আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪৩১

প্রবন্ধ

সেই সময়টা আর পেলেন না সীতারাম

গৌতম হোড়


দিল্লির গোলমার্কেটের কাছে সিপিআই(এম)-এর সদর দফতরে ঢোকার মুখে সেই ছবিটা আর দেখা যাবে না। একজন সিগারেটে সুখটান দিচ্ছেন, আর তাঁকে ঘিরে কয়েকজন সাংবাদিক বা দলের নেতা-কর্মী গল্প করছেন। আর যাঁকে ঘিরে এই সংক্ষিপ্ত বা দীর্ঘ আড্ডা তিনি পুরোটা সময় হাসছেন। এমন মন্তব্য করছেন, যাতে পাশের মানুষগুলিরও হাসি থামছে না। তারপর একসময় তাঁর খেয়াল হচ্ছে, প্রচুর কাজ বাকি পড়ে আছে, তখন বলছেন, "আরে আর গল্প নয়, এবার 'পিপলস ডেমোক্রেসি'-র জন্য সম্পাদকীয় লিখতে হবে অথবা জরুরি ফোন করতে হবে।" তারপর আবার হয়ত কোনও প্রশ্ন বা প্রসঙ্গ এসে যাওয়ায় ধূমপান এবং আরেক দফা আড্ডা। এহেন আড্ডাবাজ সীতারাম ইয়েচুরি চলে যাওয়ার পর সিপিআই(এম) অফিসের এই ছবিটা আর দেখা যাবে না।

কলকাতা থেকে দিল্লি আসার পর এবং সীতারামকে দেখার পর, কথা বলার পর, পরিবর্তনটা লক্ষ্য করেছিলাম। কলকাতায় ভয়ঙ্কর ব্যস্ত, ততোধিক গম্ভীরমুখে থাকা সিপিআই(এম) নেতাদের সঙ্গে ফারাকটা এখানেই ছিল। সীতারাম ইয়েচুরির বৈশিষ্ট্যই ছিল সর্বদা হাসিমুখে কথা বলা। সব রকম বিষয়ে বলা - কোনো প্রশ্ন পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া বা থামিয়ে দেওয়া বা পত্রপাঠ খারিজ করা তাঁর ধাতে ছিল না। কত রকম বিষয়ে আলোচনা করতেন, তার মধ্যে রাজনীতি তো থাকতই, তার সঙ্গে সাম্প্রতিক ও অতীতের সব প্রসঙ্গও। কাস্ট, ক্লাস, সুবিধাবাদী রাজনীতি সহ সব বিষয়। সিপিআই(এম)-এর বেহাল অবস্থা, কেন হাল ফেরানো যাচ্ছে না - সব বিষয়ে উত্তরও আসত খোলাখুলি। সেই জবাব পছন্দ হতে পারে বা না পারে, তাতে কিছু আসে যায় না। এই খোলাখুলি আলোচনাটা হারিয়ে যাচ্ছে। কত বিষয়ে মতপার্থক্য হয়েছে, তিনি হাসিমুখে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন। মজা করেছেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত নিজের মতের পক্ষে যুক্তি দিয়ে গেছেন। অনেক সময় আমাদের বক্তব্য মেনে নিয়েছেন।

তখন আমি 'এই সময়' কাগজে। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিআই(এম) তথা বামেদের জোট বা আসন সমঝোতা হবে কিনা তা নিয়ে প্রচুর জলঘোলা হচ্ছে। সীতারাম ছিলেন জোটের পক্ষে। কিন্তু কেরালা তথা দক্ষিণ ভারতের নেতারা চাননি। প্রকাশ কারাটের রীতিমতো আপত্তি ছিল। তাহলে কী হবে? খবর দরকার। সম্পাদকের নির্দেশ ছিল - ঠিক খবর আগে করতে হবে। সীতারামকে একলা ধরলাম। একা থাকলে বাক্যালাপ হতো মূলত বাংলায়। হিন্দি, ইংরাজি বাদে দক্ষিণের প্রায় সব ভাষা জানতেন সীতারাম। সেই সঙ্গে বাংলাও। বললাম, চাকরির ব্যাপার। একটু বলুন, কী হবে? বললেন, "হয়ে যাবে"। প্রশ্ন করলাম, জোট না আসন সমঝোতা? কীভাবে হবে এই বিরোধিতার মধ্যে? জবাব এল, "সেসব এখন বলব না। সেসব লেখারও দরকার নেই। শুধু লিখে দে, হয়ে যাবে"। তারপর কিছুটা আভাস দিলেন।

লিখে তো দিলাম। তারপর মনে হল, বৈঠক শেষ হলে আবার দেখা করি। রাত সাড়ে ন'টার পর বৈঠক শেষ হল। সবাই চলে গেলেন। সীতারাম আর নামেন না। সাড়ে দশটা নাগাদ সীতারাম বেরোলেন। বললেন, "কী রে এত রাতে কেন"? বললাম, "কী হল, একটু জানতে এসেছি"। বললেন, "যা বলেছি, তাই হবে। কালকের বৈঠকটা হতে দে। তারপর বলব। চিন্তার কারণ নেই, চাকরি থাকবে"। ছুটলাম অফিসে। কপিতে নতুন তথ্য যোগ করতে। পরের দিন কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক। মধ্যাহ্নভোজের বিরতি। আবার ধূমপানের ফাঁকে একান্তে কথা। বললেন, "বলেছি তো, আমরা এখান থেকে কিছু বলব না। আসন সমঝোতা বা জোট নিয়ে কোনও আপত্তি জানাব না। রাজ্য কমিটির উপর ছেড়ে দেব। ওরা তো বলেইছে সমঝোতা করবে। এটা হয়ে গেছে"। বললাম, "এটা সুবিধাবাদী অবস্থান হল না"? বললেন, "রাজ্য কমিটিই তো সিদ্ধান্ত নেয়"। তারপর বললেন, "এতটা যে হয়েছে, সেটা যথেষ্ট নয়"? এবার সিগারেট শেষ। কথাও।

এই সিগারেট ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। যেহেতু ধূমপান করি না, তাই আমাকে একটু দূরে দাঁড়াতে বলতেন। আগে যখন প্ল্যানিং কমিশন ছিল, তখন সেখানে নিয়মিত যেতেন সীতারাম। গেলেই সোজা চলে যেতেন অমিতাভ রায়ের কাছে। সেখানে জানালা খুলে ধূমপান করা যেত। ধূমপান করে তারপর যেতেন অন্যদের সঙ্গে দেখা করতে।

কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার কথায় ফিরি। কীভাবে অসাধ্যসাধন করেছিলেন সীতারাম, সেটা অন্য কাহিনি। তার প্রথমবার সাধারণ সম্পাদক হওয়া এবং দ্বিতীয়বার আবার হওয়াটাও তো সেই চমৎকারের মধ্যে পড়ে। তখনও একইরকম আত্মবিশ্বাসী ছিলেন সীতারাম।

তবে তাঁর তীক্ষ্ণ যুক্তি, ক্ষুরধার বক্তব্য বারবার দেখা গেছে যখন তিনি রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন। তখন বেরিয়ে আসত সেই সীতারাম যিনি দেশের প্রমুখ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন৷ তাঁর বিষয় ছিল অর্থনীতি, অর্থনীতি তো বটেই বিভিন্ন বিষয়ে নিরন্তর ছিল তাঁর পড়াশুনা। সেসময় বিতর্ক করা ছিল তাঁর নেশা। পরে সেটাই কাজে এল। যুক্তিতথ্যের উপর ভিত্তি করে সংসদে তাঁর ভাষণ আলোড়ন তুলত।

তিনি অন্যদের রাজনীতির পাঠও পড়াতেন। দলের প্রশিক্ষণের কথা বলছি না - দলের বাইরে অন্যদের। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম হল রাহুল গান্ধী। এই নিয়ে সাংবাদিকরা সীতারামকে প্রচুর প্রশ্ন করেছেন। প্রতিবারই মজা করে এড়িয়ে যেতেন। একান্তে জিজ্ঞাসা করলে জবাব মিলত, "আরে না না, কিছু বিষয় জানতে চেয়েছিল। আমার মতো করে বুঝিয়েছি৷"

সোনিয়া ও রাহুলকে এই বোঝানোটা যে কতটা কার্যকর ছিল, তা ২০০৪ সালে ইউপিএ গঠন এবং কর্মসূচি তৈরি থেকে স্পষ্ট। গত নির্বাচনেও রাহুল তথা কংগ্রেসের কৌশলে সীতারামের পরামর্শের স্পষ্ট ছাপ ছিল। এই বিষয়ে তাঁর প্রাক্তন সহকর্মী সইফুদ্দিন চৌধুরীর মতো সীতারামও মনে করতেন, রাজনৈতিক দিক থেকে বিজেপি তাদের কাছে প্রধান শত্রু। তাই তাকে আগে ঠেকানোর কৌশল নেওয়া দরকার। সেকারণেই কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলানোটা জরুরি বলে সীতারামের মত ছিল। বাধা এলেও দলকে সেই পথে চালিত করতে পেরেছেন।

তবে যেটা পারেননি, সেটা হল, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় দলের হাল ফেরাতে, দেশের অন্য জায়গায় নির্বাচনী সাফল্য এনে দিতে। সেই কষ্টটা তাঁর সঙ্গী ছিল। প্রশ্ন করলে বলতেন, "কঠিন কাজ। এর জন্য সময় লাগবে। মানুষের ধারণা বদলের কাজে সময় লাগে"। নিঃসন্দেহে খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু সেই সময়টা আর পেলেন না সীতারাম।