আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২৪ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১

প্রবন্ধ

ক্যাপচাকাহন

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী


শুরুতেই এই গল্পটির উল্লেখ না করলে ব্যঞ্জনে লবণ না পড়ার মতো হবে। গল্পটি শুনিয়েছিল আমার এক ভ্রাতৃপ্রতিম। সেক্টর ফাইভে চাকরি করা আইটি পড়া ভাইটি। এ গল্প তার প্রথম প্রেম গড়া ও তা ভেঙে যাওয়া নিয়ে। দুটি ঘটনাই ঘটেছিল একই দিনে। বলা যায়, চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে। যেমনভাবে শুনিয়েছিল ও, ঠিক তেমনভাবেই বলার চেষ্টা করছি।

প্রথম ডেটের দিন, দাদা। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ। ঝাঁ ঝাঁ রোদে হিমানী বলল, “এই গরমের একটা কোট দে।” আমি বললাম, “গরমে আবার কোট? তুই ক্ষেপেছিস নাকি হিমানী?” ও মিষ্টি হেসে বলল, “তুই না, শিলাদিত্য, একেবারে যা তা। জাস্ট যা তা। কোট মানে একটা নতুন লাইন।” ঝটিতি গুগল করলাম। প্রশ্ন করলে উত্তর আসে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। একটা কোট পছন্দ হল বেশ। বললাম, “কোথাও না কোথাও সব সময় গ্রীষ্মকাল, হিমানী। ইটস অলওয়েজ সামার সামহোয়্যার। কে বলেছিল জানিস? গিলি পুলিৎজার।“ চুপিচুপি বলি, ওই নাম আমি আগে শুনিনি কখনও। জিজ্ঞেস করলাম, “ভালো লাগলো প্রিয়া?” হিমানী নোনতা হেসে বলল, “টোকার অভ্যাসটা গেল না এখনও? তুই কি মানুষ? তোর নিজের কোনও কোট নেই? নিজের লাইন?” কচকচ করে চেবাতে থাকা বাবল গামের এক ঠোঁটজাত বিরাট বেলুন ফুলিয়ে এবং ফাটিয়ে বলল, “তুই জানিস না পোয়েট্রি আমার হবি? প্রতি ঘন্টায় আই নিড এ নিউ লাইন। না হলে আমার ভয়ঙ্কর রকমের দমবন্ধ লাগে। আই ফিল সাফোকেটেড”। মুশকিলটা হল, আমি কবিতা ভালবাসি না একেবারে। কোটের থেকেও শত যোজন দূরে। ভুল বললাম। কয়েক আলোকবর্ষ দূরে। মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের দিনযাপনে কম্পাউড-মলিকিউল থাকে। চিকিৎসকদের পটানোর জন্য তৈলসিক্ত উপহার থাকে। আমি প্রসঙ্গ ঘোরানোর জন্য বললাম, “চল্ হিমানী, আমের শরবত খাই। প্যারামাউন্ট।” হিমানী কাঁধদুটো শ্রাগ করে বলল, “দ্যাটস ফাইন। কিন্তু আগে আমের উপরে একটা কোট দে।“ সূর্যের দিকে তাকিয়ে গ্রীষ্মকালীন কোট ভাবতে ভাবতে চোখে ঝিলমিল লেগে গেলো। হিমানী গুগলের কোট পছন্দ করে না। তাই নিজেই বানালাম। বললাম, “ওহে আম, ভালো করে ফলন ওঠার আগে, তোমার যে খুব দাম।“ জীবনে প্রথম পদ্য মেলালাম। ছন্দে ছন্দে আনন্দে দুলছিলাম। হিমানী একটা তেতো হাসি ছুঁড়ে বলল, “ডিজগাস্টিং! অতি জঘন্য একটা কোট। তুই কি মানুষ?” আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। গলার মধ্যে পাথর আটকে গিয়েছিল। বিকেল চারটের সময় হিমানীকে বললাম, “আসব আরেক দিন। আজ যাই। গুড নাইট হিমানী। শুভরাত্রি।” ও কুইনাইনের মতো হাসি উগরে দিয়ে বলল, “আমি তখনই গুড নাইট বলব যদি তুই রাত্রিবেলার উপরে একটা কোট দিস। তোর বুক থেকে একটা লাইন বেরিয়ে আসে না স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তুই কি মানুষ?” মায়াবী হিমানী চলে গেলো ওলার ওটিপি বলে। ওর দুচোখ থেকে উগরোচ্ছিল উপেক্ষার চকমকি পাথরের ঘর্ষণ। কচুপাতার উপরে বৃষ্টিফোঁটার মতো ঝরে পড়ছিল আমার আবেগ। দুম করে মনে পড়ে গেল এআইয়ের কথা। আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। শুনেছি, এই বুদ্ধি অমনিবাস নাকি অনেককে দুর্গতির হাত থেকে বাঁচায়। ব্যবহার করিনি কোনওদিন। অ্যাপ নামিয়ে রেজিস্টার করার পরেই বলল, ‘প্রমাণ করুন আপনি একটি মানুষ।‘ চলে এলো ক্যাপচা। বলল, ‘নিচে দেওয়া আটটি বর্গক্ষেত্রের মধ্যে কোন ছবিগুলোতে জেব্রা ক্রসিংয়ের ডোরাকাটা আছে বাতলে দিন জলদি। সিলেক্ট করুন।‘ ভুলভাল আমি, প্রত্যাখ্যাত আমি, জেব্রা ক্রসিং চিনতে ভুল করেছিলাম। রাস্তা পেরোতে পারলাম না। উল্টোপাল্টা সিলেক্ট করে সাবমিট বটনে ক্লিক করতেই যান্ত্রিক পর্দা বলল, ‘দুঃখিত। সরি। আপনার নির্বাচন করা অপশনগুলো ইনকারেক্ট। আমাদের সংশয় আছে আপনি মানুষ কি না। পেশ করা হচ্ছে পরবর্তী ক্যাপচা। প্রমাণ করুন, আপনি রোবট নয়, একটি মানুষ’। প্রত্যাখ্যাত, প্রত্যাখ্যাত, প্রত্যাখ্যাত হতে হতে প্রবল বিরক্তি নিয়ে সাধের মোবাইল আছড়ে ফেলে দিয়েছিলাম রাজপথে। চূর্ণ স্মার্টফোনের ছিন্ন দেহ থেকে বেরিয়ে এসেছিল ব্যাটারির ধ্বংসাবশেষ। সিম কার্ড ছিটকে পড়েছিল ডিভাইডারে ধাক্কা মারা বাইক আরোহীর মতো। পথচলতি জনতা আমার মুখের দিকে তাকালো, অবাক বিস্ময়ে। প্রশ্ন করল, “আপনি কি মানুষ?” শুধুমাত্র ক্যাপচা পূরণ না করতে পারার জন্য আমি হারিয়েছিলাম আমার প্রথম প্রেম। কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিল হিমানী। হে ক্যাপচা শুনে নাও, তোমার এই সংগঠিত ষড়যন্ত্রের ক্ষমা নেই কোনও। মানুষ হতে না পারার জন্য তোমার মুখে এক দলা গরম থুতু।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমার ভাইটির গোলাপসম প্রেমকে ছিনিয়ে নিয়েছিল শুধুমাত্র ও মানুষ হতে পারেনি বলে। রক্তমাংসের মানুষ হয়েও ও প্রমাণ করতে পারেনি নিজেকে। কম্পিউটার ওকে রোবট ভেবেছিল। আর জিতে গিয়েছিল মেশিনের অ্যালগোরিদম।

কবীর সুমনের বিখ্যাত গানটির কয়েকটি শব্দ বদলে দিয়ে আমার এক কবিবন্ধু বলেছিল, “এক ক্যাপচায় আমি তোমাকে চাই।“ একটু থেমে বলেছিল, “বলা সহজ। করাটা খুব কঠিন। মানুষই ক্যাপচা গড়ে। কিন্তু সেই ধাঁধায় নিজেই হারিয়ে যায়, যুদ্ধক্ষেত্রে অভিমন্যুর মতো।”

ক্যাপচার পুরো কথা হল, 'কমপ্লিটলি অটোমেটেড পাবলিং টুরিং টেস্ট টু টেল কম্পিউটারস্ অ্যান্ড হিউম্যানস অ্যাপার্ট'। 'টুরিং' কথাটা বাদ দিয়ে বাংলা করলে দাঁড়ায়, মানুষ ও কম্পিউটারকে আলাদা করার উদ্দেশে আম আদমির জন্য বানানো একটি সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় পরীক্ষা। আরও সহজভাবে বলা যায়, আমাদের মধ্যে কোনও রোবট লুকিয়ে আছে কি না জানার জন্য একটি নির্ণায়ক পরীক্ষা। পরীক্ষায় পাশ করে গেলে সাবাশ। চটজলদি ফিরে পাওয়া যাবে এক ক্লিকের ওপারে থাকা বাইনারি ঐশ্বর্য্য। ফেল করলে সর্বনাশ। সবকিছুরই মালিক আমি জানা সত্ত্বেও ঠায় বসে থাকতে হবে কম্পিউটার কিংবা মোবাইলের পর্দার সামনে। মানব কন্ঠে বিরক্তি ছুঁড়ে দিয়ে বলব, “চিচিং ফাঁক।” কিন্তু বন্ধ দরজার সামনে যে দাম্ভিক তালা বসিয়ে দিয়েছে অনলাইনের প্রহরীরা, শত চিৎকার, অনুনয়, আকুতি, মিনতিতেও তা খোলার সম্ভাবনা দেখা দেবে না কোনও।

ধরা যাক, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আপনি মজেছেন নেটব্যাঙ্কিংয়ে। বছরখানেক আগেও আপনার প্রিয় বই ছিল পাশবই। ফি মাসে দুটো শনিবার ব্যাঙ্কে হানা দিয়ে, ঘন্টাখানেক লাইনে দাঁড়িয়ে পাশবই আপডেট করা ছিল আপনার প্রিয় হবি। টাকা জমা করার পরে ডট-ম্যাট্রিক্স প্রিন্টারের টকাটক আওয়াজ দৈব সুখ দিত। ব্যালেন্স বাড়ছে! নেটব্যাঙ্কিং সেই প্রক্রিয়াকে সহজ করল। আমি তো এমনি এমনি খাইয়ের মতো ব্যালেন্স চেক করারও সুযোগ এল এমনি এমনি, প্রাতে-অপরাহ্নে-মধ্যরাতে, যখন খুশি। এল অনলাইন পাশবই। নেটব্যাঙ্কিংয়ের পাসওয়ার্ডটি জটিল থেকে জটিলতর করতে করতে সেটি একদিন দুম করে ভুলে গেলেন বেমালুম। মোটা লাল ফন্টে স্ক্রিনে বার্তা এলো, ‘আর মাত্র দুটো অ্যাটেম্প্ট। না পারলেই লক করে দেওয়া হবে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট।‘ মাথা চুলকে আবার টাইপ করলেন। পর্দায় স্টারচিহ্ন দেওয়া পাসওয়ার্ডের মধ্যে ফের মিশেছিল ভুল। ব্যাঙ্ক চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘হাতে রইল পেনসিল। আর মাত্র একটি অ্যাটেম্প্ট।’ আর্কিমিডিসবাবুর সূত্র আবিষ্কার করার মতো এবারে ঝপ করে মনে পড়ে গেল পাসওয়ার্ড। ইউরেকা বলে, কলার তুলে সেটি নির্ধারিত জায়গায় টাইপ করে দিলেন ফটাফট। মন তখন গরাদমুক্তির আনন্দে ঝলমল। হায়! তৃতীয় যাত্রাটি ছিল ছোটগল্পের মতো। শেষ হয়ে হইল না শেষ। স্ক্রিনে চলে এলো, ‘যেহেতু পাসওয়ার্ড দিতে ভুল করেছেন একাধিকবার, প্রমাণ করুন আপনি একটি মানুষ, রোবট নয়। সমাধান করুন ক্যাপচা। নিচে দেওয়া ছবির মধ্যে যে অক্ষরগুলো দেখতে পাচ্ছেন, তা টাইপ করে ফেলুন তো দেখি।’ আপনি বেশ বুঝতে পারছেন, অ্যামোলেড স্ক্রিন আপনার দিকে তাকিয়ে চোখ মারছে। তির্যকভাবে হাসছে। পথ আটকে দেওয়া বারো চাকার লরির পিছনের লেখাগুলোর মতো বলছে, ‘দ্যাখ কেমন লাগে!’

আম আদমির ক্যাপচা সমাধানের সামগ্রিক অভিজ্ঞতা বলে, ছবিতে দেখানো অক্ষরগুলো ঠিকঠাক ধরতে গেলে বেগ পেতে হয় বেশ। আমার এক গানপাগল টেকস্যাভি বন্ধু বলেছিল, “যে কোনও ক্যাপচার অক্ষরগুলো দেখলেই মনে পড়ে যায় গুরু মাইকেল জ্যাকসনের ব্ল্যাক অর হোয়াইট গানের মিউজিক ভিডিওর কথা। শেষ দৃশ্য ফ্রেমটাকে স্থির রেখে ক্রমাগত বদলে যেতে শুরু করে মানুষের মুখ। সারা পৃথিবীর অগুণতি মানুষ এসে হাজির হয় সেখানে, এক এক করে। কে যে কোথাকার, বোঝা যায় না কিছু। মনে না থাকলে এখনই ইউটিউব করে দেখে নে!” দেখেছি। একেবারে হক কথা।

একটি উদাহরণ দিই। ধরা যাক, ক্যাপচা পূরণ করার কোনও এক পরীক্ষায় মূল শব্দটি লেখা আছে ‘পেপার।‘ হলফ করে বলতে পারি, পাঁচটি অক্ষরের এই শব্দের প্রতিটি অক্ষর হবে আলাদা ফন্টে। একটি অক্ষরের মাথা ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যেতে পারে মহাশূন্যে। স্ক্রিন ভেদ করে তা পাড়ি দিতে পারে অভ্রভেদী রথে! অন্য অক্ষরের লেজ বড় হতে হতে তলিয়ে যেতে পারে ম্যারিয়ানা খাতে। একটি অক্ষর থাকতে পারে অর্দ্ধেক। মানে, আধখানা। আবার অন্যটি হতে পারে প্রাগৈতিহাসিক কোনও ফসিলের মতো অস্পষ্ট। যদি বাঁচতে চান, শ্রী রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম জপে আপনাকে তীরে তরী ভেড়াতে হবে।

ক্যাপচানামা বলে, যা কিছু থাকবে তার প্রায় সবই ডিসটর্টেড। স্বাভাবিক হলে ‘মানুষ’ প্রমাণিত হওয়ার শতাংশ বাড়ে! কোনও ক্যাপচায় দেখা যায়, যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করতে দিয়েছে কম্পিউটারের স্ক্রিন। এমনভাবেই ‘ইমেজ’ হিসেবে প্রশ্নমালা সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার সমাধান করতে পারে একমাত্র মানুষ। বাইনারি গ্যাজেটের তা পড়ার সাধ্য নেই। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, উল্টোপাল্টা ব্যাকগ্রাউন্ডে এমন প্রশ্নের সমাধান করার জন্য যে বুদ্ধির প্রয়োজন, তা যোগাতে পারে শুধু মানবমস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটার। কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের তা বোঝার সাধ্য নেই। আলকাতরা মাখা প্রশ্নপত্রে কোথায় যে ‘প্রশ্ন’টি লুকিয়ে রয়েছে, তা বোঝার জন্য কম্পিউটার এখনও আধুনিক হয়ে ওঠেনি। কালোর মধ্যে সে আলোর সন্ধান করতে পারে না! এখানেই ক্যাপচার জয়ধ্বনি।

রোবটের একটা ডাকনাম দেওয়া হয়েছে দুনিয়াজুড়ে। তার নাম বট্। রো অক্ষরটি দিকশূন্যপুরে মিশিয়ে দেওয়ার পরে শুধু বট্ বলে ডাকলে হয়তো প্রেম বাড়ে। যন্ত্রও ছোঁড়ে ফ্লাইং কিস! তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বট্ হচ্ছে দিনের শেষ অটোমেটেড ওয়েব ক্রলার। নেটদুনিয়ায় কখন হামাগুড়ি দিয়ে এসে এই বটরা সর্বস্ব হরণ করে নেবে, তা কেউ জানে না। দেখা গিয়েছে, কোনও সার্ভে ফর্ম ভর্তি করার বিষয়ে কিংবাকি কোনও পোস্টে স্বংয়ক্রিয়ভাবে কমেন্ট করে যেতে এই রোবটদের জুড়ি নেই। নিমেষের মধ্যে কোনও প্রডাক্টের কয়েক হাজার রিভিউ লিখে ফেলা, রেটিং দেওয়া এমন রোবটদের কাছে জলভাত। ক্যাপচাঅস্ত্র রোবটদের এমন আনতাবড়ি আঁকশি মেলা থেকে আমাদের বাঁচানোর চেষ্টা করে। নেটদুনিয়ার সাগরে মেশে ক্লোরিন।

যাঁরা অনলাইন যাপন করেন দিনের অনেকটা সময়, তাঁরা জানেন, কোনও নির্দিষ্ট ক্রিয়াকলাপে ক্যাপচা বাউন্সারের মতো পথ রোধ করে দাঁড়ায়। অনলাইনে কোনও সামগ্রী কেনার শেষপাতে, চেকআউটকালে তা আমাদের মানুষ বলে যাচাই করতে উন্মুখ হয়। ইমেল অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড পাল্টানোর সময়ও তা আমাকে যাচাই করতে পারে। নেটব্যাঙ্কিংয়ের পাসওয়ার্ড বদলাই যখন, গ্যাজেটের স্ক্রিন লাল পর্দা ঘোরাতে পারে চোখের সামনে। নেট-অভিজ্ঞতা বলে, এই লালকার্ড দেখতে হতে পারে যখন তখন, সময়ে অসময়ে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ অ্যালান ম্যাথিসন টুরিংয়ের নামের উপর ভর করেই তৈরি হয়েছে এই টুরিং টেস্ট। প্রায় ৭৫ বছর আগে, ১৯৫০ সাল নাগাদ উনি একটি পরীক্ষা করেন। অ্যালানসাহেব জানতে চেয়েছিলেন কম্পিউটারও মানুষের মতো চিন্তা করতে পারে কি না। তৈরি করেছিলেন কিছু নির্ণায়ক পরীক্ষা। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিরিখে কতটা পোক্ত হয়েছে হাল আমলের কম্পিউটার, তা পরখ করার জন্য ওই ব্রিটিশ গণিতজ্ঞর গবেষণালব্ধ জ্ঞান আজও ব্যবহার করা হয় বিশ্বের আনাচে কানাচে। মেশিনে যতটুকু প্রোগ্রামিং করা আছে, তার বাইরেও ওই প্রোগ্রামিংয়ের উপর ভর করে যন্ত্র আরও বেশি কিছু ভাবতে পারছে কি না, তা নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করে গিয়েছিলেন মাত্র ৪২ বছর বেঁচে থাকা এই ক্ষণজন্মা গণিতজ্ঞ। কয়েকটি প্রশ্ন একইসঙ্গে করা হয়েছিল কম্পিউটার ও মানুষকে। যন্ত্র যা উত্তর দিয়েছিল, তা যদি মানুষের দেওয়া উত্তরের ধারেকাছে যেত, তাহলে পরীক্ষায় পাশ করে যেত ওই মেশিন। মজার ব্যাপার হল, ক্যাপচা সমাধানে রোবটও বুদ্ধিমান হয়ে গেলে মানুষের বিপদ। সিঁদুরে মেঘ দেখা দেবে আমাদের অনলাইন সিন্দুকের সুরক্ষা নিয়েও। জানতে ইচ্ছে করে, আধুনিক কালে সবচেয়ে বড় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্ল্যাটফর্ম চ্যাটজিপিটি কি এই পরীক্ষায় পাশ করে গিয়েছে? কিংবা চ্যাটজিপিটির মতো প্রবল বেগে ডানা মেলতে থাকা অন্য প্ল্যাটফর্মগুলি? আবার বলি, এই পরীক্ষায় পাশ করা মানে মেশিনও ভাবতে শিখে গিয়েছে মানুষের মতো। অবিকল। আর তা যদি সম্ভব হয় কোনওদিন, সেক্ষেত্রে যন্ত্রের সুখ, মানুষের অসুখ! এ প্রসঙ্গে উল্টো মতও অবশ্য রয়েছে প্রচুর। সরকারিভাবে কোনও প্ল্যাটফর্মনির্মাতা অবশ্য টুরিং টেস্টে পাশ করার কথা ঘোষণা করেনি এখনও পর্যন্ত। আন্তর্জালে একাধিক প্রশ্ন করে দেখেছি এ বিষয়ে। উত্তর পাইনি।

অ্যালানসাহেবের গবেষণাটি পুরনো হলেও সময় যত এগিয়েছে, এর প্রাসঙ্গিকতা বেড়েছে। নব্বই দশকের মাঝামাঝি এ নিয়ে চর্চা চলে বিস্তর। নব্বই দশক মানে আমাদের স্কুলজীবন। একটি স্পেশাল ক্লাসঘরে নিয়ে আসা হয়েছিল তিনটি কম্পিউটার। ডেস্কটপ। জীবনের নানা স্তরে, ব্যবসা বানিজ্যে কম্পিউটার নির্ভরতা শুরু হয়েছিল সেই সময় থেকেই। ইন্টারনেটকে আমরা তার আবাহনী সঙ্গীত শোনাতে শুরু করেছিলাম দৃপ্ত গলায়। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, ক্যাপচা নামক বস্তুটি প্রথমবারের জন্য ব্যবহৃত হয় অল্টাভিস্টা সার্চ ইঞ্জিনে, নব্বই দশকের শেষদিকে। ওয়েবসাইট বানানোর ধুম পড়েছিল তখন। তা তৈরি করার জন্য যে আবেদনপত্র ভর্তি করতে হতো, মানুষের পাশাপাশি তা নাগাড়ে করে চলেছিল যন্ত্রও, মানুষেরই শেখানো বুদ্ধি সম্বল করে। ওই যন্ত্রভিত্তিক আবেদন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল ভুয়ো। যাকে বলা চলে, জাঙ্ক। মোট আবেদনের থেকে মানুষের করা আবেদনগুলো ছেঁকে নেওয়ার জন্যই সম্ভবত ব্যবহার করা হয়েছিল ক্যাপচা। সিকিওরিটি গার্ডের মতো তারা প্রতিটি আবেদনের পথ আটকেছিল। পরখ করেছিল সত্য।

মজার কথা হল, যুগের নিয়মে আমরা যত বরণ করে নিচ্ছি আমাদের এই রোবট-জীবন, তখনই বারংবার প্রমাণ করতে হচ্ছে যে আমরা রোবট নই। আর সেই পরীক্ষাও নিচ্ছে আসলে একটি কম্পিউটার। বাইনারি সামাজিকতার ব্যাকরণ বলে, আমাদের অনলাইন চালচলন যত বেশি ‘নির্ভুল’ হবে, যন্ত্র আমাদের তত বেশি সন্দেহ করবে। শুরু হবে ক্যাপচাকাহন। চালচলনের নানা দিক আছে। ধরা যাক, কোনও ওয়েবসাইটে ঢুকে আপনি একটি ফর্ম ভরছেন। প্রতিটি প্রশ্নের প্রতিটি সম্ভাব্য উত্তরের পাশে দেওয়া রয়েছে চেকবক্স। আপনি যদি ঝটপট চেকবক্সগুলো ভর্তি করতে শুরু দেন, মেশিন সন্দেহ করবে। সঠিক বেঠিক পরের ব্যাপার। কিন্তু যদি প্রতিটি চেকবাক্সের ঠিক মাঝখানে এক চান্সে ক্লিক করে রাইট সিম্বলটি আনতে পারেন, মেশিন তাহলেও ভ্রু কুঁচকোবে। যদি আপনার পড়ার গতি ঘোড়দৌড়ের মতো হয়, বিপদ তাহলেও। খুব তাড়াতাড়ি স্ক্রল ডাউন করছেন দেখলে মেশিন ভাবতে পারে, আপনি কি মানুষ? আবার খুব ধীরে পড়লেও ঝামেলা! মেশিনের গভীরে থাকা অ্যালগোরিদম ভাববে, এত আস্তে পড়তে থাকা ইউজারটি কি আসলে মানুষ? কোনও অনলাইন সংবাদপত্রের একটি খবর খুব তাড়াতাড়ি পড়ে পরের খবরে যাওয়ার আগে দেখেছি, ধেয়ে এসেছে ক্যাপচা। প্রমাণ করেছি, আমি রোবট নই।

একদিকে যেমন আমরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে চলেছি নিজেদের মানুষ প্রমাণ করার জন্য, অন্যদিকে প্রযুক্তিবিশারদরাও ক্রমাগত চেষ্টা চালাচ্ছেন মেশিন যেন আরও ভালভাবে বাইনারি জ্যাকেটটি খুলে ফেলে মানুষ হতে পারে! এ এক অমোঘ লড়াই। ক্যাপচা কঠিন হচ্ছে ক্রমশ। ফন্টগুলো ধারণ করছে কাঁকড়াবিছের মতো রূপ। অক্ষরের মর্মার্থ উদ্ধার করতে হোঁচট খেয়ে ক্লান্ত হচ্ছেন নেটিজেনরা। টেক্সট ক্যাপচায় মানুষ উত্তীর্ণ হয়েছে যত, উদয় হয়েছে ইমেজ ক্যাপচা। কয়েকটি আগোছালো ছবির মধ্যে ধরতে বলা হচ্ছে সামঞ্জস্য। নটি বর্গক্ষেত্রের ছবি দেখিয়ে বলা হচ্ছে, বলুন তো দেখি কোন স্কোয়ারে মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে ট্রাফিক সিগনালের ভগ্নাংশ? একটি ছবি ঠিকঠাক যাচাই না করতে পারলেই সব মিথ্যে। মানুষ হওয়ার পরীক্ষা দিতে হবে ফের। পর্দায় চটজলদি হাজির হবে আরও জটিল কোনও ছবি। ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড হয়ে উঠতে পারে আরও বেশি ডিসটর্ডেড। এমন সময় নিজের মননের সঙ্গে যুদ্ধ চালাতে হয় খুব। মেশিনের কাছে হার মানার কালে মাথা হেঁট হয়ে আসে।

ওয়াকিবহাল শিবিরের মানুষরা বলছেন, ক্যাপচাধাঁধা কঠিন থেকে কঠিনতর হওয়ার পর্ব সবেমাত্র শুরু হয়েছে। অনেক পথ এখনও বাকি। হয়তো ক্যাপচা সমাধানের সঙ্গে তালবাদ্য যোগাবে ফিঙ্গারপ্রিন্ট কিংবা ফেশিয়াল রেকগনিশন। ক্যাপচা সমাধানের পরে ল্যাপটপের ক্যামেরা অন্ হয়ে যাবে আপনার অজান্তেই। পরখ করে দেখবে আপনার মুখ। সে যাত্রায় পাশ করে গেলে বলবে, ‘আঙুলছাপ দিন। বাজিয়ে দেখি আরও একটু।’ বাইনারি সম্পদ রক্ষা করতে গেলে এমন যাত্রায় উত্তীর্ণ হতেই হবে। এছাড়া অন্য কোনও উপায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না আপাতত।

আন্তর্জালে খোঁজ করলাম, অনেকগুলো ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টোনোর পরে কেমন হতে পারে আগামীদিনের ক্যাপচা? হায় রে! একটি ওয়েবসাইট বলল, কম্পিউটার বলতেই পারে - ১২ কট থিটার মান ৭ হলে কস থিটার মান নির্ণয় করো। সেটিই ক্যাপচা। প্রশ্নটি করা হতে পারে সামঞ্জস্যবিহীন ফন্টে, এলোমেলো ব্যাকগ্রাউন্ডে। প্রথমে প্রশ্ন উদ্ধার। তারপরে অঙ্কের সমাধান। চালু হয়ে যেতে পারে কোনও কাউন্টডাউন টাইমার। ১২০ সেকেন্ডের মধ্যে উত্তর দিতে ব্যর্থ হলেই হাঁক দেবে নতুন কোনও প্রশ্ন। হয়তো তা আরও জটিল।

অনলাইনের দুনিয়ায় আগামী দিন ভয়ংকর। পরিসংখ্যান বলছে, রক্তমাংসের মানুষ মাত্র ৮২ শতাংশ ক্ষেত্রে ক্যাপচা সমাধান করতে পারে। সময় নেয় ৯ থেকে ১৫ সেকেন্ড। পরিসংখ্যান আরও বলছে, আমাদের সাধের বট্ তার সমাধান করে মাইক্রোসেকেন্ডে। ঠিক উত্তর দেওয়ার পরিমাপ ৯৯.৬ শতাংশ। রোবটের সাফল্য শতাংশ বাড়লে ক্যাপচাও কঠিন হতে বাধ্য। ঐকিক নিয়মের অঙ্কের মতো।

যে রোবট তৈরি করতে বিলিয়ন ডলার খরচ করছি আমরা, বিশ্বজুড়ে, সেই বট্ই হয়তো একদিন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে, ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বলবে - তফাৎ যাও। তুম ঝুট হো, সব ঝুট হ্যায়। তফাৎ যাও।

ক্যালেন্ডারের ছাপা না হওয়া পাতা, এর উত্তর কি তুমি জানো?

বড্ড এলোমেলো বকছি। হয়তো আবার একটা ক্যাপচা এলো বলে!

বিশ্বাস করুন, আমি কিন্তু একটা মানুষ।