আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪৩১

প্রবন্ধ

'জাস্টিস'-এর সন্ধানে

স্বাতী মৈত্র


স্বাধীনতার প্রাক্কালের রাত। সুকান্ত সেতু ধরতে পারিনি তখনো। রাস্তা যেন একটু বেশিই জনবহুল, রবিবার রাতের হিসাবে। মাঝে মাঝেই দেখছি মহিলারা কাঁধে ঝোলা অথবা ভ্যানিটি ব্যাগ হাতে করে কোথায় যেন যাচ্ছেন।

সঙ্গে থাকা সঙ্গীর সাথে আলোচনা হচ্ছিল, "এঁরা সব কোথায় চললেন"?

এতজন সাধারণ মানুষ, একেবারেই ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা রাত সাড়ে এগারোটার সময় হেঁটে হেঁটে একটি আদ্যোপান্ত (অদলীয় হলেও) রাজনৈতিক উদ্যোগে যোগদান করতে চলেছেন? ঠিক বিশ্বাস হয়নি।

কিছুক্ষণ এগোনোর পর অবশ্য মনে আর কোনো সন্দেহ রইল না। সুকান্ত সেতু মানুষের ঢলে অচল, তারই মধ্যে অসংখ্য মানুষ হেঁটে হেঁটে চলেছেন যাদবপুর ৮বি বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্য। যেই সন্তোষপুর মেইন রোড দিয়ে রাতে চলতে একটু গা ছমছমই করে, তার যেন ভোল পালটে গিয়েছে। সুলেখার মোড় তো নয়, মেলাপ্রাঙ্গণ যেন। হাজারে হাজারে মানুষ, কেউ যাচ্ছেন, কেউ বা ফিরছেন। সন্তানের হাত ধরে মা-বাবা চলেছেন, বাবাকে সঙ্গে নিয়ে মেয়ে এগিয়ে চলেছে, মেয়েদের দল, ছেলেদের দল, জাতীয় পতাকা হাতে রাজনৈতিক দলের কর্মীরা, শঙ্খ হাতে প্রৌঢ়া, ইতিউতি বাইক-স্কুটি বাহিনী ও কিছু হতভম্ব গাড়ি, মানুষের ঢেউয়ে আটকে। পা রাখার জায়গা নেই ফুটপাথে। তারই মধ্যে কেউ গান ধরেছেন, 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে'। বৃষ্টি নামল অল্প, কিন্তু তাতেও মানুষের ভ্রূক্ষেপ নেই, ছাতা হাতে অথবা খালি হাতেই তাঁরা এগিয়ে চলেছেন ৮বি-র মোড়ের দিকে। পিছনে ছাত্রের দল আলোচনা করছে, "জ্যামার লাগিয়েছে মনে হচ্ছে, জ্যামার"। ছাত্রীর দল এক রকম কালো জামা পরে এসেছে, হাতে প্ল্যাকার্ড, 'স্টপ রেপ'।

সঙ্গীকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে সেই ভিড়ের মধ্যেই চেষ্টা করলাম যদি আরেকটু এগিয়ে যাওয়া যায়। যদি মূল মঞ্চের ধারেকাছে যাওয়া যায়। হিন্দুস্থান সুইটস অবধি কোনো রকমে পৌঁছে, বান্ধবী ও তার দলবলকে খুঁজে না পেয়ে, আবারও ফিরে গেলাম ভিড়ের উল্টোদিকে। দেখি এক ভদ্রলোক আসবার চেষ্টা করছেন, স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে, বললাম, "দাদা ওদিকে যাওয়া যাচ্ছে না তো"।

উনি বললেন, "বুঝতেই পারছি, ভাবলাম একটু মনের শান্তির জন্য দেখে আসি"।

'মনের শান্তির জন্য' দেখলাম বুলেভার্ডের রেলিং ধরে মানুষ মোমবাতি লাগাচ্ছেন, সাথে হাতে আঁকা পোস্টার। মুখে মুখে ঘুরছে একটাই স্লোগান, 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস'। স্লোগান দিচ্ছেন এমন অনেক মানুষ, যারা কেউই ঠিক স্লোগানে পটু নয়। ছন্দ মিলছে না, ঠিক জায়গায় স্ট্রেস দেওয়া নেই, রাজনৈতিক কর্মীদের মতন তাল নেই, রিদম নেই, এক অদ্ভুত অপটু কলতানে তাঁরা শুধু বলে চলেছেন, 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস, জাস্টিস ফর আর জি কর'।

এরপর আবারও সুকান্ত সেতু। হেঁটে হেঁটে ফেরবার পথে ভাবার চেষ্টা করছিলাম, ভারতবর্ষে এরকম ধর্ষণবিরোধী গণপ্রতিবাদে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে কি আগে? দিল্লীর ছাত্রজীবনে ঘটে যাওয়া হতভাগ্য জ্যোতি সিংয়ের ধর্ষণ ও খুন পরবর্তী ঘটনা মনে পড়ছিল কিছুটা। মুনির্কা বাস স্টপে 'নাইট ভিজিল', ইন্ডিয়া গেটে মানুষের ঢল, দিল্লী পুলিশের লাঠি। সদ্য ভর্তি হওয়া ছাত্রীরা কলেজে ক্লাস ছেড়ে সে সময় মিছিলে যেত, মুখে মুখে স্লোগান, 'বেহনে মাঙ্গে আজাদী/ বেটিয়া মাঙ্গে আজাদী/ দিন মে ভি আজাদী/ রাত মে ভি আজাদী'।

আজ এক মাস বাদে যখন এই লেখা লিখতে বসেছি, 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস' তখন যাদবপুর ৮বি অথবা অ্যাকাডেমির চত্ত্বর ছাড়িয়ে বাংলা পেরিয়ে প্রবাসী বাঙালিদের হাত ধরে দেশ-বিদেশের জমায়েতে ছড়িয়ে পড়েছে। স্লোগানের বৈচিত্র্য বেড়েছে বৈ কমেনি। কোথাও বা মফস্বলে মেয়েরা বলে উঠেছে, 'দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে হবে?/ পথে নেমে লড়তে হবে!' স্কুলপড়ুয়াদের মুখে মুখে শোনা গেছে, 'ক্লাসে ক্লাসে বলে দিস/ উই ওয়ান্ট জাস্টিস'। বেশ কিছু স্লোগান সরাসরি শাসককে উদ্দেশ্য করে, 'শাসক তোমার কিসের ভয়?/ ধর্ষক তোমার কে হয়?' বাতিল হওয়া ডার্বির পর ময়দানের সমর্থকরা স্লোগান তোলেন, 'এক হয়েছে বাঙাল-ঘটি/ ভয় পেয়েছে হাওয়াই চটি'। সুস্পষ্ট ইঙ্গিত এখানে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর দিকে। কোথাও স্লোগান উঠেছে পুলিশকে উদ্দেশ্য করে, 'পুলিশ তুমি চিন্তা করো/ তোমার মেয়েও হচ্ছে বড়', 'পুলিশ তোমার ডিএ বাকি/ এই মিছিলে হাঁটবে নাকি'। তার পাল্টা স্লোগান - সামান্য মাত্র গোলযোগ সত্ত্বেও - আবার সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছিলেন পুলিশকর্মীদের অনেকে, 'পুলিশের মেয়ের চিন্তা ছাড়ো,/ লড়াই করেই সে হচ্ছে বড়'। পুলিশ ও আন্দোলনকারী জনতার মধ্যে এ হেন কবির লড়াই বোধহয় কেবল বাংলাতেই সম্ভব!

স্লোগানের বৈচিত্র্য অথবা আন্দোলনের পরিধি বাড়লেও একটি দাবি কিন্তু প্রথম দিন থেকে বদলায়নি, 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস/ আই ওয়ান্ট জাস্টিস/ ইউ ওয়ান্ট জাস্টিস/ জাস্টিস ফর আর জি কর'। বাংলা ভাষার অভিধানে হয়তো এরপর থেকে 'জাস্টিস' শব্দটিও বাংলা শব্দ হিসেবে গণ্য হবে।

চলমান এই গণআন্দোলনে পথে নামা সকলেই যে এই স্লোগানে সন্তুষ্ট, তা নয়। 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস' স্লোগানে নির্দিষ্ট কোন দাবি নেই। খুন-ধর্ষণের কান্ডারি ও তার সম্ভাব্য সহযোগীদের ন্যায় বিচার ঠিক কেমনভাবে হতে পারে, এ প্রসঙ্গে আন্দোলনরত জনতা অনেকটাই দ্বিধাবিভক্ত। রাস্তায়-ঘাটে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, 'ফাঁসি চাই', অথবা 'আমাদের হাতে ছেড়ে দিক'। ফাঁসির দাবি রাজনৈতিক মহলে উঠেছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দলীয় কর্মীদের থেকে। দাবি শোনা গেছে 'এনকাউন্টার'-এর মতন বিচার-বহির্ভূত সাজারও। 'রাত দখল'-এর ডাক দেওয়া বিভিন্ন নারীবাদী ও প্রগতিশীল কর্মী, যাদের অনেকেই মৃত্যুদন্ডবিরোধী, এ হেন দাবিদাওয়া শুনে শঙ্কিত। আবার আইনজীবী থেকে চলচ্চিত্রকর্মী, অনেকের বক্তব্য, "শুধু জাস্টিস জাস্টিস করে চেঁচালে হবেনা, কিছু কংক্রিট পদক্ষেপ লাগবে"। চলচ্চিত্র জগতে ইতিমধ্যেই কেরালার হেমা কমিশনের আদলে একটি কমিটি তৈরির উদ্যোগ চলছে, সেই প্রসঙ্গে তাঁদের বৈঠক হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। আইনজীবীদের উদ্যোগে সরকারের 'রাত্তিরের সাথী' থেকে 'অপরাজিতা' বিলের খুঁটিনাটি আলোচনা হচ্ছে। পোড়খাওয়া রাজনীতিকর্মীরা আবার অনেক শুধু 'জাস্টিস' স্লোগানে সন্তুষ্ট নন। তাঁদের মিছিলে থাকছে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দাবি, শাসকদলের বিরুদ্ধে স্লোগান, 'জয় শ্রীরাম' অথবা 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ'।

এ ছাড়াও রয়েছেন বহু মানুষ, যারা এসবের মধ্যেই ভাবছেন, বাসে-ট্রামে বলেও ফেলছেন, "এসবে কিছু হবে কি"? অথবা, আরও হতাশ, "কিছুই হবেনা, দেখে নেবেন"। এখানে 'কিছু' অর্থাৎ 'জাস্টিস'। ন্যায় বলে যে আদৌ কিছু 'হওয়া' সম্ভব, এটাই যেন অনেক মানুষ কল্পনাতেও আনতে পারেন না।

'জাস্টিস' স্লোগানের ব্যবহার দেখা গিয়েছে শাসকদলের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও। জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি চলাকালীন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে মৃত্যু ঘটে কোন্নগরের এক যুবকের। ২২ বছরের বিক্রম ভট্টাচার্যের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার অভিযোগ করেছেন যে তিনি চিকিৎসা পাননি, যদিও এই অভিযোগ খন্ডন করে বিবৃতি দিয়েছেন আর জি করের এমএসভিপি সপ্তর্ষি চট্টোপাধ্যায়। তৃণমূল কংগ্রেসের বর্ষীয়ান সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় সেই প্রেক্ষিতে 'জাস্টিস ফর কোন্নগরের' দাবি তোলেন। বঙ্গ জাগরণ মঞ্চের ব্যানারে বর্ষীয়ান সাংসদ মশাল মিছিলেও হেঁটেছেন কোন্নগর শহরে, দাবি তুলেছেন 'খুনি ডাক্তারদের' বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। সেই মিছিলে সন্তানহারা বিক্রমের মা-ও পা মিলিয়েছিলেন। তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপত্র 'জাগো বাংলা'-য় লেখা হয়েছে,

জাস্টিস চাইতে গিয়ে অসহায়ের কান্না বাড়ছে। প্রশ্ন উঠছে, এর বিচার করবে কে? এই এক মাসে রাজ্যের সরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজগুলিতে চিকিৎসা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। বাতিল হয়েছে ৬ হাজারেরও বেশি অস্ত্রোপচার। সবথেকে অমানবিক ঘটনা, হাসপাতালে পৌঁছনোর পরও চিকিৎসকরা হাত দিচ্ছেন না রোগীর গায়ে। কাতরাতে কাতরাতে চোখের সামনে শেষ হয়ে যাচ্ছে রোগীরা। কিন্তু মন গলছে না চিকিৎসকদের। এ কেমন জাস্টিসের দাবি?

গত এক মাসে পশ্চিমবাংলার ঘটনাপ্রবাহ এতটাই দ্রুত, এত জায়গায় বাঁক নিয়েছে যে স্রোতের সঙ্গে চলা ছাড়া বিশেষ কিছু আমরা কেউই করে উঠতে পেরেছি বলে মনে হয়না। এর আগেও সাম্প্রতিক অতীতে রাজ্যে নিহত ছাত্রনেতা আনিস খানের 'ইনসাফ'-এর দাবি উঠেছে, রাজ্যের মাটিতে হয়েছে ডিওয়াইএফআই-এর 'ইনসাফ যাত্রা' ও কংগ্রেসের 'ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা-'র মতন রাজনৈতিক কর্মসূচি। 'জাস্টিস ফর আর জি কর' আন্দোলন এর পর কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা বলা সম্ভব নয়। তবে এটুকু নিশ্চয় বলা সম্ভব যে রাজনৈতিক কর্মসূচির গণ্ডি ছাড়িয়ে পশ্চিম বাংলার রাস্তায় রাস্তায় ওঠা 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস' স্লোগানের প্রভাব হতে চলেছে সুদূরপ্রসারী। আসলে 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস' স্লোগানে নির্দিষ্ট কোনো দাবি না থাকা যেমন অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি, ঠিক সেই একই কারণে এই স্লোগান জনমানসে আজ দারুণভাবে গ্রহণযোগ্য। ইনসাফ, ন্যায়, বা জাস্টিস - যে ভাষাতেই লেখা হোক - এক বিমূর্ত ধারণা, একেকজন মানুষের হৃদয়ে তা একেক রকম রূপে অবস্থান করে। এবং সেই কারণেই খুব চট করে কারো কাছে 'জাস্টিস' হয়ে ওঠে লিঙ্গসাম্য ও নারীসুরক্ষার প্রশ্ন, কারো কাছে দুর্নীতি ও 'থ্রেট কালচার'-এর। কেউ বা 'জাস্টিস' বলতে প্রতিহিংসার 'স্ট্রিট জাস্টিস' কল্পনা করে আনন্দ পান। হাসপাতালে মৃত রোগীর হয়ে 'জাস্টিস' চান তাঁর পরিজন। পথ দুর্ঘটনায় নিহত কিশোর অঙ্গীকার দাশগুপ্তের মা আন্দোলনে যোগদান করে সন্তানের জন্য 'জাস্টিস' চান। সুদূর হরিয়ানায় গো রক্ষকদের হাতে নিহত সাবির মল্লিকের হয়ে 'জাস্টিস'-এর দাবি ওঠে কলকাতার মিছিলে, 'আখলাক থেকে সাবির মল্লিক/ মব লিঞ্চিংয়ের বিচার চাই'।

পেশাগত কারণে সাহিত্যচর্চা করি। তার ফলেই হয়তো পথেঘাটে 'জাস্টিস'-এর দাবিতে মিছিল, ছবি, ও স্লোগানের ঢেউয়ে নিজের অজান্তেই মনে আসে গ্রীক ট্র্যাজেডির প্রসঙ্গ। অ্যাসকাইলাসের 'দা ইউমেনাইডিস' নাটকে তিন ফিউরি - ন্যায়প্রদানকারী দেবী - পিতৃহত্যার প্রতিশোধে মাতৃহত্যাকারী ওরেস্টেসকে শাস্তি দিতে উদ্যত হন। পরিশ্রান্ত ওরেস্টেস যখন দেবী এথিনার কাছে বিচার চায়, ডিউস এক্স মাখিনার মাধ্যমে তিনি নিজেই এক বিচারসভার ব্যবস্থা করে দেন। ওরেস্টেস ন্যায়বিচার পায়, তিন ফিউরির নতুন নামকরণ হয় 'দা ইউমেনাইডিস' (করুণাময়ী)। একবিংশ শতকের কঠোর বাস্তবে দেবী এথিনার হস্তক্ষেপ সম্ভব না হলেও সাধারণ মানুষের সমস্বর দাবি হয়তো বিমূর্ত 'জাস্টিস'কেও মূর্ত আকার দেবে, এ কথা ভাবতে ক্ষতি কী?

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।