আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২৪ ● ১৬-৩২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১

প্রবন্ধ

কোভিডের টিকা ও গণ-গিনিপিগদের কথা

স্বপন ভট্টাচার্য


এ লেখার শুরুতেই যাঁর কথা মনে এল আমার তিনি রাজনীতির কেউ নন, তিনি বিশটার ওপর গ্র্যান্ড স্ল্যাম বিজেতা সার্বিয়ান টেনিস তারকা নোভাক জোকোভিচ। ২০২২-এর অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে তাঁকে অংশগ্রহন করতেই দেওয়া হয়নি কোভিড টিকাকরণ সার্টিফিকেটটি দেখাতে পারেনি বলে। আজকে নোভাক যদি বলে - আমার আর একটা গ্র্যান্ড স্ল্যামের সুযোগ অস্ট্রেলিয়ান গভর্নমেন্ট স্রেফ গোঁয়ার্তুমি করে কেড়ে নিয়েছে তাহলে খুব ভুল বলা হবে কি?

যে কোনো টিকাকরণ যা সরকারি কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত তা জনসাধারণের ইমিউনিটির দিকে তাকিয়ে যতটা রাজনীতির দিকে তাকিয়েও ততটাই। যে কোনো সংক্রামক রোগের জন্যই টিকা জিনিসটা একটা পলিটিক্যাল প্রোজেক্ট, তা সে দখলদারির জন্যই হোক, ক্ষমতা ধরে রাখার কাজেই হোক বা স্রেফ বাণিজ্যের জন্যই হোক! ট্যাক্স সংগ্রহ বা সংবিধানসম্মত করনীয় ও পালনীয়গুলোর মতোই টিকা নেওয়া জনসাধারণের মনে একটা কৃত্য’র বোধ আনে এবং কৃত্যটি পালনে ব্যত্যয় মানুষের মনে একটা দুর্ভাবনার জন্ম দেয়। অতিমারি বা তুলনীয় কোনো পরিস্থিতি হলে তো কথাই নেই, তখন টিকা নেওয়া প্রায় দেশের জন্য বন্দুক হাতে রণাঙ্গনে যাওয়ার অনুভূতি নিয়ে আসে গ্রহীতার মনে। সরকারের এটা কাজে লাগে জনসমর্থন বাড়াতে এবং আপৎকালীন পরিস্থিতিতে ছাপান্ন ইঞ্চির ছাতি ফোলাতে। উপরন্তু, কোভিডের সময় টিকা হয়ে দাঁড়াল আধার বা প্যান কার্ডের মতো একটা নাকের সামনে ঝুলিয়ে রাখার মতো পরিচিতিপত্র যা পরিস্থিতিবিশেষে আপনার অস্তিত্বটিকেই মান্যতা দিতে পারে, আবার না’ও পারে। টিকার সার্টিফিকেট না থাকলে আপনি মলে ঢুকতে পারবেন না, সিনেমা দেখতে যেতে পারবেন না, প্লেনে উঠতে পারবেন না, বিদেশে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না।

একটা বিশুদ্ধতার গন্ধ গায়ে লেগে রয়েছে বলেই টিকা হল ‘গ্লোবাল পাবলিক গুড’ - বাংলায় বললে বিশ্বজনীন উৎপাদন, যা অর্থে ও ব্যপ্তিতে ‘পাবলিক গুডস’ অপেক্ষা ব্যাপকতর। পাবলিক গুডস হল তেমন উৎপাদন যা প্রতিযোগিতার আওতায় আসার কথা নয় এবং যার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না, আর গ্লোবাল পাবলিক গুডস হল তেমন উৎপাদন যা একই সঙ্গে জরুরি, নিরাপদ এবং বিশ্বজুড়ে সহজলভ্য। টিকার ক্ষেত্রে এই শর্ত তখনই পালিত হবে যখন রাষ্ট্র টিকাকরণ সুনিশ্চিত করবে প্রতিটি মানুষের জন্য। রাইট টু হেলথ অর্থাৎ স্বাস্থ্যের অধিকার এবং রাইট টু লাইফ যখন সমার্থক হয়ে যায় তখনই রাষ্ট্র ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। কোভিড অতিমারি ছিল এমনই এক পরিস্থিতি যখন রাষ্ট্রের এই ত্রাতা ভূমিকাটি বার বার প্রশ্নের মুখে পড়েছে সব দেশেই। বিজ্ঞানকে নিজের ছাঁচে ঢালতে গিয়ে দেশ-বিদেশের নামী সব ভ্যাকসিনোলজিস্টকে প্রায় শুরু থেকেই রাষ্ট্রনায়কদের এই জিজ্ঞাসার জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত হতে হয়েছে - কবে আসবে টিকা? এভাবে প্রায় ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে টিকা আবিষ্কার নজিরবিহীন। এর জন্য যে সব সতর্কতা মাথায় তুলে রাখতে হয়েছে তার কথায় পরে আসছি, কিন্তু গ্লোবাল পাবলিক গুডসের কথাটা শেষ করা দরকার। ১৯৫০-এর আগে ইউরোপ-আমেরিকার বাইরে সরকারিভাবে টিকাকরণ কর্মসূচির তেমন বড়ো কোনো তথ্য নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সারা বিশ্ব প্রভাবিত হল তিনটে ঘটনায় - ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার মধ্যে কোল্ড ওয়ার, ভারতসহ অনেকগুলো উপনিবেশের স্বাধীনতা লাভ এবং জাতিসংঘের পত্তন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা - WHO-এর হাত ধরে টিকা পশ্চিমী বিশ্বের বাইরে এল এবং একই সঙ্গে এল টিকাবাণিজ্য। টিকা উৎপাদন হয়ে দাঁড়াল জাতীয় কর্মসূচির অঙ্গ এবং জাতীয় কর্তব্য। টিকা প্রথম দিকে সরকারই বানাতো কিন্তু কর্মসূচির সার্বজনীনতার মধ্যেই যে লাভের গন্ধ আছে তার থেকে কর্পোরেট বিশ্বকে বিচ্ছিন্ন রাখাটা বিশ্বায়ণের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, সুতরাং তারা এল। টিকা বানানো, যা ছিল এককালে জাত্যাভিমানের অঙ্গ, তা থেকে সরকারি পুঁজি সরে গেল ধীরে ধীরে এবং টিকা উৎপাদন বিষয়টারই একটা মসৃণ বানিজ্যিকীকরণ ঘটে গেল ব্যক্তি মালিকানার হাতে।

কোভিড-১৯ অতিমারি ভ্যাকসিন অর্থনীতির একটা প্রকৃষ্ট পটচিত্র। অ্যাংলো-সুইস কোম্পানি 'অ্যাস্ট্রা-জেনেকা', যাদের উৎপাদিত কোভিড ভ্যাকসিন আজ বিতর্কের কেন্দ্রে, তারা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় ছাড়পত্র পাওয়া প্রথম টিকা (বৈজ্ঞানিক নাম ChAdOx1) ইউরোপে বেচেছে 'Vaxzevria' নামের বাণিজ্যিক উৎপাদনরূপে এবং ২০২২-এর অর্থবর্ষ শেষে শুধু এই কোভিড ভ্যাকসিন বেচেই তাদের লাভ হয়ছিল ৩৭.৪ বিলিয়ন ডলার। ভারতে ওই একই ভ্যাকসিন 'কোভিশিল্ড' নামে তৈরি করার ছাড়পত্র পেয়েছিল পুনের 'সেরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া' এবং তাদের ২০২২-এর বাণিজ্য ছিল ২৫,৬৪৬ কোটি টাকা যা আগের অর্থবর্ষের তুলনায় ২৪৭ শতাংশ বিন্দু বেশি। দ্বিতীয় যে সংস্থাটিকে কোভিড টিকা তৈরির আপৎকালীন লাইসেন্স দিয়েছিল ভারত সরকার সেটি হল তেলেঙ্গানার 'ভারত বায়োটেক'। এরা 'কোভ্যাক্সিন' নামের যে টিকাটি বাজারে আনল সেটির পিছনে তথাকথিত গবেষণার পুরো টাকাটাই দিয়েছে ভারত সরকার। 'ভারত বায়োটেক' সেটা আবার সরকারের কাছেই বেচে ওই একই সময়ে লাভ করেছিল ৮,৩৫২ কোটি টাকা যা তাদের পূর্ববর্তী বছরের মুনাফার তুলনায় ৪৮০ গুণ বেশি। নাম না জানা একটা গজিয়ে ওঠা সংস্থা ভারতীয় ফার্মা কোম্পানিগুলোর তালিকায় 'সেরাম ইনস্টিটিউট'-এর পরেই দ্বিতীয় স্থানে চলে এল স্রেফ টিকা বেচে। এখন যখন টিকার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় মানুষের মৃত্যু বা অসুস্থতার কথা আদালতের বিবেচনায় চলে এসেছে, তখন এই মুনাফার পাহাড় তৈরি করা কর্পোরেটগুলো যে সরকারের ওপরেই দায় ঠেলতে চাইবে তা সহজেই অনুমেয়, কিন্তু দায় তো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও কম নয়। তাদের ছাড়পত্র না পেলে এভাবে একটা অর্ধপক্ক টিকা তো বাজারে আসার কথাই নয়! এ জল অনেকদূর গড়াবে বলেই মনে হয়।

এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে 'অ্যাস্ট্রা-জেনেকা'র বিরুদ্ধে লন্ডনের একটা কোর্টে ৫১ জন আবেদনকারীর তরফে একটা মামলা রুজু করা হয় এই মর্মে যে 'অ্যাস্ট্রা-জেনেকা' জানতো কোভিডের টিকা ‘ইন ভেরি রেয়ার কেসেস’ ভয়ংকর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। 'ভ্যাক্সজেভিরা' যা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে তারা নিজেরাই তৈরি করে মার্কেট করে এবং 'কোভিশিল্ড' যা তাদের হয়ে ভারতে 'সেরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া' তৈরি ও মার্কেট করে, এ দুটো টিকাই কিছু কিছু রক্তজনিত অস্বাভাবিকতার কারণ হতে পারে। TTS (থ্রম্বোসিস উইথ থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া সিন্ড্রোম) হল এমনই একটি বিরল প্রাদুর্ভাব যার জন্য শিরায় রক্ত জমাট বেঁধে যায় এবং প্লেটলেট কাউন্ট অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়। ব্রিটেনে একটা ১০০ মিলিয়ন পাউন্ডের কোর্ট কেসে জানানো হয়েছে শুধু সে দেশেই কোভিড টিকা নেওয়ার পরে কমপক্ষে ৮১টি মৃত্যুর কারণ হিসাবে সরাসরি এই লক্ষণগুলোকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। 'অ্যাস্ট্রা-জেনেকা' প্রত্যাশামতোই এইসব মৃত্যুর সঙ্গে টিকার যোগসূত্র অস্বীকার করেছে এবং জানিয়েছে তারা এই টিকার উৎপাদন ও মার্কেটিং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে বন্ধ করছে যে কারণে তা হল তাদের হাতে রয়েছে ‘সারপ্লাস অফ অ্যাভিলেবল সারপ্লাস ভ্যাকসিনস’। তাদের ওয়েবসাইটে এখনও বলা আছে - “to keep pace with rapidly evolving SARS-Cov-2 variants and to be prepared for future pandemics, rapid clinical development and approval pathways are needed to respond in a timely manner”, অর্থাৎ মারি ফিরে আসার এবং আবার বাণিজ্য করার আশা এরা ছাড়েনি পুরোপুরি। এরা তুলে নিয়েছে ‘all monovalent vaccines that deal with original covid strain' অর্থাৎ আদি কোভিড ভাইরাসের জন্য প্রথম লাইসেন্স পাওয়া টিকাটাই এরা তুলে নিল ২০০ কোটি ডোজ ১৭০টি দেশের মানুষের দেহে গুঁজে দেবার পর!

ভারতের সুপ্রিম কোর্টে অ্যাডভোকেট বিশাল তিওয়ারি, বেনুগোপাল গোবিন্দন নামের এক ব্যক্তির হয়ে 'সেরাম ইনস্টিটিউট'-এর বিরুদ্ধে অনুরূপ একটি ক্ষতিপূরণ মামলা করার অনুমতি চেয়েছেন। বেনুগোপালের ২০ বছর বয়সী মেয়ে কারুন্যা বেনুগোপাল ২০২১-এর জুলাই মাসে কোভিড টিকা নেওয়ার এক মাসের মধ্যেই প্রায় একই রকম প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়ে মারা যায়। শ্রী তিওয়ারির দাবি সুপ্রিম কোর্ট এইমসের ডাক্তারদের নিয়ে একটা প্যানেল বানাক রিস্ক ফ্যাক্টর অ্যাসেসমেন্টের জন্য। সেরাম নিজে এই টিকা প্রায় ১৭৫ কোটি ডোজ বিক্রি করেছে। তিওয়ারি দাবি করেছেন যে ভ্যাকসিন ‘সেফ এন্ড এফেক্টিভ’ বলে দাবি করা হয়েছিল তার প্যাকেজিং ইনসার্ট (ওষুধের প্যাকেটে যে কাগজে বিবরণ, ডোজ, পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি বলা থাকে)-এর মধ্যে TTS যে হতে পারে একথা অশ্বত্থমা হত ইতি গজ-র মতো করে ছাপানো রয়েছে, তাহলে এটাকে ‘সেফ’ বলা হবে কেন? টিকা নিয়ে মানুষ মরলে দায়টা কার? 'ভারত বায়োটেক' অবশ্য এ’রকম কোন সম্ভাবনার ধার দিয়েও যায়নি। ২রা মে তারা বিবৃতি দিয়ে জানায় যে “Covaxin was developed with a single minded focus on safety first followed by efficacy”। শুধু তাই নয়, তাদের কথা হল সরকারিভাবে অনুমতিপ্রাপ্ত এটাই নাকি একমাত্র ভ্যাকসিন যার কার্যকরিতার ট্রায়াল হয়েছে ২৭,০০০ মানুষের ওপর। তারা রক্ত জমাট বাঁধা, TTS, pericarditis. myocarditis এবং অন্যান্য কোনো অসুখের সঙ্গেই তাদের ভ্যাকসিনের নাকি কোনো সম্পর্ক নেই!

শুধু আদালত নয় বিচলিত হয়ে পড়ছি আমরাও। আমরা নিজেদের নিকট ও দূর পরিবারে একাধিক মৃত্যু দেখেছি, অসহায়তা দেখেছি এবং এখন দাঁড়িয়ে এইসব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কথা জানতে পেরে ফিরে দেখার মুহূর্তগুলোকে আরও বেশি বেদনাবহ মনে হচ্ছে। 'অ্যাস্ট্রা-জেনেকা'র স্বীকারোক্তির পর সেরাম জানিয়েছে তারা ২০২১-এর পর কোভিশিল্ডের উৎপাদন এমনিতেও বন্ধ করে দিয়েছে, কিন্তু তার আগে কতজনের জীবনদীপ মুছে দিয়েছে এই টিকা তার কি কোনো হিসেব আছে? তারা টিকা ছাড়াও 'Evushed' এবং 'Sipavibart' ব্র্যান্ড নামের দুটো অ্যান্টিবডি ককটেল বেচেছে অতিমারিকালে। আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলতে পারি এটা হল আর একটা মানুষ মারা বাণিজ্য এবং এই ককটেলের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নিয়ে কোনো মামলাপত্র হয়েছে বলে অন্তত আমার কাছে কোনো খবর নেই। লক্ষাধিক টাকা খরচ করে যারা এই ককটেল নিয়েছেন তাঁরা কে কতটা ভুগেছেন বা ভুগছেন তার হিসেব নেই, কিন্তু আপৎকালীনতার সুযোগ নিয়ে যে মুনাফাটা তারা করে গেছে এই ককটেল বেচে তার উল্লেখ 'অ্যাস্ট্রা-জেনেকা'র ওয়েবসাইটে আছে। আমরা হলাম সেই গিনিপিগ যারা নিজেরাও এক অর্থে শেষ পর্যন্ত একটা উৎপাদনই বটে, তবে আমাদের কোনো ব্র্যান্ড নেম নেই - এই যা! ১০ মে 'Awaken India Movement' (AIM) নামের ডাক্তারবাবুদের একটা গ্রুপ প্রেস মিট করে দাবি করে যে ভ্যাকসিন নীতি ও বাণিজ্যকে সরকারের নজরদারির আওতায় আনতে হবে এবং বহুদিন পরে ঘটতে থাকা বিপরীত প্রতিক্রিয়াগুলো সম্পর্কে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাঁরা বলেন, ক্রমশ মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে যে কারণে তা হল 'ফেজ থ্রি ট্রায়াল' ছাড়াই EUA (Emergency Use Authorization)-এর সুযোগ নিয়ে একটা অর্ধপক্ক ভ্যাকসিন বাজারে ছেড়ে দেওয়া। গাইনোকলজিস্ট ডক্টর সুজাতা মিত্তল বলেন, হাজার হাজার মহিলা টিকা নেওয়ার পর মাসিকের গণ্ডগোলের কবলে পড়েছেন, গর্ভপাত হয়েছে অনেক অন্য সবদিক দিয়ে স্বাভাবিক প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রেও। তাঁরা এই সমস্ত অভিযোগের মীমাংসার জন্য ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট দাবি করেছেন।

টিকা গবেষণার ইতিহাস বলে সবচেয়ে কম সময়ে অনুমোদন পাওয়া টিকা হল মাম্পস ভ্যাকসিন যা ১৯৬০-এর দশকে সাড়ে চার বছর সময় নিয়েছিল অনুমোদন পেয়ে বাজারে আসতে। 'কোভ্যাক্সিন' তো নয়ই, 'কোভিশিল্ড'ও এসব ধাপ সন্তোষজনকভাবে পার হয়ে এসেছে এ’কথা তারা নিজেরাও দাবি করেনি, তবু কীভাবে এই ‘অ্যাপ্রুভাল’ এসে গেল? এই ‘ইমারজেন্সি ইউজ অথরাইজেশন’ বা জরুরী ভিত্তিতে ব্যবহারে স্বীকৃতি আদতে ‘অ্যাপ্রুভাল’ বা অনুমোদনের চেয়ে কয়েক যোজন দূরত্বের ব্যাপার। 'বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা'র সুপারিশমতেই কোনো জরুরী ব্যবস্থা নেবার তাগিদে (যেমন, এই কোভিড অতিমারির প্রকোপে) পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই ওষুধ-বিসুধের পূর্ণ অনুমোদনের আগে অন্তর্বর্তীকালীন অনুমোদনের সংস্থান আছে যদি তা যথেষ্ট নিরাপদ এবং কার্যকরী বলে বিবেচিত হতে পারে। ভারত সহ যে সব দেশে টিকা অনুমোদিত হয়েছে তার কোনটিই পুর্ণ অনুমোদন নয়। যা হয়েছে তা হল ওই অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা, যেখান থেকে এই টিকাগুলোর যে কোনোটিরই ভবিষ্যতে বাতিল হবার সম্ভাবনা ছিল আক্ষরিক অর্থেই ষোল আনা। অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিক দ্রুততায় টিকা বাজারে আনার জন্য কিছু গাইডলাইন 'বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা' তৈরি করে ২০১৪-১৬ সময়কার ইবোলা মহামারির সময়। তারা বলছে ‘পাবলিক হেলথ ইমারজেন্সি অফ ইন্টারন্যাশানাল কনসার্ন’ দাবি করে ওষুধ বা টিকা বা বায়োমেডিক্যাল উপাদানসমূহের অন্তর্বতীকালীন অনুমোদনের। তারা এটাকে ঝুঁকিভিত্তিক বা Risk Based Procedure বলেই চিহ্নিত করছে। ইবোলা প্রতিরোধে দুটি এরকম আবেদন এসেছিল বটে কিন্তু কোনোটাকেই হু অনুমোদন দেয়নি। এই অতিমারি ছিল অভূতপূর্ব এবং হতচকিত 'বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা' জাতীয়তার দাবির কাছে হার মেনে এই প্রথমবার সেটা দিল। কিন্তু তার জন্য নিরাপত্তা যে বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল এই সন্দেহ পাকা হতে শুরু করেছে সবেমাত্র। একটা সঠিক গবেষণাজাত টিকা আসতে যেমন বহু সময় লাগে, একটা সন্দেহজনক টিকার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াও ঠিক তেমনই বহু বছর পরেও দেখা দিতে পারে। রাস্তায় ঘাটে কান পাতলে কত মানুষের কথা শুনতে পাই যারা বলে কোভিডের টিকা নেওয়ার পর তারা আগে ছিল না এমন অনেক উপসর্গের শিকার। এমন প্রতিটি মানুষকে বিবেচনায় আনার দাবি তুলতেই হবে এবার, কেন না মুনাফা অনেক হয়েছে! মূল মামলা যেখানে, অর্থাৎ ইংল্যান্ডে, আইন জিনিসটা ক্ষমতার হাত ধরে চলে না। ১৯৭০ থেকে ৯১ পর্যন্ত সে দেশে HIV উপস্থিতি পরীক্ষা না করেই যত রক্ত দেওয়া হয়েছিল তার জন্য ৩০,০০০ সংক্রমণের কথা সে দেশের 'ন্যাশানাল হেলথ সার্ভিস' (NHS) মেনে নিয়েছে এবং এই ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে দেউলিয়া হতে হলেও দেবে তারা, কিন্তু আমাদের দেশে, যেখানে শ্রমের ক্ষমতা কমে যাওয়া মানেই একটা মানুষের বেঁচে থাকাটাই সংশয়ে পড়ে যাওয়া, সেখানে আমাদের মতো এই গিনিপিগরা কোনো বিচার পাবে কিনা সেটাই দেখার।