আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২৪ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪৩১

সম্পাদকীয়

ইউরোপের নির্বাচন


সম্প্রতি ইউরোপের অন্যতম দুটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইউরোপের অন্যতম প্রাচীন গণতান্ত্রিক দেশ, যুক্তরাজ্য (ইউনাইটেড কিংডম) এবং ফ্রান্সের নির্বাচন ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিসর দখল না করলেও এই দেশের রাজনৈতিক মহল এই দুটি দেশের সংসদ নির্বাচন নিয়ে নজর রেখেছিল। যথারীতি অন্তিম ফল ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে পরিবেশিত হলেও তা নিয়ে খুব বিস্তারিত মতামত উঠে আসেনি। এমনকি এই নির্বাচন ভারতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোনো নতুন সম্ভাবনার জন্ম দিতে পারে কিনা - এ জাতীয় কোনো আলোচনাও কেউ এখনও অবধি সবিস্তারে রাখেননি। অথচ এই দুই দেশের নির্বাচনী ফলাফল কেবল যুক্তরাজ্য বা ফ্রান্সেই রাজনীতির নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেনি, বরং এই দেশের প্রেক্ষিতেও কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছে।

ভারতীয় প্রেক্ষিতে এই দুই দেশের নির্বাচনী ফলাফলের প্রভাব বুঝতে গেলে আগে তার তথ্যভিত্তিক কিছু অনুসন্ধান প্রয়োজন। এবারের যুক্তরাজ্যের হাউস অফ কমন্সের নির্বাচনে কিয়ের স্টেরমারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি তাদের ইতিহাসে সর্বাধিক ৪১২টি আসনে জয়লাভ করেছে। অন্যদিকে পূর্বতন শাসকদল কনসার্ভেটিভরা ঋষি সুনকের নেতৃত্বে কেবল ১২১টি আসনে জয়লাভ করেছে। তাদের ইতিহাসে এটা তাদের সর্বনিম্ন ফলাফল। অন্যদিকে লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা ৭২টি আসন জিতে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে পার্লামেন্টে এসেছে। গ্রীন পার্টিও তাদের এযাবৎ সবেচেয়ে ভালো ফল করেছে। তারা মোট ৪টি আসন পেয়েছে। পাশাপাশি প্রথমবারের জন্য হাউস অফ কমন্সে নাইজেল ফারাজের নেতৃত্বে অতি দক্ষিণপন্থী রিফর্ম ইউকে মোট ৫টি আসন পেয়েছে। তাদের নেতা ফারাজ অষ্টমবারের চেষ্টায় হাউস অফ কমন্সে নির্বাচিত হয়েছে।

নির্বাচনী আসনের ভিত্তিতে লেবার পার্টির জয় বিশালাকার হলেও যদি ভোটপ্রাপ্তির হিসাব করা যায় তাহলে বিষয়টি খুব উৎসাহব্যঞ্জক থাকে না। প্রথমত এবারের নির্বাচনে ভোটদানের হার ছিল খুবই কম। এবারে যুক্তরাজ্যের মানুষদের মাত্র ৬০% মানুষ ভোট দিতে গিয়েছেন যা অন্যান্যবারের তুলনায় খুবই কম। এর মধ্যে লেবার পার্টি পেয়েছে ৩৩.৭% ভোট যা ২০১৯-এর তুলনায় মাত্র ১.৬ শতাংশ বিন্দু বেশী। অন্যদিকে কনসার্ভেটিভরা পেয়েছে ২৩.৭% ভোট যা ২০১৯-এর তুলনায় ১৯.৯% শতাংশ বিন্দু কম। আবার লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা মাত্র ১২.২% ভোট পেয়ে আসনের বিচারে তৃতীয় বৃহত্তম হলেও রিফর্ম ইউকে পেয়েছে ১৪.৪% ভোট। ফলে তারা মাত্র ৫টি আসন পেলেও ভোটপ্রাপ্তির বিচারে তারাই তৃতীয় বৃহত্তম। তাই অতি দক্ষিণপন্থার বিপদ যে এই নির্বাচন রুখতে পেরেছে এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায়না। অন্যদিকে মুসলিমপ্রধান অঞ্চলে ৪ জন নির্দল প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন যারা সরাসরি গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তারা সেখানে লেবার পার্টির প্রতিনিধিদের পরাজিত করেই জয়ী হয়েছেন। নির্বাচনী ফলের আসন ভিত্তিক তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে এবারের নির্বাচনে কোনো দলই তাদের ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত ঘাঁটিগুলোতেও জয় নিশ্চিত করতে পারেনি।

অন্যদিকে ফ্রান্সের নিম্নকক্ষের নির্বাচন এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এই নির্বাচনে কোনো শক্তিই এককভাবে গরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজনীয় ২৮৫টি আসন দখল করতে পারেনি। সেখানে সর্ববৃহৎ জোট হিসাবে নবগঠিত বামপন্থী জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট তথা এনপিএফ পেয়েছে ১৭৮টি আসন। তাদের প্রাপ্ত ভোট মোট ভোটের ২৬.৯%। দ্বিতীয় স্থানে আছে রাষ্ট্রপতি মাক্রোন-এর মধ্যপন্থী জোট ফ্রান্স এনসেম্বল। তারা ২২.৩% ভোট পেয়ে ১৫০টি আসন দখল করেছে। তৃতীয় স্থানে আছে মেরিন লা পেনের উগ্র দক্ষিণপন্থী তথা নব্য ফ্যাসিবাদী শক্তি ন্যাশনাল র‍্যালী। তারা ১৪২টি আসন পেলেও একক দল হিসেবে পেয়েছে ৩৭.৩% ভোট যা সর্বোচ্চ। এখানেও দেখা যাচ্ছে আসন সংখ্যার বিচারে নয়া ফ্যাসিবাদী শক্তি পিছিয়ে গেলেও তারা অপ্রাসঙ্গিক তো হয়ইনি বরং তারাই বেশীরভাগ মানুষের সমর্থন পেয়েছে।

ফ্রান্সের নির্বাচনে এই ফলাফল বামপন্থী ও মধ্যপন্থীদের এক কৌশলগত বোঝাপড়ার ফসল। প্রথম দফার নির্বাচনে ন্যাশনাল র‍্যালী সবচেয়ে বেশী জয়লাভ করেছিল। কিন্তু তারা একক গরিষ্ঠতা না পাওয়ায় দ্বিতীয় দফার নির্বাচন হয়। নব্য ফ্যাসিবাদের ঠেকাতে বামপন্থী ও মধ্যপন্থীরা এক ধরণের সমঝোতায় আসেন। নির্বাচনকে ত্রিমুখী থেকে দ্বিমুখী করতে দুই জোটের প্রায় ১৫০ জন প্রার্থী যারা প্রথম দফায় তৃতীয় হয়েছিলেন তারা নাম প্রত্যাহার করে নেন। ফলে সর্বত্রই লড়াই দ্বিমুখী হয় এবং সাধারণ মানুষও এই সমঝোতাকে এক রকমের মান্যতা দেন। ফলে অন্তিম নির্বাচনে ফ্যাসিবাদীদের তৃতীয় করে দেওয়া সম্ভব হয়। মধ্যপন্থীদের জোট পূর্বপ্রতিষ্ঠিত হলেও বামপন্থীদের জোটটি ছিল নতুন এবং নির্বাচনের আগে গঠিত। এই জোটে সর্বোচ্চ আসন পেয়েছে অতি বামপন্থী হিসেবে পরিচিত আবদে ফ্রান্স, যাদের সাথে মাক্রোন সমঝোতায় আসতে নারাজ। ফলে নির্বাচনী ফলে ফ্যাসিবাদের পরাজয় ঘটলেও এই নির্বাচন ফ্রান্সের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে এখনও অনিশ্চিতই রেখেছে। নির্বাচনের আগে বামপন্থী ও মধ্যপন্থীদের জোট হলেও নির্বাচনের পরে সরকার গঠন বা সংসদ পরিচালনায় সেই সমঝোতা খুব কার্যকর হবেনা। এর ফলে অতি দক্ষিণপন্থী শক্তির বাড়বৃদ্ধি যে ঘটবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

ইউরোপের এই দুটি নির্বাচনের ফলাফলে এক ধরণের মিল রয়েছে যা ইউরোপীয় রাজনীতির গতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উভয় ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে অতি দক্ষিণপন্থীরা অনেক বেশী মানুষের সর্মথন আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই তাদের রাজনৈতিক প্রচারের অভিমুখ ছিল এক ধাঁচের। স্বদেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটকে তারা হাতিয়ার করেছে এবং তার কারণ হিসেবে তারা অভিবাসীদের দায়ী করেছে। একইভাবে গাজার সঙ্কটকে তারা পাত্তা না দিয়ে ইজরায়েলপন্থী অবস্থান নিয়েছে। দুই শক্তিই - মেরিন লা পেন ও নাইজেল ফারাজ - বর্তমান পুঁজিবাদী রাজনীতির সঙ্কটকে আড়াল করে মানুষের ক্ষোভ অন্য সম্প্রদায়ের দিকে ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম। বর্তমান বৃহৎ পুঁজির পক্ষপাতী ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে বিপথে চালিত করে তাকে জাতি বিদ্বেষ বা সম্প্রদায় বিদ্বেষে পরিণত করতে এরা সফল। দুইক্ষেত্রেই তারা দেশীয় বড় বড় একচেটিয়া সংবাদমাধ্যমের সমর্থন পেয়েছে। অন্যদিকে দুই দেশের মধ্যপন্থী রাজনীতির একরকমের অন্তঃসারশূন্যতা প্রকাশ পেয়েছে। জনতা এবং বৃহৎ পুঁজি - এই দুই নৌকায় পা দিয়ে রাজনীতিকে চালানোর কৌশল আর জনপ্রিয় নয়। ফলে দুই দেশেই মধ্যপন্থীদের সমর্থন বিপুলভাবে কমেছে। অন্যদিকে দুই দেশের যে বামপন্থী শক্তিরা জনতার পক্ষে দাবি তুলেছে, বৃহৎ পুঁজি বিরোধী অবস্থান নিয়েছে, গাজার প্রশ্নে মানবিক দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে তারা আগের তুলনায় নির্বাচনে ভালো ফল করেছে। যুক্তরাজ্যে গ্রীন পার্টি, নির্দল শক্তি, ফ্রান্সে বামপন্থী জোটের ফল তারই নিদর্শন। যদিও লেবার পার্টির বিপুল জয় এই ধারার বিপরীত কারণ, সেখানে লিবারেল ডেমোক্রেটিক শক্তি ক্ষমতাসীন কনসার্ভেটিভদের যতটা ক্ষতি করতে পেরেছে তার লাভ পেয়েছে লেবার দল। কিন্তু প্রকৃত বিচারে লেবারদের এই জয় এক শূন্য বুদ্বুদ, যা ক্ষণস্থায়ী। তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে তারা কিছু জনকল্যাণমূলক কাজের কথা বললেও বৃহৎ পুঁজির বিরুদ্ধে খানিক নীরব। ফলে জনগণের একটা অংশ এই জনমোহিনী রাজনীতির দিকে সাময়িক ঝুঁকলেও ব্রিটেনের আর্থিক সংকটে সেই সমর্থন ধরে রাখা জটিল। এই জয়কে খানিক এ রাজ্যে তৃণমূলের নির্বাচনী জয়ের তুলনীয় ভাবা যায়।

যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের নির্বাচন কিছু ভাবনার খোরাক যোগায়। প্রথমত ইউরোপীয় রাজনীতিতে যে আগামীদিনে অভিবাসীবিদ্বেষী রাজনীতি আরও পোক্ত হবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। অর্থনৈতিক সঙ্কটকে মোকাবিলা করতে অক্ষম মধ্যপন্থী রাজনীতি যে আর মানুষকে আশা দিতে পারছে না তা স্পষ্ট। ফলে বীতশ্রদ্ধ জনতা হয় রাজনীতি বিমুখ হবে নয়ত আরও বেশি করে ফ্যাসিবাদীদের দিকে যাবে, কারণ এরা বৃহৎ পুঁজির স্বার্থকে অক্ষুন্ন রেখে মানুষের ক্ষোভকে বিদ্বেষী রাজনীতির দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম। দুই দেশেই গড়ে ৬০-৬৩% মানুষ ভোট দিয়েছেন, যার অর্থ প্রায় ৪০% মানুষ ভোটদানে বিরত থেকেছেন। এরপরেও ফ্রান্সে বামপন্থীদের জোরালো উপস্থিতি ভোটের হার খানিক বাড়ালেও, যুক্তরাজ্যে মানুষের অনাগ্রহ প্রকট হয়েছে সেভাবে কোনো বড় বামপন্থী শক্তির উপস্থিতি না থাকায়। সুতরাং বলা যায় যে বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নিপীড়িত মানুষের পক্ষ নিয়ে রাজনৈতিক সংগ্রাম করলে সমর্থন আসবে। অন্যদিকে সুবিধাবাদী মধ্যপন্থী রাজনীতি যে মানুষকে আরও বেশী করে অতি দক্ষিণপন্থী শিবিরে ঠেলে দিচ্ছে তা স্পষ্ট। হয়ত আগামীদিনে এই দুই দেশেই অতি দক্ষিণপন্থীরাই মধ্যপন্থীদের নেতৃত্বে আসীন হবে অথবা মধ্য দক্ষিণপন্থী শিবির অতি দক্ষিণপন্থী বা ফ্যাসিবাদীদের সাথেই মিশে যাবে। ফলে আগামীদিনে ইউরোপে মূল লড়াই যে অতি দক্ষিণপন্থার সাথে বামপন্থীদেরই হতে চলেছে তা অনুমান করা যায়। দ্রষ্টব্যঃ যে সেখানে বামপন্থীরা এই লড়াইয়ে জয়ী হওয়ার মতো বিচক্ষণতা, মতাদর্শগত দৃঢ় লড়াই গড়ে তুলতে পারেন কিনা।

এই প্রেক্ষিতেই ভারতের রাজনীতির সাথে এর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে লড়াই ছিল সরাসরি বিজেপি ও বিজেপি বিরোধী শক্তির। সেই লড়াইতে এক সাময়িক স্বস্তি পাওয়া গিয়েছে যেখানে বিরোধী শিবির নিজেদের খানিক গুছিয়ে নেয়ার সময় পেয়েছেন। এখানেও বিজেপির রাজনীতির মূল অক্ষ বৃহৎ পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করা এবং নিপীড়িত মানুষের ক্ষোভকে এক বিশেষ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে চালিত করা। স্বাভাবিকভাবেই এই কৌশল সমস্ত বৃহৎ পুঁজি ও তার আজ্ঞাবাহী সংবাদমাধ্যমের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। বিপরীতে বিরোধী শক্তি, বিশেষত আঞ্চলিক দলগুলো খানিক জনমোহিনী রাজনীতি দিয়ে বিজেপিকে সাময়িক রুখলেও সেই জয়ের ভিত্তি কোনো মতাদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। বরং তা খানিক মধ্যপন্থী। গোটা বিরোধী শিবির আজও মধ্যপন্থী রাজনীতিকেই আত্মিকরণ করেছে। কিন্তু গোটা বিশ্বের রাজনীতির গতিতে তার টিকে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বরং আজকে বিরোধী শিবিরের উচিত একটি মতাদর্শগত জোট তৈরী করা। কিন্তু তা দু' নৌকায় পা দিয়ে সম্ভব নয়। এ দেশের বিরোধী শক্তি ইউরোপের এই নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রকৃতই কোনো মানবমুখী রাজনীতির অবতারণা ঘটাবেন নাকি বিলুপ্তির দিকেই যাবেন তা তাঁদেরই ঠিক করতে হবে।