আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪৩১

প্রবন্ধ

ফাঁস হোক প্রাতিষ্ঠানিক চক্রান্তের জাল

পার্থপ্রতিম বিশ্বাস


উত্তরের 'ভোর দখল' থেকে দক্ষিণের 'রাত দখল' এক অদ্ভুত অধ্যায়ের সাক্ষী হচ্ছে রাজ্যের মানুষ প্রতিদিন। এক মাস অতিক্রান্ত। আর জি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসক খুনের বিচার চেয়ে আন্দোলনের ঢেউ উপচে পড়ছে শহর-শহরতলি থেকে গ্রাম বাংলার পাড়ায় পাড়ায়। 'We want justice' শব্দবন্ধের ধ্বনি প্রতিধ্বনিতে উদ্বেল হয়ে উঠেছে বাংলা। রাজনীতির রঙের ছোঁয়া এড়িয়েই আমজনতার ক্রোধের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ ছড়িয়ে পড়ছে 'রাত দখল' থেকে পথ দখল করা মানুষের মধ্যে। ইতিমধ্যে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের চাপে স্বাস্থ্য ভবনের অবস্থান মঞ্চে হাজির হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু স্বচ্ছতার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার টেবিলে বসতে নারাজ সরকার। ফলে আন্দোলনের জট দীর্ঘায়িত হয়ে চলেছে।

প্রতিবাদেও চক্রান্ত

ইতিমধ্যে রাজ্যের শাসকদল বিরোধীদের 'চক্রান্ত' রুখতে রাজ্যের সর্বত্র আওয়াজ তুলেছে 'We want justice'। রাজ্যে পঞ্চায়েত, পুরসভা থেকে শুরু করে লোকসভা, বিধানসভা সর্বত্র নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী সেই দল রাজ্যের সরকার চালাচ্ছে বাছা বাছা বাঘা বাঘা আমলাদের দিয়ে। অথচ এক সরকারি হাসপাতালে মধ্যরাতে একত্রিশ বছরের এক তরুণী চিকিৎসকের হত্যা রহস্য উন্মোচন করতে ব্যর্থ প্রশাসন। আর শাসকদলের নেতা মন্ত্রীরা বিচারের দাবিতে গলা ফাটাচ্ছেন রাজপথে নেমে। এর চেয়ে বড় হাসির খোরাক কী হতে পারে! ইতিমধ্যে কলকাতার পুলিশ প্রতিবাদীদের শায়েস্তা করতে ডাক্তারদের, ছাত্র-যুবদের, এমনকী নিজের দলের বেসুরো বর্ষীয়ান সাংসদকে লালবাজারে ডেকে পাঠাচ্ছেন। গ্রেফতার করেছেন বাম যুব আন্দোলনের নেতাকে - সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্রের প্রমাণ হিসাবে এক অডিও ক্লিপকে হাতিয়ার করে। সেই অডিও জাল নাকি নির্ভেজাল তা প্রমাণেরর আগেই গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। এক বছরেও কালীঘাটের কাকুর কণ্ঠস্বর প্রমাণ করতে পারেনি পুলিশ; তাঁরাই এক দিনে কণ্ঠস্বরের প্রমাণ যাচাই করে গ্রেফতার করেছে। রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী দলের নেতাকর্মীদের বার্তা দিয়েছেন বিরোধীদের প্রতিবাদে 'ফোঁস' করে ওঠার জন্য। কিন্তু প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজ্য জুড়ে গড়ে ওঠা এই অভূতপূর্ব গণ আন্দোলন সেই ফোঁসের সামনে আরও বেশি স্পর্ধায় ফুঁসে উঠছে।

আর জি করঃ প্রাতিষ্ঠানিক ষড়যন্ত্র

ইতিমধ্যে এমন হত্যা রহস্যে শাসকদলের ঘনিষ্ঠ সেই হাসপাতালের অধ্যক্ষ এবং পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা এই অপরাধের ব্যাপ্তিকে বাড়িয়ে তুলেছে। নির্যাতিতার মা-বাবার ভাষ্য অনুযায়ী পুলিশের বড়কর্তারা সেই চিকিৎসক খুনের ব্যাপারে মোটা টাকা দিয়ে তাঁদের মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা করেছিলেন। এখানেই প্রশ্ন এই চিকিৎসক খুন আড়াল করতে পুলিশের কেন এত আগ্রহ? স্পষ্ট হচ্ছে এমন খুনের পেছনে অবশ্যই জড়িয়ে রয়েছে কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা চক্র। স্পষ্ট হচ্ছে সেই কারণে এমন হত্যাকে হাসপাতাল প্রথম থেকেই আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টায় ছিল! আরও স্পষ্ট হচ্ছে যে সেমিনার রুমের আশপাশের প্রমাণ লোপাটের জন্যই কি তাহলে খুনের পর অধ্যক্ষ পূর্ত দপ্তরকে দিয়ে সেই ঘর ভাঙিয়েছিলেন? অথচ এমন ভাঙচুরের ঘটনায় প্রমাণ লোপাট হবে জেনেও কেন চুপ ছিল পুলিশ? কেন একবারের জন্যও সেই অধ্যক্ষকে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি পুলিশ? এমনকী তরুণীর মৃত্যুর পরেও তাঁর মৃতদেহ ঘিরে থাকা মানুষদের পরিচয়-বিভ্রান্তি ঘটিয়ে ছবি এডিট করে এই হত্যা তদন্তকে বিপথে চালনার চেষ্টা করে গেছে পুলিশ। আর এই সবকিছুই হয়েছে পুলিশের সদর দপ্তরে থাকা কর্তাদের নির্দেশেই। কিন্তু এতকিছুর পরেও উত্তরে 'স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের' বড় কর্তা জানিয়েছেন, গত এক মাস ধরে চলা শহরের উথাল পাথাল পরিবেশেও তিনি তাঁর নিজের কাজে খুশি। এমন প্রেক্ষিতে গোটা রাজ্যের মানুষ যখন পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকায় ক্ষোভে যন্ত্রণায় ফুটছে তখনও যদি পুলিশ কমিশনার স্বস্তিতে থাকেন তাহলে সেই কারণেই অমন বেআক্কেলে কমিশনারের চেয়ার খোয়ানো উচিৎ। জনসমক্ষে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলে চলেছেন দোষীদের ফাঁসির সাজা অথচ তাঁর নেতৃত্বে চলা রাজ্যের পুলিশ প্রশাসন অপরাধের প্রমাণ লোপাটে ব্যস্ত।

শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সিন্ডিকেট

অভিযুক্ত আর জি করের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগ হাসপাতালের ডেপুটি সুপার স্বাস্থ্য দপ্তর এবং মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে করলেও পুলিশ কোনো সদর্থক ভুমিকা পালন করেনি। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও চাকরি প্রার্থী পড়ুয়ারা 'whistle blower'-এর ভুমিকা পালন করলেও সরকারের শিক্ষা দপ্তর সেই দুর্নীতি ধরতে যেমন নিস্পৃহ ছিল ঠিক তেমনটাই হয়েছে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালে দুর্নীতি ধরার প্রশ্নে। উপরন্তু মৃতদেহ থেকে হাসপাতালের বর্জ্য, পড়ুয়াদের নম্বর থেকে কলেজের যন্ত্রপাতি, সবেতেই দুর্নীতির শিরোমণিকে আন্দোলনের জেরে আর জি কর থেকে সরিয়ে কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের মাথায় নিয়ে বসিয়েছিলেন খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী। কেবল অধ্যক্ষ নয় তাঁর অনুগামী ডাক্তারদের নিয়ম ভেঙে বদলি, প্রমোশন, কাটমানি, তোলাবাজী সবেরই কুশীলব ছিল শাসক আশ্রিত এমন মাফিয়া ডাক্তারেরা। কার্যত হাসপাতালে সন্দীপ, প্রাথমিক শিক্ষায় মানিক এবং উচ্চশিক্ষায় সুবিরেশবাবুদের মতো মানুষেরা মাফিয়াদের মতো করে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট ব্যবস্থা কায়েম করে দুর্নীতি চক্র গড়ে তুলেছিলেন। ফলে আজ হাসপাতালে মধ্যরাতে কর্মরতা চিকিৎসকের মৃত্যু মামুলি খুন নাকি এক প্রাতিষ্ঠানিক অপরাধ সেই প্রশ্নটাই এখন মানুষের মনে গেঁথে বসেছে।

তদন্তে আটকে বিচার

রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠে 'We want justice' বাক্যবন্ধ আপাতদৃষ্টিতে অরাজনৈতিক এক সাধারণ দাবি মনে হলেও তার আড়ালে নিহিত রয়েছে নির্যাতিতার বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে যাবতীয় রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জগুলি। সরকারি ব্যবস্থায় তদন্তে কালবিলম্বের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ক্ষোভের বহর বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে ন্যায্য বিচার দ্রুত পাওয়ার জেদ। সেই হত্যার এক মাস অতিক্রান্ত অথচ রাজ্যের পুলিশের থেকে সিবিআই-এর হাতে তদন্তভার যাওয়ার পরেও উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। মানুষ অভিজ্ঞতার বিনিময়ে বুঝেছে যে সুবিচারের লক্ষ্যে প্রয়োজন দ্রুত, স্বচ্ছ এবং কার্যকরী তদন্ত। তদন্ত বিলম্বিত হলে আখেরে সুবিচার বিলম্বিত হয়। আর সেই ফাঁক গলে দোষীরা সমাজে ঘুরে বেড়ায় কলার উঁচিয়ে। কিন্তু এক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব যে প্রশাসনের ওপরে সেখানে 'সরষের মধ্যে ভূত' থাকলে বিচারের নামে প্রহসনের সম্ভাবনা প্রবল। এমন প্রেক্ষিতে প্রশাসনের এই অন্যায় অনাচারের অবসানের পথ চেয়ে মানুষ এখন দেশের বিচার ব্যবস্থার দিকে তাকিয়ে। কিন্তু রাজ্যের চাপান-উতোরে বিলম্বিত বিচারের কোপে পড়ে এমন বহু বড় বড় প্রাতিষ্ঠানিক অপরাধের নিস্পত্তি আজও করেনি সিবিআই।

আন্দোলনে দখলদারি

ইতিমধ্যে এই আন্দোলনের দখলদারি কায়েমের চেষ্টা শুরু হয়েছে পদ্মফুল শিবিরে। রাজ্যে এতকাল খুন ধর্ষণ হলেই কেন্দ্র বনাম রাজ্যের নারী সুরক্ষা কমিশনের চেনা ছকের তর্জায় আসল ঘটনা হারিয়ে যেত ঘাসফুল বনাম পদ্মফুলের আবর্তে। কিন্তু প্রতিবাদের নামে এই নিম্নরুচির সার্কাস দেখতে দেখতে ক্লান্ত মানুষ রাজনীতির চেনা ছকের বাইরে এবার প্রতিবাদের ভিন্ন পথ ভিন্ন ধারা বেছে নিয়েছে। এমন অবস্থায় মাঠের বাইরে দাঁড়ানো ম্যাচ রেফারীর হাল হওয়া রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি ভোটের অংকে থাবা বসাতে খেলোয়াড় সেজে আন্দোলনের মাঠে নেমেছে। ছদ্মনামে নবান্ন অভিযানের মেকি ডাক কিংবা দলীয় ব্যানারে বাংলা বনধ-এর ডাক কার্যত হয়ে উঠেছে তাঁদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির পথ। সেটা বুঝেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে বিজেপির বিভাজন তৈরির পথে পা মাড়ায়নি রাজ্যের মানুষ। ফলে এই বন্ধ কিংবা নবান্ন অভিযানকে কেন্দ্র করে আবার যে বাইনারি রচনার চেষ্টা হচ্ছিল সেটাও ভেস্তে গেছে। বিজেপি আদর্শগতভাবেই মহিলাদের সমানাধিকারের বিরুদ্ধে। তাই মনুবাদে বিশ্বাসী দলের প্রধানমন্ত্রী মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন মনিপুরের মতো নৃশংস নারী ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনাতে। সেই কারণেই বিলকিস বানোর ধর্ষকেরা আদালতের রায়ের পরেও জেল থেকে মুক্তি পায় গুজরাতের ডবল ইঞ্জিন সরকারের ষড়যন্ত্রে। সেই কারণে মহিলা ক্রীড়াবিদদের যৌন নির্যাতনে অভিযুক্ত বিজেপি নেতা ব্রিজভূষণ সসম্মানে বহাল থাকে নিজ পদে। সেই দিক থেকে দেখলে হাঁসখালি অথবা হাথরাস কিংবা উন্নাও অথবা কামদুনির প্রশাসনের মধ্যে ফারাক সূচ এবং চালুনির ছিদ্রের মতো।

রাজ্যজুড়ে একুশে আইন

ইতিমধ্যে রাজ্য সরকার যুদ্ধকালীন তৎপরতায় খুন-ধর্ষণের দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়ার লক্ষ্যে নতুন আইন 'অপরাজিতা' পাশ করেছে রাজ্য বিধানসভায়। কার্যত আর জি কর কাণ্ডে রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনের ব্যর্থতা আড়াল করে জনরোষ প্রশমিত করার কৌশল হিসাবেই আনা হয়েছে এই নতুন আইন। রাজ্যের রাজ্যপাল বিধানসভায় পাশ হওয়া সেই আইনের বহু ত্রুটি আবিষ্কার করে সেটি পাঠিয়েছেন রাষ্ট্রপতির দপ্তরে। এই ডামাডোলের বাজারে রাজ্য সরকার নতুন আইন এনে প্রমাণ করতে চাইছে উপযুক্ত আইন না থাকার কারণেই যেন এই তদন্ত কিংবা সাজা দেওয়ার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। কিন্তু দেশের চালু আইনেই ধর্ষণের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও বিভিন্ন অপরাধে প্রশাসনিক গাফিলতি, অনীহা এবং পেশাদারিত্বের অভাবে দোষীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। রাজ্যের কামদুনি ধর্ষণ মামলাতেও নিম্ন আদালতে ফাঁসির সাজা পাওয়া আসামিদের উচ্চ আদালতে বেকসুর খালাস কিংবা সাজা হ্রাস হয়েছে পুলিসি তদন্তের গাফিলতির কারণে। আর সেই গাফিলতি যে ইচ্ছাকৃত রাজনৈতিক কারণেই সেটা বোঝা যায় অভিযুক্তদের সঙ্গে শাসক ঘনিষ্ঠতার সূত্র ধরে। বিচার বিলম্বিত কিংবা উপেক্ষিত হয় আইনের অভাবে নয়, আইন প্রয়োগে সরকারি সদিচ্ছার অভাবে।

নেতৃত্বে প্রতিবাদী মেয়েরা

আমজনতার প্রতিদিনের আন্দোলনের মেজাজে মাননীয়া টের পেয়েছেন যে আর জি করের প্রতিবাদ আর কেবল এক ডাক্তারের মৃত্যুর ঘটনায় আটকে নেই বরং সেই পুঞ্জীভূত মানুষের ক্ষোভ দ্রুত সরকারের প্রতি অনাস্থায় রূপান্তরিত হচ্ছে। বিশেষত এই প্রতিবাদী আন্দোলনে নারীদের অগ্রণী ভূমিকা আন্দোলনকে ভিন্ন মাত্রায় উত্তরণ ঘটিয়েছে। বাংলার মেয়েদের রক্তের তেজে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে শাসকের। ফলে এযাবৎ রাজ্যের শাসকদল সরকারি প্রকল্পের বৃহত্তম উপভোক্তা হিসাবে যে নারীশক্তিকে 'মহিলা ভোটার' বানাতে চেয়েছিল প্রতিবাদের প্রবল ঢেউয়ে এবার তাঁরাই ভেস্তে দিয়েছে শাসকের চেনা সমীকরণের ছক। এটাই এই সময়ের বড় প্রাপ্তি।