আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ● ১৬-৩১ ভাদ্র, ১৪৩১

প্রবন্ধ

আর জি কর ও বঙ্গ অস্মিতা

সুখবিলাস বর্মা


এই জীবন সায়াহ্ণে সময়ের কিছুটা হলেও কাটছে টিভি সিরিয়াল দেখে। প্রিয় চ্যানেল জ়ি টিভির 'গোপাল ভাঁড়' ও 'সিআইডি'। এসিপি প্রদ্যুমনের নেতৃত্বে সিআইডি কীভাবে জটিল সব খুনের কেসের কিনারা করছে বসে শুয়ে তারই নাট্যরূপ দেখে খুব মজা পাই। প্রায় সব খুনের ক্ষেত্রেই চেষ্টা করা হয় তথ্য ও সাক্ষ্যপ্রমাণ মুছে ফেলার, যাতে প্রকৃত সত্য উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য প্রায়শই দেখা যায় খুনের জায়গা (place of occurrence) সম্পর্কে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করা, সেই স্থানের/বাড়ির মালিকের নেতিবাচক কাজকর্ম, ভিক্টিমের দেহের পজিশন পরিবর্তন করা, কখনো কখনো দেহ উধাও করিয়ে দেওয়া, ঠিক সময়ে পুলিশ থানায় এফআইআর না করা, তড়িঘড়ি দেহ পুড়িয়ে ফেলা, তড়িঘড়ি পোস্টমর্টেম করানো, যে স্থানে দেহ শনাক্ত/উদ্ধার, পরিষ্কার বা রিপেয়ার করার অজুহাতে আশপাশের এলাকা সহ সেই স্থান অক্ষত না রাখা, তদন্তের প্রাথমিক স্তরে ধৃত ব্যক্তি/ব্যক্তিদের জেরা করে ঘটনার প্রকৃত তথ্য উদ্ধারে অনীহা ইত্যাদি অপচেষ্টা।

৯ই আগস্ট কলকাতার আর জি কর মেডিকেল কলেজে এমডি পাঠরতা এক মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় মাননীয় কলকাতা হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের আদেশে যে তদন্ত চলছে সেখানে আমি সিআইডি কেসেরই ছায়া দেখতে পাচ্ছি। ধর্ষিতার দেহ উদ্ধার হয়েছে চেস্ট মেডিসিন বিভাগের বাড়ির চতুর্থ তলার সেমিনার রুমে, পাশের ঘরে রয়েছে ডাক্তারদের বিশ্রামের ঘর। তাহলে ধর্ষণ ও খুনের প্রকৃত জায়গা সেমিনার রুম, নাকি বিশ্রাম ঘর নাকি অন্য কোথাও? অকুস্থল ঘিরে না রেখে সেখানে বহু মানুষের চলাফেরার সুযোগ করে দিয়ে ফুটপ্রিন্ট বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট নষ্ট করা, বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে দেহ তড়িঘড়ি বাড়ি পাঠিয়ে যত শীঘ্র সম্ভব শবদাহের ব্যবস্থা করা সবই হয়েছে পুলিশের উপস্থিতি ও মদতে। ঘটনাস্থলে কলকাতার পুলিশ কমিশনার (সিপি) বিনীত গোয়েল নিজে উপস্থিত থেকে তদারকি করছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর আদেশে তিনিই নাকি শবদেহ সহ বাবা-মাকে নিয়ে তাদের বাড়িতে গিয়ে দেহ পোড়ানোর ব্যবস্থা করেন। অকুস্থানের অবস্থান ও পারিপার্শ্বিকতা, বহুল সংখ্যক আঘাত চিহ্ণযুক্ত ডেডবডির অবস্থা, হাসপাতালেরই ফরেনসিক বিভাগকে দিয়ে কোনো প্রকারে পোস্টমর্টেম পর্ব উতরে যাওয়া ইত্যাদি সবকিছু বিচার করে দুঁদে পুলিশ অফিসার বুঝেছিলেন যে ডেডবডির ডিস্পোজাল সংক্রান্ত মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর উপদেশ তাকে পালন করতে হবে - যত শীঘ্র সম্ভব এ বডি খালাস করতে হবে। তিনি এত কিছু করলেন, এত কিছু বললেন কিন্তু পুলিশের যে প্রাথমিক কাজ এফআইআর সেটা তিনি বেমালুম ভুলে গেলেন - নাকি ইচ্ছা করে অ্যাভয়েড করলেন? কলেজের অধ্যক্ষ মুখ্যমন্ত্রীর প্রিয়পাত্র সন্দীপ ঘোষকে সম্ভবত ঘাঁটানোর সাহস করলেন না। যার ফলে এফআইআর হল ঘটনার সাড়ে এগারো ঘণ্টা পরে। কেস গুবলেটের প্রথম ধাপ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন।

হাড়ের ডাক্তার মুখ্যমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ সন্দীপ ঘোষকে তো সিপি মহোদয়ের হাড়েহাড়ে চেনার কথা। কলকাতার এইসব প্রথম সারির প্রভাবশালী সম্পর্কে জানকারী না রাখতে পারলে তিনি তো সিপি হিসাবে চরম ব্যর্থ। ঐতিহ্যবাহী কলকাতা পুলিশের কাজ কি শুধু মহান মহীয়সী নেতানেত্রীর চামচাবাজি করা? সে যাই হোক, এই পুলিশ অফিসারের কেস গুবলেট করার দক্ষতা আমজনতা থেকে প্রশাসন, মাননীয়া তো বটেই, সবাই দেখেছে কামদুনি কাণ্ডে। আর জি কর-এর পুরো ঘটনাটিকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার জন্য এবং তাৎপর্যপূর্ণ প্রমাণাদি লোপাটের জন্য সংগঠিত ৭০/৮০ জনের প্রধানত তৃণমুলী গুণ্ডাবাহিনীর তাণ্ডব ছিল গুবলেটের সবচেয়ে নিন্দনীয় অথচ গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আর এই কাজটি কলকাতা পুলিশ গুণ্ডা বাহিনীকে নির্বিঘ্নে করতে দিয়েছে। ঘটনাস্থলে পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ থাকলেও গুণ্ডাদেরকে কেউ বাধা দেয়নি, পরিচিত গুণ্ডাদের গায়ে হাত দেওয়া মানা বা দেওয়ার সাহস হয় নি। হাসপাতালের কোটি টাকার সম্পত্তি ধ্বংস করেছে তারা - তাণ্ডব চালিয়েছে প্রধানত যেসব জায়গায় খুন সংশ্লিষ্ট প্রমাণ থাকার সম্ভাবনা বেশি সেখানে। উদ্দেশ্য মহান রাম-বামের উপর দোষ চাপাও, প্রমাণাদি লোপাট করো। মহান সিপির তদারকিতে থাকা পুলিশ নিষ্কর্মা দাঁড়িয়ে থাকবে, প্রয়োজনে হাসপাতাল কর্মীদের কাছে আশ্রয় চাইবে, নিরাপত্তা চাইবে। ঘটলও তাই। শুনেছি এই তাণ্ডব-কাণ্ডের জন্য স্কেপগোট করে দু’জন এসিকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। অথচ প্রকাশ্যে যিনি স্বীকার করলেন যে তার অ্যাসেসমেন্টে ভুল হয়েছিল, যিনি সব গুবলেটের জন্য দায়ী সেই বিনীতবাবু বহাল তবিয়তে চালিয়ে যাচ্ছেন তার নিয়ম বেনিয়মের সব কাজকর্ম।

প্রমাণ লোপাটের মাধ্যমে কেস গুবলেট বিষয়টি কলকাতা হাইকোর্ট সহজেই বুঝেছিলেন বলেই সিবিআই-কে তৎক্ষণাৎ দায়িত্ব সঁপেছেন। সুপ্রিম কোর্ট তো ‘সুও মোটো’ কেস করেছে। গুবলেটের পরিমাণ এত গভীর যে সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারপতিদের সাদামাটা প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজ্য সরকারের উকিল কপিল সিব্বাল পর্যন্ত গলদঘর্ম হয়ে উঠলেন - অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলেন শুধু।

তদন্ত কাজকে বিভ্রান্ত করার জন্য উল্লিখিত প্রাথমিক সব প্রচেষ্টার ফলে মূলত সিসি ক্যামেরার ফুটেজের প্রমাণকে ভিত্তি করে সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া ছাড়া তদন্ত বেশীদূর এগোলো না। ভারতের রাজনৈতিক প্রশাসনিক ইতিহাসে সিভিক ভলান্টিয়ার এক আশ্চর্য প্রজাতি - আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো। প্রথমে এদের রিক্রুটমেন্ট হয়েছিল 'সিভিক পুলিশ' নামে। মহামান্য কোর্টের আদেশে এদেরকে পুলিশ বলা যাবে না, তাই এরা 'ভলান্টিয়ার'। কী কাজ এদের? উত্তর হল - কী নয়? কোথায় কাজ করেন এরা? উত্তর হল - কোথায় নয়? সংখ্যায় এরা কত? উত্তর - কেউ জানে না।কয়েক বছর আগে বিধানসভায় মাননীয়ার বক্তৃতায় শুনেছিলাম এক লক্ষ তিরিশ হাজার।

তারপরে গঙ্গা, তিস্তা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে - অনেক সিভিককে কাজে নেওয়া হয়েছে। এদের রিক্রুটমেন্টে কোনও সমস্যা নেই - আলাদা বাজেট বরাদ্দের প্রশ্ন নেই, বিজ্ঞাপন নেই - কোনকিছুর বালাই নেই। এই সরকারের বহু কাজের মতো উঁচু মহলের মৌখিক আদেশই যথেষ্ট। রিক্রুটমেন্ট করেন কোনও চ্যাটার্জি, ব্যানার্জি, ভট্টাচার্য, গাঙ্গুলি শোভিত বোর্ড বা সংস্থা নয়, থানার ওসি। তিনিই তৃণমূলের নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে তৃণমূলের ক্লাব, সিণ্ডিকেট বা নেতা-নেত্রীর আত্মীয়-স্বজনদের মধ্য থেকে কাজে লাগান। পুলিশ কর্তাদের ভাগও নিশ্চিত থাকে। এদের প্রধান কাজ হল পুলিশ ও দলের হয়ে তোলাবাজি করা, বিরোধী দলের লোকজনকে শাসিয়ে দাবিয়ে রাখা, এমনকি থানার ফোর্সের উপর খবরদারি করা। বহু থানায় সংখ্যায় রেগুলার অফিসার-ফোর্সের চেয়ে এরা বেশি; তাই কর্তৃত্বও বেশি। ধৃত সঞ্জয় রায় সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত যা তথ্য বেরিয়েছে, তাতে উপরোক্ত কথাগুলির সত্যতায় ভেজাল নেই। এমত ধৃত ব্যক্তির সবকিছুই কমিশনার মহোদয়ের জানা থাকার কথা। কোন থানার কোন অফিসার এই মহাপুঙ্গবকে রিক্রুট করেছেন, 'পুলিশ ওয়েলফেয়ার বোর্ড'-এর কোন কোন অফিসারের মদতে পুলিশের মোটরবাইক নিয়ে সঞ্জয় মাস্তানি করে বেড়ায়, তোলা তুলে বেড়ায়, কার কার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ইত্যাদি সবই সিপির অজানা থাকার কথা নয়। অথচ তাকে ধরে পুলিশের গাড়িতে থানায় নিয়ে যাওয়া ছাড়া কিছুই করা হল না। তবে কি ভবানীপুরের বাসিন্দা সঞ্জয়ের যোগাযোগ এমন কারুর সঙ্গে যে সিপির হাত-পা বাঁধা? কেস গুবলেট করার দায় হয়ত সেকারণেই বেড়ে গিয়েছিল।

মাননীয়া বেশ আটঘাট বেঁধেই আসরে নেমেছিলেন। প্রথমেই বললেন দোষীদের ফাঁসি চাই। বললেন, পাঁচ দিন সময় দিচ্ছি - সেই সময়ের মধ্যে কলকাতা পুলিশ কিছু করতে না পারলে, এই কেস সিবিআই-কে দিতে রাজ্যের আপত্তি থাকবে না। প্রশাসনের এতদিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজ করা পুলিশমন্ত্রীর অজানা নয় যে এমন এক গুরুত্বপূর্ণ কেস যেখানে ধরা পড়েছে পুলিশ ঘনিষ্ঠ এক ভলান্টিয়ার, সেই কেসের সুরাহা পাঁচ দিন কেন, পাঁচ সপ্তাহতেও সম্ভব নয়। তবুও সে কথা তিনি কেন বললেন? জলের মতো পরিষ্কার। পাঁচ দিন সময়ে গোয়েলের তদারকিতে সব প্রমাণ লোপাটের ব্যবস্থা পুলিশ করতে পারবে। রাজ্য সরকারের এই অপচেষ্টা কোর্টের কাছে ধরা পড়েছে। দেখা যাক জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।

আশার কথা, বহুদিন পর বাঙালি চেতনায় বোধহয় আঘাত লেগেছে। তিরিশ বছরের এক মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুন বাংলাকে, বাঙালিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ঘটনার প্রতিবাদে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন সারা দেশ তো বটেই সারা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে। স্বঘোষিত 'বাংলার গর্ব' পাশে অভিনেত্রীদের (মূলত যারা তার অভিনয়ের ছাত্রী) নিয়ে উল্টোপাল্টা শ্লোগানে সব কিছুর দায় রাম-বামের উপর চাপাতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাতে ফল উলটো হয়েছে। জনৈকা রিমঝিম সিনহার বার্তায় সাড়া দিয়ে ১৪ই আগস্ট রাত ১১-৫৫-তে কলকাতা, শহর - গ্রাম বাংলা ও বাইরের রাজ্যে যে প্রতিবাদ মিছিল শুরু হয়েছিল তা ইতিমধ্যে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছে - সমস্ত প্রোফেশনের মানুষের মধ্যে। প্রতিবাদ মিছিল চলছেই। ইতিমধ্যে ২৪শে আগস্ট আর জি কর মেডিকেল কলেজের ধর্ষণ খুনের এই ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মেডিকেল জার্নাল ‘দি ল্যান্সেট’-এ (The Lancet), “The incident has brought into focus the poor working conditions for health workers, as well as the growing threat of violence against them”। অন্যায় কিছু হবে না যদি বলা হয় স্বঘোষিত 'বাংলার গর্ব'-এর কীর্তিতে 'বঙ্গ অস্মিতা' আজ বিপুলভাবে বিপন্ন।