আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ● ১৬-৩১ ভাদ্র, ১৪৩১

প্রবন্ধ

জাগিয়ে দেয় যে মরণ

সংযুক্তা সিংহ


সবার আগে একটা কথা খুব স্পষ্টভাবে বলা দরকার। না, বানতলা, ধানতলা, হাথরস, উন্নাও, কাঠুয়ার সঙ্গে আর জি কর হাসপাতালের ঘটনা তুলনীয় নয়। ধর্ষণ, হত্যার ঐ ঘটনাগুলির কোনওটিই কর্মক্ষেত্রে ঘটেনি। সারা দেশ যে প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে আর সেই গর্জন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, যার ঢেউ আছড়ে পড়েছে দেশের বাইরেও, তার সবচেয়ে বড় কারণ হয়তো এটাই। নিজের কাজের জায়গায়, সরকারী হাসপাতালে, একজন মহিলা চিকিৎসকের ওপর এত ভয়ঙ্কর নৃশংসতার নজির কেউ দেখাতে পারেন নি। অনেকে মনে করাচ্ছেন মুম্বইয়ের হাসপাতালের ধর্ষিত নার্স অরুণা শনবাগের কথা। মৃত্যু যাঁকে নিষ্কৃতি দিয়েছিল ৪২ বছরের কোমাচ্ছন্ন জীবন থেকে। কিন্ত চারতলার সেমিনার রুমে ৯ আগস্ট সকালে পিজি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী চিকিৎসকের বিবস্ত্র ক্ষতবিক্ষত দেহ আবিষ্কারের পর এখনও জানা যায়নি, ৩৬ ঘন্টা টানা ডিউটি করে ক্লান্ত, ঘুমন্ত মেয়েটার ওপর অত্যাচার চালিয়েছিল কজন! ময়নাতদন্তের রিপোর্টে শরীরজুড়ে আঘাতের যে বিবরণ শোনা গেছে, তাতে ক্রমশ পোক্ত হয়েছে গণধর্ষণের অনুমান। পুলিশের বড়কর্তা বা রাজ্যের সর্বময় কর্ত্রী, প্রাথমিক তদন্তপর্বের কুশলতা নিয়ে যতই বড়াই করুন, ঘটনা জানাজানি হবার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রকৃত সত্য ধামাচাপা দেবার সন্দেহ উস্কে দিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, একজন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার, তার সিভিক ভলান্টিয়ার পরিচয় পুলিশ কর্তার এড়িয়ে যাওয়া - দৃশ্যতই দুর্বল চিত্রনাট্য। আদালতের নির্দেশে তদন্তভার সিবিআই-এর হাতে যাবার পর অকুস্থলের কাছে ভাঙাভাঙি শুরু করা, সেই কাঁচা চিত্রনাট্যেরই অংশ। সেমিনার রুমই প্রকৃত অকুস্থল কিনা, এখন তো সে প্রশ্নও উঠছে।

তবে, সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা আহ্বান যে এত মেয়েকে ১৪ই আগস্ট মধ্যরাতে রাস্তায় টেনে আনবে, "উই ওয়ান্ট জাস্টিস" গর্জন কলকাতা শহরের রাজপথ ছাপিয়ে ছড়িয়ে যাবে রাজ্যের সর্বত্র, চিত্রনাট্যকার হয়তো তা অনুমান করতে পারেননি। করা সম্ভবও ছিল না। নবতিপর নারীর সঙ্গে হাঁটছেন মধ্য তিরিশের যুবক। ষাটোর্ধ পুরুষের পাশে স্লোগান দিচ্ছেন কুড়ি পেরোনো তরুণী। কারো হাতে মোমবাতি, কারো মশাল। কেউ তুলে ধরেছেন পোস্টার, কেউ প্ল্যাকার্ড। টেলিভিশনের পর্দায় সেই আশ্চর্য অভূতপূর্ব দৃশ্য, জনজাগরণের এক নতুন কাহিনির জন্ম দিচ্ছে। অনেকে বলছেন, চমকে দেওয়া এ দৃশ্য, শাসকের স্নায়ুর ওপর কতটা চাপ সৃষ্টি করেছিল, ঐ রাতে আর জি কর হাসপাতালে গুন্ডাবাহিনীর তান্ডব তার প্রমাণ। স্বীকার করতেই হবে, কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ধ্বংস, অবস্থান মঞ্চ ভেঙে তছনছ আর আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে ক্যামেরার চোখ অন্যদিকে ঘোরানোর সেই মরিয়া চেষ্টা আপাত সফল হয়েছিল। কিন্ত তাতে জনরোষ আরও বেড়েছে। দেশজুড়ে কর্মবিরতিতে নেমেছেন ডাক্তার নার্স স্বাস্থ্যকর্মীরা। দুর্বৃত্ত তান্ডবের দায় বাম আর রামের ঘাড়ে চাপানোর কাউন্টার ন্যারেটিভ কাজে আসেনি। বরং আরও গাঢ় হয়েছে প্রমাণ লোপাটের সন্দেহ। দুর্বৃত্তদের রাজনৈতিক আনুগত্যও গোপন থাকছে না। হামলার সময় রক্ষাকর্তা পুলিশের ভূমিকা এখন আতশ কাঁচের নীচে।

প্রকাশ্যে আসছে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অন্দরের রোমহর্ষক নানা কেচ্ছা কাহিনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে অনেক অডিও ক্লিপ, ভিডিও। কোনটা সত্যি, কোনটা ভুয়ো, যাচাই করার উপায় নেই। প্রয়োজনও মনে করছেন না সবাই। শিউরে উঠছেন, ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটিতে চিকিৎসার আড়ালে চলা অশুভ চক্রের কথা জেনে। মেয়েটাকে কি তবে এই চক্রের হাতেই মরতে হলো? এত নৃশংসতা কি কোনও আক্রোশবশত? নাহলে প্রথমে আত্মহত্যা কেন বলা হবে? খুনের অভিযোগ দায়ের হবে না কেন? মৃত মেয়েকে দেখার জন্য মা বাবাকে কেন অপেক্ষা করতে হবে তিন ঘন্টা? দেহের সৎকার করার এত তাড়াই বা ছিল কেন পুলিশের? সিবিআই তদন্তে আপত্তি নেই বলেও কেন গড়িমসি করলেন সরকার মুখ্য? যে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ভুরি ভুরি অভিযোগ, মৃতার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর ইস্তফা গ্রহণ না করে আর এক হাসপাতালে পাঠানোর ঘোষণা, সরকারের চরম অসংবেদী মনোভাবকেই বেআব্রু করেনি কি? স্রোতের মতো ধেয়ে আসা প্রশ্নের কোনও জবাব নেই প্রশাসনের কাছে। অস্বস্তি, মতভেদ বাড়ছে শাসকদলের অভ্যন্তরেও। দিশেহারা দেখাচ্ছে তাদের। কিছুই নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। শুধু দেশী নয়, বিদেশী সংবাদমাধ্যমেও এখন চর্চায় আর জি কর-কান্ড আর তাকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদ বিক্ষোভ। একটা মৃত্যু, নাড়িয়ে দিয়েছে, জাগিয়ে দিয়েছে অগুন্তি মানুষকে।

জানতে ইচ্ছে করে, শাসকদলের দোর্দন্ডপ্রতাপ বাহুবলী নেতা আর তার দলবলের দীর্ঘ শোষণ আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাঁশ লাঠি ঝাঁটা হাতে সন্দেশখালির যে মহিলারা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, যাঁদের তুমুল বিক্ষোভের সামনে হাতজোড় করে ভুল স্বীকার করতে দেখা গিয়েছিল পুলিশ কর্তাদের, যে স্বতঃস্ফূর্ত গণরোষ, ফায়দাসর্বস্ব রাজনীতির কানাগলিতে পথ হারিয়েছিল, প্রতিদিনের বেঁচে থাকার সংগ্রামে বলদর্পীদের হাতে অপমানিত, লাঞ্ছিত সেই প্রান্তিক নারীদের কাছে কি পৌঁছেছিল রাত দখলের বার্তা? তাঁরাও কি একাত্ম বোধ করছেন ন্যায়ের দাবিতে জনগর্জনের সঙ্গে? পার্ক স্ট্রিট থেকে কামদুনী, মধ্যমগ্রাম থেকে হাঁসখালি, দাড়িভিট থেকে আমতা, প্রতিটি অপরাধে শাসকের ভাষ্য মুখ বুজে মেনে না নিয়ে যদি আজকের মতো পথে নামত সাধারণ মানুষ, ভয় না পেয়ে চোখে চোখ রেখে পাল্টা প্রশ্ন করতো, ৩১ বছরের সম্ভাবনাময় জীবনটা কি তাহলে রক্ষা পেত? চিত্রনাট্য কি তবে অন্যরকম হতো? কে জানে!