আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪৩১
সম্পাদকীয়
আন্দোলনের পথে
এক মাসের বেশি সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গে যেই গণআন্দোলন চলছে তার তুলনীয় কোনো ঘটনা ভারতে নিকট অতীতে ঘটেনি। আর জি কর হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় এক তরুণী ডাক্তারের নির্মম ধর্ষণ ও হত্যা রাজ্য তথা দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মনে যে এক প্রবল আলোড়ন তৈরি করেছে তারই পরিণাম বর্তমানে এই ঐতিহাসিক আন্দোলন।
এই আন্দোলনের নেপথ্যে একদিকে যেমন রয়েছে রাজ্যের শাসকদল ও সরকারের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, তেমনি রয়েছে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজ্য পুলিশ ও প্রশাসনের চরম অপদার্থতা যা দেখে অনেকের মনে হচ্ছে যে কিছু একটা আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে প্রথম দিন থেকে। এই ধারণা যে সম্পূর্ণ অমূলক নয় তার প্রমাণ সিবিআই-এর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন আর জি কর হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ এবং টালা থানার পুলিশকর্তা। সিবিআই আদালতের সামনে জানিয়েছে যে উভয়েই বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন এবং তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করেছেন। সিবিআই-এর দাবি যদি সত্যি হয় তাহলে রাজ্যের পুলিশ ও প্রশাসন সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন ওঠে। প্রথমত, টালা থানার ওসি কি কারো নির্দেশে তথ্যপ্রমাণ লোপ করার চেষ্টা করলেন? দেরি করে এফআইআর গ্রহণ করা হল কেন? যেদিন তরুণী ডাক্তারের মৃতদেহ পাওয়া যায় সেদিন সকাল সকাল কলকাতা পুলিশের নগরপাল আর জি কর হাসপাতালে চলে আসেন। তাঁর উপস্থিতিতে কলকাতা পুলিশের আধিকারিকরা এহেন আইনবিরুদ্ধ কাজ করলেন কী করে? স্বয়ং সুপ্রিম কোর্ট এই প্রশ্ন তুলেছিলেন যে তাদের আশঙ্কা যে তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করা হয়েছে, কলকাতা পুলিশ সঠিকভাবে কাজ করেনি। অতএব এই অপদার্থতা এবং তথ্যপ্রমাণ লোপাটের দায় নিয়ে কলকাতা পুলিশ কমিশনারের অবিলম্বে পদত্যাগ করা উচিত।
কলকাতা পুলিশের কমিশনারের পদত্যাগের দাবিতে জুনিয়র ডাক্তাররা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, তারা লালবাজার অভিযানও করেছেন। পদত্যাগ করার দাবিপত্র তাঁরা স্বয়ং নগরপালের হাতে তুলে দিয়েছেন। রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করে জানালেন যে নগরপাল নাকি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি তাঁকে বারণ করেছেন! কিন্তু কেন বারণ করলেন? সরকারী হাসপাতালে ঘটে যাওয়া নারকীয় ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে যখন সারা রাজ্য ফুঁসছে, পুলিশের অপদার্থতা সর্বজনবিদিত হয়ে গিয়েছে তখন কেন মাননীয়া নগরপালকে তাঁর চেয়ারে রেখে দিতে চাইছেন? এতে একদিকে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন প্রশমিত হচ্ছে না, অন্যদিকে মাননীয়ার ভূমিকা নিয়ে জনমানসে প্রশ্ন উঠছে। অতএব এই আন্দোলনের অন্যতম দাবি মেনে কলকাতা পুলিশের নগরপালের পদত্যাগ করা উচিত, বিশেষ করে সিবিআই যেখানে তাঁর অধীনস্থ একজন ওসিকে গ্রেপ্তার করেছে।
পদত্যাগের বিষয়ে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বিচক্ষণতার পরিচয় আগেও দেননি। সন্দীপ ঘোষের মতন একজন দুর্নীতিগ্রস্থ ডাক্তারকে বারংবার তৃণমূল সরকার গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধে এর আগেও নানা অভিযোগ থাকার পরেও। তিনি যখন আর জি করের অধ্যক্ষের পদ থেকে সরে গেলেন তখন তড়িঘড়ি তাঁকে আরেকটি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের পদে বসিয়ে দেওয়া হল কেন? এখন সিবিআই দুর্নীতির অভিযোগে এবং খুন ও ধর্ষণ মামলায় সন্দীপ ঘোষকে গ্রেপ্তার করেছে। রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর দায় রয়েছে রাজ্যের মানুষকে জানানোর যে কোন বাধ্যবাধকতায় তাঁর দপ্তর সন্দীপ ঘোষের মতন ব্যক্তিদের উচ্চপদে বসিয়েছে। তিনি ডাক্তারদের ধর্নামঞ্চে গিয়ে বলেছেন যে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তাদের তিনি চেনেন না, সব ফাইল তার কাছে আসে না ইত্যাদি। কিন্তু রাজ্যের প্রধান হওয়ার দরুন তাঁকেই তো জবাবদিহি করতে হবে যে কেন তাঁর সরকার বেছে বেছে সন্দীপ ঘোষের মতন ব্যক্তিদের প্রশ্রয় দিয়েছে। ভুলে গেলে চলবে না যে সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আগেই টালা থানায় জমা পড়েছিল। সেই অভিযোগের পরে সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে টালা থানা। সেই কথা যদি মাননীয়া পুলিশমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী না জেনে থাকেন তাহলে তো আরও বড় প্রশ্ন উঠতে বাধ্য।
সুপ্রিম কোর্টে বারংবার নানা প্রশ্ন উঠছে। মহামান্য বিচারপতিরা এফআইআর-এর সময় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কেন তৎকালীন অধ্যক্ষ নিজে এফআইআর দায়ের করেননি সেই প্রশ্ন তুলেছেন, কেন মৃতদেহ সৎকারের পরে এফআইআর দায়ের করা হয় সেই প্রশ্নও তুলেছিলেন মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট। ৯ সেপ্টেম্বরের শুনানির সময় ময়নাতদন্ত সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কাগজ চেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু রাজ্য সরকারের উকিল কপিল সিব্বল সেই কাগজ কোর্টের হাতে তুলে দিতে ব্যর্থ হন। এইসব ঘটনা পরম্পরা মানুষের মনে এই সন্দেহ দৃঢ় করেছে যে কলকাতা পুলিশ তথা রাজ্য প্রশাসন সঠিকভাবে তাদের কাজ করছে না। সেদিনের শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট জুনিয়র ডাক্তারদের বলেন কাজে যোগ দিতে এবং বলেন যে এরপরে রাজ্য সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে কোর্টের কিছু করার থাকবে না।
সুপ্রিম কোর্টের এই পর্যবেক্ষণের পরেই মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বোধহয় ভেবেছিলেন যে আন্দোলন প্রশমিত হয়ে যাবে। তিনি রাজ্যবাসীকে বলেন যে একমাস হল আন্দোলন চলছে, পুজোর আর বেশিদিন বাকি নেই, সবাই উৎসবে ফিরুন। মানুষ আন্দোলন করবেন নাকি পুজোর উৎসবে সামিল হবেন তা সম্পূর্ণভাবে মানুষের ব্যাপার। কোনো রাজনৈতিক নেতাকে মানুষ এই অধিকার দেয়নি যে তাদের উৎসবযাপন কখন ও কীভাবে হবে তা কোনো নেতা ঠিক করে দেবে। অতএব রাজ্যের মানুষ মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের বিরুদ্ধে গিয়ে আন্দোলনকেই উৎসবের মর্যাদা দিলেন। মাননীয়ার উক্তির পরেও আন্দোলন চলছে এবং নিত্যদিন সাধারণ মানুষ আন্দোলনকে এক নতুন রূপ দিচ্ছেন।
এই আন্দোলনের কেন্দ্রে অবশ্যই রয়েছে জুনিয়র ডাক্তাররা। বিগত বেশ কিছুদিন ধরে তারা স্বাস্থ্যভবনের সামনে ধর্না চালিয়ে যাচ্ছেন। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে, রোদে জলে, দিনে রাতে, তাঁদের দৃঢ়চিত্ত আন্দোলন সাধারণ মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। মানুষ তাঁদের সমর্থনও করছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা দেখলাম যে পরপর দুইবার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁদের বৈঠক ভেস্তে গেল দুইপক্ষের টানাপোড়েনে। লাইভ স্ট্রিমিং, ভিডিও রেকর্ডিং ইত্যাদি হওয়া উচিত কি উচিত নয় তা নিয়ে আলোচনা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, যা কখনই কাম্য নয়। আসলে সরকারের যেটা বোঝা উচিত তা হল এই যে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে জুনিয়র ডাক্তার সবার মধ্যেই সরকার তথা প্রশাসনের প্রতি একটি প্রবল অবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে। সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে লাগাতার কমেছে। এই বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর দায়িত্ব সরকার তথা মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকেই নিতে হবে। ধর্না মঞ্চে তাঁর আগমন যেই আলোচনার আশা জাগিয়েছিল তা তাঁর বাড়ির সামনে এসে ব্যর্থ হল। দুইপক্ষকেই আবারও আলোচনার টেবিলে আসতে হবে এবং আলোচনার ভিত্তিতে জুনিয়র ডাক্তারদের দাবিদাওয়া গ্রহনযোগ্যভাবে পূরণ করতে হবে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন যে তিনি জুনিয়র ডাক্তারদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন না। আমরা আশা রাখব তিনি তাঁর কথা রাখবেন। তা না হলে আন্দোলন আরো বড় আকার ধারণ করবে।
জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন নির্যাতিতার বিচারের দাবির বাইরে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মানুষের সামনে নিয়ে এসেছে যা নিয়ে সবাইকে ভাবতে হবে। প্রথমত, স্বাস্থ্য বিভাগের ভিতরে যে-ধরণের দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে তা নিয়ে তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দিতে হবে। একই সঙ্গে সমস্ত ডাক্তারদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাঁরা রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিকাঠামো নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন। বিশেষ করে ডাক্তার ও হাসপাতালের সংখ্যা, কলকাতার বাইরে জেলার হাসপাতালের অপ্রতুল পরিকাঠামো ইত্যাদি বিষয়গুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে স্বাস্থ্যে সরকারী খরচ পৃথিবীতে অন্যতম ন্যূনতম। অতএব রাজ্য তথা গোটা দেশে স্বাস্থ্যে সরকারী খরচ বাড়ানোর দাবি একটি ন্যায্য এবং গুরুত্বপূর্ণ দাবি। আমরা আশা রাখব যে নির্যাতিতা বিচার পাওয়ার পরেও এই দাবি নিয়ে ডাক্তার তথা নাগরিক সমাজ আন্দোলনে থাকবেন। রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নয়ন অগুনতি মানুষের প্রাণ বাঁচাবে যা ‘তিলোত্তমা’-র প্রতি আমাদের সবার যথার্থ সম্মান প্রদর্শন হবে।