আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ● ১৬-৩১ ভাদ্র, ১৪৩১

প্রবন্ধ

লজ্জা ঢাকার কাপড় নেই

মালবী গুপ্ত


নাহ, আজ আর কেউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাজা/রানিকে এই প্রশ্ন করবে না ‘...তোর কাপড় কোথায়?’ কারণ সে কাপড় অনেকদিন আগেই তাকে বেআব্রু করে ফেলেছে। এখন তাই আর লজ্জা ঢাকতে তার কোনও কাপড়ের দরকার হয় না। কোনও নৃশংসতা আড়াল করতে কাপড় লাগে না।কোনও চুরি/ডাকাতি চাপা দিতেও কাপড়ের প্রয়োজন হয় না তার। লাগে না তার অজস্র কুকর্ম আর মিথ্যা লুকোতেও।আসলে সেই কাপড়ের শোভনসজ্জা যে ভূলন্ঠিত হয়েছে বহু বহু দিন আগে।

তা না হলে, যাঁদের হাতে আমাদের জন্ম হয়, যাঁদের চিকিৎসায় সুস্থ হই, অনেক সময়ই নবজীবন লাভ করি, সেই রকমই এক মহিলা চিকিৎসকের এই কলকাতার বুকে সরকারি হাসপাতালেই এমন নৃশংসতম হত্যা ঘটত? তা না হলে, প্রকট হয়ে ওঠা সরকারি নির্লজ্জ গাফিলতির দায় স্বীকার না করে অভিযোগ ওঠা ওই হত্যায় ‘ষড়যন্ত্রকারী’দের সর্বতোভাবে এমন আড়াল করার ব্যাকুল প্রচেষ্টা লক্ষ করা যেত? তা না হলে, ওই হত্যার বিরুদ্ধে দল-মত নির্বিশেষে আবালবৃদ্ধবনিতার শহরজুড়ে, রাজ্যজুড়ে, দেশজুড়ে এবং বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে উঠে আসা প্রতিবাদের বজ্র নির্ঘোষের গায়ে এমন সহজেই দলীয় রাজনীতির রং চাপিয়ে দেওয়া যেত?

যেত না। আসলে যেই লঙ্কায় যান না কেন, সেই ক্রমে ওই রাবণই হয়ে ওঠেন। ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হয়ে যাওয়া রাজা-রানিরা তখন প্রজাদের ওপর তাঁরই পারিষদদের দ্বারা অবিরত ঘটতে থাকা যাবতীয় অন্যায়, অত্যাচার আর নিষ্ঠুরতায় ছাড়পত্র দিতে থাকেন। না গুপ্ত নয়, বরং রাস্তায় বুক চিতিয়ে চলা তাঁর ‘অবৈধ’ বাহিনীর মাধ্যমে নাগরিকদের এক অংশকে শোষণ, পীড়ন আর নানা অত্যাচারের মাধ্যমে নিজেদের ও দলীয় কোষাগার ভরে তোলেন। এবং সেই কোষাগার থেকে ছিটেফোঁটা অর্থ অনুদান আর এক অংশের নাগরিকদের দিকে ছুঁড়ে দেন। বিনিময়ে তাদের আনুগত্য কিনে নিয়ে, ‘মানুষের জন্য প্রচুর কাজ করা’র দুর্বিনীত অহঙ্কার প্রদর্শন করেন। কেউ কেউ আবার নিজেকে সর্বশক্তিমান ভেবে ফেলার আহাম্মকিও করে ফেলেন।

অথচ এখন কান পাতলেই শোনা যায়, সমাজের নানা স্তর থেকে উঠে আসা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা, যন্ত্রণা আর অসহায়তার কথা। কেউ তার প্রতিবাদ করলে তার প্রতি চলতে থাকা হুমকি, পীড়ন, এমনকি হত্যার ঘটনাও তো মাঝেমাঝেই ঝলকে ওঠে সংবাদমাধ্যমে। যা আবার অনেক সময়ই ‘পারিবারিক’ বা ‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব’ কিংবা শাসক ও শাসকদলের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র’র তকমা সেঁটে প্রচারে জায়গা নিয়ে নেয়।

আসলে ক্ষমতায় আসীন শাসকরা এখন আর নিজেদের ভুলত্রুটি জানতে সিংহাসন ছেড়ে পথে নেমে আসেন না, ভুল সংশোধন তো দূরের কথা। আসলে অন্যের চোখ দিয়ে দেখতে দেখতে, অন্যের কান দিয়ে শুনতে শুনতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়া উদ্ধত অহঙ্কারী শাসকরা ধরেই নেন তাঁরা অজেয়।ধরেই নেন তাঁদের অন্যায়, পীড়নের মৌরসি পাট্টা কায়েম রাখবে অনন্তকাল ধরে। কিন্তু তা যে চলে না, তার এখনও পর্যন্ত সর্বশেষ সদ্য অতীত হয়ে যাওয়া বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতন তো জ্বলজ্বল করছে।

যে পতনের প্রধান কান্ডারী ছিল সে দেশের অরাজনৈতিক ছাত্র-যুব সমাজ ও সাধারণ নাগরিক। যাদের রাজপথ দখলের অভিঘাত সারা বিশ্বকেই কাঁপিয়ে দিয়েছে। একথা সত্য যে, কোনও কোনও দেশে হঠাৎ ঘটে যাওয়া এমন রাজনৈতিক পালাবদলে অনেকেই ঘোলা জলে মাছ ধরতে যান। যার মাশুল গুনতে হয় সেই দেশের সাধারণ মানুষকেই। যার ঝাপটায় বহু নাগরিকের ঘরবাড়ি জীবন-জীবিকা গভীর অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হতে থাকে। পিছনে ধাওয়া করা সংঘঠিত বর্বরোচিত হত্যার উন্মাদনায় তাদের জীবন তলিয়ে যেতে থাকে চরম নিরাপত্তাহীনতার অতলান্তিক গহ্বরে। যেমনটা ঘটেছে সে দেশে।

যার রেশ কাটতে না কাটতেই ৮-৯ আগস্ট গভীর রাতে কলকাতায় আর জি কর হাসপাতালে ঘটে যাওয়া এক মহিলা চিকিৎসকের বীভৎসতম নারকীয় হত্যা সারা দেশকে নাড়িয়ে দেয়। স্তম্ভিত করে দেয় গোটা বিশ্বকে। এবং ওই চিকিৎসক হত্যার প্রতিবাদে ও মেয়েদের নিরাপত্তার দাবিতে কলকাতার এক গবেষক ছাত্রী সমস্ত নারীর কাছে মধ্যরাতে রাজপথ দখলের আহ্বান জানালে, তাতে সাড়া দিতে সারা ভারত যেন উত্তাল হয়ে ওঠে। তিনি বেছে নেন ৭৭ বছর আগে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণার মাহেন্দ্রক্ষণটিকে। আর তাঁর সেই আহ্বানকে সফল করতে গোটা দেশে, বিশ্বের নানা প্রান্তে যে অভাবনীয়, অভূতপূর্ব গর্জন উঠল ১৪ আগস্টের মধ্যরাতে, তা পৃথিবীর গণপ্রতিবাদের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

এবং তার পর থেকে ওই নৃশংস হত্যার বিচার তথা অপরাধীদের শাস্তি চেয়ে প্রতিদিন রাজ্যের, দেশের, বিদেশের কোথাও না কোথাও প্রতিবাদী কন্ঠ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। অবশ্য যাঁরা ধর্মেও থাকেন, জিরাফেও থাকেন তাঁরা বাদে, জাস্টিস’র দাবিতে সমাজের সমস্ত স্তরের নারী পুরুষ নির্বিশেষে যেভাবে আওয়াজ তুলেছেন, তা যে অচিরেই স্তব্ধ হওয়ার নয়, তা রাজ্যের শাসক ভালই টের পেয়েছে।

তাই সেই প্রতিবাদের গায়ে দিশেহারা রাজ্য সরকার অবিরত কলঙ্ক লেপনের চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু সেই কলঙ্কের কালি যে ক্রমাগত তার নিজের গায়েই ছিটকে পড়ছে।এমনিতে রাজ্যে কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদ হলেই তা ‘বিরোধী দলের চক্রান্ত’, বলে এ ক্ষেত্রেও দাগিয়ে দেওয়ার তত্ত্ব যে ক্রমশ অতি হাস্যাস্পদ হয়ে উঠছে, শাসকের পরামর্শদাতারা কি সে ব্যাপারে সরকারকে কোনও সতর্কবার্তা দিচ্ছেন না? নাকি সেই সত্য অনুধাবনের ক্ষমতাটুকুও তাঁদের নেই। নাকি মুন্ডু যাওয়ার ভয়ে আনুগত্য আর তোষামোদের জাল কেটে বেরিয়ে এসে সরকারকে সৎ পরামর্শ দিতে চাইছেন না? অবশ্য মুন্ডু গেলে কী খাব - তার একটা ঝুঁকিও থেকে যায় বৈকি। নাকি অতি আত্মবিশ্বাসী তাঁরাও ভাবছেন, রাজ্যবাসীর জন্য ‘এত ভাল কাজ’ হয়েছে, ‘আর কিছু করার বাকি নেই’। এবং ওই দু' চারটে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ অনায়াসে ঝেড়ে ফেলে ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে।

আসলে ওই ক্ষমতা দখল এবং তা টিকিয়ে রাখার অদম্য বাসনা ও লোভই তাদের এমন অন্ধত্বের চোরাগলিতে নিক্ষেপ করে যে, তারা নিজেরাই আর বেরোনোর পথ খুঁজে পায় না। তবে মনে রাখা দরকার, বিশ্বের বহু দেশেই সরকারে আসীন, ক্রমশ হয়ে ওঠা একনায়ক বা একনায়িকারাও জনতার জন্য প্রথমে কিছু ভাল কাজ করে।কিন্তু সেই ভাল কাজই ক্রমশ চাপা পড়তে থাকে তাদের বিবিধ খারাপ ও অনৈতিক কাজের নীচে। এবং সব কিছু দখলে রাখার প্রবণতা তাকে স্বৈরাচারী করে তোলে। আর আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য যে, সেইসব সরকার অনুমোদিত স্বৈরাচারের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে এবং তা বন্ধের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে, অন্ধ প্রশাসকদের কঠোর নির্দেশ দিতে হয় সেই দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে।

পশ্চিমবঙ্গেও তার অন্যথা ঘটেনি। সরকারের কিছু ভাল কাজের দোহাই দিয়ে সর্বস্তরে বিপুল চুরি, তোলাবাজি, গুন্ডামির মতো যাবতীয় অন্যায় দুর্নীতি যে বৈধতা পেতে পারে না। এবং সেই কুকর্ম অসংখ্য সাধারণ নাগরিকের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা কেড়ে নিয়ে তাদের জীবনকে যদি ক্রমাগত এক দুর্দশার দিকে ঠেলে দিতে থাকে, তা হলে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সেইসব মানুষ এক দিন না এক দিন তো তার প্রতিবাদে ঘুরে দাঁড়াবেই। এবং তার সমর্থনে তো অন্যরাও পথে নামবে। মিথ্যার চাবুক হাঁকিয়ে তো তাকে দমন করা যাবে না।

আসলে মুশকিল হল এই, অতি উৎসাহে যে সরকার একবার বাঘের পিঠে চড়ে বসে, সেই বাঘের পিঠ থেকে অত সহজে যে নেমে পড়া যায় না, তা তার বোধগম্যই হয় না। কারণ সত্য যে, সত্যই। তার অমোঘ শক্তিকে চাপা দিতে লক্ষ কন্ঠের মিথ্যাও এক দিন যে তৃণবৎ উড়ে যায় - সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কি আমরা বার বার প্রত্যক্ষ করছি না?