান রহিয়াছে কয়লা, অর্ধদগ্ধ অস্থি ও মানুষের মাথার খুলি'।
'ডোম' শব্দটি শুনলেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে শ্মশানভূমির এই দৃশ্যপট। কিন্তু ডোম মানে কি কেবলই মৃতদেহ সৎকারকর্মী? ইতিহাসের ভুলে যাওয়া গল্পে, লোককথায় তার অঙ্গাভরণে রয়েছে শৌর্যের পরিচয়।
'আগডোম বাগডোম ঘোড়াডোম সাজে।
ঢাক মৃদঙ্গ ঝাঁঝর বাজে।।'
এই ছড়ায় লুকিয়ে রয়েছে ডোমদের বীরত্বের আখ্যান। আগডোম মানে অগ্ররক্ষী ডোম সৈন্যদল, বাগডোম অর্থাৎ পার্শ্বরক্ষী সেনা এবং ঘোড়াডোম হল অশ্বারোহী সৈন্যদল। বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের, রাজনগরের সামন্তরাজাদের ডোমসেনা ছিল। ঝাড়গ্রামের শিলদা অঞ্চল ছিল ডোমদের রাজ্য। রাজধানী ছিল ডোমগড়। সেনাপ্রধানের মতো রাজকর্মচারীর পদও মিলত ডোমদের। ডোমসেনাদের দায়িত্ব ছিল যুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষকে আক্রমণের পথ তৈরি করা, শত্রুর উপর নজরদারি চালানো, যুদ্ধের পরিস্থিতির উপর নজর রাখা। এই ডোম সেনারাই ছিল বাংলার পশ্চিম-সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী।
সাতগাঁ অর্থাৎ সপ্তগ্রামের বাগদি রাজা রূপারাজা ও বর্মনরাজ হরিবর্মার যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল ডোমসেনারা। ডোম জাতি রাঢ় বাংলার সেই সমস্ত তথাকথিত অন্ত্যজ, অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীর শরিক, যারা একদিন নির্ভীক বীরের মতো যুদ্ধ করতেন সমাজের উঁচুতলার রাজা ও সামন্তপ্রভুদের জন্য, যাদের বীরত্বে ভর করেই রাজা, মহারাজারা ইতিহাসে পরাক্রমী বীর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তারপর একদিন এই ডোম সৈন্যদলের সামাজিক প্রয়োজনীয়তা ফুরোল, আর আমাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেলেন এই সেনারা। বঙ্গের প্রচলিত ইতিহাসে ডোমসেনাদের বীরগাথা ঠাঁই পায়নি। এদের বীরগাথা, সীমান্তরক্ষার কাহিনি লুকিয়ে আছে বাংলার ছোট ছোট ছেলেদের খেলার ছড়ায়, আছে লোকসঙ্গীতে, লোকগাথা ও রাঢ় বাংলার মঙ্গলকাব্যে। মধ্যযুগের বাংলার লৌকিক সাহিত্যে এইরকম অনেক ডোম বীরের শৌর্যের কাহিনি আছে।
ডোমদের পূর্বপুরুষ কালুবীর ছিলেন 'লেট' পুরুষ ও 'চণ্ডাল' রমণীর সন্তান। ঐতিহ্যগতভাবে, ডোম সম্প্রদায়ের চারটি উপগোষ্ঠী - 'আকুঁড়িয়া', 'বিশদেলিয়া', 'বাজুনিয়া' এবং 'মঘৈয়া'। এদের মধ্যে 'আকুঁড়িয়া' ও 'বাজুনিয়া' বঙ্গজ বংশোদ্ভুত ডোম হিসেবে পরিচিত। 'বিশদেলিয়া' উপগোষ্ঠী বাংলায় দেখা যায় না। 'মঘৈয়া' উপগোষ্ঠীর আদি নিবাস বিহার ও ঝাড়খণ্ড। আবার, একই জনজাতির উপগোষ্ঠী হলেও 'আকুঁড়িয়া' ডোমদের সামাজিক অবস্থান 'বাজুনিয়া' ডোমদের থেকে উঁচুতে। 'আকুঁড়িয়া' ডোম সম্প্রদায় মূলত কৃষিনির্ভর। 'বাজুনিয়া' ডোম জনজাতি 'বাদ্যকর' ডোম রূপে পরিচিত।
বাংলার ডোমজাতি মূলত বাজুনিয়া গোষ্ঠীর। রাঢ়বাংলার অন্যতম ভূমিপুত্র এই ডোম সম্প্রদায়। বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ায় এদের বাস। বাঁকুড়া-পুরুলিয়ায় কালিন্দী - ডোমেরা নিজেদের পরিচয় দেন কালু ডোমের বংশধর বলে; 'ধর্মমঙ্গল'-এ বর্ণিত মহা-পরাক্রান্ত যোদ্ধা সেনাপতির নাম কালু ডোম - 'কিঙ্কর বীরের বেটা কালু বীর নাম'। ঐতিহ্যের সূত্র ধরে এরা বাঁশ-বেত ইত্যাদির হস্তশিল্প এবং ঢোল কাঁসর-সানাই সমন্বিত যন্ত্রসংগীতশিল্প - দুই পেশাতেই সমান পারদর্শী।
বাজুনিয়া ডোমদের বাজনা ছাড়া কোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান পূর্ণ হয় না। এদের কাঁধের ঢোলই হয়ে ওঠে মূর্তিমান মঙ্গলের প্রতীক। ডোমরা নিজেদের অভাবী পেটের জ্বালাকে চাপা দিয়ে বেসুরো গলায় ঝরিয়ে দেয় মঙ্গলগান। গানে গানেই কামনা করে গৃহস্থের মঙ্গল, নবদম্পতির সুখসমৃদ্ধি, মেয়ে বিদায়ের কান্না, নবজাতকের দীর্ঘায়ু। লেখক মনিশঙ্কর তাঁর 'কালু ডোমের উপাখ্যান' উপন্যাসে তুলে ধরেছেন নবজাতকের দীর্ঘায়ু কামনার অনুষ্ঠানের সূচনায় 'ঢোল মোগলানো'র কথা - 'মানাও... ঘাড় থেকে নামাল ঢোলটা। নিয়মমাফিক প্রথমে বাজাল দু'খাড়ি। তারপরেই ঘরের এয়োতিরা শুরু করল মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান। শালপাতার উপরে ঢেলে দিল একপাই চাল। একটা হরিতকীও। ঢোলে তেল-হলুদ দিয়ে পূজা করল। উপাচার সাজানো কুলো দিয়ে বরণ করল ঢোলটাকে। সমবেত হ্লুধ্বনিতে ভরে উঠল ঘরের উঠোন। মানা উঠে দাঁড়াল। ঢোল গলায় ঝুলিয়ে আবার দিল কাঠি। সুখু কাঁসিতে ধরল তাল।... কালু গাইল,
অবোধ নামিছে কথা বলব দ্যাশে-বিদ্যাশে
ঘটি দিবে না বাটি দিবে দাও গো মনের খুশিতে
কথা বলব দ্যাশে-বিদ্যাশে...।
গিহ শূন্য ছিলেক উদয় হলেক নীলমণি
সাগর গমন করেছিলম আমি
তমারে ধন পাঁইয়ে পাঁইয়েচি নীলমণি।
আইস রে নীলমণি কোলে করি আমি
দিব ক্ষীর সর ননী
আজি কি আনন্দ হলেক নন্দরানি'।।
লোকসংস্কৃতিবিদ আশুতোষ ভট্টাচার্যের লেখায় পাই -
'খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত পাল রাজাদের আমলে তাঁদের (ডোমদের) আধ্যাত্মিক সাধন ভজনের জীবন খুব উন্নত ছিল'।
ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, তখনকার ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের মতো ডোম পণ্ডিতরাও চতুষ্পাঠী, টোলে সংস্কৃত, ব্যাকরণ পাঠ করতেন। এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডোম ছাত্রদের পাশাপাশি ব্রাহ্মণ ছাত্রদের শিক্ষা-গ্রহণের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ কার্নেগি ডোমদের বৃত্তি সম্পর্কে লিখেছেন,
'দেশীয় রাজা ও শাসকগণ ডোম সম্প্রদায়ের মানুষদের যন্ত্রসংগীতশিল্পী হিসেবে নিয়োগ করতেন ও তাঁদের উচ্চ সম্মানে ভূষিত করতেন'।
বিদ্যাচর্চা ও সাংস্কৃতিক সৃজনশীলতার প্রতি অনুরাগ - মধ্যযুগের ডোম সম্প্রদায়ের এরকম মর্যাদাপূর্ণ সামাজিক অবস্থানের অজস্র দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় সমকালীন প্রামাণ্য ইতিহাসে। 'শূন্যপুরাণ'-এর রচয়িতা রামাই পণ্ডিত ছিলেন ডোম সম্প্রদায়ের মানুষ। একথা আজ ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, 'ধর্মমঙ্গল' ও 'ধর্মরাজ'-এর সঙ্গে ডোম সম্প্রদায়ের প্রত্যক্ষ, নিবিড় সম্পর্ক। বৌদ্ধ পাল রাজাদের আমলে ধর্মরাজের পূজাঅর্চনার অধিকারটি ছিল একান্তভাবে ডোম পুরোহিতদের জন্য সংরক্ষিত।
বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের আমলের পরবর্তী কিছু সময় বিভিন্ন আঞ্চলিক বা দেশীয় সামন্ত শাসকদের যুগে সমাজ-সংস্কৃতিতে ডোম সম্প্রদায়ের গৌরবময় পর্বের পরেই হয়তো ক্রমশ তাদের জীবনে নেমে এসেছিল বিপর্যয়, যার প্রধান কারণ হিসেবে একদিকে যেমন উল্লেখ করা যায় পাল-পরবর্তী আমলে উগ্র ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের নিপীড়ন, অন্যদিকে তেমনই উল্লেখ্য, আরও পরবর্তী সময়ের সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকদের শোষণ-শাসন-নিপীড়ন।
H. H. Risley তাঁর 'The Tribes and Castes of Bengal' গ্রন্থে ডোম সম্প্রদায় সম্পর্কে লিখছেন -
'Doms believe their original profession to be the making baskets and mats, and even the menial and scavenging sub-castes follow these occupations to some extent. [...] The Bajunia sub-caste are employed to make highly discordant music at marriages and festivals. His women-folk, however, only perform as musicians at the wedding of their own people, it being considered highly derogatory for them to do so for outsiders. At home the Domni manufactures baskets and rattles for children.'
বিনয় ঘোষ তাঁর 'বাংলার লোকসংস্কৃতির সমাজতত্ত্ব' গ্রন্থে লিখেছেন,
'ঝুড়ি বোনা বাংলাদেশের ডোম জাতির প্রধান পেশা, ...এ শিল্পে, ডোম জাতির পুরুষ, নারী এমনকি শিশুদেরও রয়েছে এক বংশগত দক্ষতা'।
সপ্তদশ শতকে লেখা কেতকাদাসের 'মনসামঙ্গল'-এ বেহুলাকে দেখতে পাই ডোমনি সেজে ধুচুনি, চুবড়ি, হাতপাখা বিক্রি করতে এসেছে নগরে। বেহুলা বলে,
"অতি হীন কূলে জন্ম মোরা ডোম জাতি। ধুচনী চুপড়ি বুনি... ডালা"।
'চণ্ডীমঙ্গল কাব্য'-এও ডোম জাতির জীবিকা নির্বাহের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এইভাবে -
'বিয়নী চালুনী ঝাঁটা
ডোম করে টোকাছাতা।
জীবিকার হেতু এক চিত্তে'।
ডোমদের সামাজিক হীনদশার বর্ণনা প্রসঙ্গে নীহাররঞ্জন রায় লিখছেন,
'ডোম... প্রভৃতিরা গ্রামের বাইরে উঁচু জায়গায় বাস করিতেন, ব্রাহ্মণ প্রভৃতি উচ্চবর্ণের লোকেরা ইঁহাদের ছুঁইতেন না। ...বাঁশের তাঁত, চ্যাঙারি ইত্যাদি তৈরি ও বিক্রয় ছিল ইঁহাদের বৃত্তি'।
একসময়ে যে ডোমরা ছিল বীরের জাত, আজ তারা বাবুদের ঘরে একটা কুলো বা একটা খাঁচি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কেউ দেয় সেরখানেক মুড়ি, কেউ বা আধসের চাল। কখনো মনিবদের ঘরে মুনিষ-কামিন খেতে সব ধান রোয়া পোতা করে। অঘ্রাণে সেই ধানই তুলে দেয় মনিবদের মরাইয়ে।
নৃতত্ত্ব, সামাজিক সংস্কার, আচরণবিধি, ধর্ম, উপগোষ্ঠীগত বিভাজনকে মাথায় রাখলে বাংলার ডোম সম্প্রদায়ের সঙ্গে বহির্বঙ্গের ডোম সম্প্রদায়ের পার্থক্য সুস্পষ্ট। ঐতিহাসিকভাবে এমনকি বর্তমানেও ডোম সম্প্রদায়ের পেশাগত বা সামাজিক অবস্থান ঘিরে ওঠে নানা বিভ্রান্তি। সে কারণে, তার পরিচয়লিপিতে কখনও সে শ্মশান ডোম, কখনও মর্গের ডোম, কখনও রাজন্য-শাসক-পালিত জল্লাদ ডোম, আবার কখনও বা তাকে বহন করতে হয় জমাদার-ধাঙ্গড় ডোমের পরিচিতি। আসলে, আর্থ-সামাজিকতার নিম্নতম বলয়ের বাসিন্দা রূপে চরমতম দারিদ্রের কারণে ডোম সম্প্রদায়ের অনেক মানুষই সময় বিশেষে বাধ্য হয়েছিল তথাকথিত দাস্যপূর্ণ বৃত্তি গ্রহণ করতে।
ডোম সম্প্রদায় অর্থনৈতিক দিক দিয়ে 'দীনের হতে দীন', সমাজের চোখেও 'সবার অধম'। কোনো সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে তাদের উপস্থিতিকে অপবিত্র মনে করা হয় ভদ্রসমাজে। ঔপনিবেশিক শাসকদের বর্ণনায় তাদের গণ্য করা হয় অপরাধপ্রবণ উপজাতি বা 'ক্রিমিনাল ট্রাইব' হিসেবে। বিখ্যাত সমাজকর্মী, ঐতিহাসিক শ্রী রণজিৎ গুহ উল্লেখ করেছেন পঁচাত্তর বছর আগে কেনেডি ডোমদের অবস্থান বর্ণনায় লিখেছিলেনঃ
'ডোম জন্মায় অড়হর খেতে, ছোটবেলা থেকেই সে চুরি করতে শেখে। জীবনের প্রথম থেকেই সে পতিতের মতো ঘুরে বেড়ায়। মাথার ওপর ছাদ ছাড়াই সে বাঁচে, থাকে না পরের দিনের অন্নের কোনো সংস্থান। পুলিশের তাড়নায় জীবনভর সে পালিয়ে বেড়ায় এক শিবির থেকে অন্য শিবিরে। গ্রাম থেকে সে সদাই বহিষ্কৃত।... সে আছে হিন্দু ধর্মের নাগালের বাইরে। সভ্যতার অগ্রগতি তাকে শুধু আরও অবনমনের দিকেই ঠেলে দিয়েছে'।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'কবি' উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র নিতাই ডোম বংশের প্রতিভূ। লেখক লিখছেন,
'এ ডোমেরা বাংলার বিখ্যাত লাঠিয়াল - প্রাচীনকাল হইতেই বাহুবলের জন্য ইহারা ইতিহাসবিখ্যাত। ইহাদের উপাধিই হইল বীরবংশী। নবাবী পল্টনে নাকি একদা বীরবংশীরা বীরত্বে, বিখ্যাত ছিল। কোম্পানির আমলে নবাবী আশ্রয়চ্যুত হইয়া দুর্ধর্ষ যুদ্ধব্যবসায়ীর দল পরিণত হয় ডাকাতে'।
একাধিক গবেষক বারবার ডোমদের পরিচয়লিপিতে সেঁটে দিয়েছেন নিম্নতম তথা প্রান্তিকতম 'অন্ত্যজ' ছাপ। ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজ গবেষক Wise-এর ভাষায় -
'By all classes of Hindus, the Dom is regarded with both disgust and fear, not only on account of his habits being abhorrent and abominable, but also because he is believed to have no humane or kindly feelings'.
বলা বাহুল্য, এ ধরনের বহুল প্রচারিত জাতি-বিবরণীর চাপে বিশেষজ্ঞ পর্যালোচনায় প্রায়শই উহ্য থেকে যায় ডোম সম্প্রদায়ের হস্তশিল্প দক্ষতা তথা লোকায়ত শিল্পমনস্কতা ও সাংগীতিক যন্ত্রকুশলতার মতো বিরল, উন্নততর ও নান্দনিক চারিত্র বৈশিষ্ট্যের মূল্যবান তথ্যানুসঙ্গ।
গ্রামীণ সমাজে আজও ডোমরা দরিদ্রের মধ্যে দরিদ্রতম এবং সামাজিক বর্ণবিন্যাসে তাঁরা নিম্নতম শ্রেণিভুক্ত। সব প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁরা আজও ধরে রেখেছে তাঁদের ঐতিহ্যপূর্ণ পেশা - বাঁশ-বেত-বাখারির শিল্পকর্ম। বাদ্যযন্ত্র চর্চার ঐতিহ্যে লেগেছে আধুনিকতার স্পর্শ। পুজো পরবে ঢাক-কাঁসি-সানাই-এর পাশাপাশি প্রায়শই শোনা যায় ডোম শিল্পী পরিবেশিত ড্রাম-সাইড্রাম-ক্ল্যারিওনেট-ব্যাগপাইপের ঐকতান, যা ব্যান্ডপার্টি নামে পরিচিত। তবুও এ ধরনের বাদ্যানুসঙ্গ তাঁদের সাময়িক উপার্জনের উৎস মাত্র, আজও তা নিয়মিত আয়ের উৎস হতে পারেনি। যেমন বেলপাহাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত বামুনডিহা গ্রামের ডোমপাড়া। সন্ধ্যে নামলেই অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে গোটা গ্রাম। ঘরে ঢুকে পড়ছে চিতি সাপ। লেখাপড়া করতে পারছে না ছেলেমেয়েরা। কারণ, চড়া দামে বাজার থেকে কেরোসিন তেল কেনারও সামর্থ্য নেই তাদের। বাসিন্দারা মূলত বাঁশ থেকে ঝুড়ি সহ বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করে তা বিক্রি করে সংসার চালান। বাঁশের কাজ করার পাশাপাশি দুর্গা পুজো সহ বিভিন্ন পার্বণে ঢাক বাজান। তবে লাউড স্পিকার, মাইকের দাপটে এখন দুর্গা পুজো বাদে অন্যান্য সময়ে তেমন ঢাক বাজানোর বায়না পান না। ডোমপাড়ার বাসিন্দাদের কথায়, আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে তাঁরা বাধ্য হচ্ছেন ঢাক বন্ধক দিতে। এদিকে বাঁশের দাম ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। একটা বাঁশ থেকে চার থেকে পাঁচটা ঝুড়ি হয়। তা ত্রিশ থেকে চল্লিশ টাকা দরে বিক্রি করেন। ঝুড়ি বিক্রি করে দেড়শো থেকে দুশো টাকা হাতে থাকে। কিন্তু সংসার নির্বাহ করে সেই বাঁশও তাঁরা কিনতে পারছেন না। একপ্রকার বাধ্য হয়ে সারাদিন ধরে জঙ্গল থেকে এক ধরনের লতা সংগ্রহ করে সন্ধ্যের পর তা' দিয়ে ঝুড়ি বানাচ্ছেন। ফলে বর্তমানে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটজনক।
হতদরিদ্র ডোমদের বিভিন্ন রকম রোষানলে পুড়তে পুড়তে বাঁচতে হয়, তাঁরা জানে এটাই তাদের ভবিতব্য, দেবতার অভিশাপ তাঁরা মেনে নেয়, ধর্মরাজের থানে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে, বিপদ থেকে উদ্ধারের প্রার্থনা জানায়, আর মনে মনে ভাবে কেউ হয়তো পৃথিবীতে নেমে আসবে তাদের শাপমুক্ত করতে, যেমন একদিন এসেছিল তাদের পূর্বপুরুষ কালুবীর।
একবিংশ শতাব্দীর এই প্রযুক্তি-বিপ্লবের যুগেও, ডোমরা বাস করেন এক অন্য মানসবৃত্তে, এক পৃথক আখ্যানের জগতে। তাঁরা আশ্রয় খোঁজেন তাঁদের নিজস্ব মানসিক পরিসরে। তাঁদের নিজস্ব সৃষ্টি-পুরাণ আর দেব-দেবী কল্পনায় তাঁরা মানসিক শান্তি পায়। কখনও-বা নিজেদের বংশধারাকে যুক্ত করেন কোনো পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক রাজকাহিনির সঙ্গে। যেমন উত্তর কলকাতার চিৎপুরের রামবাগানে ডোমপাড়ায় যারা বাঁশের কাজ করেন, তাঁদের বক্তব্যঃ "আমরা কিন্তু ডোম নই। আমরা বাঁশের কাজ করি। শ্মশানের ডোমেদের জন্য বাঁশ চ্যালা করি, ধাঙড়-মেথরদের জন্য বাখারি তৈরি করি। তাই লোকে আমাদের বলে ডোম। কিন্তু আসলে আমরা হরিশচন্দ্রবংশ"। আবার শ্মশানঘাটের ডোমেরা শোনান হরিশচন্দ্র পুরাণের কালু বা কালুয়া ডোমের কাহিনি। দানবীর রাজা হরিশচন্দ্রের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক অবশ্য সকলেই গর্ব করে প্রচার করেন।
দলিত সমাজের ডোম সম্প্রদায় এইসব কাহিনিকে সযত্নে তাঁদের মনের ভেতর লালন করেন। ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিবাদ হয়তো সবসময় উচ্চকিত নয়, কিন্তু আখ্যানের অন্তর্লোকে নিভৃত থাকে প্রতিবাদের স্বর; আর থাকে প্রচ্ছন্ন গর্ববোধ আর স্বাতন্ত্র্য চেতনা। তাই 'কবি' উপন্যাসে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়-এর লেখনিতে পাই -
'নিতাই ডোম শ্রেণীবিভক্ত সমাজে তথাকথিত ছোটজাত হয়েও আপন জাতের হীনতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত নয়। বরং রাজনের প্রতি নিতাই-এর সংস্কারহীন বলিষ্ঠ উচ্চারণ প্রমাণ করে নিতাই মানবতার ধর্মে বিশ্বাসী -
...ডোমেই বা লজ্জা কি? ডোমই বা ছোট কিসে? ডোমও মানুষ বামুনও মানুষ'।
তথ্য সহায়তাঃ
● H. H. Risley. 1891. The Tribes and Castes of Bengal. Calcutta: Bengal Secretariat Press.
● M. Kennedy, Notes on the Criminal Classes in the Bombay Presidency (Bombay, 1908); Briggs, p. 147.
● কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ। ১৯৬১। মনসামঙ্গল। বিজনবিহারী ভট্টাচার্য - সম্পাদিত। কলকাতাঃ সাহিত্য অকাদেমি।
● তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৪৩। কবি। কলকাতাঃ মিত্র ও ঘোষ।
● নীহাররঞ্জন রায়। ১৩৫৯। বাঙালীর ইতিহাস। কলকাতাঃ দেজ পাবলিশিং।
● বিনয় ঘোষ। ১৯৫০। পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি। কলকাতাঃ পুস্তক প্রকাশক।
● ভব রায়। ২০১০। বাংলার 'ডোম' সম্প্রদায়। এবং আমরা। ষষ্ঠ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা। কলকাতা।
● মনিশঙ্কর। ২০১৮। কালু ডোমের উপাখ্যান। হুগলীঃ প্ল্যাটফর্ম।
● রমেশচন্দ্র সেন। ডোমের চিতা।
● সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৭। দলিতের পুরাণকথা। কলকাতাঃ অনুষ্টুপ।