আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ● ১৬-৩১ ভাদ্র, ১৪৩১
প্রবন্ধ
কর্মস্থলে নারী সুরক্ষা
দেবাদিত্য রায়চৌধুরী
আর জি কর হাসপাতালের নারকীয় ও পৈশাচিক ঘটনা বাংলা সহ গোটা দেশ-বিদেশের মানুষকে স্তম্ভিত ও আতঙ্কিত করেছে। পিজি ডাক্তার ভদ্রমহিলার ধর্ষণ-খুনের ভয়াবহতা ও নৃশংসতা গোটা নাগরিক সমাজকে উত্তাল করে তুলেছে। "আমরা ন্যায়ের দাবি জানাই (We Want Justice)" আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তরূপে অংশগ্রহণ করেছে সমাজের এক বৃহৎ অংশ। এই আবহে ১৪ই আগস্ট রাতে 'রাত দখল' আন্দোলন হয় নারীদের নেতৃত্বে, যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলার প্রতিটি কোণ থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন শহর হয়ে বিদেশের শহরগুলোতেও। স্বাধীনতা দিবসের আগের রাত হয়ে উঠেছিল এক ঐতিহাসিক রাত। নির্যাতিতার সাথে যারা নির্মম অন্যায় করেছিল সেইসকল অন্যায়কারীর দ্রুত গ্রেফতার, শাস্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার দাবির পাশাপাশি নারী সুরক্ষা, নারী-অধিকার, লিঙ্গ-বৈষম্য বিরোধী লড়াই, নারীদের কর্মস্থলে সুরক্ষার অধিকার ছিল মূল আদর্শ - যেগুলিকে সামনে রেখে লড়াই আন্দোলন দানা বেঁধেছিল। এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে অসংখ্য সংগঠন, মানবাধিকার মুভমেন্টের সাথে যুক্ত সক্রিয় কর্মীগণ, রাজনৈতিক দলের কর্মীরা এবং অসংখ্য রাজনৈতিক সচেতন অদলীয় মানুষজন। এই মুহূর্তে রাজপথের দখল নিয়ে রেখেছে মানুষ, তাদের স্লোগান ও দাবিদাওয়া। এই উত্তাল ও সম্ভাবনাময় মুহূর্তে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা প্রয়োজন কর্মস্থলে নারীদের সুরক্ষা ব্যবস্থা, যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও তদন্তের পরিকাঠামো এবং তার সাথে যুক্ত আইনি স্ট্যাটুটরি বডিগুলির সক্রিয়তা (বা নিষ্ক্রিয়তার) বিষয়ে।
দিল্লিতে ২০১২ সালে ঘটে নৃশংস নির্ভয়া-কান্ড, যে ঘটনা গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল - সংসদ থেকে রাজপথ। সেই সময়ে ২০১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর, সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি জে. এস. ভার্মার নেতৃত্বে একটি তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছিল, যা অপরাধ আইন সংশোধনীর সুপারিশ প্রদান করবে, যাতে মহিলাদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত অপরাধীদের দ্রুত বিচার এবং কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়। কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন প্রাক্তন উচ্চ আদালতের বিচারক লীলা শেঠ এবং ভারতের প্রাক্তন সলিসিটর জেনারেল গোপাল সুব্রমণিয়ম। কমিটি তাদের প্রতিবেদন ২০১৩ সালের ২৩ জানুয়ারি জমা দেয়। এতে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, নারী পাচার, শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন, ভুক্তভোগীদের চিকিৎসা পরীক্ষা, পুলিশ, নির্বাচন এবং শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার সম্পর্কিত আইন নিয়ে সুপারিশ করা হয়। প্রসঙ্গতঃ ষাট হাজারের বেশি নাগরিক কিংবা সংগঠনের সুপারিশ জমা পরে ভার্মা কমিটির কাছে। ভবিষ্যতে ভার্মা কমিটির সুপারিশে আসে 'কর্মস্থলে নারীদের প্রতি যৌন হয়রানি (প্রতিরোধ, নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিকার) আইন, ২০১৩' [The Sexual Harassment of Women at Workplace (Prevention, Prohibition and Redressal) Act, 2013]। এখানে বিশদে উল্লেখিত রয়েছে কর্মস্থলে নারীদের উপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগ গ্রহণ ও তদন্তের পদ্ধতি, তদন্তের সময়সীমা, শাস্তির সুপারিশ, 'ইন্টারনাল কমপ্লেইন্টস্ কমিটি' (ICC - আইসিসি) গঠনের নিয়মাবলী, লোকাল কমপ্লেইন্টস কমিটির বিবরণ, জেলাভিত্তিক অফিসার নিয়োগের বিষয়, নিয়োগকর্তার কর্তব্য ইত্যাদি। এই আইনের ভিত্তিতে ২০১৬ সালে ইউজিসি তৈরি করে 'ইউজিসি (উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মহিলা কর্মচারী ও ছাত্র-ছাত্রীদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধ, নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিকার) বিধিমালা, ২০১৫' [UGC (Prevention, Prohibition and Redressal of Sexual Harassment of Women Employees and Students in Higher Educational Institutions) Regulations, 2015]।
আমি নিজে স্নাতকস্তরের শিক্ষাজগতের সাথে যুক্ত, তাই আমি মূলত 'ইউজিসি (উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মহিলা কর্মচারী ও ছাত্র-ছাত্রীদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধ, নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিকার) বিধিমালা, ২০১৫'-র বাস্তবায়ন, প্রভাব, সক্রিয়তা (বা নিষ্ক্রিয়তা), কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এই নিয়মাবলীর ব্যাবহারিক বিষয়গুলি নিয়ে কিছু কথা বলতে ইচ্ছুক। বহু হাজার মতামত, পরামর্শকে অন্তর্ভুক্ত করে তৈরি ইউজিসি-র এই নিয়মাবলী। কিন্তু বর্তমানে সরেজমিনে বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আইনের বাস্তবায়নের চিত্রটি মোটেই আশাব্যঞ্জক পরিস্থিতিতে নেই।
'ইউজিসি (উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মহিলা কর্মচারী ও ছাত্র-ছাত্রীদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধ, নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিকার) বিধিমালা, ২০১৫'-তে প্রথমেই বলা রয়েছে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যথাযত ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে সকল কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা আইনটিতে থাকা বিভিন্ন শব্দ - 'সংক্ষুব্ধ (aggrieved)', 'ইন্টারনাল কমপ্লেইন্টস কমিটি (ICC)', 'যৌন নির্যাতন', 'থার্ড পার্টি নির্যাতন', 'ভিক্টিমাইজেশন', 'কর্মক্ষেত্র' ইত্যাদি সম্বন্ধে একটি ধারণা তৈরি করতে পারে। বলা রয়েছে যে এই আইনের কোন কোন প্রভিশন-এর দ্বারা কীভাবে কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথ রয়েছে সেই ব্যাপারে ব্যাপক সচেতনতা বিস্তার করা ও প্রচার করার কথা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের কর্তব্যের মধ্যে পড়ছে সেমিনার, ওয়ার্কশপ, ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামের মধ্যে দিয়ে সকল স্টেকহোল্ডারকে সচেতন করা এবং আইন অনুযায়ী তাদের অধিকার, প্রাপ্য এবং দায়িত্ব সম্পর্কে জ্ঞান ও সচেতনতা নিশ্চিত করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এই বিষয়ে চূড়ান্ত উদাসীনতা ও দায়সারা ভাব। বহু কলেজেই এই বিষয়গুলোর ওপর তৈরি পোস্টার কলেজের নোটিশ বোর্ডে টাঙানো থাকে না, আইনের বিষয়গুলো লেখা থাকে না সর্বজনীন প্রদর্শনে। অ্যান্টি-র্যাগিং এবং কর্মস্থানে যৌন নির্যাতন সংক্রান্ত আইনি বিষয়গুলি (যেমন অপরাধের সংজ্ঞা, নালিশ জানানোর স্থান, তদন্ত প্রক্রিয়া ইত্যাদি) কলেজে বহু স্থানে সর্বজনীন প্রদর্শনের দ্বারা দৃশ্যমান থাকার কথা, কেবলমাত্র কলেজের ওয়েবসাইটের কোনো কোণায় তা পড়ে থাকার কথা নয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই বিষয়গুলিকে অবজ্ঞা করে এগোনোর প্রবণতা সিংহভাগ কলেজ প্রশাসকদের মধ্যে প্রবল। এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে খুব কম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই কর্মস্থানে যৌন নির্যাতন সংক্রান্ত আইন সম্বন্ধে জনসচেতনতা গড়ে তোলার তাগিদ দেখা যাচ্ছে। সামনে ন্যাক (NAAC) ভিজিট নামক প্রহসনটি থাকলে অবশ্য রাতারাতি বোর্ড টাঙিয়ে এই বিষয়গুলির পোস্টার, ছবি ইত্যাদি বানানো হয়ে থাকে, নচেৎ সিংহভাগ কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসকই এই বিষয়গুলিতে উদাসীন মনোভাব দেখিয়ে চলেন। বেশিরভাগ কলেজ কর্তৃপক্ষ ব্যস্ত মানুষ, তারা 'উন্নয়নের' কাজে ব্যস্ত থাকেন, এটি দুর্ভাগ্যের যে জনসচেতনতা আজও আমাদের দেশে উন্নয়নের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি।
পূর্বোক্ত আইনের একটি মূল জায়গা সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে 'ইন্টারনাল কমপ্লেইন্টস কমিটি (ICC - আইসিসি)' তৈরি করা। যৌন হয়রানির ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে লিঙ্গ সংবেদনশীলতার জন্য একটি অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়া থাকতে হবে এই আইসিসি-র মধ্যে। এই আইসিসি গঠনের রূপ কি হবে সেই বিষয়ে পূর্বোক্ত আইনে বলা আছে। আইসিসি-র প্রিসাইডিং অফিসার হবেন একজন মহিলা যিনি কোনোভাবেই অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর (কলেজের ক্ষেত্রে) র্যাঙ্কের তলায় হবেন না। যদি ওই র্যাঙ্কের কোনো মহিলা অফিসার না থাকেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, তাহলে একই প্রশাসনিক অনুক্রমে থাকা কোনো অফিস থেকে প্রিসাইডিং অফিসার মনোনীত হবেন। শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মী, শিক্ষাবন্ধু ও শিক্ষার্থীদের থেকেও প্রতিনিধি মনোনীত আকারে থাকতে হবে এই আইসিসি-তে। লিঙ্গ অধিকার এবং আইনি জ্ঞানে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বেসরকারী সংস্থার একজন সদস্যকেও আইসিসি-র অংশ হিসেবে মনোনীত করতে হবে। এই কমিটির পঞ্চাশ শতাংশ সদস্য অবশ্যই মহিলা হতে হবে। প্রত্যেক তিন বছর অন্তর এই কমিটির পরিবর্তন করতে হবে। এবং পারতপক্ষে কর্তৃপক্ষের প্রত্যেক এক বছর অন্তর এই কমিটির এক-তৃতীয় অংশকে পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রশাসনিক পদে থাকা কোনো মানুষ (উপাচার্য, অধ্যক্ষ, সহ উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, বিভাগীয় প্রধান ইত্যাদি) এই কমিটির অংশ হতে পারবেন না। এই সকল প্রকারের নিয়ম ও শর্ত মেনে আইসিসি সদস্যদের মনোনয়ন করতে হবে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষকে।
এ তো গেল আইনে থাকা ভালো সুন্দর কথাগুলি যে কী হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই কমিটিটিকে নিষ্ক্রিয় করে রেখে দেওয়া হয়। সিংহভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইসিসি-র মাথায় এবং বাকি পদে রাখা হয় কর্তৃপক্ষের 'নিকটবর্তী' মানুষজনকে, এর ফলে আইসিসি-র কার্যকারিতায় বিশ্বাসযোগ্যতা ও ভরসার জায়গাটি কমে যায় বাকিদের মধ্যে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই কমিটিটি বছর ঘুরে গেলেও মিটিংয়ে বসে না, কলেজের কোথাও কোনো ধরণের নির্যাতনের বিষয় আছে কিনা সেটি খুঁটিয়ে দেখতে চেষ্টা করে না। যেহেতু তারা নিজেদের থেকে কোনো প্রচেষ্টা করে না অন্ধকার অন্যায়ের দিকগুলি খুঁজে পেতে বা নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে স্থাপিত করতে, তাই বাকি কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা ভরসা পায় না সমস্যার কথা নিয়ে এগিয়ে আসতে। এই কমিটিটি একটি স্বতন্ত্র কমিটি হওয়ার কথা যার উপর অধ্যক্ষ কিংবা কোনো প্রশাসনিক পদে থাকা মানুষের হস্তক্ষেপ চলার কথা নয়। কিন্তু কার্যকরী ক্ষেত্রে দেখা যায় যেহেতু কমিটির মানুষগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে অধ্যক্ষের কাছের মানুষ, তাই এই কমিটির কোনো তদন্ত বা অন্য বিষয়ের আলোচনাতে অধ্যক্ষ বা পদে থাকা মানুষরা অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। এর ফলে বহুক্ষেত্রেই কমিটির নিরপেক্ষতা ও স্বতন্ত্রতা নিয়ে ন্যায়সঙ্গত প্রশ্ন জাগে বাকিদের মনে। যে মহৎ উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল আইসিসি, সেই লিঙ্গ অধিকার, লিঙ্গ কর্মসূচি, যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের জায়গাগুলি দুর্বল হতে থাকে। দুর্বল হয়ে পড়ে নারী সুরক্ষার লড়াই।
আর জি করের নৃশংস ঘটনার আবহে আরও বেশি করে এই দিকটিকে আমাদের গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। যে সকল অভিযোগ, কথোপকথন, ক্লিপ্স, বক্তব্য, ঘটনাক্রম (যাচাইকৃত ও অযাচাইকৃত) উঠে এসেছে মানুষের সামনে তাতে করে সিস্টেমের বা কর্তৃপক্ষের ভিতরে থাকা প্রভাবশালী মানুষদের হাত থাকাকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না একেবারেই। আজকের আবহে আর জি কর-এ আইসিসি-র ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরি। যদি আইসিসি-র ভেতরে থাকা মানুষজনের একটি বড় পরিচয় হয় যে তারা কর্তৃপক্ষের কাছের ও বিশ্বস্ত মানুষ তাহলে তাদের কাছ থেকে স্বতন্ত্র ন্যায়বিচার পাওয়া কি কোনোদিন সম্ভবপর কোনো নির্যাতিতার পক্ষে? এই কারণগুলির জন্যে আন্দোলনরতরা দাবি তুলছে সর্বত্র আইসিসি-কে ঢেলে সাজাতে হবে নতুন করে। পূর্বোক্ত আইনকে 'অক্ষরে অক্ষরে ও মর্মে (in letter and spirit )' মেনে সেই কাজ করতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ তথা অধ্যক্ষকে।
পূর্বোক্ত আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আইসিসি-র কাজের পরিধি ও দায়িত্ব, যা স্পষ্টভাবে লেখা আছে। কোনো নির্যাতিতা লিখিত অভিযোগ জানাতে ভীত বা দ্বিধাবোধ করলে কমিটির সদস্যদের তার মধ্যে কনফিডেন্স গড়ে তুলতে হবে, এবং সময় নিয়ে সেই লিখিত অভিযোগ করাতে হবে নির্যাতিতাকে দিয়ে। বিতর্ক নিষ্পত্তি এবং সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা পূর্বানুমান এবং সমাধানের জন্য এমন একটি পদ্ধতি সরবরাহ করতে হবে যা অভিযোগকারীর অধিকারকে ক্ষুণ্ণ না করে ন্যায়সঙ্গত এবং সুবিচারপূর্ণ সমঝোতার মাধ্যমে সম্পন্ন করে। বিষয়টি বিচারাধীন থাকা অবস্থায়, অভিযোগকারীর পরিচয় ফাঁস না করে তার নিরাপত্তা সুরক্ষিত করা এবং অনুমোদিত ছুটি, উপস্থিতির শিথিলতা, বা অন্য বিভাগ বা তত্ত্বাবধায়কের কাছে স্থানান্তরের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা আইসিসি-র কর্তব্য। কমিটির কর্তব্য নিশ্চিত করা যে ভুক্তভোগী বা সাক্ষীরা যেন নির্যাতনের শিকার না হন বা বৈষম্যের সম্মুখীন না হন। কিন্তু এই সকল নিয়ম কতটা বাস্তবায়িত করতে সচেষ্ট বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটিগুলি এবং কর্তৃপক্ষ সেই বিষয়ে প্রচুর সংশয় থেকে যাওয়ার যুক্তিসঙ্গত অবকাশ আছে। এখানেই প্রশ্ন আসে সিংহভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্তমানে লিঙ্গ সংবেদনশীলতার পরিস্থিতি ঠিক কোন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে। ন্যায়ের জন্যে যে লড়াই লড়ছেন নাগরিকরা রাজপথে তার একটি মূল দিক এই লিঙ্গ সংবেদনশীলতা, যেটি ছাড়া পুনরায় ঘুরে ঘুরে দিল্লি, হাথরাস, উন্নাও, আর জি কর হতেই থাকবে এক নৃশংস গোলাকার চক্রের স্বরূপ।
উপরোক্ত আইনে বিস্তারিত বলা দেওয়া আছে অভিযোগ দায়ের এবং তদন্ত পরিচালনার প্রক্রিয়া সম্বন্ধে। অভিযোগ দায়ের এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অভিযোগের তদন্ত করার জন্য আইসিসি উপরোক্ত আইনের বিধি ও পদ্ধতি মেনে চলবে। নির্যাতিতাকে নির্যাতনের ঘটনার ৩ মাসের মধ্যে লিখিত অভিযোগ জানাতে হয় কমিটিকে, এবং যদি নির্যাতিতা কোনো কারণে লিখিত অভিযোগ জানাতে দ্বিধাবোধ করেন তাহলে কমিটিকেই তাকে সকল রকম সহায়তার (মানসিক এবং অন্য) মাধ্যমে রাজি করাতে হবে। কমিটিকে অভিযোগ গ্রহণের পর থেকে ৯০ দিনের মধ্যে নিজেদের তদন্ত সেরে অধ্যক্ষকে রিপোর্ট জমা করার বিধান আছে আইনটিতে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় বহু ক্ষেত্রেই সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও তদন্ত ও তার নামে প্রহসন চলতে থাকে, যেখানে তদন্তের প্রক্রিয়া নির্যাতিতার কাছে আরেকটি অভিশাপ ও নির্যাতন হয়ে ওঠে। অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিকার, শাস্তি, ক্ষতিপূরণ-এর বিষয়ে বিশদে বলা আছে উপরোক্ত আইনে। সমঝোতার অবকাশ রাখা আছে আইনে, কিন্তু সেটি অবশ্যই আইসিসি-কে সাথে ও মাঝে রেখে। আর্থিক মীমাংসা কোনোভাবেই সমঝোতার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।
অভিযোগ দায়ের এবং তদন্তের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল অভিযোগকারিণীর সুরক্ষা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যায় যে অভিযোগ দায়ের হওয়ার পর অভিযোগকারিণীকে বিভিন্ন অংশ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হুমকির সম্মুখীন হতে হয় এবং কর্মক্ষেত্রে তাকে মানসিক হেনস্থার শিকারও হতে হয়। কর্মক্ষেত্রে অঘোষিত সামাজিক বয়কটের মতন ঘৃণ্য অত্যাচারের ফলে অনেককে অভিযোগ তুলে নিতে হয় কিংবা কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করতে হয়। দেশের বিভিন্ন ইনস্টিটিউট থেকে গবেষকদের এই ধরণের অভিযোগ হামেশাই শুনতে পাওয়া যায়। পিএইচডি সুপারভাইজারের বিরুদ্ধে অভিযোগকারিণীকে অন্য কোনো শিক্ষক তার অধীনে পিএইচডিতে না নেওয়ার একটি দুর্ভাগ্যজনক রীতি আছে বহু জায়গায়। এই বিষয়ের মীমাংসার দিক হলো ব্যাপক হারে লিঙ্গ সচেতনতার ও যৌন হেনস্থা বিরোধী প্রচার এবং অভিযোগকারিণীকে সকল ধরণের উৎপীড়ন থেকে সুরক্ষা প্রদান করার দায়িত্ব যে কর্তৃপক্ষের সেই বিষয়ে সকলকে ওয়াকিবহাল করা। কোনো জায়গায় অভিযোগকারীর সুরক্ষার সমস্যা এলে বাকি সহকর্মীদের দায়িত্ব হলো একত্রিত হয়ে আইন অনুসারে কর্তৃপক্ষকে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করা যাতে অভিযোগকারিণী কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষিত বোধ করে এবং প্রতিহিংসার শিকার না হয়।
আইনটির শেষ যে বিষয়ে আলোচনা করতে চাই সেটি হল অযৌক্তিক ও মিথ্যে অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা। কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি থেকে সুরক্ষার জন্য প্রদত্ত বিধানগুলির যাতে অপব্যবহার না হয় তা নিশ্চিত করতে, মিথ্যা বা ক্ষতিকর অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে আইনটিতে এবং তা সমস্ত উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচার করতে হবে। যদি আইসিসি সিদ্ধান্তে পৌঁছয় যে অভিযোগ মিথ্যা, ক্ষতিকর ছিল বা অভিযোগকারী মিথ্যা জানার পরেও অভিযোগ করেছে, অথবা তদন্তের সময় জাল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য সরবরাহ করেছে, তাহলে অভিযোগকারী শাস্তির যোগ্য হবেন। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মিথ্যা অভিযোগ জমা পড়ার প্রবণতা বাড়ছে, এবং সেই মিথ্যা অভিযোগকে ঘিরে অভিযুক্তর উপর মানসিক উৎপীড়ন সৃষ্টির প্রক্রিয়া তৈরি হচ্ছে। কোথাও মিথ্যা অভিযোগ, কোথাও বা 'ভিন্ন সুরের' মানুষের নামে অযৌক্তিক অভিযোগ ঘিরে ক্যাঙ্গারু কোর্ট বসানোর প্রক্রিয়ার প্রবণতা চোখে পড়ছে। এই ধরণের মিথ্যা অভিযোগের ঘটনা, অভিযুক্ত মানুষটির মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে এবং তাকে মানসিক অত্যাচারের শিকার বানাচ্ছে। যেই প্রতিষ্ঠানগুলিতে আইসিসি-কে কর্তৃপক্ষের কুক্ষিগত করে রাখা রয়েছে এবং তার স্বতন্ত্র কার্যকারিতা সম্বন্ধে প্রশ্ন আছে তাদের বিরুদ্ধেই এই অভিযোগগুলি বেশি করে বিরাজমান। এই খারাপ প্রতিহিংসাপরায়ণ কাজগুলি আসলে লিঙ্গ অধিকার, লিঙ্গ সংবেদনশীলতা এবং যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে লড়াইকে দুর্বল করে।
এ' প্রসঙ্গে দেশের বাস্তব চিত্রটি একটু দেখে নেওয়া যাক। ভারতে ২০১৮ সাল থেকে প্রতি বছর ৪০০টিরও বেশি যৌন হয়রানির মামলা রিপোর্ট হয়েছে, 'জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরো' (এনসিআরবি)-এর তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর গড়ে ৪৪৫টি মামলা রিপোর্ট হয়েছে। ২০২২ সালে, সর্বশেষ উপলব্ধ তথ্য অনুযায়ী, দেশের মধ্যে ৪১৯টিরও বেশি মামলা রিপোর্ট হয়েছে, যা প্রায় ৩৫টি মামলা প্রতি মাসে। অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক তথ্য ও বিশ্লেষণ কেন্দ্রের তথ্য উল্লেখ করে, দেশের কোম্পানিগুলি ২০২২-২৩ আর্থিক বছরে ১,১৬০টি যৌন হয়রানির অভিযোগ রিপোর্ট করেছে। এটি গত দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যা। বহুক্ষেত্রে দেখা গেছে অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়েছে চাপের মুখে অথবা কোম্পানি বদল করে নেওয়ায়। 'কর্মস্থলে নারীদের প্রতি যৌন হয়রানি (প্রতিরোধ, নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিকার) আইন, ২০১৩' [The Sexual Harassment of Women at Workplace (Prevention, Prohibition And Redressal) Act, 2013] আইনটি এক দশকেরও বেশি সময় আগে নারীদের সুরক্ষিত করার এবং যৌন হয়রানি মোকাবিলা জন্য ব্যবস্থা প্রদান করার উদ্দেশ্যে গৃহীত হয়। তারপরেও দেশজুড়ে কর্মক্ষেত্রে নারীদের সুরক্ষার এইরূপ দুরবস্থা। এই দুরবস্থা একটি সিস্টেমিক সমস্যা যার বিরুদ্ধে লড়াইটাও ব্যবস্থা ও সিস্টেম বদলের লড়াইয়ের সমান।
লেখাটির সিংহভাগজুড়ে রয়েছে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী সুরক্ষা, যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইসিসি-র ভূমিকা। আমাদের দেশের এক বিশাল অংশ অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক (যারা সরকারি বা বড় কর্পোরেট সেক্টরে পড়ছে না)। এই অংশের নারীশ্রমিকদের সুরক্ষা, যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে অভিযোগের জায়গা প্রচণ্ডই দুর্বল এবং সম্পূর্ণরূপে মালিকশ্রেণি নির্ভরশীল। কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন লেবার কোডগুলি (যেগুলি ২০১৯ ও ২০২০ সালে সংসদে পাস হয়েছে) প্রবলরূপে শ্রমিকবিরোধী আইন, যা নিয়ে দেশের ট্রেড ইউনিয়নগুলি তীব্র আন্দোলনে নেমেছে। নতুন লেবার কোডগুলিতে যেমন একদিকে কর্মী নিয়োগ ও বরখাস্ত করাকে সরল করে দিয়েছে (লেবার ডিপার্টমেন্টের ভূমিকা হয়ে গেছে নগন্য) মালিকপক্ষের সুবিধার্থে, অপরদিকে কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও নারীসুরক্ষার জায়গাকেও দুর্বল করা হয়েছে। মালিকপক্ষের স্বেচ্ছায় শ্রমিক নিয়োগ ও বরখাস্ত করার ব্যবস্থা আরও নিরুৎসাহিত করবে নির্যাতিতাদের এগিয়ে এসে অভিযোগ করার বিষয়ে। মহিলা শ্রমিকদের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা, মাতৃত্বকালীন ছুটির বিষয়ে নতুন লেবার কোডগুলি নিশ্চুপ। মহিলা শ্রমিকদের জন্যে রাত্রিকালীন শিফট বা প্রসারিত কর্মসময়ের বিষয়ে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থার উল্লেখ নেই আইনগুলিতে। এটি স্পষ্ট যে কেন্দ্রের সরকার সম্পূর্ণরূপে শ্রমিক-বিরোধী অবস্থান থেকে লেবার আইনগুলি এনেছে এবং সেই শ্রমিক বিরোধিতার অংশ হিসেবে মহিলা শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও অধিকারের বিষয়গুলিও প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়েছে। দেশের ট্রেড ইউনিয়নগুলি যেরকম তীব্র আন্দোলন করছে এই নতুন লেবার আইনগুলির বিরুদ্ধে, সেইরূপ আরও জোরালো আন্দোলন লাগবে মহিলা শ্রমিকদের অধিকার, কর্মক্ষেত্রে নারীসুরক্ষা ও যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্যবস্থার বিষয়ে। অতীতের শ্রমিক অধিকারের সংগ্রামের আলোকে, আমরা উপরোক্ত বিষয়গুলিতে বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলির উপর ভরসা করতে পারি।
আমাদের দেশে নারীসুরক্ষা ও যৌন নির্যাতন বিরোধী আইনের প্রভিশনস আছে, আইনি ব্যবস্থা আছে কিন্তু নারী সুরক্ষা আজও সোনার পাথরবাটি হয়ে রয়ে যাচ্ছে। নারীদের আজ রাত দখলের ডাক দিতে হচ্ছে কারণ আমরা বুঝতে পারছি কোথাও একটা রাত, অন্ধকার এই সময়গুলি দেশের পঞ্চাশ শতাংশ জনগণের জন্যে বিভীষিকা। আর জি কর-এর ডাক্তার বোনটির সাথে ঘটে যাওয়া নৃশংস ঘটনার ন্যায়ের দাবি ও লড়াই আমাদের আবার বুঝিয়ে দিচ্ছে কর্মক্ষেত্রে (এবং বাকি জায়গাতেও) মহিলারা কতটা অসুরক্ষিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আইসিসি-কে ঢেলে সাজানোর এবং তাকে কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ থেকে স্বতন্ত্র করার দাবি উঠুক। সময় মতন আইসিসি-র মিটিং, নিরপেক্ষ তদন্তের পরিবেশ ও পরিকাঠামো তৈরি, লিঙ্গ অধিকার, লিঙ্গ সংবেদনশীলতা এবং যৌন হয়রানি ও নির্যাতন বিষয়ক সেমিনার আয়োজন হোক - এই আমাদের দাবি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে। যেইসব দুষ্ট শক্তি মিথ্যা অভিযোগ সামনে এনে লিঙ্গ সংবেদনশীলতার পক্ষে এবং যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াইকে দুর্বল করতে চায় তাদের আসল উদ্দেশ্য এই শক্তিশালী যুগান্তকারী আইনকে অকার্যকর এবং অপ্রয়োজনীয় করে তোলা। আমাদের সকলের লড়াই হোক এই শক্তিদেরকে চিহ্নিত করে বিচ্ছিন্ন করা। ন্যায়ের লড়াইয়ে এখনও অনেক দূর হাঁটতে হবে, সংগ্রাম করতে হবে আমাদের। সুরক্ষিত কর্মস্থান আমাদের অধিকার, এবং সেই অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের। সেই লক্ষ্যে সবাই মিলে একত্রিত হয়ে আওয়াজ তোলা জরুরি।
“Injustice anywhere is a threat to justice everywhere. We are caught in an inescapable network of mutuality, tied in a single garment of destiny. Whatever affects one directly, affects all indirectly.” - Martin Luther King Jr.
ডিসক্লেইমারঃ এই নিবন্ধটি দেশের বিভিন্ন স্থানের সমাজ-রাজনৈতিক, একাডেমিক পর্যবেক্ষণ এবং ঘটনাবলির ভিত্তিতে লেখা হয়েছে, এবং কোনো নির্দিষ্ট বা বিশেষ কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিতে নয়। নিবন্ধে উত্থাপিত সমস্যাগুলি লেখকের নিজস্ব কর্মস্থল (কলেজ)-এর সাথে কোনোভাবেই সম্পর্কিত নয়।