আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২৪ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪৩১
প্রবন্ধ
'ডংকি'
শুভাশিস মুখোপাধ্যায়
সরকারি মদতে মানুষের জন্য বিজ্ঞানচর্চার অভিমুখ স্থির করার এক কষ্টকর প্রক্রিয়া চালু করার চেষ্টায় একদিকে যেমন জনমুখী বিজ্ঞানীরা উদ্যোগ নিয়েছিলেন, অন্যদিকে প্রকৃত বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত একদল 'আমলা বিজ্ঞানী' বা পরিভাষায় 'টেকনোক্র্যাট' একইরকমভাবে উদ্যোগী হন। নরসিমা রাও-এর প্রধানমন্ত্রীত্বের কালে ভুবনায়ন বা 'গ্লোবালাইজেশন'-এর উদ্যত রথ সারা ভারতে কখনও 'সুযোগ্য সারথি' কখনও বা 'অযোয্য সারথি'-দের হাত ধরে চলা শুরু করেছে। 'জনকল্যাণ' আসলে 'অপ্রয়োজনীয় ভরতুকি', এই ধারনা জনমনে গেঁথে বসছে ধীরে ধীরে। যেখানে 'প্রফিট', সেখানে সরকারের 'লগ্নি' নেই, এই ধারনার গ্রহণযোগ্যতা সমাজে মন্দ নয়।
বিজ্ঞানী ও আমলাদের যৌথ উদ্যোগেই হয়তো বা ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের অধীনে তিন-চার দশক আগে একটি বিচিত্র বিভাগ খোলা হয়। এই বিভাগের উদ্দেশ্য ছিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন ধারণা সমাজের মানুষদের মধ্যে, সরকারি এবং 'এনজিও'-দের প্রিয় ভাষায় বলতে গেলে বলা যায় যে 'গ্রাস-রুট ইনিশিয়েটিভ'-এর মাধ্যমে প্রচার করা। কিছুদিন চেষ্টা করেই এই বিভাগের প্রধানরা বুঝতে পারেন যে এই ব্যাপারটি মন্ত্রকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত আধিকারিকদের দিয়ে হবে না। কলম পিষতে পিষতে আর ফাইল-এ 'নোট' লিখতে লিখতেই যাঁদের চাকরি জীবনের অর্ধেক সময় চলে যায়, আর বাকি সময়টায় রিপোর্ট লেখা, মিটিং করে ব্যয় হয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জনপ্রিয়করণের মতো কাজের সময় তাঁদের কোথায়? এদিকে বিভাগটি যখন খোলা হয়ে গেছে, তখন তো আর সেটিকে আচমকা গুটিয়ে নেওয়া যায় না। যিনি এই 'আইডিয়া' দিয়েছিলেন, তিনি এখন আরও উচ্চপদে আসীন, তাঁর 'ব্রেন চাইল্ড'-এর যদি এমন অকাল-মৃত্যু ঘটে, তবে এখন যাঁরা ঐ বিভাগের বরিষ্ঠ আধিকারিক, তাঁদের কাশ্মীর বা আন্দামানে ৫ বছরের জন্য বদলি হয়ে যাবে তা এক রকম নিশ্চিত। এমন এক মহা ধর্মসংকটে পড়ে একজন আধিকারিকের আচমকা মনে পড়ে গেল তার কলেজের একজন সহপাঠীর কথা, যে 'সায়েন্স রিপোর্টার', 'ইলেক্ট্রনিক্স ফর ইউ' ইত্যাদি নানান পত্রিকায় লিখতো, যার জীবনের ধ্যান জ্ঞান ছিল স্কুল কলেজের পড়ুয়াদের বিজ্ঞানের বিষয়ে উৎসাহী করে তোলা।
ভারত সরকার তখন নানান বিষয়ে সরকারি দায়িত্ব 'ফ্র্যাঞ্চাইজ' করার পরীক্ষা শুরু করেছে। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের কাজটি 'এনজিও'-দের মাধ্যমে করা যায় কি না সেই বিষয়ে এক প্রস্তাব মন্ত্রকের কাছে যাওয়ার পর তা ধ্বনি ভোটে গৃহীত হয়। তৈরি হলো বিজ্ঞান প্রসার, এনসিএসটিসি নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কের অন্যতম কাজ নির্ধারিত হলো বছর বছর সারা দেশজুড়ে 'শিশু বিজ্ঞান কংগ্রেস' আয়োজন করা। ৯০-এর দশকের মাঝামাঝি এই মহাযজ্ঞের সূচনা হলো। প্রথম কয়েকটি বছর তেমন না জমলেও ক্রমে ক্রমে তা সারা দেশের ৬ থেকে ১১ ক্লাসের স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যে খানিকটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শেষ পর্বের 'শিশু বিজ্ঞান কংগ্রেস' অনুষ্ঠিত হতে থাকে। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী যশপাল বিষয়টিতে উৎসাহী হওয়াতে পণ্ডিতমহলে এই 'শিশু বিজ্ঞান কংগ্রেস' খানিকটা মনোযোগ আদায় করে নেয়। এক সময়ে এই 'শিশু বিজ্ঞান কংগ্রেস'-এ পঠিত কয়েকটি নির্বাচিত প্রকল্প ভারতের 'বিজ্ঞান কংগ্রেস'-এর মূল অনুষ্ঠানের অংশ হয়ে ওঠে।
বিষয়টার মধ্যে খানিকটা অভিনবত্ব আছে। জাতীয় স্তরের বিজ্ঞানীদের একটি কমিটি দু' বছরের জন্য 'শিশু বিজ্ঞান কংগ্রেস'-এর মূল 'থিম' এবং সঙ্গে গুটিকয়েক উপবিষয় ঠিক করে দেন। এরপর একজন গাইড শিক্ষকের অধীনে শিশুদের এক একটি দল ঐ উপবিষয়ের কোনও একটির ওপর হাতে কলমে কাজ করার একটি প্রকল্প বেছে নেয়। তারপর দলগতভাবে ঐ প্রকল্প রূপায়ণের কাজে তারা সময় দেয়, বিদ্যালয় তাদের সাধ্যমতো সহায়তা দেয়। তারপর তারা তাদের নিজস্ব জেলায় অনুষ্ঠিত 'শিশু বিজ্ঞান কংগ্রেস'-এ তাদের প্রকল্প নিয়ে হাজির হয়। সেখান থেকে কয়েকটি প্রকল্প আবার রাজ্য স্তরের কংগ্রেসের জন্য নির্বাচিত হয়। এরপর সব রাজ্যের নির্বাচিত প্রকল্পগুলি জাতীয় স্তরে, হ্যাঁ, পুরোপুরি মাতৃভাষার মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়।
একবার পূর্ব ভারতের একটি শহরে এই রকম জাতীয় স্তরের 'শিশু বিজ্ঞান কংগ্রেস' অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সমস্যা দেখা দিয়েছে যে সেই বছর প্রায় সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রবল বন্যা। গৌহাটি শহর জলে থইথই, মেঘালয়-মণিপুর-নাগাল্যান্ড-এর শিশু বিজ্ঞানীরা আটকে পড়ল। অনুষ্ঠান সূচির ব্যাপক বদল ঘটিয়ে (প্রধানমন্ত্রী এই কংগ্রেস উদ্বোধন করেন এবং তিন মাস আগে 'ডেট' নেওয়া আছে!) শেষ পর্যন্ত সবাইকে তাদের কাজ উপস্থাপনের সুযোগ করে দেওয়া গেছে। সেই বছরই প্রথম অধ্যাপক যশপাল এই বিজ্ঞান কংগ্রেসের কাজকর্ম দেখার জন্য উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে আমন্ত্রিত। এই সময়ের কয়েক মাস আগে দূরদর্শনে তাঁর অতি জনপ্রিয় বিজ্ঞান ধারাবাহিক শেষ হয়েছে, ফলে তিনি সর্বদাই ৫০-৬০ জন শিশু বিজ্ঞানী পরিবৃত হয়ে রয়েছেন, সরকারি প্রোটোকল অফিসার তাঁর প্রোটোকল বজায় রাখতে হিমসিম খেয়ে একসময় রণে ভঙ্গ দিলেন। একবার তাঁর কানের কাছে তিনি ফিসফিস করে বললেন, "স্যার আপকা লাঞ্চ তৈয়ার হ্যায়"। যশপাল বললেল, "আরে, আমি তো এদের সঙ্গেই খাবো, একটা দারুন বিষয়ে আলোচনার মধ্যে আছি। উড়িষ্যার ঐ মেয়েটি কোথা থেকে আমার জন্য একটা লাঞ্চ কুপন যোগাড় করে দিয়েছে। তোমার ছুটি, আমাকে দেখার এতো লোক আছে যে কেউ আমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না"। এই বলে তিনি একটা পলিথিনের খাবার জলের কাপ নিয়ে বায়ুর চাপের একটা পরীক্ষা শিশু বিজ্ঞানীদের দেখাতে মেতে উঠলেন।
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে উত্তর ভারতের নানা রাজ্যের শিশু বিজ্ঞানী তাদের প্রকল্পের উপস্থাপনা করবে। হরিয়ানা রাজ্যের একদল ছেলে-মেয়ে 'হিংলিশ' (হিন্দি + ইংলিশ) ভাষায় কথা বলছে। একটি ছেলের পেছনে সবাই মিলে লাগছে। ছেলেটি বেশ সপ্রতিভ, সে সবাইকে বেশ ভালোভাবেই সামাল দিচ্ছে। হঠাৎ ঘোষণা হল যে বিভিন্ন ঘরে এর পর প্রকল্পগুলি উপস্থাপন করতে হবে। দেখা গেলো ছেলেটির পড়েছে সেদিন বিকেলে। ছেলেটিকে ডাকলাম, সে এসে বলল এইবার সে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল, সবাই তার পেছনে লাগছিল।
তারপর সে নিজেই তার কাহিনী শুরু করল। এবারের 'শিশু বিজ্ঞান কংগ্রেস'-এর মূল বিষয়, জীববৈচিত্র্য। এটা তার প্রিয় বিষয়। এই বছর এপ্রিল মাসে (যখন 'শিশু বিজ্ঞান কংগ্রেস'-এর কাজ সবে শুরু হওয়ার মুখে) সে তার ক্লাসে গাধা কেমন উপকারি জন্তু সে বিষয়ে একটা রচনা লিখেছিল। ব্যস, ক্লাসে তার নাম হয়ে গেলো 'ডংকি'! এখানেও সে ডংকি-র ওপর প্রকল্প হাজির করেছে। শুনে আমরা অনেকেই চমৎকৃত। বিকেলে শুনতে গেলাম। প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ছেলেটি গাধার বিভিন্ন প্রজাতি, তাদের কে কোনো কাজে বেশ দক্ষ এবং কীভাবে সংকর প্রজাতি তৈরি করে তাদের মধ্যে 'তিলোত্তমা' পাওয়া যেতে পারে সে বিষয়ে সপ্রতিভভাবে দশ মিনিট ঝাড়া বলে গেল। স্পষ্টতই কাজের বহর নবম শ্রেণীর পড়ুয়ার পক্ষে বেশ উচ্চস্তরেরই বলতে হবে। যাঁরা বিভিন্ন প্রকল্পের বিচার করছিলেন, তাঁরা ভাবলেন ছেলেটিকে বুঝি কেউ কাজগুলি করে দিয়েছে। কিন্তু ওকে যে প্রশ্নই করা হয়, ও তার এক জুতসই জবাব দিয়ে দেয় চটপট। একজন বিচারক ছিলেন আমাদের বন্ধু, মুম্বাইয়ের ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বরিষ্ঠ অধ্যাপক। সে নিজে ছেলেটিকে অনেক জেরা করে নিশ্চিৎ হয় যে পুরো কাজটিই সে নিজে করেছে। পরে এক প্রশ্নের জবাবে সে বলে যে তাদের একটি নিজস্ব 'ডংকি ফার্ম' আছে, আর পুরো কাজটিই সে সেখানে একাই করেছে। আমাদের পশু বিজ্ঞানী বন্ধু তাকে তার কাজটিকে আরও উন্নত করার জন্য কিছু কথা বলে। ছেলেটির প্রকল্পটি উচ্চ প্রশংসিত হয়। এই রকম একটা দুটো ঘটনা প্রায় প্রতি বছরই ঘটে। তাই বিষয়টি পরে ভুলেই যাই।
পরের বছর ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরে কংগ্রেস সংক্রান্ত একটা কাজে গেছি। মিটিং আর কিছুতেই শুরু হচ্ছে না, কেননা ঐ মিটিং-এ আমাদের মুম্বাইয়ের সেই বন্ধুর মুখ্য ভূমিকা রয়েছে, সে না এলে তাই মিটিং শুরুই করা যাচ্ছে না। অথচ সে দিল্লি এসে পৌছেছে আগের দিন। মিটিং-এর নির্ধারিত সময়ের প্রায় দু' ঘন্টা পরে এসে সে খুব দুঃখ প্রকাশ করে মিটিং চালালো। পরে সে সবাইকে জানালো যে তার দেরি হওয়ার কারণ আজকে দিল্লির জীবপ্রযুক্তি মন্ত্রকের একটি মিটিং ছিল, যেখানে নতুন পদ্ধতিতে পশু প্রজননের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ সংক্রান্ত আলোচনা ছিল। হরিয়ানার ঐ ছেলেটির প্রকল্পটি সেখানে সর্বাধিক ভোটে গৃহীত হয়েছে, কিন্তু সে স্কুল পড়ুয়া, তাই তাকে কীভাবে ইস্রায়েল সরকারের প্রশিক্ষণ কোর্সে পাঠানো সম্ভব। ছেলেটি ১১ ক্লাস থেকে স্নাতক হওয়া পর্যন্ত আমাদের বন্ধুর সঙ্গে লাগাতার যোগাযোগ রেখে গেছে, একবার মুম্বাই গিয়ে হাতে-কলমে কিছু কাজ শিখেও এসেছে। ইস্রায়েল সরকারের প্রতিনিধির অবশ্য এই বিষয়ে কোনও আপত্তি নেই, যদি ভারত সরকারের কোনও আপত্তি না থাকে! আমাদের বন্ধুটি শেষ পর্যন্ত বলে যে বিল গেটস-এর কোনো ডিগ্রি ছিল না, সে যখন কমপিউটার চালানোর প্রথম প্রোগ্রামটি লেখে। তাকে এই কারণে সুযোগ না দিলে পৃথিবী 'মাইক্রোসফট করপোরেশন'-এর মুখ দেখতো না! অতঃপর ছেলেটির ছাড়পত্র মেলে।
২০১৮-তে সেই কিশোরটি তারুণ্যে ভরপুর টগবগে এক যুবক, ভারতের খুব বড়ো এক পশুখামারের সে মালিক, তার গবেষণাগার যে কোনও বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ঈর্ষার কারণ। ইতিমধ্যে সে বিদেশের দুটি নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ও একটি থেকে পি.এইচ.ডি. করা। সে আমাদের বন্ধুকে আজও চিঠি লিখে সই করে, 'ডংকি'!