আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২৪ ● ১৬-৩২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
প্রবন্ধ
জীবনানন্দঃ পুনরাবিষ্কার
সুনন্দন চক্রবর্তী
কাল ভোরবেলা আমি শয়তানকে দ্বন্দ্ব-যুদ্ধে
আহ্বান করেছি
লাইব্রেরির মাঠে কাল অসি খেলা হবে।
- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
এই কবিতার জন্যে যদিও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন না, তবু আমাদের কথারম্ভে পঙক্তিগুলো স্মরণ করা যেতে পারে। চিন্তার জগৎ - বিশ্ববিদ্যালয়, লাইব্রেরি, সেমিনার-কক্ষ, টেক্সট (মুদ্রিত বা ডিজিটাইজড) - এ-সব কোনো নিরীহ ক্ষেত্র নয়। ধ্রুপদি সাহিত্যকে নিজের মতো করে জিতে নেওয়ার লড়াই সেখানে সবসময় জারি থাকে। এমনকি ‘ধ্রুপদী’ কী বা কোনটা তা নিয়েও অবিরাম অসিচালনা চলছে। তীর্থঙ্কর চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘উত্তরপ্রবেশের কবিতাঃ জীবনানন্দ ১৯৩৮-১৯৪৮’ বইটিতে জীবনানন্দের পক্ষে অসি ধরেছেন।
আজীবন মৃদুভাষী বলে নিজের কবিতা সম্পর্কে যে-সব কথা জীবনানন্দ নিম্নস্বরে বলেছেন তা অধিকাংশ পাঠকের অগোচরে থেকে গেছে। সাহিত্যের ছাত্র এবং অধ্যাপক জীবনানন্দ জানতেন কবিদের জীবনে পর্বান্তর থাকে। তাঁর ‘বনলতা সেন’ এবং ‘রূপসী বাংলা’-র মায়াপাশ কাটিয়ে একেবারে ভিন্ন ভাষার, ভিন্ন মেজাজের, ভিন্ন বোধের কবিতা নিরন্তর লিখে যাওয়া সত্ত্বেও ‘নির্জন’ খোপের মধ্যে রয়ে গেছেন তিনি। ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ বা ‘সাতটি তারার তিমির’ কোনো আকস্মিক স্বরান্তর নয়, জীবনানন্দ অনেকদিন ধরেই প্রস্তুত হচ্ছিলেন তাঁর নবপর্যায়-এর কবিতার জন্যে। বারবার বলছিলেন যে ‘বনলতা সেন’, ‘হাওয়ার রাত’ বা ‘বিড়াল’ তাঁর এক ‘বিলুপ্ত পর্যায়’-এর কবিতা। চাইছিলেন কাব্য-সংকলনগুলোতে যেন তাঁর পরের পর্যায়ের কবিতা গ্রথিত হয়। প্রভাকর সেনকে লেখা জীবনানন্দের একটি চিঠি উদ্ধৃত করে তীর্থঙ্কর চট্টোপাধ্যায় দেখাচ্ছেন - ঈষৎ কৌতুকের স্বরে কবি জানাচ্ছেন বুদ্ধদেব বসু মনে করেন ‘বনলতা সেন’-এর পরবর্তী কাব্যে তিনি বুদ্ধদেবের অপরিচিত পৃথিবীতে চলে গেছেন, হয়তো তাঁর নিজেরও অপরিচিত পৃথিবীতে চলে গেছেন।
মনে রাখা ভালো শিল্প-সাহিত্য কী এবং কেন এই নিয়ে একটা জবরদস্ত অসিখেলা হয়েছিল এই চল্লিশের দশকেই। প্রচুর রক্তপাত শেষে বুদ্ধদেব ‘সমাজসচেতন’ শিবির থেকে সরে এসেছিলেন আর জীবনানন্দ কখনওই কোনো শিবিরে ভর্তি হননি। তীর্থঙ্কর চট্টোপাধ্যায় অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন নিবিড় অনুশীলন এবং সূক্ষ্ম শিল্পবোধ দিয়ে জীবনানন্দ প্রস্তুত হচ্ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা এক কবিতার জন্যে যা সময়-সংক্ষুব্ধ, তির্যক, ইতিহাস-সম্পৃক্ত। বলাই বাহুল্য, অদ্যাবধি বিষয়টি সমালোচকদের নজরে তেমন পড়েনি।
জীবনানন্দ নিয়ে এরকম একটা পাঠ কোলাহলময় বিরোধিতার সূত্রপাত করতে পারে। কিন্তু বাঙালি পাঠকের সৌভাগ্য তীর্থঙ্কর চট্টোপাধ্যায় সাহিত্য সমালোচনা-বিদ্যায় সুশিক্ষিত এবং পারঙ্গম। প্রথম অধ্যায়ে প্রস্তাবনা (১)-এর পর তিনি সাতটি ভিন্ন ভিন্ন কাব্য-উদ্ধৃতি দিয়ে দেখাচ্ছেন শুধু যে চলতি, এ-পর্যন্ত কবিতায় অচ্ছুত শব্দ জীবনানন্দ ব্যবহার করছেন তা নয়, তাঁর প্রতীতিঃ কাল কেবল চক্রাকারে ঘোরে না - সমাজসংঘাত সরল বা বক্ররেখাও নিতে পারে। তীর্থঙ্কর বলছেন যে-সব সংঘাত ইতিহাসের মোড় ফেরায় তার শক্তি আর ক্লেদকে ধরার জন্যেই এই নব-সৃষ্ট কাব্যভাষার দরকার ছিল।
এরপর ১৯৩৮-১৯৪৮ এই সীমা নির্দেশ সম্পর্কে তিনি বলেছেন এই ভাগ মূলত ‘আরবিট্রারি’। তার পরেও এই বিভাগ বিষয়ে তিনি যে যুক্তিগুলি দিয়েছেন তার সঙ্গে দ্বিমত হওয়া কঠিন।
অতঃপর রয়েছে সতেরোটি কবিতার নিবিড়পাঠ। জীবনানন্দের পুনরুক্তি, অনুরণন, নিগূঢ়ভাষ এবং পুনরুক্তি থেকে অগ্রগমনের ছায়াপথের মানচিত্র এঁকেছেন আর তালিকাভুক্ত করেছেন জীবনানন্দের বহু-ব্যবহৃত প্রতীকগুলি এবং তাদের ব্যঞ্জনা।
এর পরের অধ্যায়টি মূলতঃ ‘আবহমান’ কবিতার আলোচনার সূত্রে রবীন্দ্র-উত্তর কবিতার বিশ্বাস, বিশ্বাসের সংকট, ব্যক্তি জীবনানন্দের বোধের অনন্যতা, তাঁর দ্বিধা, নিরাশা চল্লিশের চুল্লিতে কেমনভাবে জারিত হয়ে উঠছে তার বিবরণ। যাঁরা জীবনানন্দের কবিতা ভালোবাসেন তাঁদের জন্যে বহু মণিমুক্তা সেঁচে তুলেছেন তীর্থঙ্কর চট্টোপাধ্যায়।
তৃতীয় অধ্যায় (শ্লেষে লিখিত মহাকবিতার দিকে) বিশ্লেষণ করছে তামাশা, শ্লেষ, বিদ্রুপ, তির্যকতার এই নতুন কাব্যভাষা জীবনানন্দের নতুন উপলব্ধি, মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ, দাঙ্গার পৃথিবীর সঙ্গে কতটা ওতপ্রোত। তীর্থঙ্কর উদ্ধৃত করেছেন জীবনানন্দের ‘বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ’ প্রবন্ধে সমসাময়িক বাংলা কবিতায় কী নেই তার তালিকায় রয়েছে দীর্ঘ কবিতা, শ্লেষ, কাব্যনাট্য এবং সিদ্ধান্ত করেছেন এমন ধারণা অসঙ্গত নয় যে অভাবগুলির কোনো-কোনোটি দূর করার চেষ্টা নিজের কবিতায় তিনি করেছিলেন।
এই অধ্যায়ে দুটি উজ্জ্বল সংযোজন রয়েছে। একটি অংশে আছে কোরাস কী এবং ধ্রূপদি সাহিত্যের ছাত্র জীবনানন্দ কীভাবে কোরাস-এর ধারণা তাঁর একাধিক কবিতায় ব্যবহার করেছেন। আর রয়েছে ‘মহিলা’ কবিতাটি নিয়ে একটি অপূর্বপাঠ। 'বনলতা সেন'-এর থেকে অনেক যোজন দূরে এই মহিলা, একই সঙ্গে ঐতিহাসিক এবং প্রাগৈতিহাসিক, শরীরী এবং অশরীরী, যে নিজেই স্রষ্টা এবং সৃষ্টি, যে কামোদ্দীপক এবং লিঙ্গদৃষ্টির শিকার, যার ব্যাসকূট ভেদে কৃষ্ণদ্বৈপায়নও অক্ষম।
চতুর্থ অধ্যায়ে দেখা হয়েছে সময়, ইতিহাস, মেধা আর কর্মোদ্দীপনার সঙ্গে এক অনেকান্ত জটিল সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন কবি। মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, ঔপনিবেশিকতার স্মৃতি-জর্জর মধ্যবিত্তদের নিয়ে দুটি কবিতা, ‘সুবিনয় মুস্তাফি’ এবং ‘অনুপম ত্রিবেদী’-র আলোচনাও পূর্ণ হচ্ছে এই অধ্যায়ে। আর তীর্থঙ্কর চট্টোপাধ্যায় পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন ‘উত্তরপ্রবেশ’ শব্দবন্ধের সংকেত। ‘উত্তরমেঘ’ বা ‘উত্তররামচরিত’ শব্দবন্ধগুলির মতোই ইঙ্গিত আছে 'উত্তরপ্রবেশ' শুধু উৎক্রান্তি নয় এ-এক ‘বিক্ষত উত্তরণ’।সহজিয়া আশাবাদের গণ্ডি ছাড়িয়ে মানুষ তার জানা আর হৃদয়, তার ভয় আর বিভ্রম নিয়ে যে নতুন পর্বে আসছে তাই হল উত্তরপ্রবেশ।
সংঘ ও ব্যক্তির চলবিদ্যা তাঁর হাড়ের মধ্যে ছিল, তাঁর অনুশীলনের মধ্যে ছিল বলেই তাঁর সময়ের দ্বন্দ্বগুলিকে কবিতায় ধরতে পেরেছিলেন, তাঁর ‘বনলতা সেন’-এর বিলুপ্ত পর্যায় ছাড়িয়ে উত্তরপ্রবেশ করেছিলেন অনেক অস্থির এক প্রতীতিতে - এ-কথা তীর্থঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের থেকে বেশি অভিনিবেশ সহকারে, বেশি প্রাঞ্জল করে, বেশি তীক্ষ্ণভাবে আর কেউ বলেননি।
উত্তরপ্রবেশের কবিতাঃ জীবনানন্দ ১৯৩৮-১৯৪৮
তীর্থঙ্কর চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশকঃ একলব্য
প্রথম প্রকাশঃ জানুয়ারি, ২০২৪