আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২৪ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪৩১
সম্পাদকীয়
বেহাল অসংগঠিত ক্ষেত্র
বিগত দশ বছর ধরে নরেন্দ্র মোদী সরকার দেশের অর্থব্যবস্থা এবং সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কী সর্বনাশ করেছে তা অনেক সময়েই আমরা বুঝে উঠতে পারি না। এই অপারগতার একটি প্রধান কারণ তথ্যের অপ্রতুলতা। আরেকটি কারণ অবশ্যই অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে ঝুরি ঝুরি মিথ্যা যা ‘গোদী মিডিয়া’-র দৌলতে সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে পৌছে যায়। কিন্তু মোদীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় স্তরে সংগ্রহীত তথ্যভাণ্ডারের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হলেও, নিজস্ব জোরেই সত্য জনগণের সামনে প্রকট হতে বাধ্য। তেমনটাই সম্প্রতি ঘটল অসংগঠিত শিল্প নিয়ে কেন্দ্রীয় নমুনা সমীক্ষার সর্বশেষ রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার মাধ্যমে।
অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মসংস্থান, উৎপাদন ইত্যাদি অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে এটিই দেশের একমাত্র তথ্যভাণ্ডার। ২০১৫-১৬ সালে এই সমীক্ষা করা হয়েছিল। তারপরে ২০২১-২২, এবং ২০২২-২৩ সালে এই সমীক্ষা আবার করা হয়। ২০২১-২২ সাল থেকে এই সমীক্ষাটি বার্ষিকভাবে চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাই ২০২২-২৩ সালে আবারও এই সমীক্ষা করা হয়।
২০১৫-১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, অসংগঠিত ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে মোট ৩ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ কর্মরত ছিলেন। ২০২১-২২ সালে তা কমে হয় ২ কোটি ৭৯ লক্ষ, যা ২০২২-২৩ সালে আবার বেড়ে হয় ৩ কোটি ৬ লক্ষ। অর্থাৎ অসংগঠিত ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে ২০১৫-১৬ সালের তুলনায় ২০২২-২৩ সালে মোট ৫৪ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। অসংগঠিত সাধারণ খুচরো বা পাইকারি ব্যবসায় ২০১৫-১৬ সালে ৩ কোটি ৮৭ লক্ষ মানুষ কর্মরত ছিলেন। ২০২১-২২ সালে এই সংখ্যা কমে হয় ৩ কোটি ৬৯ লক্ষ, যা আবার ২০২২-২৩ সালে বেড়ে হয়েছে ৩ কোটি ৯০ লক্ষ। আবার অসংগঠিত পরিষেবা ক্ষেত্রে ২০১৫-১৬ সালে মোট ৩ কোটি ৬৫ লক্ষ মানুষ কর্মরত ছিলেন যা ২০২১-২২ সালে কমে হয় ৩ কোটি ৩১ লক্ষ, যা আবার ২০২২-২৩ সালে বেড়ে হয় ৪ কোটি। অর্থাৎ ২০১৫-১৬ এবং ২০২২-২৩ সালের মধ্যে তুলনা করলে দেখা যাবে যে সব মিলিয়ে কৃষি ব্যতীত অসংগঠিত ক্ষেত্রে ১৬ লক্ষ মানুষের কাজ চলে গেছে।
মনে রাখতে হবে যে ভারতের মতন দেশে অসংগঠিত ক্ষেত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের মতন অনুন্নত দেশে সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ তৈরি হয় খুবই কম। কিন্তু তাই বলে মানুষ বেকার হয়ে তো আর বসে থাকতে পারে না। তাই তারা আশ্রয় খোঁজে অসংগঠিত ক্ষেত্রে। একদিকে বর্তমান ভারতে সংগঠিত ক্ষেত্রে চাকরি তৈরি হচ্ছে না। অন্যদিকে, অসংগঠিত ক্ষেত্রেও কাজের সংখ্যা কমছে। এর থেকে বোঝা যায় যে মানুষের অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। মোদ্দা কথাটা হল এই যে গোটা দেশে জীবিকার এক ভয়াবহ সংকট তৈরি হয়েছে।
এই সংকট ঘনীভূত হওয়ার কারণ কী? দ্বিধাহীনভাবে এই কথা বলতেই হবে যে বর্তমানে অসংগঠিত শিল্পে যেই সংকটের কথা উপরে বলা হয়েছে তার জন্য দায়ী মোদী সরকার। বিগত দশ বছর ধরে তারা যেই নীতি নিয়ে চলেছে তার সরাসরি আঘাত এসে লেগেছে দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রে। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর তারিখে যে নোট বাতিল ঘোষণা করা হয়, তার সর্বাধিক কু-প্রভাব পড়ে অসংগঠিত ক্ষেত্রে, কারণ এখানে নগদ টাকার লেনদেন হয় সবচেয়ে বেশি। সমস্ত দেশবাসীকে এমন একটা কথা বোঝানো হল যেন নগদ টাকায় লেনদেন হলেই তা বেআইনি। এই কথাটি সর্বৈব মিথ্যা। কর জমা না করে কোনো লেনদেন করা বেআইনি। সে আপনি নগদে করুন বা চেকে। এই নীতির ফলে নগদ ব্যবহারকারী অসংগঠিত ক্ষেত্র সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যার ফলে কর্মসংস্থান কমতে বাধ্য।
নোট বাতিল যদি একমাত্র ধাক্কা হতো অর্থব্যবস্থায় তাহলে হয়ত সামলে নেওয়া যেত। কিন্তু নোট বাতিলের পরেই জিএসটি লাগু করা হয়। জিএসটি-র ফলেও অসংগঠিত ক্ষেত্র আবার ক্ষতিগ্রস্থ হয় কারণ একটি বড়ো অংশকে করের আওতায় নিয়ে আসা হয়। জিএসটি-র জন্য বহু সংস্থাকে বহু টাকা খরচ করে তাদের কর ব্যবস্থাকে উন্নত করতে হয়। এই ক্ষতির মধ্যেই করোনাকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই লকডাউন ঘোষণা করা হয়। যার ফলে লাখো মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েন। অতএব যদি উপরোক্ত তথ্যের দিকে আবার তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে যে ২০১৫-১৬ সালের তুলনায় ২০২১-২২ সালে এই ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বিপুলভাবে হ্রাস পায়। ২০২২-২৩ সালে তা আবার কিছুটা বাড়ে।
এই তথ্যের দিকে তাকালে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চোখে পড়ে। ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে কর্মসংস্থান হ্রাসের পরিমাণ সর্বাধিক। অর্থনীতির স্নাতক স্তরের ছাত্ররাও জানে যে কোনো দেশকে উন্নত হতে গেলে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে এই ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান কমছে। অতএব আমরা মুখে যতই বড় বড় কথা বলি না কেন যে আমরা ‘বিশ্বগুরু’ হয়ে গিয়েছি, অথবা আমরা খুব তাড়াতাড়ি উন্নত দেশে পরিণত হব, সত্য হল এই যে আমরা আসলে পিছিয়ে পড়ছি। সরকারের এই উন্নত দেশ হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আসলে গরীব মানুষ তথা মেহনতী মানুষের পেটের উপরে সরাসরি আক্রমণ। একদিকে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান কমছে, অন্যদিকে সংগঠিত ক্ষেত্রে তা বাড়ছে না। অতএব দেশে সার্বিকভাবে কর্মসংস্থান কমছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের প্রধানমন্ত্রী বলছেন পকোড়া ভাজতে, যেখানে সেনাবাহিনীর স্থায়ী চাকরিকে বদলানো হচ্ছে অস্থায়ী অগ্নীবীর স্কিমে, রেলের তথা কেন্দ্রীয় সরকারের হাজার হাজার পদ খালি পড়ে রয়েছে কিন্তু কোনো নিয়োগ করা হচ্ছে না। আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও একই বাণী দিচ্ছেন যে তেলেভাজা ভাজো, চপশিল্প বানাও ইত্যাদি। কথা হচ্ছে এই যে যেই পকোড়া শিল্প অথবা চপ শিল্পের কথা এই দিক্গজরা বলছেন, তাও আর কর্মসংস্থান বাড়াতে পারছে না।
গোটা দেশের প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গের চিত্র যেন আরও বেশি ভয়ঙ্কর। উপরোক্ত সমীক্ষা রিপোর্ট বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গে ২০২৫-১৬ এবং ২০২২-২৩ সালের মধ্যে প্রায় ৩০ লক্ষ কর্মহানী হয়েছে অসংগঠিত ক্ষেত্রে। যেখানে পড়শি রাজ্য ওডিশাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে একই সময়ে ৭,৬১,০০০ সেখানে পশ্চিমবঙ্গের এই বেহাল দশা আসলে দেখাচ্ছে যে রাজ্যে তৃণমূলের আমলে উন্নয়ন হওয়া দূরের কথা আদতে কর্মসংস্থান কমেছে।
ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গে বৃদ্ধির হার নিয়ে যত হইচই হয়, কর্মসংস্থানের তথ্য নিয়ে সেই পরিমাণ আলোচনা হতে দেখা যায় না। কারণ, বৃদ্ধি হলে পুঁজিপতিদের লাভ, কর্মসংস্থান না হলে তাদের ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। অতএব, তাদের বশংবদ মিডিয়া সবসময়েই ঢাকঢোল পিটিয়ে উন্নয়ন হচ্ছে বলে চিৎকার করে। কিন্তু কয়েকটি পদের জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষের আবেদন, ১০টি পদের জন্য গুজরাটে হাজার হাজার ব্যক্তির আবেদনপত্র জমা দেওয়ার চিত্র প্রমাণ করে যে দেশে কী পরিমাণে কর্মসংস্থানের সংকট রয়েছে। কর্মসংস্থান বাড়ানোর দাবি, বেকারত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন সরকারী শূন্যপদে নিয়োগের দাবি, ইত্যাদি নিয়ে বিরোধী দলগুলি যদি লাগাতার কর্মসূচী নিতে থাকে তাহলেই এই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব।