আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২৪ ● ১৬-৩২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
প্রবন্ধ
বাংলা নিউজ চ্যানেলের আজব দুনিয়া
গৌতম হোড়
টেলিভিশন চ্যানেলের দুনিয়াটা আমার কাছে বরাবরই বড়ই অবাক করা আজব দুনিয়া। আমি বিনোদনের চ্যানেলের দুনিয়ার কথা বলছি না। বাংলা ভাষায় এত উৎকৃষ্ট সাহিত্য ছেড়ে দিয়ে তারা যেসব ধারাবাহিক বিনোদনমূলক সিরিয়াল আমদানি করেছেন, বিশ্বাস করুন, তা আমি পাঁচ মিনিটও দেখতে পারি না। ফলে আমার অক্ষমতা ক্ষমা করবেন। যে জিনিস আমি দেখতে পারিনি, তার সম্পর্কে বলার কোনো অধিকারও সম্ভবত আমার নেই। কারণ, আমি দেখতে না পারলেও লাখ লাখ মানুষ তা দেখেন এবং নিশ্চয়ই মনোর়ঞ্জন পান বলেই দেখেন।
সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে এবং কিছুদিন নিউজ চ্যানেলে কাজ করার সুবাদে ওই আজব দুনিয়া সম্পর্কে কয়েকটা কথা মনে হয়েছে। সেই কথাগুলো বলার আগে একটা বিধিসম্মত সতর্কীকরণ দেওয়া দরকার। তা হলো, এই মনে হওয়াটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত। আমার সঙ্গে একমত হতেই হবে এমন কোনও পূর্বশর্ত নেই।
কোথাকার তরবারি কোথায় রেখেছ?
প্রথম কথা ভাষার ব্যবহার নিয়ে। বঙ্গসন্তানদের একটা গর্ব আছে, বাংলা ভাষাটা খুব শ্রুতিমধুর। শুনতে ভালো লাগে। যারা বাংলা বোঝেন না, তারাও বলেন, ভাষার মধ্যে একটা ঝংকার আছে, মাধুর্য আছে। আমার মনে হয়েছে, বাংলা নিউজ চ্যানেলের ভাষা সেই মাধুর্যকে প্রতিদিন দুরমুশ করছে।
টেলিভিশনের সাংবাদিকরা ‘কিন্তু‘ রোগে ভোগেন। লাইভ দিতে গিয়ে, পিটিসি (পোজ টু ক্যামেরা) দিতে গিয়ে, কারও সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে, তারা হরির লুটের মতো ‘কিন্তু‘ ছড়িয়ে দেন। কথার প্রথমে কিন্তু, মাঝে কিন্তু, শেষে কিন্তু, কারণে-অকারণে কিন্তু। হয়ত তারা ভাবেন, এভাবে কিন্তু-র ব্যবহার বোধহয় তাদের ভাষাকে শ্রুতিমধুর করে, স্মার্ট করে, মানুষের আরও বেশি কাছে পৌঁছে দেয়। এই কিন্তুর ধাক্কাটা এমন জোরে লাগে যে আমি বেশিক্ষণ বাংলা নিউজ চ্যানেলের লাইভ দেখতে পারি না।
অথচ, নিউজ টেলিভিশন জগতে প্রচুর শিক্ষিত মানুষ আছেন, অনেক জ্ঞানী মানুষ আছেন। সেখানে অনেক প্রাজ্ঞ মানুষ আসেন, গবেষক আসেন, সাহিত্যিক আসেন, নানান স্তরের অসংখ্য মানুষ এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হন। অথচ, কেউ এই কিন্তু-দোষ নিয়ে সোচ্চার হন না। যারা পরিচালনা করেন, তারাও সাংবাদিকদের বলতে পারেন না, এভাবে কিন্তু-র ব্যবহারের ফলে ভাষা বিকৃত হচ্ছে। খুব খারাপ লাগছে শুনতে। মান নেমে যাচ্ছে। কে কাকে বোঝাবে?
আর এই রোগটা এতটাই ছোঁয়াচে যে, টেলিভিশনের মাইকের সামনে বলতে গিয়ে সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক কর্মী থেকে শুরু করে অনেকেই যথেচ্ছভাবে কিন্তু ব্যবহার করে যাচ্ছেন। এমনকী যারা ব্লগ করেন, তারাও কথা বলতে গিয়ে কিন্তু ছাড়া বলতে পারছেন না।
তাই টেলিভিশনের সাংবাদিককুলের কাছে একটাই অনুরোধ, দয়া করে এত কিন্তু কিন্তু করবেন না।
কেন এই বোধহীন পুনরুক্তি?
টেলিভিশন সাংবাদিক কারও সঙ্গে কথা বলছেন। তিনি রাজনৈতিক নেতা হতে পারেন, শিল্পী হতে পারেন, সাধারণ মানুষ হতে পারেন, কথা বলা শেষ হতেই প্রথম য়ে বাক্যটি অ্যাঙ্কর এবং শ্রোতাদের বলেন, "আপনারা শুনলেন, অমুক বললেন..."। আমরা তো শুনেছি, তিনি কী বলেছেন, সেটা আবার বলার তো কোনও দরকার নেই। বরং যদি তাকে ওই মানুষটির কথা ব্যাখ্যা করতে বলা হয় তো তিনি বলুন, কোন পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এই কথা বলেছেন, কেন বলেছেন, এর কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে। যে কথাগুলো একজন বলে দিয়েছেন, তার কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করার তো কোনও দরকার নেই, এই সার সত্যটা কবে তারা বুঝবেন।
আসলে কথা বলাটাও একটা শিল্প। টিভি-র সাংবাদিক হতে গেলে কথা বলতে জানতে হয়। সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে কথা বলতে হয়। অনেকক্ষণ ধরে বলতে হয়। তাই প্রথমেই তাঁর শেখা উচিত, কেমনভাবে যুক্তিপূর্ণ কথা বলতে হয়। কেমন করে বিশ্লেষণধর্মী কথা বলতে হয়। সেটা না পারলে তখন, "আপনারা শুনলেন, অমুক এই বলেছেন"-এর মতো বোধহীন পুনরুক্তি করতে হয়।
সংবাদপাঠ ও চিৎকার
এখন চোখমুখ কঠিন করে প্রচণ্ড চেঁচিয়ে কথা বলাটাই ভারতীয় টেলিভিশনের দস্তুর। এভাবেই তারা দেখাতে চান, বিষয়টি কতটা গুরুতর, কতটা মারাত্মক। এভাবে চিৎকার করে, চোখমুখ কঠিন করে না বললে, অভিনয় না করলে বোধহয় মানুষ বুঝতে পারবেন না।
অথচ, বিদেশি নিউজ চ্যানেলের দিকে চোখ রাখুন। সেখানে অত্যন্ত গুরুতর বিষয়েও কেউ চেঁচান না। অ্যাঙ্কর চেঁচান না, রাজনীতিক চেঁচান না, সাধারণ মানুষ চেঁচান না, বিশেষজ্ঞরা চেঁচান না। ডেসিবল লেভেল বাড়লে শব্দদূষণ ছাড়া আর কিছু কী হয়? হয় নিশ্চয়ই। দর্শকরা নিশ্চয়ই তাদের এই কাঠিন্য, এই চিৎকার, এই কঠোর মনোভাব, এই উত্তেজনা, ওই কড়াভাবে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া, কাউকে রেয়াত না করার মনোভাব পছন্দ করেন। না হলে, তারা এই সব দেখেন কী করে?
এর ফলে মানুষ ভুলে যাচ্ছে, উত্তেজিত না হয়েও কথা বলা যায়। যুক্তিপূর্ণ কথা বলা যায়। অবশ্য এটা যুক্তির যুগ নয়, আবেগের যুগ, অন্ধ বিশ্বাসের যুগ, যার যা মনে আসে তা বলার যুগ, চিৎকারের, ঝগড়ার, মনের কলুষ সর্বসমক্ষে ছড়িয়ে দেওয়ার যুগ, কুকথার যুগ, মিথ্যার যুগ এবং অভিনয়ের যুগ। রিল ওয়ার্ল্ড, রিয়েল ওয়ার্ল্ড নয়। বাস্তবের দুনিয়ায় অনেক কষ্ট, অনেক সমস্যা, অনেক চিন্তা, সেসব থেকে দূরে থাকার জন্য, অথবা আরও সহজ করে বলতে গেলে খবরের থেকেই মানুষকে দূরে সরিয়ে দিতে অথবা শুধুই টিআরপি বাড়ানোর খাতিরে এই সব করা হয়।
আবার ভাষা ব্যবহারের প্রসঙ্গে আসি। যদি কাউকে বলা হয় ‘বেতাজ বাদশা‘ অথবা কোনও একটা এলাকার বাঘ, তাহলে তো তাকে গৌরবান্বিত করা হয়। একজন অভিযুক্তকে কি এইভাবে ডাকা যায়? নাকি তাকে সোজাসাপটা অভিযুক্ত বলা উচিত? আর সেই অভিযোগ তো সামান্য নয়, রীতিমতো গুরুতর। আর যারা জেলে যান, তারা কী খাচ্ছেন, কত পা হাঁটলেন, এ সব জেনে কার কোন উপকারটা হবে? এ সবই সূত্রের মাধ্যমে পাওয়া। আমরা ধরে নিচ্ছি, সেই সূত্র খুবই পাকাপোক্ত। সহজে ছেঁড়ার নয়। তিনি কেন জেলে গেছেন, কোন অভিযোগে গেছেন, আদালতে আইনজীবী কী যুক্তি দিচ্ছেন, সে সবই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু বাকি অপ্রাসঙ্গিক তথ্যের দিকেই সবার নজর। সেগুলি হয়ত চাটনির মতো উপাদেয়। কিন্তু তাতে কার কী যায় আসে?
এই অপ্রাসঙ্গিক কথায় আজ টেলিভিশন নিউজ চ্যানেল ভরে যাচ্ছে। কেন প্রাইম টাইমে এসে কিছু রাজনীতিক ঝগড়া করবেন? করলেও আমরা কেন শুনব? আমরা যদি না দেখি, তাহলে টিআরপি আসবে কোথা থেকে। টেলিভিশন কর্তারা ভাবছেন, মানুষ ঝগড়াটা খুবই উপভোগ করছে। হয়ত করে। না হলে দেখে কেন? আমি দেখি না। বিশ্বাস করুন, আমার ভালো লাগে না। কেন মানুষ অন্য কারো উপর এমনভাবে চিৎকার করবে, একে অন্যকে গলার জোরে থামিয়ে দেবে? শুধু গলাবাজি করে জেতার চেষ্টা করবে? এটাই কি সুস্থ, গণতান্ত্রিক পথে আলোচনা? এর একটাই উত্তর, এটা কোনও আলোচনাই নয়। আলোচনা করতে গেলে, নিজের যুক্তি দিতে হবে। না চেঁচিয়ে। অন্যের কথা শুনতে হবে। অন্যকে কথা বলতে দিতে হবে। সব জায়গার মতো টেলিভিশনেও শুধু অসহিষ্ণুতা কেন থাকবে?
অসহিষ্ণু অ্যাঙ্কর, অসহিষ্ণু রাজনীতিক, অসহিষ্ণু মানুষ, অসহিষ্ণু পরিবেশ আমাদের কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে? এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবার সময় নিশ্চয়ই এসেছে।