আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২৪ ● ১৬-৩২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
প্রবন্ধ
গাহি অসাম্যের জয়গান
অর্ধেন্দু সেন
ভারতের অর্থব্যবস্থা এখন বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম। আমেরিকা, চিন, জাপান ও জার্মানির পরেই আমাদের স্থান। আমাদের মাথাপিছু আয় অবশ্য আমেরিকা ইউরোপের তুলনায় নগণ্য। চিনের এক-চতুর্থাংশ। এক্ষেত্রে আমরা মাথাপিছু হিসাবটা আলোচনায় আনিনা। সেটা কাজে লাগে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণের বেলায়। আমরা জানি এই নিঃসরণই বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য দায়ী। মোট নিঃসরণের হিসাবে আমরা তৃতীয় কিন্তু আমাদের মাথাপিছু নিঃসরণ অত্যন্ত কম। সেখানেই আমাদের গৌরব। আমাদের পরিবেশ সচেতনতার প্রকৃত পরিচয়।
মাথাপিছু আয় কম হওয়াতে বহুদিন আমাদের সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সাম্প্রতিককালে তার চেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে ভারতে আয় এবং সম্পদের অসাম্য নিয়ে। 'অক্সফ্যাম' দেশের তীব্র এবং ক্রমবর্ধমান অসাম্যের উপর বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করেছে বেশ কয়েক বছর ধরে। টমাস পিকেটির গবেষণাগার ইউএনডিপি আইএমএফ এবং ক্রেডিট-সুইস ব্যাঙ্কও তাদের বিভিন্ন প্রতিবেদনে এই বিষয়ে তথ্য পরিবেশন করেছে। অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বলেছেন, এই অসাম্য অসহ্য। পিএম মোদীর উপদেষ্টামণ্ডলীর প্রধান কিন্তু বলেন এই বিষয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। অর্থনীতিতে দ্রুত বৃদ্ধির সময়ে অসাম্য বাড়ে। ওটা স্বাভাবিক।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে প্রধান উপদেষ্টা সম্প্রতি এও বলেছেন যে যুগ বদলেছে তাই আমাদের প্রয়োজন নতুন সংবিধানের। উপদেষ্টামণ্ডলী প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিবৃতি দিয়ে বলেছেন এটা তাঁর নিজস্ব অভিমত। মণ্ডলীর অভিমত নয়। নতুন সংবিধানে মানুষ আপত্তি করছেন এই ভেবে যে তফসিলি জাতি উপজাতির জন্য বা পিছিয়ে পড়া বর্গের জন্য সংরক্ষণ থাকবে না। এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। সরকার কখনওই বলবে না যে তারা সংরক্ষণের বিরুদ্ধে। নিঃশব্দে সরকারি চাকরির সংখ্যা কমিয়ে আনলেই তো হবে। সংরক্ষণ আপনি বিদায় নেবে।
সরকারের আরেক উপদেষ্টা বলেছেন সরকার কখনই মানুষের সব সমস্যার সমাধান করতে পারেনা। উদাহরণ? সরকার সবাইকে চাকরি দিতে পারেনা। ফ্যাক্টরি লাগাতে চান। জমি পাচ্ছেন না? সরকার সাহায্য করবে। ব্যাঙ্ক চড়া সুদে ঋণ দিচ্ছে? সরকার সাহায্য করবে। শ্রমিক অন্যায্য দাবি করছে? সরকার সাহায্য করবে। ঐ এক চাকরি না চাইলেই হল। ফলে হয়েছে এই যে বেকারত্ব বেড়েছে। পিএম মোদী বলেছিলেন বছরে দেড় কোটি ভাল মানের চাকরি তৈরি করবেন। তা তিনি পারেননি। অবশ্য তিনি বিশ্বগুরু। কখনই বলেননি সব চাকরি এই দেশেই হবে। তাই আমাদের শ্রমিক ইদানীং ইউক্রেন, ইসরায়েল ইত্যাদি দেশে পাড়ি দিয়েছে চাকরি করতে। ঘরকুনো হলে কি করে চলবে?
অসাম্য নিয়ে গবেষণা করেছিলেন বিখ্যাত মার্কিন অর্থনীতিবিদ সাইমন কুসনেতস। ১৯৫০-এর দশকের এই গবেষণায় তিনি দেখান যে আর্থিক বৃদ্ধির গোড়ার দিকে সব দেশেই অসাম্য বাড়বে। অসাম্য বলতে তিনি বোঝান উপার্জন এবং সম্পদের অসাম্য। অর্থনীতি পরিণত হলে দেখা যাবে অসাম্য কমে আসছে। গড় আয়ের সঙ্গে অসাম্যের রেখাচিত্র হবে উলটো করা ইংরেজি অক্ষর 'U'-এর মতো। এই রেখাচিত্রের নাম হয় 'কুসনেতস রেখাচিত্র'। এই রেখাচিত্র সরকার দুইভাবে কাজে লাগায়। অসাম্য কমে আসার সময় সরকার বলে তাদের প্রগতিশীল নীতির জন্যই অসাম্য কমছে। অসাম্য বাড়ার সময় সরকার বলে এ তো সাধারণ নিয়ম। সরকারের কী করার আছে? প্রধান উপদেষ্টা সেই কথাই বলেছেন।
কিন্তু এ বিষয়ে দ্বিমত আছে। অর্থনীতির বৃদ্ধির সঙ্গে অসাম্য কি হারে বাড়বে তা নির্ভর করে কর্মসংস্থানের উপর। কাজের সুযোগ বাড়লে অসাম্য কম হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ বেশি হলেও অসাম্য কম হবে। ভারত সরকার উদারনীতি গ্রহণ করার পরে অর্থনীতি দ্রুত বেড়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু চাকরি দেবার ক্ষেত্রে আমাদের রেকর্ড ভাল নয়। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ নিম্নমুখী। তাই আমাদের দেশে অসাম্য আমেরিকা ও চিনের থেকে বেশি। পিকেটির হিসাব অনুযায়ী দেশে অসাম্য এখন ব্রিটিশ আমলের চেয়েও বেশি। সরকারের উপর সংবিধানের নির্দেশ আছে আর্থিক অসাম্য কমিয়ে আনার। ১৯৮০ পর্যন্ত আমরা এই নির্দেশ মেনেছি। অসাম্য কমেছে। তার পর বিশেষ করে ১৯৯০-এর উদারনীতির পরে অসাম্য দ্রুত বেড়েছে। নেহেরু নিজে ভূমি সংস্কারের পক্ষে থাকলেও কংগ্রেস ছিল বড় চাষির দিকে। তাই চিন জাপান কোরিয়ার মতো ভূমি সংস্কার আমাদের দেশে হয়নি। অর্থাৎ সাম্যবাদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়নি। এছাড়া আমরা সমাজকে হাজার বছর পুরনো বর্ণবৈষম্যের হাত থেকে মুক্ত করতে পারিনি। হিন্দু রাষ্ট্র স্থাপিত হলে কি এর প্রকোপ বাড়বে?
ভারতে অসাম্যের বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে যে দেশের সবচেয়ে ধনী ১ পারসেন্ট মানুষের রোজগার দেশের মোট রোজগারের ২৩ পারসেন্ট। এই অনুপাত আমেরিকার তুলনায় বেশি। একমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়ে কম। এই ১ পারসেন্টের হাতে আছে দেশের মোট সম্পদের ৪০ পারসেন্ট। অন্যদিকে দেশের সবচেয়ে গরিব ৫০ পারসেন্টের হাতে সম্পদ ১৫ পারসেন্ট। ১৯৯০ সালে দেশে মাত্র একজনের হাতে ১০০ কোটি ডলারের বেশি সম্পদ ছিল। এখন ডলার বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা ১৬২। বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা বাড়ায় তো আমাদের খুশি হবার কথা। অবশ্যই আমরা খুশি হতাম যদি দেশে দারিদ্র না থাকত। মানুষ বিএমডব্লিউ অথবা পোরশা গাড়ি চড়ুক ক্ষতি নেই। যদি হাজার হাজার লোককে ফুটপাথে না শুতে হয়।
কোনও ক্লাসের সব ছাত্রছাত্রী কি পরীক্ষায় একই নম্বর পায়? যে বেশি পড়াশোনা করেছে সে তো ভাল নম্বর পাবেই। অসাম্যের ব্যাপারটা অনেকে এভাবেই দেখে। কিন্তু সবাই কি পরীক্ষার ফি জমা দিতে পেরেছে? যে ভালভাবে পড়াশোনা করেনি তার বাড়িতে লাইট আছে তো? ফলাফলের অসাম্য মেনে নেওয়া যায় কিন্তু সুযোগের অসাম্য মেনে নেওয়া যায়না। আমাদের দেশে সুযোগের অসাম্য চলে আসছে হাজার বছর ধরে। মনুর সময় থেকে। একলব্যের সময় থেকে। পিএম মোদী চেষ্টা চালাচ্ছেন দেশকে সেই যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু তিনি অর্থনীতিতে দ্রুত বৃদ্ধি পছন্দ করেন। অসাম্য বাড়লে কিন্তু বৃদ্ধির হার কমে যাবে। তাই তিনি চান বা না চান অসাম্যে লাগাম লাগাতেই হবে।
মোদী সরকারের ধারণা এবং দাবি যে তাঁরা দশ বছরে দেশের ১৪ কোটি মানুষকে দারিদ্ররেখার উপরে নিয়ে এসেছে। নিচে রয়ে গেছে মাত্র ৫ পারসেন্ট! কি করে সম্ভব হল এই চমৎকার? দেশের অর্থনীতির পরিমাপ হল জিডিপি। কিন্তু জিডিপি কি বলতে পারে দেশের মানুষ সুখী কিনা বা কতোটা সুখী? পারেনা কারণ পয়সাই সব নয়। একই কারণে কারও পকেটে পয়সা নেই তাই বলা উচিত না সে গরিব। তাকে স্টক মার্কেটের ঝুঁকি নিতে হয়না। মেয়ের জন্য কলেজ খুঁজতে হয়না। প্রতিবছর ইনকাম ট্যাক্সের হিসাব তৈরি করতে হয়না। সে সিবিআই ইডির ধরাছোঁয়ার বাইরে। ডাক্তারদের আয়ত্তের বাইরে। কাউকে গরিব ঠাউরে তার পিছনে অনুদান নিয়ে ছুটবার আগে এই বিষয়টা বুঝতে হবেনা?
পিএম মোদীর মুখে কখনও দুশ্চিন্তার ছাপ দেখবেন না। দারিদ্র এবং অসাম্য দুইই তিনি নিয়ন্ত্রণে এনেছেন। সমস্যা একটাই। নেহেরু, মহলানবিশের সময় থেকেই সরকার অর্থনীতির উপর বিভিন্ন রিপোর্ট প্রকাশ করে আসছে। এমনকি জনগণনার ফলাফলও গোপন রাখার প্রথা নেই। জাতির নিরাপত্তার স্বার্থে এই ব্যবস্থায় দ্রুত পরিবর্তন করা প্রয়োজন।