আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪৩১
প্রবন্ধ
সরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং একটি ধর্ষণ ও মৃত্যু
সায়ন পাল
সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার মৃত্যু ঘটেছে বেশ কিছুদিন হল। তার শবদেহ সাদা চাদরে ঢেকে কাজ চলছিল এতকাল। আর জি কর-এ কর্মরত অবস্থায় 'অভয়া'র নৃশংসভাবে ধর্ষিতা ও খুন হওয়ার ঘটনা এই সাদা (বাংলার ক্ষেত্রে নীল-সাদা) চাদরটা এক ঝটকায় সরিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পচাগলা শবদেহ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। যদি সমস্যার গভীরে যাই তাহলে একটু পরিসংখ্যানের দিকে চোখ রাখতে হবে। দশকের পর দশক, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থেকে নীতি আয়োগ, স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ সেই দুই শতাংশ। পরিকাঠামোহীনতা, স্বাস্থ্য কর্মীদের বেতন, সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য, বেসরকারি পুঁজির সাথে প্রতিযোগিতায় স্বেচ্ছা পরাজয়, এই মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করেছে অনেকদিন। যেটুকু আছে সীমাহীন দুর্নীতি তাও কুরে কুরে খাচ্ছে।
ব্যক্তিগতভাবে সরকারি মেডিকেল কলেজে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার বাম আমলে। স্বজনপোষণ, অবিচার, অন্যায় সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, বিরুদ্ধ মতকে গায়ের জোরে থেঁতলে দেওয়া সে আমলেও ছিল। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক পালাবদলের সাথে এই দলতান্ত্রিক ব্যবস্থার খানিক 'পরিবর্তন' হল। খোলনলচে বদলে ফেলার চেষ্টা মোটেও হল না। সুষ্ঠু কাজের পরিবেশ, পরিকাঠামো, বেতন ও সুযোগ-সুবিধার পরিবর্তে দেওয়া হল দুর্নীতি করবার ঢালাও সুযোগ। ঠিক যেমনি ডিএ-র বদলে বাড়িয়ে দেওয়া হল ছুটি। একটা দুর্নীতিবাজ গোষ্ঠী তৈরি হল যারা এই গোটা ব্যবস্থাটাকে এমনভাবে রাখবে যাতে কেউ টুঁ শব্দটি না করতে পারে। কিছু কিছু সুযোগ দেওয়া হল আনুগত্য আর অর্থের বিনিময়ে (খবরে যা প্রকাশ)। পছন্দসই জায়গায় পোস্টিং, কলকাতা থেকে দূরে পোস্টিং হলে সপ্তাহে দু'দিন গিয়ে কাজ চালানো, বাইরে প্র্যাক্টিস করার এবং সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী বাইরে নিয়ে চিকিৎসা করা ইত্যাদি। এসব সুবিধার বিনিময়ে আদায় করা হল আনুগত্যের অঙ্গীকার। এই গোষ্ঠী হয়ে উঠল সর্বশক্তিমান, এদের কার্যনির্বাহক হিসেবে নিযুক্ত হল ছাত্র, জুনিয়র ডাক্তারদের কিছু অনুগত ক্যাডার। অপরিসীম তাদের ক্ষমতা। এতটাই যে একজন বিভাগীয় প্রধান একটি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ছাত্রকে অনুরোধ করেন তাঁকে যেন কলকাতায় বদলি করে দেওয়া হয়। সেই ছাত্রটি আবার কনভোকেশনে ডিগ্রি প্রদান করে। ক্ষমতার দম্ভ বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় পৌঁছে যায় যে সে আর কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করে না। দুর্নীতি নাকি শুরু হয়েছিল এমবিবিএস-এর পরীক্ষায় পাশ ফেল নিয়েও। জুনিয়র ডাক্তার যাদের মেরুদণ্ড এখনও বিক্রি হয়নি (যৌবনের শক্তি হয়ত বা) তারা মাঝে মাঝে প্রতিবাদ করেছেন। তা সে প্রতিবাদ আমাদের মতো সিনিয়র ডাক্তার যারা সরকারি হাসপাতাল-এর সাথে যুক্ত নয় তাদের কানেই পৌঁছতে পারেনি, সাধারণ মানুষ তো দূরস্থান। আসলে আমরা ঠিক সেইভাবে এসব নিজেদের দৃষ্টির বাইরে রেখেছিলাম, ঠিক যেভাবে ভিখারি পথশিশুকে না দেখেই বাবু-বিবিরা পার্ক স্ট্রিট-এর ঝাঁ চকচকে রেস্তোরাঁয় ঢুকে যান অবলীলায়।
অভয়ার ধর্ষণ ও খুন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার শবদেহ থেকেই শুধু নয়, কাপড় খুলে নিয়েছে আপামর বাঙালি ভদ্রসমাজের। যে দুর্নীতি, যে অরাজকতাকে আমরা দেখতে চাইনি সে হঠাৎ আমাদের ঘরে ঢুকে পড়েছে এবং আমাদের সাজানো সংসার তছনছ করে দিয়েছে। প্রথমত কর্তব্যরত অবস্থায় ধর্ষিতা ও খুন হওয়া এবং দ্বিতীয়ত তারপর তথ্যপ্রমাণ লোপাটের প্রশাসনিক প্রচেষ্টার সাথে আইনরক্ষক পুলিশের সক্রিয় সহযোগিতার অভিযোগ কাঁপিয়ে দিয়েছে আমাদের মর্মমূল। প্রতিবাদ উঠে এসেছে মোটামুটি সমাজের সব স্তর থেকেই এই লড়াই-এর অভিমুখ হওয়া উচিত দুটোঃ এক, দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো উন্নতি, ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধি, দুই, যে সমাজব্যবস্থা ধর্ষণকে নারী-স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, নারীকে শৃঙ্খলিত করতে চায় নানাপ্রকারে সেই সমাজব্যবস্থার অবসান।
একটা কথা মনে রাখা দরকার অনেকে হয়ত দুর্নীতির বা বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে কিন্তু একই সঙ্গে পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাধারী। এই বিরুদ্ধ মানসিকতার বর্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্নীতিপরায়ণ শাসকের অপসারণ কিন্তু সাম্প্রদায়িক শক্তির আহ্বান নয়। ধর্মের নামে নারীকে শৃঙ্খলিত করার বিরুদ্ধেও এই আন্দোলন। তা সে ঘোমটাই হোক কি বোরখা। এই আন্দোলনে মানুষ এসেছেন মনুষ্যত্বের তাগিদে, তাই মনুষ্যত্ব জাগ্রত করাটা প্রাথমিক প্রয়োজন। তবেই লড়াই সার্থক।
ধর্ষককে চিনে নেওয়ার সাথে সাথে ধর্ষকামী মানসিকতাকেও চিনে নেওয়া প্রয়োজন। সমাজের আমূল সংস্কার বিবর্তনের মাধ্যমে আসবে, এই আশা কম। বিপ্লবের মাধ্যমে আসতে পারে । কিন্তু আমরা ছাপোষা মানুষ আমরা কি বিপ্লব করতে রাস্তায় নেমেছি? না। কিন্তু রাস্তায় নামাটা জরুরি। যতদিন আমরা প্রতিবাদ করব ততদিন এই নরপিশাচরা ভয় পাবে। ভয় পাওয়ানোটা দরকার যাতে দ্বিতীয়বার আর জি কর-এর মতো ঘটনা ঘটানোর চিন্তা মাথায় এলে এরা ভয়ে কাঁপে। ভয় পাওয়ানো প্রয়োজন দুর্নীতিবাজদের। জনগণের সম্পত্তি নয়ছয় করার অধিকার গণতান্ত্রিক সমাজ তাদের দেয় না। এটা বোঝানোর জন্যেও প্রতিবাদ চাই। পরিশেষে বলি সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে আশা রাখতে পারেন ব্যালটের মাধ্যমে 'পরিবর্তন'-এর।