আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪৩১

সমসাময়িক

ধমক ও চমক


ধমকে, চমকে কাজ চলেছে। বেশ অনেকদিন ধরে।

২০১১ সালে দীর্ঘদিন বাদে রাজ্যের সরকারে পরিবর্তন হয়েছে, মানুষের মনে রং লেগেছে - হয়তোবা বসন্ত এসেছে, সুখময় জীবনের সন্ধান পাওয়া গেছে।

ওই বছরই রাজ্যে ক্ষমতার পরিবর্তনের পরে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী কলকাতার 'বাঙুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোসায়েন্স'-এ ব্যস্ত সময়ে সরকারি আধিকারিক, সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে ঢুকে পড়েন আউটডোরে। তার ফলে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় তাতে আপত্তি জানান তৎকালীন ডিরেক্টর বিশিষ্ট চিকিৎসক শ্যামাপদ গড়াই - মুখ্যমন্ত্রী হাসপাতালে আসতেই পারেন কিন্তু তাঁর সঙ্গে এত লোক ঢুকে পড়লে চিকিৎসা পরিষেবা ব্যাহত হতে পারে।

তিনি জানতেন না, এটাই এখন রাজ্যের দস্তুর। ক্যামেরা নিয়ে কাজের ছল, সঙ্গে থাকে ধমক দিয়ে চমকের চল। ডাক্তারবাবুকে সাসপেনশনের চিঠি ধরানো হয়। ২০১৩ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন - সাসপেনশন চলতে থাকে। সংগ্রাম তারপরেও চলতে থাকে, অবশেষে দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে ২০২০ সালে তিনি তাঁর বকেয়া বেতন ও পেনশন পান।

এ তো গেল মহানগরের এক ডাক্তারের কথা। এবারে আসা যাক প্রান্তিক মানুষের প্রতি ঘোর বিকারে ধমক ও অন্যায় অবিচারের কথায়।

৮ই আগস্ট, ২০১২ সাল। বিনপুরে রাজ্য প্রধানের প্রশাসনিক তথা তৃণমূল কংগ্রেস দলের সভা হচ্ছে। শিলাদিত্য চৌধুরী ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থক। বেলপাহাড়ি থেকে বাসে করে সকলের সঙ্গে মিলে গিয়েছিলেন সভাতে। দিদিকে দেখতে, শুনতে। বক্তব্য শেষে দিদি উৎসাহিত করলেন প্রশ্ন করতে। শিলাদিত্য প্রান্তিক চাষী, চাষের অবসরে বাসের হেল্পার - রাজ্যের দরিদ্রতম অংশের প্রতিনিধি। সাহস পেয়ে বলে উঠলেন, "সারের দাম বাড়ছে, এদিকে চাষের ফসলের দাম কমছে, দিদি, চাষীরা খাবে কী?"

ভালোবেসে, বিশ্বাস করে সরল এই প্রশ্ন করার পরে শিলাদিত্যকে তিনি বললেন, "তুমি মাওবাদী" - পুলিশকে আদেশ করলেন তাঁকে ধরবার জন্য; পুলিশ অনুসন্ধান করে শিলাদিত্যকে ছেড়ে দিল। ১০ই আগস্ট মুখ্যমন্ত্রী শহরে ফিরে জানলেন, শিলাদিত্যকে বন্দি করা হয়নি, তিনি পুলিশকে ধমকে দিলেন। পুলিশ বাহিনী বুঝেছে সময় পাল্টেছে, তারাও চাষের মাঠ থেকে শিলাদিত্যকে পুনরায় গ্রেপ্তার করে।

ঠিক তার ৯ মাস আগে কিষেনজি হত্যা সাধিত হয়েছে।

আজ সাগরিকা ঘোষ তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভা সদস্য। ২০১২ সালে একটি লাইভ ইন্টারভিউতে নতুন মুখ্যমন্ত্রী বসেছেন সাংবাদিক সাগরিকা ঘোষের সঙ্গে। দর্শকদের থেকে একটি মেয়ে প্রশ্ন করে কলকাতা শহরে মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে। মুখ্যমন্ত্রী তার উত্তরে বললেন, "তুমি সিপিআই(এম) ক্যাডার, মাওবাদী ক্যাডার... আমি সিপিআই(এম)-এর প্রশ্নের উত্তর দেব না"। এরপরে মুখ্যমন্ত্রী লাইভ শো ছেড়ে উঠে যান।

ধমক দিয়ে, জেলে ভরে, মিথ্যা মামলা দিয়ে, কুৎসা করে, ধর্ষিতা নারীদের চরিত্রের ইঙ্গিত দিয়ে, (সারদা ইত্যাদির) প্রমাণ লোপাট করে বেশ চলছিল। ধমকের সঙ্গে থাকে চমকের ইঙ্গিত। সাগরিকা ঘোষ আবার তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্যও হয়েছেন। এভাবেই চলেছে। তবে তাতে এবার পড়ে যতি।

তিলোত্তমার বীভৎস ধর্ষণ, হত্যা এবং হাসপাতাল ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে দুর্নীতিগ্রস্তদের চক্র জনমানসে দীর্ঘদিন ধরে ধমক খেয়ে যে অবদমিত ক্রোধ তৈরি করেছিল, তাতে ধরিয়েছে আগুনের স্ফুলিঙ্গ। স্ফুলিঙ্গ থেকে অগ্নিশিখা শহর-মফস্বল ছাড়িয়ে গ্রামে-গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। রাজ্যের মানুষ আর ধমকে ভয় করছেন না, দমে যাচ্ছেন না। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, "এক মাস হয়ে গিয়েছে, এবার উৎসবে ফিরুন"।

বহু ব্যবহারে ব্যবহৃত সেই ধমকের অস্ত্রে এবারে আর তেমন ধার নেই। বরং মুখ্যমন্ত্রীর এই উৎসবে ফেরার ধমক মানুষের রোষে পরিণত হয়েছে।

যিনি ধমক দিয়ে চমক দেবেন তিনি এবার পাল্টা ধমক খাবেন।