আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪৩১
সমসাময়িক
গো-রক্ষক বাহিনী নিষিদ্ধ হোক
পশ্চিমবাংলার রাজনীতি উত্তাল হয়েছে আর জি করে কর্মরতা চিকিৎসক পড়ুয়া তরুণীর নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যাকান্ড নিয়ে। এরই মধ্যে সমধিক এক নারকীয় ঘটনা ঘটে গিয়েছে ভারতের অন্য প্রান্তে। হরিয়ানায় সম্প্রতি সাবির মালিক, এই রাজ্যের বাসিন্দা, পরিযায়ী শ্রমিক, এবং হরিয়ানার বাসিন্দা আরিয়ান মিশ্রকে তথাকথিত গোরক্ষকরা পিটিয়ে হত্যা করেছে। নয়া ভারতে এমন ঘটনা প্রায় গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। মোদী সাহেবের বিকশিত ভারতের কর্মযজ্ঞে এরকম দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। হিন্দু-হৃদয়সম্রাটের(!) ডাকে সাড়া দিয়ে অখণ্ড ভারতের স্বপ্নে বিভোর হিন্দুত্ববাদী গুণ্ডারা মাঝে মাঝে তাদের গোমাতার সম্মান বাঁচাতে এরকম কান্ড ঘটিয়ে থাকে। সাময়িক মুখ তাতে পুড়ছে বটে, তবে বৃহৎ লক্ষ্যে এমন ছোট ঘটনা বাংলা থেকে গুজরাট, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীতে হয়ে যায়। রাজ্য আর দেশের শাসক সেইসব ঘটনাকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ধরে নিয়ে সামনে এগিয়ে চলেন নিজেদের লক্ষ্যে।
এমন ঘটনা কি আগে ঘটেনি? আলবাত ঘটেছে। মনে পড়ে মহম্মদ আকলাখ। বাড়ির রান্নাঘরে গোমাংস রাখা ছিল, এই অভিযোগে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা গিয়েছিল। সেই থেকে শুরু। পেহলু খান হয়ে হালফিলে সাবির মালিক হোক বা আরিয়ান মিশ্র। অভিযোগ একটাই, হয় এরা গোমাংস খাচ্ছিল নয়ত গরু পাচার করছিল। ফলে স্বঘোষিত গোরক্ষকের দল বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি তাদের গোমাতার প্রতি অবিচারের প্রতিশোধ নিতে। একবারে হাতেগরম ন্যায়ের মতো, যেমন এ রাজ্যে পিসি থেকে ভাইপো চাইছেন, ওই রাজ্যে তাই গোরক্ষকরা সময় নষ্ট না করে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে সন্দেহভাজনকে। পুরস্কারও তো মিলেছে। স্থানীয় বিধায়ক থেকে আরএসএস সবাই তাদের নিয়ে জয়জয়কার করেছে। মালা পরিয়ে মিছিল করেছে। মায়, বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী অবধি করেছে। যেভাবে ধর্ষকদের নিয়ে বিজেপি গর্বিত মিছিল করে, সেভাবেই এইসব গোরক্ষকরাও তাদের সম্পদ। এদের দিয়েই তো চলছে নয়া ভারতের নির্মাণ।
রেগে গিয়ে ভাবছেন, এসব হচ্ছেটা কি? আপনার বিরক্ত হওয়া সবে শুরু। আপনি এখন বাস করেন শিব ঠাকুরের আপন দেশে। বিরক্ত, ক্রুদ্ধ হওয়ার আগে আরও কিছু তথ্য জেনে নিন। আরিয়ান মিশ্রকে খুন করা হল এই সন্দেহে যে তিনি মুসলমান এবং গো-হত্যা করেছেন। আরিয়ানের বাবা একজন প্রকৃত মানুষের মতই প্রশ্ন তুলেছেন, কে অধিকার দিয়েছে গো-রক্ষার নামে মানুষ হত্যা করার? মুসলমান হলেই কি হত্যা করা যায়? কিন্তু আরএসএস-বিজেপি তথা হিন্দুত্ববাদীরা এইসব মানবিক ভাবনা থেকে বহু দূরে। দেখা যাচ্ছে যে মূল অভিযুক্ত অনিল কৌশিক কেবল স্বঘোষিত গোরক্ষক নয়। বস্তুত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই গোরক্ষকরা কোনো বেআইনী সংগঠন নয়, বরং তারা স্থানীয় পুলিশদের দ্বারা নিয়োজিত লোক যারা নাকি গোমাতার ওপর অত্যাচারের খবর পৌঁছে দেবে। দরকারে সরকারি সাক্ষীও হবে। অর্থাৎ একদিকে এরা পুলিশেরই দ্বারা পরিচালিত। আপনারা হয়ত মনে পড়বে গত বছর আগস্ট মাসে রাজস্থানের আলোয়ারে ওয়াকিল আহমদকে পিটিয়ে খুন করে তার ভিডিও করা হয়। মূল অভিযুক্ত তথাকথিত গোরক্ষক মনু মানেসর এবার হরিয়ানায় নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছে এবং স্বাভাবিকভাবেই বিজেপি তার বিরুদ্ধে কোনো প্রার্থী দেয়নি। এমনকি বাংলার বাসিন্দা সাবির মালিকের বিরুদ্ধে প্রথমে অভিযোগ করা হয় যে তারা নাকি বাড়িতে গোমাংস রান্না করেছেন। পুলিশ এসে মাংসের নমুনা নিয়ে যায়। কিন্তু পরীক্ষার ফল আসার আগেই, প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই গোরক্ষকরা এসে ডেকে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে সাবিরকে হত্যা করে। এর পরে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন যে গোমাতার প্রতি সংবেদনশীল মানুষ কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। অর্থাৎ কোনো নিন্দা নয়, হত্যার বিচারের আশ্বাস নয়, বরং হত্যাকারীরা আবেগে ভেসে হত্যা করেছে এমন এক ভাষ্য তৈরী করা হচ্ছে সরকার থেকে। ফলে এই গোরক্ষকরা মোটেই আইন বহির্ভুত দুষ্কৃতী নয়, বরং প্রশাসন ও পুলিশি মদতে বেড়ে ওঠা রাজনৈতিক গুন্ডা।
আপনি রেগেমেগে প্রশ্ন করতে পারেন সরকার কীভাবে এতে মদত দিচ্ছে। দিচ্ছে, কারণ তারা আইন বানিয়েছে। ২০১৭ সালের ২৬শে মে মোদী সরকার গোটা দেশজুড়ে পশু বাজারে জবাইয়ের জন্য গবাদি পশুর কেনাবেচা নিষিদ্ধ করে। যদিও সুপ্রিম কোর্ট ওই বছর জুলাই মাসের এই আইনে স্থগিতাদেশ জারি করে, কিন্তু রাজনৈতিক বার্তা ঠিকই পৌঁছে যায়। ২০১৪ থেকে ২০২৪, বিগত ১০ বছরে সরকারি হিসাবে ৫২ জনকে এই গোরক্ষকরা হত্যা করেছে। আহত শতাধিক। অবস্থা এমনই ভয়ঙ্কর যে প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচনের আগে বলতে হয় যে, গোমাতার নামে হত্যা মেনে নেওয়া যাবেনা। তবে সেসব যে কেবল নির্বাচনী জুমলা তা ওনার দলবল ভালোই বোঝে। তাই নির্বাচন পার করে এসেও গরুর নামে মানুষ জবাই চলছেই।
দেশে একের পর এক ঘটে যাওয়া গো-হত্যার নামে গণপিটুনি দিয়ে মুসলমান মানুষের হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়। এই মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট জানায় যে কোনো অবস্থাতেই এই ধরণের হত্যা মেনে নেওয়া যায় না। মহামান্য আদালত কেন্দ্রীয় সরকারকে তীব্র সমালোচনা করেন এই অপরাধের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য। এরপরে সুপ্রিম কোর্ট সমস্ত রাজ্যকে নির্দেশ দেয় গো-রক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রত্যেক জেলায় একজন সিনিয়র পুলিশ আধিকারিকের নেতৃত্বে বিশেষ সেল গঠন করার জন্য। কিন্তু এই বিষয়ে কতটা অগ্রগতি হল, কী ব্যবস্থা হল তা নিয়ে কোনো সরকার অথবা সুপ্রিম কোর্ট খুব বেশি মাথা ঘামিয়েছে বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যে আরএসএস-হিন্দুত্ববাদীরা নিজেদের মতন করে তাদের অপরাধমূলক সাম্প্রদায়িক আক্রমণ চালিয়ে চলেছে। বাংলার পরিযায়ী শ্রমিককে পিটিয়ে খুন করা হল। কিন্তু যেই নাগরিক সমাজ যথার্থভাবেই আর জি কর কান্ড নিয়ে গর্জে উঠেছে, তাদের এই ঘটনার প্রতিবাদ করতে দেখা গেল না।
বিজেপি তথা আর এস এসের ভারত ভাবনার মূলে আছে এক ভ্রান্ত ধারণা। কয়েক বছরের দীর্ঘ প্রচেষ্টায় তারা দেশের বড় অংশের মনে এই ধারণা প্রোথিত করতে পেরেছে যে ভারত কেবল হিন্দুদের দেশ। আদতে দেশ যে সবার, সব ধর্মের, সব গোষ্ঠীর মানুষের তা আরএসএস এবং বিজেপির রাজনীতির পরিপন্থী এক ভাবনা। তাই তারা এক দেশ, এক ধর্ম এবং এক ভাষার মতো নীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু ভোট বড় বালাই। তাই চাইলেও বাকিদের দেশের বাইরে ছুঁড়ে ফেলা যাচ্ছেনা। তাই আজ তারা এই গোরক্ষক বাহিনীর মাধ্যমে বিশেষত মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষকে সন্ত্রস্ত করতে চায়, তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানাতে চায়। এ কেবল ধর্মীয় ফ্যাসিবাদই নয়, বরং এর মাধ্যমে নিজেদের ব্যর্থ রাজনীতিকে আড়াল করার এক প্রচেষ্টাও বিদ্যমান। মোদীর তথাকথিত বিকশিত ভারতে গরিব বাড়ছে, বেকারত্ব বাড়ছে, মানুষের গড় আয় কমছে। গোমাতার নামে মানব হত্যা সেই অপদার্থতাকেই আড়াল করার এক কৌশল। প্রশ্ন হল, ভারতের সংসদে বিরোধী দলগুলো কি এই সংবেদনশীল প্রশ্নে নীতিগত অবস্থান নিয়ে এক আন্দোলন গড়ে তুলবেন? এই হিন্দুত্ববাদী আদর্শ এবং সরকারের বিরুদ্ধে, সংখ্যালঘু তথা সমস্ত মানুষের অধিকারের প্রশ্নে আপোষহীন সংগ্রাম করে যেতে হবে। সমস্ত রাজ্যে গো-রক্ষক বাহিনীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করার লড়াই সংগঠিত করতে হবে। নয়ত আরও শত শত সাবির মালিক, পেহলু খানকে নির্মম হত্যার সম্মুখীন হতে হবে।