আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২৪ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪৩১

প্রবন্ধ

গৃহিণী গৃহমুচ্যতে

রঞ্জন রায়


আমাদের ঘরে অতিথি, আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধব এসে পড়লে আমরা খুব খুশি হয়ে এসো-বসো করি, তারপর জমিয়ে আড্ডা দিই। একটু পরে উঁচু গলায় বলি - কই গো, অমুক এসেছে। তারপর সেই অতিথির আদর-আপ্যায়ন - জলের গেলাস থেকে চা-জলখাবার বা আহারের ব্যবস্থা - সব আমাদের ঘরের মহিলারা করেন (মা অথবা স্ত্রী)।

আমি আর কী করি? - ওই, জমিয়ে আড্ডা দিই। তারপর অতিথি যখন বলেনঃ বৌদি (মাসিমা), আপনার হাতে যা স্বাদ - তখন মাতৃ অথবা পত্নী গর্বে গর্বিত হয়ে তার সঙ্গে সুর মেলাই।

আচ্ছা, যদি উলটোটা হয়? যেদিন আমার স্ত্রীর বান্ধবী বা বোনেরা তাঁর সঙ্গে গল্পগুজব করতে আসেন? সেদিন কি তাঁদের নিজেদের মতো আড্ডা মারতে দিয়ে আমাকে চা-জলখাবার এবং দরকার পড়লে ভোজনের ব্যবস্থা আমার করা উচিত নয়?

না, তা হয়না। সেদিনও সবকিছুর ব্যবস্থা স্ত্রী বা মাতাঠাকুরাণী করেন।

কেন? কারণ ঘরের পুরুষ রান্নাঘরের কাজ করবে সেটা শোভন নয়।

কেন শোভন নয়? এইরকমই চলে আসছে যে! কেন?

কারণ, ঘরের কাজ নারীর, বাইরের কাজ পুরুষের - ‘গৃহিণী গৃহমুচ্যতে’। অর্থাৎ যেখানে গৃহিণী থাকেন সেটাই গৃহ। শিব্রাম চক্রবর্তীর ভাষায় এর মানে - গিন্নির কাজ ঘর মোছা!

আর এসব কাজ নারীর সহজাত, পুরুষদের নয়।

এটা কে ঠিক করেছে? কেন পুরুষেরা। হাজার বছর ধরে আমরা নারী-পুরুষ সম্পর্কে কিছু শব্দকে আত্মসাৎ করেছি। যেমন, পতি, স্বামী, কর্তা ইত্যাদি। এই তিনটে শব্দেরই অর্থ প্রভু। কার প্রভু? কার আবার? আমার গৃহে নারীর।

তাহলে নারী কি পুরুষের দাসী? নয়তো কী?

নইলে কেন আগেকার দিনে বিয়ে করতে যাবার সময় মাকে বলতে হতো - মা, তোমার জন্যে দাসী আনতে যাচ্ছি?

বাঙাল ভাষায় ছেলেবৌ পছন্দ করার লক্ষণ হলঃ ‘ছোট্ট-মট্টো বৌ লা, খাইব কম, কাজ করব বেশি’! কারণ নতুন বৌ শুধু ছেলের মায়েরই নয়, গোটা পরিবারের দাসী বটেক।

খুব বেশিদিনের কথা নয়। 'আনন্দবাজার', 'যুগান্তর' আদি পত্রিকায় পাত্র-পাত্রী কলমে বিজ্ঞাপন দেখলে একটা শব্দ খুব চোখে পড়ত - পাত্রী ‘গৃহকর্মনিপুণা’।

ফুলশয্যা হোক, যাই হোক, পরের দিন সে উঠবে সবার আগে কাকভোরে, নইলে বদনাম হবে। কিন্তু কুলতিলক ছেলেটি? তার কোনো ভোরে ওঠার দায় নেই, সে যতক্ষণ ইচ্ছে বিছানায় গড়াবে - বদনাম হবে না।

সমস্ত পুরোনো বাংলা বা হিন্দি সিনেমায় সুখী দাম্পত্যের ছবিটি দেখুন। নতুন বৌ বেড-টি এনে স্বামীর ঘুম ভাঙাবে - প্রায় ‘জাগো মোহন প্রীতম’ গেয়ে! উল্টোটা হয় না। নতুন বৌ স্বামীর ছাড়া জামাকাপড় পরিষ্কার করবে। কিন্তু স্বামী স্ত্রীর ছাড়া শাড়ি ধুচ্ছে? লাখে একটাও হয় কিনা সন্দেহ।

হিন্দি বলয়ে কেন করওয়া চৌথের ব্রত করার সময় সারাদিন উপোস করে রাত্তিরে চাঁদ দেখে স্বামীর পা ধোয়াতে হয়? কেন স্বামীকে 'আপনি' সম্বোধন করতে হয়? আর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা? অফিস ফেরত স্বামীর পা থেকে জুতোর ফিতে খুলে দেয়া?

এক বন্ধু বললেন – আপনি এর মধ্যে দাসীভাব দেখলেন? ভালবাসাটা চোখে পড়ল না?

- পড়ত, যদি আপনিও বৌয়ের পায়ে হাত দিতেন। জুতো পরিয়ে দিতেন। ভালবাসা কি একতরফা হয়?

তাহলে বিবাহ নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে একটু খোলা চোখে দেখা যাক।

বিবাহ

“পুরুষ মানুষ ‘বিবাহ’ নামক চুক্তির মাধ্যমে একজন মহিলাকে ঘরে আনে তার (এবং/অথবা তার বাবা-মায়ের) ঘর সংসারের কাজের লোক জোগাড় করার জন্য - এই অর্থনৈতিক সামাজিক অপ্রিয় সত্যটি”[১] শুধু আমাদের মায়ের জন্যে দাসী আনার গল্পে লুকিয়ে আছে এমন নয়, আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের জনক এমিল ডুরখাইমের শ্রমবিভাগের তত্ত্বেও এটি স্পষ্ট।

উনি বলছেন, আদতে বিবাহ হল পুরুষের শ্রমলাঘবকারী চুক্তি বিশেষ

কিন্তু উনি তো ফরাসী, আমাদের দেশে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী হল হিন্দু। এখানে ছবিটা কীরকম?

ভারতে হিন্দুমতে বিবাহ হল প্রজাপতির নির্বন্ধ, নারী -পুরুষের জোড়া নির্ধারণ মানুষের হাতে নয়। নন-বায়োলজিক্যাল অস্তিত্ব দ্বারা অন্য জগতে নির্ধারিত হয়। আমাদের শাস্ত্রেও আছে - ‘জায়াই গৃহ, জায়াই যোনি’, (ঋগবেদ, ৩ মণ্ডল, ৫৩ সূক্ত, ৪ ঋক)।

মনু বলেছেন - যে গৃহে নারীকে সম্মান দেওয়া হয় বা পুজো করা হয় সেখানে দেবতারা বাস করেন। বেশ কথা, কিন্তু সেই সম্মানের ব্যবহারিক রূপটি কী?

প্রজনার্থং মহাভাগাঃ পূজার্হা গৃহদীপ্তয়ঃ। (৯/২৬)

স্ত্রীলোক সন্তান প্রসব ও পালন করে বলেই তারা গৃহের দীপ্তি।

অপত্যং ধর্মকার্য্যাণি শুশ্রুষা রতিরুত্তমা।
দারাধীনস্তথা স্বর্গঃ পিতৃণামাত্মনশ্চহ।।
 (৯/২৮)

যে নারী বংশরক্ষা, ঘরে ধর্মকাজ, সবার সেবা এবং স্বামীকে উত্তম রতিদান করেন, পিতৃকূল এবং স্বামীর বংশের স্বর্গলাভ তাঁর অধীন হয়।

মনু বলছেন - স্ত্রীলোকের জন্য পতিসেবাই গুরুগৃহে বাস, গৃহকর্মই তাঁদের যজ্ঞ।[২]

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এগুলোর থেকে রেহাই পেতে 'শ্রীমতী অনিলা দেবী' ছদ্মনামে 'ভারতবর্ষ' পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩২৩ সংখ্যায় প্রবন্ধ লিখে এদের তুলোধোনা করেছেন।[৩]

স্পষ্টতঃ গৃহবধূকে স্তোক দিয়ে দেবী বানিয়ে কল্যাণীরূপের গুণগান করে, বাস্তবে তাঁর দাসী স্বরূপকে আড়াল করা হচ্ছে। পিতৃতন্ত্রের কাঠামোটিকে আরও মজবুত করা হচ্ছে।

তার মানে ‘উন্নত’ দেশে বা পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে কী ব্যাপারটা আলাদা? খুব একটা নয়।

আমাদের সময়ের প্রথা ভাঙা বিপ্লবী দার্শনিক ফ্রান্সের জাঁ পল সার্ত্র এবং তাঁর সঙ্গিনী প্রখ্যাত নারীবাদী তাত্ত্বিক সিমন দ্য বোভোয়া-র দৈনন্দিন গেরস্থালির খোঁজ নেওয়া যাক।

তাঁর আত্মজীবনীতে সংসারযাত্রা বিষয়ে যে ছবিটি ফুটে উঠছেঃ

“বলাই বাহুল্য ঘরের কাজ - রান্নাবান্না ইত্যাদি আমিই করতাম, সার্ত্র কিছুই করতেন না। - তার কারণ প্রথাগত পুরুষমানুষের মতো মানুষ হয়েছিলেন বলেই তাঁকে গৃহস্থালীর নিত্যকৃত্য থেকে বেশ খানিকটা দূরে থাকতে হয়েছিল।” (বাংলা ভাষান্তরঃ অধ্যাপক অরিন্দম চক্রবর্তী)।

এর বিপ্রতীপে দেখা যাক বঙ্গের উনিশ শতকীয় জীবনযাত্রার একটি গার্হস্থ্য ছবি।

রাসসুন্দরী দাসীর আত্মকথা 'আমার জীবন' (প্রথম প্রকাশ ১৮৭৬ সালে) থেকে জানা যায় যে তাঁর শ্বশুরবাড়ি ফরিদপুরের এক গ্রাম্য জমিদারবাড়ি, "ঐ বাটিতে আটজন চাকরাণী ছিল"।

তা সত্ত্বেও রান্নাঘর আর অন্য দায়িত্ব সামলাতে সামলাতে অতিথি অভ্যাগতদের খাতিরদারি করতে করতে তাঁর একদিন খাওয়াই হল না। পরের দিন যখন বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দু’টি ভাত খেতে বসেছেন তখন "বসা মাত্রই ছেলেটি কোলের মধ্যে হাগিয়া দিল। - ভাতের উপর এত প্রস্রাব করিল যে সমূহ ভাত এককালে ভাসিয়া চলিল"।

দুটো জীবনযাত্রার মধ্যে স্থানকালের তফাৎ রয়েছে - প্রথম বিশ্বের ফ্রান্স এবং তৃতীয় বিশ্বের ভারত, আর উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দী। কিন্তু অন্তর্বস্তুতে, অর্থাৎ দৈনন্দিন গেরস্থালিতে শ্রম বিভাজনে মেয়েদের অবস্থান?

প্রশ্ন ওঠেঃ আজকের মধ্যবিত্ত বাঙালী এই ঘরে-বাইরে শ্রমবিভাগকে কী ভাবে দেখে? কী যুক্তি দিয়ে উচিত ঠাওরায় বা ‘জাস্টিফাই’ করে? প্রধানত দুটো যুক্তি আজকাল নতুন করে শুনতে পাচ্ছিঃ

● গৃহকর্ম ও সেবাযত্ন জাতীয় কাজ (রান্নাবান্না, বাসন ধোয়া, কাপড়কাচা, ঘর পরিষ্কার, বাচ্চার দেখাশোনা) কর্মমর্যাদার মাপকাঠিতে নিম্নমানের কাজ। বাধ্য হয়ে করতে হয়, কিন্তু করাটা সম্মানজনক নয়।

● এই জাতীয় কাজ মহিলাদেরই যোগ্য - পুরুষদের নয়। এবং মহিলারা এই কাজগুলো ঘর এবং পরিবারকে ভালবেসে স্বেচ্ছায় করে থাকেন।

বাস্তবে ঘরোয়া মহিলাটি কী করেন? তাঁর বঞ্চনার দিকটি সিমন দ্য বোভোয়া স্পষ্ট করেছেনঃ

"এই কাজের দ্বারা একজন নারী নিজের ঘরটাকে নিজের করে নেয়; নিজের জীবনের সামাজিক একটা কুলুঙ্গী তৈরি করে এবং নিজের জন্য একটা পেশা বা বৃত্তি তৈরি করে নেয়। তাতে করে রান্নার উনুন, থালাবাসন, ঝক্‌ঝকে তক্‌তকে করে রাখা - এতে হয়তো তৃপ্তি করে সংসার করা হয়, কিন্তু নারী তার আত্মসীমিত গণ্ডি থেকে কোনো মুক্তি পায় না আর পায় না নিজের বিশেষ ব্যক্তিত্বের কোনো স্বীকৃতি।

তিনি কিছুই করেননা - কেবল বর্তমানে যা আছে তাকে কোনওমতে রক্ষা করেন। - এইভাবে কেবল প্রহর গুনে গুনে গৃহিণী (নিজে বেঁচে এবং অন্যকে বাঁচিয়ে রাখতে রাখতে) নিজেকে ক্ষয়িয়ে ফেলেন।"

সেসব তো পুরনো যুগের কথা। আজকের ভারতে?

আজকের দিনে গার্হস্থ্য শ্রম

এক প্রজন্ম আগে অনেকের বাড়িতে দেখতাম একটি বাক্য কাগজে লিখে বা কার্পেটে সেলাই করে ফ্রেমে বাঁধিয়ে দেওয়ালে টাঙানো - 'সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে!'

আজকাল সেটা চোখে পড়ে না। অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারে, বিশেষ করে শহরে, মহিলারা ঘরের বাইরে কোনো না কোনো পেশায় নিযুক্ত। গ্রামেও কৃষক পরিবারের মেয়েরা ধান বোনা এবং ফসল কাটার সময় মাঠে কাজ করেন।

কিন্তু তাতে তাঁদের গার্হস্থ্য শ্রম কি কিছুটা লাঘব হয়েছে?

মানছি, আর্থিক স্বাচ্ছল্যে এবং পেশার বাধ্যবাধকতায় শহুরে জীবনে মোটা দাগের কাজগুলো ঠেলে দেওয়া হয়েছে কাজের মাসির দিকে - আজকের লব্জতে ‘আউটসোর্সিং’। তবু যা কাজ থাকে সেখানে কি পুরুষ-মহিলা শ্রমসময় ভাগাভাগি করে নেন?

ভারত ও বাংলাদেশের কিছু স্টাডি দেখাচ্ছে এখনও ঘরের কাজের দায়িত্বভার মেয়েদেরই বইতে হয়। গৃহকর্মে মেয়েদের সময়দান এবং পরিশ্রম পুরুষের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। এবং সেই শ্রম অবৈতনিক।

কারণটি নিহিত আমাদের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতায়।

দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কিছু রায়ে আজকের ভারতের পরিবারে ‘হোমমেকার’ বা গৃহবধূদের সামাজিক অবস্থানের চমকে দেওয়ার মতো ছবি ফুটে উঠেছে।

আদালতের রায়

সুপ্রীম কোর্ট ২০১০ সালের একটি রায়ে বলেছিলেন যে, গৃহবধূরা সারা বছর বিনা ছুটি নিয়ে বিনা আর্থিক লাভ নিয়ে যে শ্রমদান করেন সেই ত্যাগের প্রকৃত মূল্যায়ন করা হয় না। এর আর্থিক মূল্য এবং সেটা মহিলাকে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নিয়ে সংসদের আইন পাশ করা উচিত

কোর্ট এটা দেখে স্তম্ভিত যে গৃহবধূদের সম্মান দেওয়ার বদলে সরকারি জনগণনায় অ-শ্রমিক আখ্যা দিয়ে ‘ভিখিরি, বেশ্যা এবং কয়েদি’দের সঙ্গে একই ব্র্যাকেটে রাখা হচ্ছে[৪]

২০০৬ সালে পথ দুর্ঘটনায় একজন গৃহিণীর মৃত্যু হলে ট্রাইব্যুনাল তার স্বামী এবং নাবালিক সন্তানের ভরণপোষণের জন্য ২.৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করে। স্বামী উত্তরাখন্ড হাইকোর্টে আপিল করলে সেটা ২০১৭ সালে খারিজ হয়ে যায়।

আদালতের বক্তব্যঃ মৃত মহিলাটি গৃহবধূ মাত্র। তাঁর নোশনাল ইনকাম একজন অদক্ষ মজুরের দৈনিক আয়ের চেয়ে কম হবে এতে আশ্চর্য্যের কী হয়েছে?

এ’বছর সুপ্রীম কোর্টের দুইজন বিচারপতির বেঞ্চ তাঁদের গত ফেব্রুয়ারির রায়ে হাইকোর্টের ওই রায় খারিজ করে বিচারপতিকে তাঁর মান্ধাতার আমলের দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য তিরষ্কার করে বলেন যে গৃহবধূর শ্রম কোনওমতেই তাঁর পরিবারের রোজগেরে পুরুষের থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ হতে পারেনা। বেঞ্চের মতে - গৃহবধূর অমূল্য শ্রমের আর্থিক মূল্যায়ন কঠিন। এর মূল্য ধার্য করা উচিত একজন গৃহবধূ পরিবারে কী পরিমাণ নিবিড় শ্রম দেন তাই দিয়ে।

অতঃপর সুপ্রীম কোর্টের রায়ে ওই ক্ষতিপূরণ রাশি বেড়ে গিয়ে ৬ লক্ষ টাকা ধার্য হয়।[৫]

এটাই যথেষ্ট নয়। এখনও ভারতে গার্হস্থ্য ধর্ষণ (marital rape) অপরাধ বলে স্বীকৃত নয়।

অর্থাৎ স্বামী যদি জোর করে স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সংসর্গ করেন, সেটা অপরাধ নয়। স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রী অভিযোগ আনলে তা গ্রাহ্য হবে না।

মহিলাদের একটি সংগঠন সুপ্রীম কোর্টে রিট দায়ের করলে বর্তমান ভারত সরকার আদালতে বলে যে এই দাবি আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে বেখাপ্পা এবং এটা আইন হলে পরিবার ভেঙে যাবে।

সেইজন্যেই ১লা জুলাই থেকে যে নতুন 'ন্যায় সংহিতা' গোটা দেশে প্রভাবশীল হচ্ছে তাতে আগের মতোই - স্ত্রীর বয়েস ১৫ বছরের চেয়ে কম হলে তবেই সেটা ধর্ষণের পদবাচ্য।নইলে ‘নো মিনস্‌ নো’ গ্রাহ্য হবে না।

বাঙালী মধ্যবিত্তর ভাবনা

গৃহকর্মকে কেন ঠিক ‘কাজ’ পদবাচ্য নয়?

আলোচনায় সাধারণতঃ পাঁচটি যুক্তি শোনা যায়।

এক, ঘরের কাজ ঠিক ‘কাজ’ নয়। কারণ ওতে নতুন কিছুর সৃষ্টি বা উৎপাদন হয় না। বড়জোর পরিবারের লোকজনের কিছু অসুবিধা বা কষ্ট লাঘব হয়।

দুই, অভ্যেস হয়ে গেলে ঘরের কাজের খাটুনি সয়ে যায়। আর অত্যাধুনিক গ্যাজেটের ব্যবহার এবং মাইনে করা লোকের সাহায্যের ফলে এগুলো আর ‘শ্রমসাধ্য’ নয়, অতএব ‘কাজ’ নয়।

তিন, গৃহকর্ম ঠিক কর্ম নয়। কেবল যান্ত্রিক বা শারীরিক কাজ, বুদ্ধি খাটাতে হয় না।

- তিনটেই ছেঁদো যুক্তি। দুই আর তিন পরস্পর বিরোধী। যদি ৩ নম্বর অনুযায়ী ওটা কেবল শারীরিক কাজ হয়, তাহলে ২ নম্বর - মানে কোন খাটুনি নেই, একসঙ্গে সত্যি হতে পারে না।

আবার দুই নম্বর মানলে অধ্যাপক, কোম্পানীর এগজিকিউটিভ, মন্ত্রী, আইটি প্রফেশনাল - এঁরা কোনো কাজ করেন না।

এক নম্বরের কাজের সংজ্ঞা মানলে ডাক্তার, শিক্ষক, বিধায়ক, গায়ক - এঁরা কোনো কাজ করেন না। অভ্যাসের ফলে রোজ অফিসে যাওয়া বা একই টেবিলে বসে একই ধরণের ফাইল ক্লিয়ার করার পরিশ্রমও সয়ে যাওয়ার কথা।

- আচ্ছা, পরিবারের সদস্যদের নিত্যনতুন রোগ-দুশ্চিন্তা-সামাজিক বিপর্যয় সামলে তাদের পালন - পোষণ করতে মাথা খাটাতে হয় না? এটা যে কতবড় মিথ্যে সেটা যে করেছে সেই জানে।

চার, যান্ত্রিক হোক বা বুদ্ধি খাটিয়ে, শ্রমসাধ্য বা প্রয়োজনীয় - এসব কাজই গৃহিণী করেন ‘ভালবেসে’ এবং স্বতঃস্ফুর্তভাবে, ‘বাধ্য হয়ে’ নয়। কাজেই সেটা কাজ নয়।

- এটা মহা কুযুক্তি। যে অধ্যাপক ভালবেসে পড়ান, বা যে ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার বা বৈজ্ঞানিক নিজের পেশাকে ভালবেসে ছুটি না নিয়ে কাজ করে চলেন, তিনি তাহলে ‘কাজ’ করেন না!

পাঁচ, গৃহকর্মের কোনো পরিমাপ সম্ভব নয়। স্ত্রী বা মা-বোনের ভালবাসার ফলে যে সেবাযত্ন পাওয়া যায় তার কি আর্থিক বা কোনো পরিমাপ সম্ভব?

আমাদের অনেকেরই ধারণা যে গৃহকর্ম এবং ঘরকন্নার শ্রম, অর্থাৎ ‘মা-বোনেদের সেবাযত্ন’ ও গৃহকর্মকে বাজারের আওতায় আনাটাই অনুচিত।

প্রশ্নঃ আজ যদি ক্রেসে আয়ার কাছে বাচ্চাদের পারিশ্রমিকের বদলে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হই্‌,এবং রান্নাবাড়া, ঘরমোছা আদি গৃহকর্ম তুলে দিই কাজের মাসিদের হাতে - যাদের পারিশ্রমিকের বাজারদর সেই সাপ্লাই ডিমান্ডের কাটাকুটিতেই ঠিক - তাহলে গার্হস্থ্য শ্রমেরও মূল্য নির্ধারণ হবে না কেন?

পালটা যুক্তি এলঃ কাজের মাসি যখন নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে রান্না করেন, ঘর ধোয়ামোছা করেন, তখন কি তিনি টাকার কথা তোলেন?

না তোলেন না।

এর সমাধান হলঃ

ঘরের কাজের দাম ঠিক করে পরিবারের সামগ্রিক আয়ের একটা অংশ গৃহবধূর জন্য নির্ধারিত করা - তিনি পেশায় কাজের মাসিই হোন বা স্কুল টিচার। অথবা শ্রমের ঘন্টা হিসেবে ঘরের কাজ স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া।

মার্ক্সীয় মডেলে গৃহশ্রম

দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তী তুলে ধরেছেন আর একটি চমৎকার বিষয়। মার্কসবাদী অর্থনীতিতেও গৃহকর্মকে কর্ম বা শ্রম হিসেবে স্বীকার করা হয়নি। তরুণ মার্ক্স যখন ‘শ্রমের বিচ্ছিন্নতা’র (alienation) তত্ত্ব দাঁড় করাচ্ছিলেন তখন তিনি কলকারখানা তথা বাজারে বিক্রয়যোগ্য শ্রমের কথাই ভেবেছিলেন।

তাই তিনি লিখেছিলেন যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিক (পুরুষ?) যখন খাটে তখন সে ঠিক স্বচ্ছন্দ, ধাতস্থ এবং নিজগৃহবাসী থাকে না (he is not at home), আর যখন বাড়িতে থাকে তখন সে কাজ করছে না (he is not working)।

কিন্তু ঘরোয়া গৃহিণীদের ঘরের কাজ অফুরান। তাঁর বিশ্রামস্থল ও কর্মস্থল দুটোই এক - গৃহ। তাহলে তাঁর ‘কাজ’ ও ‘অকাজ’, গৃহে থাকা এক অর্থে না-থাকা। অরিন্দমের ভাষায় - গৃহকর্মব্যাপৃতা গৃহিণী স্বগৃহেই পরবাসিনী।

কালিদাসের ‘গৃহিণী সচিবঃ সখী মিথঃ প্রিয়শিষ্যা ললিতে কলাবিধৌ’ দৈনন্দিন গেরস্থালিতে স্রেফ কথার কথা।

শেষপাতে

সেদিন এক এনজিও’র নেতৃস্থানীয় মহিলার সঙ্গে তর্ক বেঁধে গেল - বিষয় ইউরোপ এবং ভারতের নারীমুক্তি আন্দোলন।

উনি বললেন - আজকের দিনে উইমেন’স লীব মানে ব্রা-পোড়ানো বা পুরুষ খেদানো নয়। আমাদের লক্ষ্য পুরুষদের চেতনা জাগ্রত করা। তাদের বোঝানো যে যুগ যুগ ধরে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সুবিধাভোগী হওয়ার ফলে তারা অনেক অন্যায়কে অন্যায় বলে চিনতে পারেনা, স্বাভাবিক মনে করে।

দিলেন আজকের আমেরিকার উদাহরণঃ

"বাইরের অর্থকরী পেশায় যোগ দেবার আগে যে সময় ব্যয় করে মহিলারা দামহীন লালনপালনাদি গৃহকর্মে দক্ষতা অর্জন করে সগৌরবে সংসারনির্বাহ করতেন - সেই সময় ও কুশলতা পণ্যের ও শ্রমের খোলা বাজারে বিক্রয় করলে তাঁরা অনেক বেশি স্বাধীনতাও অর্থ উপার্জন করতে পারবেন।

আর এই বোধ জাগ্রত হলে পরে অত্যাচারী বা উদাসীন স্বামীর অধীনস্থ থাকা, পুরস্কারহীন সেবাকর্মে বা প্রণয়ের 'পুতুল খেলা'য় মগ্ন থাকা আর একটি লাভজনক বিকল্প খুঁজে পেয়ে মার্কিন নারী আরও ঘন ঘন অপছন্দের বিয়ে থেকে বেরিয়ে আসছে। একেই বলে ‘নিজের পায়ে দাঁড়ানো"।[৬]

সে তো প্রথম বিশ্বের সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশের কথা হল। কিন্তু আজকের ভারতে? আজকের বাংলায়? আমরা ঠিক কী করতে পারি? বাঙালি পুরুষেরা?

আমাদের রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্প, আর কবিতা ‘সুবলা’।

আমরা অন্ততঃ তাঁরই কিছু কথা ধার করে ‘মানহারা মানবীর’ সামনে দাঁড়িয়ে নম্র কণ্ঠে উচ্চারণ করতে পারি "ক্ষমা কর"। পারি কি?

পারলে একটি শুভক্ষণের সূচনা হবে - ব্যষ্টি ও সমষ্টির জীবনে।


ঋণ স্বীকারঃ

'দেহ গেহ বন্ধুত্বঃ ছটি শারীরক তর্ক', অরিন্দম চক্রবর্তী।

 

তথ্যসূত্রঃ

১) অরিন্দম চক্রবর্তী, 'দেহ গেহ বন্ধুত্বঃ ছটি শারীরক তর্ক', পৃঃ ৩৭।
২) মনুস্মৃতি, ২/৬৭।
৩) সমাজধর্মের মূল্য - শরৎচন্দ্রের পুস্তকাকারে অপ্রকাশিত রচনা। 
৪) এনডিটিভি (ডিজিটাল), ২৩শে জুলাই, ২০১০।
৫) বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ১৯শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪। 
৬) অরিন্দম চক্রবর্তী, 'দেহ গেহ বন্ধুত্বঃ ছটি শারীরক তর্ক', পৃঃ ৩৯।