আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ● ১৬-৩১ ভাদ্র, ১৪৩১
প্রবন্ধ
ওষুধ সংস্থার বিপণনে বেনিয়ম
প্রতীশ ভৌমিক
।। এক ।।
আমাদের দেশ ওষুধ শিল্পে স্বনির্ভরতা অর্জন করে ১৯৭০ সালে পেটেন্ট আইন প্রণয়নের পর থেকে। ভারতীয় পেটেন্ট আইন ১৯৭০-এর আইনি প্রক্রিয়ায় রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতিতে কম দামে একই মৌল/ফর্মুলেশন ওষুধ তৈরি শুরু হয় মূলত রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ওষুধ সংস্থাগুলোর মাধ্যমে। এর ফলে ভারতের বাজারে বিদেশি ওষুধগুলো প্রতিযোগিতায় বেশি দামের কারণে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছিল এবং আমাদের দেশ ওষুধ শিল্পে ক্রমশ স্বনির্ভর হতে শুরু করেছিল। যখন থেকে দেশীয় ব্যক্তিগত মালিকানার সংস্থাগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থা থেকে মৌল কিনে নিজস্ব কোম্পানির মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত কম দামে বাজারে ওষুধ বিক্রি করছিল তখন দেশীয় ব্যক্তিগত মালিকানার ও রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কোম্পানিগুলো একচেটিয়া বহুজাতিকদের বাজারে থাবা বসিয়েছে। এর ফলে বিদেশি বহুজাতিক সংস্থাগুলো নিজেদের টিকিয়ে রাখতে এদেশে ওষুধের দাম কমাতে বাধ্য হয়েছিল। পাশাপাশি সরকার 'Drug Price Control Order' (DPCO)-এর তালিকায় প্রয়োজনীয় ৩৭৮টি ওষুধের মূল্য বেঁধে দিয়েছিল, ফলতঃ ঐ ওষুধগুলোর দাম কোনওভাবেই বাড়ানো যাচ্ছিল না।
।। দুই ।।
আশির দশকের শেষদিকে শুরু হল অন্য এক ষড়যন্ত্র, এর জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থার মাথায় বসে থাকা আমলাদের সাহায্য নিয়ে ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থার জমি, ফ্যাক্টরি প্রোডাকশন ইউনিটগুলো বহুজাতিক বা দেশীয় কর্পোরেট সংস্থার কাছে বিক্রি করতে থাকে সরকার। ভারতের ওষুধ বাজারে 100% Foreign Direct Investment (FDI)-এর মাধ্যমে সুবিধা পায় বিদেশি বহুজাতিকরা। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থাগুলোকে বিক্রি করে, ভি.আর.এস. দিয়ে, দুর্বল করে - এসব একপ্রকার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই না। পাশাপাশি গ্লোবালাইজেশনের নামে লিবারালাইজেশন ও প্রাইভেটাইজেশন নীতি গ্রহণ করে ভি.আর.এস. মাধ্যমে কর্মী সংকোচন সহ ব্র্যান্ড ও কোম্পানি কেনাবেচা শুরু হয়। এক অস্থিরতার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল দেশজুড়ে। যেমন আমরা দেখছি BSNL-এর ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে সংস্থাকে মৃতপ্রায় করে তোলা হয়েছিল, ঠিক তেমনিভাবেই ওষুধ বাজার ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল কর্পোরেটদের জন্য। সুযোগের ব্যবহার করে বিদেশি বহুজাতিকরা, দেশীয় ব্যক্তিগত মালিকানার সংস্থাগুলোর ব্র্যান্ড কিনে সেই কম দামের ওষুধের দাম বাড়াতে শুরু করল, 'Drug Price Control Order' (DPCO)-র তালিকা ক্রমশ ছোট হয়ে এল এবং একসময় ৭৪-এ গিয়ে ঠেকল। উৎপাদনের খরচ অনুসারে ওষুধ-মূল্য নির্ধারণের সঠিক পদ্ধতি বদলে কেন্দ্রীয় সরকার কর্পোরেটদের সুবিধার্থে বাজারভিত্তিক ওষুধ-মূল্য নির্ধারণের পথ দেখাল। ফলতঃ ওষুধের দাম আবারও বেড়ে গেল, বছর বছর ওষুধের দাম ১০ শতাংশ হারে বাড়ানোর নীতি ঘোষিত হল।
ওষুধের বাজারের দখল নিতে দেশীয় ব্যক্তিগত মালিকানার সংস্থার সঙ্গে এবার বহুজাতিকদের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। মাঝের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থার উপস্থিতি আর নেই বললেই চলে। কম দামে মৌল সংগ্রহ করা যাচ্ছিল না, মৌল কিনতে হলো চিন, ইতালি থেকে। ভারতীয় সংস্থাগুলোর আগের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল, তাই ওষুধের দাম বাড়াতে হল।
।। তিন ।।
এবার বিপণনের ক্ষেত্রে আরও বেশি মুনাফা করতে কোম্পানিগুলোর চিকিৎসকদের আইনি বিপণন পদ্ধতির বাইরে দামি উপঢৌকন দিয়ে ওষুধ লেখানো ক্রমশ বাড়ছিল। বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কিছু সংখ্যক চিকিৎসকদের সঙ্গে বোঝাপড়া শুরু হচ্ছিল দেশীয় ও বিদেশি কর্পোরেটদের। এক্ষেত্রে লক্ষ্য করা গেছে বিদেশি কোম্পানিগুলো তাদের বিদেশি আইনের কড়া শাস্তি এড়াতে আইন বজায় রেখেই চিকিৎসকদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ওষুধ লিখিয়েছে। বিপণনের অনিয়মে কোম্পানির লাভের পরিমাণ কমলে সেই ব্যবসা সামাল দিতে জনগণের উপর আরও দামের বোঝা চাপানো হয়েছে। এই দেওয়া-নেওয়ার ব্যবসায়ী সম্পর্ককে বিশাল সংখ্যক চিকিৎসকরা মেনে নিতে পারেনি, তাঁরা এই পদ্ধতির প্রতিবাদ করেছেন, প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ফিল্ড কর্মীদের ও চিকিৎসকদের সংগঠন ক্রমাগতভাবে এই অনৈতিক বিক্রির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ করেছেন।তাঁদের কথায় এটি একপ্রকার সামাজিক ব্যাধি, এর জন্য চিকিৎসকদের কঠোরভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণ করা যেমন প্রয়োজন, পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি বিশেষ কোড 'Uniform Code of Pharmaceuticals Marketing Practices' (UCPMP)-কে শক্তিশালী করে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণ করা উচিত ছিল।
।। চার ।।
ওষুধ বিপণন মূলত বৈধ নিয়োগপত্র আছে এমন সেলস্ প্রোমোশন কর্মীদের দ্বারাই করার কথা, যদিও বর্তমান সময়ে সরকারের কোনো নজরদারি নেই। Third Party, Special Economic Zone (SEZ) থেকে ওষুধ বানিয়ে অনেক ক্ষেত্রে নিজেরাই বিনিময় প্রথায় বেআইনি বিপণন চালায়। 'ম্যাজিক রেমিডিজ এ্যাক্ট ১৯৫৪' অনুযায়ী বলা হয়, ওষুধ সংক্রান্ত প্রচার কোম্পানি ও চিকিৎসকের মধ্যে বিশ্বাস রক্ষা করতে হবে। মিথ্যে তথ্য পরিবেশন, অবৈজ্ঞানিক দাবি, ক্ষতিকারক ওষুধ বিক্রির প্রচার করলে কর্তৃপক্ষের কঠিন শাস্তি হতে পারে (আশ্চর্যজনকভাবে এই আইনের প্রয়োগ নেই বলে এসব কথা শুধু কাগজ কলমে লেখা হয়ে আছে)।
বিদেশে ওষুধ সংক্রান্ত বিষয়ে, মিথ্যা তথ্য, অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক দাবি, অবৈধ ওষুধ বা ভেজাল ওষুধ বিক্রির জন্য কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি পেতে হয় - আমাদের দেশে বিধি লঙ্ঘনের এমন ভুরি ভুরি ঘটনা ঘটেছে যার জন্য আজ অবধি কর্তৃপক্ষের কোনো শাস্তি হয়নি।
তবে একথাও মানতে হবে যে কঠোর নিয়মের মধ্যে থেকে সংখ্যায় বেশি এক বিশাল সংখ্যক চিকিৎসক যেমন লোভ সংবরণ ও আত্মনিয়ন্ত্রণ করে সুস্থ সামাজিক দায়িত্ব পালন করে সুনাম বজায় রাখতে পেরেছেন, ঠিক তেমনই দেখা গেছে বহুসংখ্যক জাতীয় ও বহুজাতিক সংস্থা এখনও নীতিনিষ্ঠ পদ্ধতি গ্রহণ করে ওষুধ শিল্পের সুস্থ ব্যবসার পরিকাঠামোকে ধরে রেখেছে। বিক্রির হিসেবে এরা কেউই পিছিয়ে নেই, বরঞ্চ বলা যেতে পারে এধরনের কর্তৃপক্ষ ওষুধের বাজারে দুর্নীতি বেষ্টিত সমাজে যথেষ্ট সুনাম বজায় রেখে সামনের সারিতেই রয়েছে।
।। পাঁচ ।।
বর্তমানে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৮০-৯০ লাখের বিনিময়ে ডাক্তারিতে ভর্তি হওয়া যায়, সম্পূর্ণ চিকিৎসক তৈরি হতে খরচ হয় প্রায় দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার কাছাকাছি, অথচ সরকারি ব্যবস্থাপনায় একজন পূর্ণ চিকিৎসক হতে খরচ অনেক কম। অতএব কেবল টাকার জোরে যারা চিকিৎসক হয়ে উঠছেন তাদের মূল্যবোধ অন্যরকম হতে বাধ্য কারণ যেই বিপুল ব্যয় তারা করেছেন সেই টাকা ঘরে তুলতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তারা। NEET-এর পরীক্ষার জালিয়াতি প্রমাণ করে কর্পোরেট-রাজ ও উদারনীতির প্রবক্তারা ক্রমশঃ দুর্নীতির রাস্তা প্রশস্ত করেছে এবং সামাজিক অবক্ষয় ঘটিয়েছে।
এতদিনে সব ঘুষ রহস্যের জাল উন্মোচন করে প্রকাশিত হয়েছে ইলেক্টোরাল বন্ডের মতো দুর্নীতি, জালিয়াতি, যেখানে সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই অভিযুক্ত। সরকার 'ইউনিফর্ম কোড অব ফার্মাসিউটিক্যাল মার্কেটিং প্রাকটিস' (UCPMP) গঠন করেছিল কেবল নামেই, ২০১৪ সালে বিশেষ নীতি নির্ধারণ করেছিল সরকার, কিন্তু তা ছিল ঐচ্ছিক। এত ঘটনার পরেও ২০২৪ সালে UCPMP Code-এর কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাতে কোনো কঠিন শাস্তির কথা বলা নেই, এবং কোনো কর্তৃপক্ষই আজ অবধি মানেনি। এই সুযোগে রাজনৈতিক দলগুলো ভেজাল ওষুধ, বেআইনি ওষুধ বিক্রি করায় মদত দিয়ে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে, বেপরোয়াভাবে শুধু ঘুষের বিনিময়ে নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি করেছে।
।। ছয় ।।
এমন এক দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে বহুসংখ্যক ব্যক্তিগত মালিকানার কোম্পানি, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর একটা বড় অংশ এখনও বাজারে বৈজ্ঞানিকভাবে সার্ভে করে নির্দিষ্ট উপভোক্তা চিহ্নিত করে। বৈজ্ঞানিক তথ্য দিয়ে ওষুধের প্রচার করা ছাড়াও সঠিক ওষুধের প্রয়োগ, অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া, ওষুধ ক্ষমতার তুলনামূলক আলোচনা, আরও বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন ওষুধ হিসেবে প্রমাণ দেওয়া, তুলনামূলকভাবে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া মুক্ত ওষুধের প্রকৃত তথ্য প্রচার করে বাজারে টিকে আছে আর এই সমস্ত কাজ একজন প্রশিক্ষিত সেলস্ প্রোমোশন কর্মী সহজভাবেই করে থাকেন - এক্ষেত্রে তাদের অবদানকে অস্বীকার করা যাবেনা। একজন আদর্শবান চিকিৎসক কম দামের, সঠিক গুণমানের ওষুধ খোঁজেন, তাঁরা ওষুধ এভাবে বাছাই করে নেন। এজন্য চিকিৎসকদের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে কর্তৃপক্ষও তাদের ওষুধ তৈরি করে ব্যবসা বৃদ্ধি করেছে। এভাবে কোম্পানিগুলো বছরের পর বছর সামনের সারিতেই স্থান দখল করে আছে অথবা কঠিন পরিস্থিতিতেও টিকে আছে। ঐসব কর্তৃপক্ষ জানে যে ঘুষের বিনিময়ে ব্যবসা বেশিদিন চলতে পারে না। তবে একথা ঠিক যে ওষুধ কোম্পানির প্রলোভন, সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে কিছু সংখ্যক চিকিৎসকের ঐ প্রলোভনে গা ভাসিয়ে দিতে এক বিশাল সংখ্যক চিকিৎসকের আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। সামাজিক অবস্থার পুনরায় পরিবর্তন হবার আশায় বুক বেঁধে আছে বিশাল সংখ্যক চিকিৎসক - ওষুধ শিল্পে সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নতির আশায় রয়েছেন সাধারণ মানুষ।