আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২৪ ● ১৬-৩২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১

প্রবন্ধ

‘দারুণ অগ্নিবাণে রে’

মালবী গুপ্ত


বস্তুতই ব্যাপক অগ্নিবাণে পৃথিবীর নানা প্রান্ত যেন জ্বলে পুড়ে ঝলসে যাচ্ছে। প্রকৃতির গাছপালা পুড়ছে। বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার হেক্টর অরণ্য পুড়ছে। পুড়ছে তার জীব-জন্তু, কীট-পতঙ্গ সবই। পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে আদিগন্ত বিস্তৃত চাষের খেত। পুড়ছে মানুষও। এবং প্রচন্ড দাবদাহে শুধু দিন নয়, ‘দীর্ঘ দগ্ধ’ হয়ে নিদ্রাহীন থাকতে হচ্ছে রাতের পর রাতও। বছরের পর বছরের রেকর্ড ভেঙে উচ্চ তাপমাত্রার পারদ যে হারে চড়চড় করে উঠেছে, পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের নানা রাজ্যের বাসিন্দারা গত এপ্রিল ও মে মাসের বেশ কয়েক দিনে তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। কারণ কলকাতায় এপ্রিলের শেষ ও মে’র প্রথম কয়েক দিন দেখা গেছে তাপমাত্রা পৌঁছেছিল ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। স্বাভাবিকের থেকে যা ৭.৪ ডিগ্রি বেশি। আর পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমানের পানাগড়ে ৪৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও পশ্চিম মেদিনীপুরের কলাইকুন্ডায় এপ্রিলের শেষে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পৌঁছে যায় ৪৭.২ ডিগ্রিতে। ভারতে এই এপ্রিলে সেটাই ছিল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। 'ইন্ডিয়ান মিটিওরোলজিকাল ডিপার্টমেন্ট' (আইএমডি)-এর মতে, যা ছিল ওই মরশুমে স্বাভাবিকের তুলনায় ১০.৪ ডিগ্রি বেশি। এবং এপ্রিলে এত দীর্ঘ সময় ধরে এত উচ্চ তাপপ্রবাহ চলতে থাকার অভিজ্ঞতা সাম্প্রতিক অতীতে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গে ছিল না।

এই লেখাটি লেখার সময় অবশ্য সেই উত্তাপের পারদ কিছুটা কমেছে। কিন্তু আবার সে ফিরবে না তেমন নিশ্চয়তাও নেই। কারণ এবার যে, এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত অস্বাভাবিক বেশি দিন ধরে তাপপ্রবাহের ঘটনা ঘটবে আগেই তেমন পূর্বাভাস দেয় আইএমডি। ওই সংস্থা গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ সহ ওড়িশা, বিহার, ঝাড়খন্ডে তাপপ্রবাহের লাল সর্তকতাও জারি করে। ওড়িশায় তো প্রায় ১৬ দিন ধরে তাপপ্রবাহ চলে, যা গত ১০ বছরে ঘটেনি। এমনকি হিমাচলের উনাতেও তাপমাত্রা পৌঁছে যায় ৪৪.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। মে’র ২৪ পর্যন্ত লাল সর্তকতা জারি ছিল রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, চন্ডীগড়, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাটেও। তবে এখনও পর্যন্ত ২০১৬ সালে ১৯ মে ভারতের রাজস্থানের ফালোদি’তে সর্বকালের রেকর্ড ভেঙে তাপমাত্রা পৌঁছেছিল ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। নাহ, ওই রেকর্ড আজও ভাঙেনি বটে, তবে পশ্চিম ও উত্তর ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে তাকে ছুঁয়ে ফেলার প্রতিযোগিতা যেন সমানে চলছে। গত ২৪ মে ফালোদিতে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রিতে পৌঁছে যায়। ইতিমধ্যেই রাজস্থানে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ৯ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে।

প্রসঙ্গত, বিহারের কথা মনে করা যায়। যেখানে ২০১৯-এর জুনে প্রচন্ড তাপপ্রবাহে মাত্র ৪৮ ঘন্টায় ৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল সে রাজ্যের ঔরঙ্গাবাদ, গয়া ও নওদা জেলায়। এবং সেখানে পাঁচটি জেলায় ১০০ জনের মৃত্যুর পর জেলাশাসক দিনের বেলায় পথে ঘাটে মাটি কাটা, ইঁট, বালি, পাথর, চিপস ইত্যাদি বওয়ার মতো শ্রমিকদের কাজ বাধ্যতামূলকভাবে বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর কে না জানে বন্যা, সাইক্লোন, ভূমিধস হোক কিংবা খরা, তাপপ্রবাহ বা শৈত্যপ্রবাহ - প্রাণ যায় সেই দরিদ্র মানুষেরই। ক্ষতিগ্রস্ত হন তাঁরাই সব থেকে বেশি। কারণ বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ তাঁদের নাগালের বহু দূরেই থেকে যায় যে।

এমনিতে তাপপ্রবাহের নির্দিষ্ট কোনও সংজ্ঞা নেই। তবে কয়েক দিন ধরে সমতলে কোথাও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও তার বেশি এবং পাহাড়ি এলাকায় ৩০ ডিগ্রি বা তার বেশি ছাড়ালেই তাকে তাপপ্রবাহ বলা হয়। সেই হিসেবে এবারে পশ্চিমবঙ্গ গত ৫০ বছরের তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙেছে। তাই দিনের যে সময় সব চেয়ে বেশি তাপমাত্রা থাকে সেই সময় বাইরে না থাকা, স্কুল বন্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। কারণ দীর্ঘ সময় চলতে থাকা তাপপ্রবাহ দেহের ওপর যে চাপ সৃষ্টি করে, তা মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক হয়ে ওঠে। ওই সময় ডিহাইড্রেশন, হিট স্ট্রেস, চামড়ায় র‌্যাশ, হাতে পায়ে ক্র্যাম্প ধরা, হিট স্ট্রোক ইত্যাদির শিকার হয় মানুষ। যার ফলে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটার সম্ভাবনা থাকে। এই বছর ১ মার্চ থেকে দেশে ১৬,০০০ হিট স্ট্রোকের ঘটনা নথিভূক্ত হয়েছে। লেখার সময় পর্যন্ত তাতে মারা গেছেন ৬০ জন। তাই হয়ত 'ইন্ডিয়ান মিটিওরোলজিকাল ডিপার্টমেন্ট' তাপপ্রবাহ নিয়ে দেশের কোথাও কমলা সতর্কতা, কোথাও লাল সতর্কতা জারি করেছিল।

ভারতে সাধারণত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত তাপপ্রবাহের ঘটনা ঘটে। মে মাসেই ঘটে সব থেকে বেশি। তবে কখনও কখনও সেটা জুলাই পর্যন্তও যায়। এবং জম্মু-কাশ্মীর ও উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি ছাড়া ভারতের বেশিরভাগ রাজ্যই কম বেশি তাপপ্রবাহপ্রবণ। উত্তর ভারতে গড়ে ৫-৬টা তাপপ্রবাহ হয়ই। কিন্তু এবারে বসন্তের রেশ কাটতে না কাটতেই গ্রীষ্মের দেবতা যেন চাবুক হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মধ্য এপ্রিলেই পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাদের এমন প্রখর দহন জ্বালার অভিজ্ঞতা বোধহয় আগে হয়নি। এবং দেখা যাচ্ছে এখনও পর্যন্ত ঘোষিত উষ্ণতম বছর ২০২৩। তবে তার থেকেও এবছর গরমের প্রভাবে মানুষ যেন বেশি কাহিল হয়েছে।

তবে শুধু ভারত কেন, ২০২৪-এ এশিয়ার অন্যান্য দেশও চরম তাপপ্রবাহের সম্মুখীন হচ্ছে। বিগত কয়েক বছর ধরে গোটা বিশ্বেই অসহনীয় তাপপ্রবাহে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। আসলে জলবায়ু পরিবর্তনে পৃথিবী গরম হয়ে উঠছে। আর সব দেশই কোনও না কোনওভাবে এই বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব প্রত্যক্ষ করছে। সাধারণভাবে তাপপ্রবাহ আগে অল্প সময়ে থাকত। কিন্তু এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, বায়ুমন্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাত্রা বাড়ায় পৃথিবীর উষ্ণতা ক্রমশ বাড়ছে। বিশ্বে মোট নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাসের ২০%-এর জন্য দায়ী মানুষের কর্মকান্ড - অরণ্য ধ্বংস এবং পরিবহনের দূষণ। কারণ বর্ধিত বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন। যার ফলে তাপপ্রবাহও বেশি সময় ধরে এবং ঘন ঘন ও চরম মাত্রায় হচ্ছে। যা জনস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার পক্ষে ক্রমশই হুমকি হয়ে উঠছে। এবং দেখা যাচ্ছে বছরে ২০ দিনেরও বেশি চরম তাপপ্রবাহের মধ্যে থাকছে পৃথিবীর ৩০ শতাংশ মানুষ।

যদিও জলবায়ু পরিবর্তন অতি সম্প্রতি ঘটছে এমনটা নয়।বরং তার ইতিহাস যে বহু পুরোনো এবং সেই পরিবর্তনের প্রমাণ পাথরে, বরফের মধ্যে ও গাছের কান্ডের ভিতর, সমুদ্রের পলিতে, প্রবাল প্রাচীরে ছড়িয়ে আছে। এই পরিবর্তন যুগ যুগ ধরেই চলেছে। এবং গত ৮ লক্ষ বছরে এই পৃথিবী ৮টি তুষার যুগ ও উষ্ণতার কাল পেরিয়ে এসেছে। জানা যায় শেষ তুষার যুগটির অবসান হয়েছে ১১,৭০০ বছর আগে। তারপর থেকেই এই আধুনিক জলবায়ুর যুগ ও মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ বলা যায়। সেই সভ্যতাও জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর ছাপ ফেলতে ফেলতে এগিয়েছে। এবং শিল্পবিপ্লবের পর সেই মানব সভ্যতার গতি যত দ্রুত হয়েছে পরিবর্তনেও তার প্রভাব তত দ্রুত বেড়েছে। দেখা যাচ্ছে মানুষের কর্মকান্ডই অভূতপূর্ব হারে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রধান কারণ। যার প্রভাবে উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু ও হিমালয় (যাকে তৃতীয় মেরু বলা হয়) সহ সর্বত্র হিমবাহ ও বরফের চাদরগুলি গলে যাচ্ছে। কিন্তু এখন যে হারে পৃথিবী গরম হয়ে উঠছে গত ১০,০০০ বছরে তেমনটা ঘটেনি।এবং শেষ তুষার যুগের পরে যে হারে গড়ে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছিল, তার থেকে বর্তমানে ১০ গুণ দ্রুততায় বাড়ছে।

নাসা’র বিজ্ঞানীরা আরও জানাচ্ছেন যে, সেই সময় প্রাকৃতিক কারণে কার্বন ডাইঅক্সাইডের নির্গমন যে হারে হতো তার তুলনায় মানুষের কর্মকান্ডে ২৫০ গুণ দ্রুততায় কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা বাড়ছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে গড়ে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সমুদ্র যেহেতু ভূপৃষ্ঠের তাপ অনেকটা শোষণ করে নেয় তাই সাগরের জলও উষ্ণ হয়ে উঠছে। এবং সেখানে জন্ম নেওয়া ‘এল নিনো’ই বায়ুমন্ডলে আরও উত্তাপ ছড়াচ্ছে। ওই এল নিনোর জন্যই ২০২৩ হয়েছিল উষ্ণতম বছর। যার রেশ ২০২৪-কেও দগ্ধ করছে। কে জানে উষ্ণতার রেকর্ড ভাঙায় এই বছরটি এগিয়ে যাবে কিনা। এমনিতে পূর্বের রেকর্ড ভাঙার মধ্যে একটা গর্ব থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে তেমনটা ঘটলে তা অদৌ গর্বের হবে না। আসলে নিজেদের কৃতকর্মের ফল আমরা নিজেরাই এখন ভোগ করছি।

সূত্রঃ
● ডবলিউএইচও.ইন
● সায়েন্স.নাসা.গভ
● ডাউনটুআর্থ.ওআরজি