আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২৪ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪৩১

প্রবন্ধ

তৃণমূল ও লুম্পেনরাজ

সুখবিলাস বর্মা


আড়িয়াদহের একটি ক্লাবে কয়েকজন যুবক মিলে একজনকে হাত পা ঝুলিয়ে প্রহারের ভিডিও সম্প্রতি প্রকাশ্যে এলে কামারহাটি-আড়িয়াদহের ত্রাস জয়ন্ত সিং ওরফে ‘জায়েন্ট’ (দৈত্য) সিংকে নিয়ে সারা রাজ্যের সব ধরনের মিডিয়া সরগরম। এই ঘটনার অব্যবহিত পূর্বে রাজ্য সরগরম ছিল উত্তর দিনাজপুর জেলার ইসলামপুর মহকুমার চোপড়ার তাজিমুল ইসলাম ওরফে ‘জেসিবি’-র কাজির বিচার নিয়ে। সেখানেও একই কায়দায় এক পুরুষ ও মহিলাকে অবৈধ প্রেমের অভিযোগে আড়ং ধোলাই-এর ভিডিও নিয়ে হৈচৈ চলেছে কিছুদিন। উভয় স্থানেই ঘটনার বিবরণীর আলোচনায় এই মহাজনদের আরও অনেক কীর্তি বেরিয়ে এসেছে। কামারহাটির বিধায়ক, তার সুপুত্র, পুত্রবধু সহ বহু নেতা-নেত্রীর সামাজিক রাজনৈতিক কীর্তির সঙ্গে ‘জায়েন্ট’-এর আরও কিছু প্রকাশিত ভিডিও বেশ কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন চ্যানেলের আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। বিধায়ক মহোদয় বলছেন, তিনি এদেরকে ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন - কিন্তু এদের ঘনিষ্ঠ নন! জানিনা, তিনি ঠিক কী বলতে চেয়েছেন। এখন ফোন-হুমকিতে তিনি নাকি প্রাণভয়ে এবং এলাকা হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে ভীত। তিনি নাকি জায়েন্ট যতদিন ফুটবল খেলত ততদিনই চিনতেন। মদনবাবুর ফুটবল প্রীতি এবং বাংলার ভুঁইফোঁড় ক্লাবকে দরাজ হস্তে সরকারের অর্থ সাহায্য থেকেই ভোট-ক্যাচার ক্লাব রাজনীতির জন্ম। বাংলার সব ক্লাবেই এখন দু’চারজন জায়েন্ট পাবেন। এই জায়েন্টদের মুখোমুখি হয়ে অন্য দলের পক্ষে ভোট বৈতরণী পার হওয়া খুবই শক্ত, কারণ এদের সহযোগী শক্তি বহুবিধ।

এলাকার সাংসদ সৌগত রায় মহোদয়ও মোটামুটি বিধায়কের সুরে দায় ঝেড়ে ফেলে তাঁর অসহায় অবস্থার করুণ কাহিনী শুনিয়েছেন। ওদিকে উত্তরে চোপড়ার বিধায়ক হামিদুল রহমান জেসিবির হয়ে সাফাই গাইছিলেন - পরে বেগতিক দেখে রণে ভঙ্গ দিয়েছেন। জেসিবির নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস দল চোপড়া ইসলামপুর এলাকায় কী কী মহৎ কাজ করেছে তার নমুনা আমরা বিভিন্ন চ্যানেলে দেখেছি। এরাই আমাদের মূল্যবান সম্পদ। জেসিবির কীর্তি দেশের পার্লামেন্ট পর্যন্ত পৌঁছেছে - প্রধানমন্ত্রী ঘটনার উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়াও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে চোর সন্দেহে হত্যার ঘটনা নিয়ে বেশ শোরগোল চলছে।

এ সবে রাজ্যের পুলিশ মন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর কোনো হেলদোল নেই। তবে জায়েন্টকে নিয়ে কথা না বলে তিনি থাকতে পারেননি। এ সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়া যে উপনির্বাচনের সময়ে শাসকদলের ক্ষতি করার জন্য ২০২১ সালের ভিডিও বার বার দেখানো হচ্ছে। ঐ সময়ে সেখানকার সাংসদ ছিলেন অর্জুন সিং এবং তার মদতেই এসব হয়েছিল। অর্জুন সিং কামারহাটি এলাকার সাংসদ কখনই ছিলেন না। তবুও সব দোষ তিনি তাঁর দলের এক সময়ের বড় সম্পদ অর্জুন সিং-এর উপর চাপালেন কারণ অর্জুন এখন বিজেপি দলে। কিন্তু এলাকার সন্ত্রাস জায়েন্ট-এর ২০২১ সালের আগে-পরের অত্যাচারের বিরুদ্ধে পাঁচবার ধরা ও ছাড়া ব্যতিরেকে পুলিশ কী কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে সে সম্পর্কে তিনি নীরব। অর্জুন সিং-এর মতো কিছু বাহুবলী ছাড়াও আজ যাকে নিয়ে তাঁর এত মাথাব্যথা, বর্তমান বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে দিয়ে তিনি কী না করিয়েছেন - মুর্শিদাবাদের এক ডজন, মালদা উত্তর দিনাজপুরের এক ডজন কংগ্রেসি বিধায়ককে লোভ ও ভয় দেখিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করিয়েছেন। একইভাবে জলপাইগুড়ি সহ সব জেলার কংগ্রেসিদের লোভ ও ভয় দেখিয়ে, এমনকী মার্ডার কেসে ফাঁসিয়ে দল ভারী করেছেন।আসলে মমতা বানার্জীর কাছে ভোটই সব। ভোটের জন্য, ভোট আদায়কারীদের জন্য তিনি সবকিছু করতে পারেন। এরাই তোলাবাজি, সিণ্ডিকেটবাজি, জমি দখল, বে-আইনি বাড়ি তৈরি ইত্যাদি কাজের এজেন্ট।

স্বভাবতই আলোচনায় আসে সদ্য সমাপ্ত লোকসভা ভোট। লোকসভা নির্বাচনে সারা দেশে ‘ইণ্ডিয়া’ ব্লকের মূল বিষয়গুলি (মুদ্দা) ছিল সংবিধান রক্ষা, ধর্মীয় মেরুকরণ, হিন্দুত্ব, গণতন্ত্রবিরোধী কার্যকলাপ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জীর ‘মুদ্দা’ ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম - প্রধানত ইডি সিবিআই-এর দৌরাত্ম্য ও অন্যায় অত্যাচার, রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনা, এনআরসি, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ইত্যাদি মারফত অর্থ সাহায্য প্রকল্পের প্রচার - যার প্রায় সবটাই মিথ্যা।

বিজেপির সত্য-মিথ্যা প্রচারে যখন সন্দেশখালি জ্বলছে, আমাদের স্বঘোষিত বাংলার গর্ব তখন পশ্চিমে পুরুলিয়ার জনসভায় গর্জন করছেন মোদির কেন্দ্রীয় সরকার বাংলার শ্রমিকদের ১০০ দিনের কাজের বকেয়া মজুরীর টাকা, বাংলার বাড়ি ইত্যাদি প্রকল্পের টাকা আটকে দিয়েছে। বকেয়া দাবীর সমর্থনে/প্রমাণে রাজ্য সরকার এই প্রকল্পগুলির খরচের হিসাব সিএজিকে দিয়ে অডিট করিয়ে সেই প্রত্যায়িত রিপোর্ট পাঠায়নি - সে কথা বলছেন না। অডিট করলে রাজ্য সরকারের ভাণ্ডার থেকেই ১০০ দিনের কাজের বকেয়া মজুরীর কেন্দ্রীয় প্রাপ্য মেটানোর নাটক প্রচারিত হতে পারত না। কী পরিমাণ কাজ হয়েছে, তার মধ্যে কত পরিমাণ জেসিপি মেশিনে, কত ভুয়ো জব কার্ডে কাজ দেখানো হয়েছে, মজুরী বাবদ রাজ্য সরকারের দেয় কত টাকা - সেসব প্রকাশ্যে আসত। অডিট করতে না দিয়ে মাঠে ঘাটে তর্জন গর্জন চলছে, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের পাওনা দিচ্ছে না। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর কাছে মুখ্যমন্ত্রীর পেশ করা বকেয়া টাকার দাবি ছিল - 'শিক্ষা'র খাতে ১৫,৮৬৪ কোটি, একশ দিনের কাজে ৬,৫৬১ কোটি, খাদ্য ভর্তুকির ১,২৬৩ কোটি টাকা। শিক্ষা ও খাদ্য ভরতুকি খাতে দাবির যথার্থতা বিচার্য দুই বিভাগের সীমাহীন দুর্নীতির নিক্তিতে। রাজ্য সরকারের বাজেট বই থেকে দেখা যায়, ১০০ দিনের কাজের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার থেকে ২০১৯-২০-তে পাওয়া গেছে ২,৩১১ কোটি, ২০২০-২১-এ কেন্দ্রীয় সাহায্য ২,৭০০ কোটি বাজেটকে কমিয়ে করা হয়েছে ২,০০০ কোটি টাকা। ২০২১-২২-এর বাজেটের অঙ্ক ২,৫৫৮ কোটি টাকা। পাঠক বিচার করবেন বঞ্চনা কতটা হয়েছে।

আমফান বাবদ মুখ্যমন্ত্রীর দাবি ৩২,৩১০ কোটি টাকা। ইকোনোমিক রিভিউ ২০২০ এবং ২০২১-২২-এর অর্থমন্ত্রীর বাজেট ভাষণ অনুযায়ী আমফানে খরচ হয়েছে ১৯৫৪.৭৩ কোটি টাকা, আর মুখ্যমন্ত্রীর দাবি ৩২,৩১০ কোটি টাকা। বঞ্চনা কতটা হয়েছে?

‘বাংলার আবাস যোজনা’ বা 'বাংলার বাড়ি' প্রকল্পের রূপায়ণ মুখ্যমন্ত্রীর মিথ্যার চরমতম উদাহরণ। বাজেট ভাষণে অর্থমন্ত্রী দাবি করেছিলেন যে ২০১৭-১৮ থেকে চার বছরে ২৭ লক্ষ বাড়ি তৈরি হয়েছে। কিন্তু এর জন্য বাজেট বরাদ্দ কোনো বছরেই ছিল না।

অর্থমন্ত্রী মিথ্যাচারে বিধানসভাকে বিভ্রান্ত করছিলেন, তাই তাঁর বিরূদ্ধে প্রিভিলেজ কেস করতে হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর মিথ্যাভাষণ মেনে নিয়ে মাননীয় অধ্যক্ষ রুলিং-এ বলেছেন যে breach of privilege হয়নি কারণ অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য সভাকে বিভ্রান্ত করার জন্য willfully and deliberately করা হয়নি। কিন্তু সরকার এই মিথ্যাচার থেকে বিরত থাকেনি। ২০২১-২২-এ আবার মিথ্যাভাষণ - ২০২০-২১ সালে সর্বোচ্চ সংখ্যায় বাড়ি তৈরি হয়েছে, ২০২১-২২ সালে সবচেয়ে বেশি বাড়ির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ২০২২-২৩ বক্তৃতায় নতুন মন্ত্রীর দাবি যে, এই প্রকল্পে ৩৪.৫৭ লক্ষ বাড়ি মঞ্জুর হয়েছে। অস্তিত্ববিহীন এই বাড়ির টাকাই মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে এবং গরীব মানুষদের বোকা বানাচ্ছেন। গৃহহীনকে গৃহ দেওয়ার নাম করে বাংলার দলিত-আদিবাসী-ওবিসি গরীব মানুষকে রাজ্য সরকার সব চেয়ে বেশি ঠকিয়েছে এই প্রকল্পে।

এই রাজ্যে শিক্ষা বিভাগ সহ সব বিভাগে চাকরির জন্য লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয় তা আজ সর্বজন স্বীকৃত। ইতিমধ্যে যোগ হয়েছে অনুব্রতের দোসর শাহজাহান - সুন্দরবনের টাইগার। অনুব্রত, পার্থ, অর্পিতা এদের কারুর হিম্মত হয়নি কেন্দ্রীয় এজেন্সির উপর হামলা করার বা পুলিশের নজর এড়িয়ে ৫৬ দিন গা ঢাকা দেওয়ার। দলের সর্বোচ্চ মহল থেকে এমনতর প্রোটেকশন বেতাজ নবাবের জুটেছে। সন্দেশখালির এই ঘটনার তাল সামলাতে ‘গর্জন থেকে জনগর্জন’ আয়োজন করে বাংলার মানুষের দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা করেছেন। নাগরিকত্ব নিয়ে, উন্নয়ন নিয়ে ধাপ্পাবাজ বিজেপি নতুন রসদ পেয়েছে - অত্যাচার, অনাচার, নারী ধর্ষণ ইত্যাদি নিয়ে আন্দোলনে বাংলার দৃষ্টি ঘোরাতে মরিয়া মোদিজি। দিদিও বলছেন বিলকিস বানো, হাথরস, মনিপুরের কথা। মোদি-দিদির নকল লড়াইয়ে বাংলার রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিল। তবে দুই দলের তরজার মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের অনেক অপকর্মের খতিয়ান বেরিয়ে এসেছিল।

উক্ত পরিস্থিতিতে মানুষকে ঠিক পথে চালিত করার ভরসা হতে পারত বাম ও কংগ্রেসের সুচিন্তিত সুপরিকল্পিত জোট ও সংগ্রাম। বাংলার মানুষ সাগ্রহে তাকিয়ে থাকলেও তেমন কিছু ঘটেনি প্রধানত কংগ্রেসের সর্বোচ্চ মহলের বিলম্বিত সিদ্ধান্তে, বামফ্রণ্টে বিভিন্ন দলের মধ্যে ঐক্যের অভাবে এবং মমতা ব্যানার্জির ভোট সর্বস্ব রাজনীতির নির্লজ্জ কর্মকাণ্ডের জন্য। একটি উদাহরণই যথেষ্ট। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিবিআই তদন্তে বেরিয়ে আসা নানা গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ শুনানির পর কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের ঐতিহাসিক রায়ে স্কুল সার্ভিস কমিশনের ২০১৬ সালের ২৫,৭৩৫ জনের চাকরি বাতিল ঘোষিত হয়। কমিশন প্রার্থীদের নম্বর সহ পূর্ণ মেরিট তালিকা কখনও প্রকাশ করেনি, ওএমআর শিট বা ওএমআর থেকে স্ক্যান করা 'ডাটা ব্যাঙ্ক' সংরক্ষণ করেনি, ব্ল্যাঙ্ক ওএমআর বা সাদা খাতা জমা দেওয়া ব্যক্তি চাকরি পেয়েছে, প্যানেলভুক্ত নয় ও মেয়াদ শেষ হওয়া প্যানেল থেকে চাকরি দেওয়া হয়েছে, বেশি নম্বর পাওয়া প্রার্থীকে বাদ দিয়ে কম নম্বরের প্রার্থীকে চাকরি দেওয়া হয়েছে। পার্লামেন্ট নির্বাচনী ময়দানে অবস্থানকালে হাইকোর্টের এই রায় জানামাত্রই তিনি দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি মান্যতা, শ্রদ্ধা ও ভব্যতা বিসর্জন দিয়ে রাজ্যের নানা স্থানের প্রকাশ্য নির্বাচনী সভায় ঘোষণা করলেন, এই রায় বিজেপির রায়, বিচারপতিরা বিজেপি প্রভাবিত হয়ে এই রায় দিয়েছেন, বিজেপি দল কোর্টকে কিনে নিয়েছে ইত্যাদি। এই রায় তিনি মানেন না। অর্থাৎ দুর্নীতিগ্রস্ত সবাইকে রক্ষা করতে তিনি মরিয়া। ভোট ব্যাঙ্ক অটুট রাখতে কোনো কাজই তাঁর কাছে অন্যায় নয়।

এমন অশুভ শক্তির সঙ্গে কি লড়াই সম্ভব?