আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২৪ ● ১৬-৩২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
সম্পাদকীয়
কলকাতা হাইকোর্টের ওবিসি সংক্রান্ত রায় প্রসঙ্গে
দেশে সাত দফা নির্বাচন পর্বে প্রধানমন্ত্রী এবং শাসকদলের পক্ষ থেকে যেই পরিমাণ সাম্প্রদায়িক এবং বিদ্বেষমূলক প্রচার করা হয়েছে তার তুলনা স্বাধীন ভারতে আর নেই। মুসলমান সমাজের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার করা হয়েছে যে তারা হিন্দু মহিলাদের মঙ্গলসূত্র কেড়ে নেবে, হিন্দুদের গরু-মোষ কেড়ে নেওয়া হবে কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে, এবং ওবিসি তথা এসসি-এসটির জন্য বরাদ্দ সংরক্ষণ লঘু করে তা নাকি মুসলমানদের দিয়ে দেওয়া হবে, এহেন কথা দেশের প্রধানমন্ত্রী গোটা দেশে ঘুরে ঘুরে বলেছেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে মহামান্য কলকাতা হাইকোর্ট বিগত ২২ মে যে রায় দিয়েছে তা বিজেপি-র প্রচারে নতুন অস্ত্র জুগিয়েছে। হাইকোর্ট জানিয়েছে যে ২০১২ সালে যে সমস্ত সম্প্রদায়কে ওবিসি তালিকাভুক্ত করে সংরক্ষণ দেওয়া হয়েছে, তা বাতিল করা হচ্ছে। এর সঙ্গে হাইকোর্ট এও জানিয়েছে যে এই তালিকা বাতিল করা হলেও যারা এই সংরক্ষণের মাধ্যমে চাকরি বা অন্যান্য সুবিধা পেয়েছেন তা বাতিল হবে না। এই তালিকায় যাদের সংরক্ষণ বাতিল করা হয়েছে তারা মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রান্তিক অংশের মানুষ। তাই বিজেপি কোর্টের এই রায় নিয়ে প্রচারে সরব হয়েছে।
হাইকোর্টের রায়ের আলোচনায় আসার আগে একবার পশ্চিমবঙ্গে এই সংরক্ষণের ইতিহাস দেখে নেওয়া যাক। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারের সময় ২০১০ সালের ৫ মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখের মধ্যে মুসলমান সমাজের ৪১টি জাতিকে ওবিসি সংরক্ষণের আওতায় আনা হয়। আবার ১২ সেপ্টেম্বর আরে ৫৬টি জাতিকে ওবিসি (বেশি প্রান্তিক) এবং ৫২টি জাতিকে ওবিসি (প্রান্তিক) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১১ মে, ২০১২ সালে মমতা সরকার ৩৫টি জাতিকে ওবিসি (প্রান্তিক) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে যার মধ্যে ৩৪টি মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত। ২০১২ সালে মমতা সরকার একটি আইন করে ৭৭টি ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত জাতিকে নতুন করে প্রান্তিক এবং অতি প্রান্তিক তালিকাভুক্ত করে। হাইকোর্ট এই সিদ্ধান্তগুলিকে বেআইনি আখ্যা দিয়েছে মূলত চারটি কারণে। প্রথমত, আদালতের মতে এই জাতিগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সরকারী নির্দেশনামার মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গ অনগ্রসর শ্রেণি কমিশনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তালিকাগুলি নতুন করে গঠন করা হয়নি। তৃতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গ অনগ্রসর শ্রেণি কমিশনের সুপারিশগুলি বৃহৎ কোনো ক্ষেত্রসমীক্ষা ছাড়াই করা হয়েছে। কমিশনের সুপারিশ বিধানসভায় পেশ করা হয়নি এবং তা প্রকাশ্যে আনা হয়নি। চতুর্থত, রাজ্যের সরকারী চাকরিতে এই শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব কম রয়েছে এর পক্ষে পর্যাপ্ত পরিমাণ পেশ করা হয়নি।
২০০৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত সচ্চার কমিটি রিপোর্টে দেখা যায় যে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান সমাজের মানুষেরা বাকি দেশের মুসলমানদের তুলনায় বেশি পশ্চাদপদ। এই পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারকে যথেষ্ট সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয় এবং তারা রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের সুপারিশ মেনে মুসলমান সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশকে ওবিসি তালিকাভুক্ত করে তাদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। তৃণমূল সরকার এই নীতিকেই এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু সঠিকভাবে সমীক্ষার মাধ্যমে, বিধানসভায় অনগ্রসর শ্রেণি কমিশনের রিপোর্ট পেশ না করেই বিভিন্ন সম্প্রদায়কে ওবিসি তালিকাভুক্ত করে, যা হাইকোর্টের রায়ে বাতিল বলে ঘোষণা হয়েছে।
তৃণমূল সরকারের এহেন স্পর্ষকাতর বিষয় যা রাজ্যের বহু প্রান্তিক মানুষের ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িত তা নিয়ে আরও বেশি সচেতন এবং সজাগ থাকা উচিত ছিল, এই নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বারবার কোর্টে সরকার পক্ষকে অপদস্ত হতে হচ্ছে। কোনো রাজ্য সরকার যদি সঠিকভাবে মানুষের স্বার্থে কাজ করে তাহলে তাদের আদালতের কাছে এইভাবে অপদস্ত হতে হয় না। কিন্তু তৃণমূল সরকার যেমন খুশি চলো নীতি নেওয়ার ফলে মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। সরকার বলেছে তারা সুপ্রিম কোর্টে এই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন জানাবে। আমরা সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অপেক্ষায় থাকব।
সুপ্রিম কোর্ট তাদের মতন করে বিচার করে সঠিক ন্যায় করবেন এই নিয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। আমরা এই সম্পাদকীয়তে কিছু আইনগত এবং কিছু রাজনৈতিক প্রশ্ন তুলতে চাই। প্রথমত, মাননীয় হাইকোর্টের বিচারপতিরা সচ্চার কমিশনকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছেন। সচ্চার কমিশন কোনো সংরক্ষণ দেওয়ার জন্য সমীক্ষা করেনি বা তাদের সেই এক্তিয়ারও ছিল না এই কথাও ঠিক। কিন্তু মাননীয় বিচারপতিরা যখন বলেন যে ২০১০ সালে সচ্চার কমিটি রিপোর্টে মুসলমানদের নিয়ে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তা পুরোনো হয়ে গেছে তখন তাকে মেনে নেওয়া কঠিন হয়, কারণ দেশের কোনো সমাজের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি পাঁচ বছরের মধ্যে বদলায় না। মাননীয় বিচারপতিদের অভিমত যে পশ্চিমবঙ্গ অনগ্রসর কমিশন নির্ধারিত জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে ওবিসি নথিভুক্ত করা হবে কি না তা নির্ধারণ করে, যা যথেষ্ট নয়। কিন্তু সঠিকভাবে রাশিবিজ্ঞান মেনে সমীক্ষা করা হলে তার থেকেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে কোনো একটি সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি কীরকম। অন্যদিকে এই সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশ কিছু ইতিমধ্যেই মণ্ডল কমিশন এবং জাতীয় অনগ্রসর শ্রেণি কমিশনের সুপারিশ মেনে ওবিসি তালিকাভুক্ত রয়েছে। তাহলে নতুন করে তাদের বাতিল করা হয় কী করে?
কিন্তু এতসব কিছুর পরেও কয়েকটি কথা থেকে যায়। উপরের আলোচনা থেকে পরিষ্কার যে মাননীয় বিচারপতিরা একদিকে যেমন পদ্ধতিগত ত্রুটির কথা বলেছেন তেমনই এই সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের বিষয়ে যে তথ্য পেশ করা হয়েছে তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এখানে সেই তথ্য নিয়ে বাদানুবাদ শেষ করার একটি সহজ উপায় রয়েছে, তা হল জাতিভিত্তিক জনগণনা। যারা ধর্মের নামে রাজনীতি করার জন্য হাওয়া গরম করছেন, মুসলমান সমাজকে গাল পাড়ছেন সেই বিজেপি কিন্তু সরাসরি জাতিভিত্তিক জনগণনার বিরোধিতা করেছে। অথচ দেশের মানুষের উন্নয়নের জন্য, কারা এগিয়ে রয়েছে কারা প্রান্তিক রয়েছেন তা জানার জন্য জাতিভিত্তিক জনগণনা করা দরকার। একবার সেই গণনা হলে বিভিন্ন সম্প্রদায়কে সংরক্ষণ দেওয়ার যে রাজনীতি তাতে স্বচ্ছতা আসবে, হাইকোর্ট তথ্য সংক্রান্ত যেই প্রশ্নগুলি তুলেছেন সেগুলি অবান্তর হয়ে যাবে। তাই জাতিভিত্তিক জনগণনার কথা সবাইকে ভাবতে হবে। এর মাধ্যমে এই ধরনের বিবাদ বন্ধ হবে।
দ্বিতীয়ত, সংরক্ষণের প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে সরকারী চাকরি অথবা শিক্ষার প্রশ্ন। সরকার আর চাকরি দেয় না। বেসরকারীকরণের ফলে অনেক সরকারী ক্ষেত্র বন্ধ। যদি সরকারী চাকরির সংখ্যা অথবা সরকারী কলেজ, বা বিশ্ববিদ্যালয় বা স্কুলের সংখ্যা কমতে থাকে তাহলে সংরক্ষণ বিষয়টিই অবান্তর হয়ে যাবে। তাই সংরক্ষণ শুধু নয়, সরকারী চাকরি তথা শিক্ষা এবং পরিষেবা বাড়ানোর লড়াই লড়তে হবে। সমতা এবং সামাজিক ন্যায়ের রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যদি প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনীতি তৈরি করতে হয় তাহলে তার প্রধান দাবি হওয়া উচিত জাতিভিত্তিক জনগণনা এবং সরকারী চাকরি তথা শিক্ষার বিস্তার। তৃণমূল অথবা বিজেপি সেই লড়াই লড়বে না। অতএব দায়িত্ব নিতে হবে বাম প্রগতিশীল শক্তিদের।