আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২৪ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
প্রবন্ধ
মৃত্যুর ছন্দ
আশীষ লাহিড়ী
একটা গপ্পো বাজারে চালু আছে যে, ভারত আর বাংলাদেশ তো বটেই, শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতও নাকি রবীন্দ্রনাথের রচনা। ওটি নাকি 'চিত্ত যেথা ভয়শূন্যর'-ই অনুবাদ। কথাটা অর্ধসত্য, কিংবা বলা যায় এক-তৃতীয়াংশ সত্য। শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতের ইংরেজি অনুবাদটি এইরকম -
Thou Mother Lanka,/Oh Mother Lanka we salute, salute, salute, salute Thee!
Plenteous in prosperity, Thou,/Beauteous in grace and love,
Laden with grain and luscious fruit,/And fragrant flowers of radiant hue,
Giver of life and all good things,/Our land of joy and victory,
Receive our grateful praise sublime, we worship, worship Thee.
Oh Mother Lanka! We salute, salute, salute, salute Thee!
#
Thou gavest us Knowledge and Truth,/ Thou art our strength and inward faith,
Our light divine and sentient being,/ Breath of life and liberation.
Grant us, bondage free, inspiration./ Inspire us for ever.
#
In wisdom and strength renewed,/ Ill-will, hatred, strife all ended,
In love enfolded, a mighty nation/ Marching onward, all as one,
Lead us, Mother, to fullest freedom, we worship, worship Thee/
Oh Mother Lanka! We salute, salute, salute, salute Thee!
গানের শেষ দুটি স্তবকে রবীন্দ্রনাথের 'চিত্ত যেথা ভয়শূন্য'-র প্রভাব খুব স্পষ্ট।
এই গানটিকে ঘিরে একটি দুঃখজনক ও শিক্ষাপ্রদ কাহিনি আছে। বিচারের স্রোতঃপথকে গ্রাস করে শেষ পর্যন্ত তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি কীভাবে জয়যুক্ত হয়, তার এক অবাক-করা কাহিনি সেটি।
এটির কাব্যাংশ ও সুরের মূল রচয়িতা আনন্দ সামারাকুন (১৯১১-১৯৬২)। এঁর আদি নাম ছিল জর্জ উইলফ্রেড অ্যালুইস সামারাকুন (Egodahage George Wilfred Alwis Samarakoon)। বাবা ছিলেন একটি ব্রিটিশ চা বাগিচার কেরানি। মা একটি স্কুলের শিক্ষিকা। কোত্তি-র ক্রিশ্চিয়ান কলেজে পড়াশোনা করে ১৯২৯ সালে সামারাকুন ওই কলেজেই সঙ্গীত ও চিত্রকলার শিক্ষকতা করতে থাকেন। ১৯৩৪ সালে রবীন্দ্রনাথ শ্রীলঙ্কায় আসেন। তাঁর নাচগানের দলের অনুষ্ঠান শ্রীলঙ্কার সাংস্কৃতিক মহলে প্রচণ্ড সাড়া জাগায়। অনেক তরুণ এবং অল্প কিছু তরুণী তার দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। জর্জ উইলফ্রেড এঁদেরই একজন। তিনি ১৯৩৬ সালে শান্তিনিতেকনে চলে আসেন। নন্দলাল বসুর কাছে চিত্রকলা এবং শান্তিদেব ঘোষের কাছে সঙ্গীত শিক্ষা শুরু করেন। কিন্তু সম্ভবত আর্থিক কারণে ছ' মাস পর তাঁকে দেশে ফিরে চাকরি নিতে হয়।
খ্রিস্টধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ হয়ে নাম নেন আনন্দ সামারাকুন। ১৯৩৮ থেকে মাহিন্দ সঙ্গীত কলেজে সঙ্গীতের অধ্যাপনা করতে থাকেন। শ্রীলঙ্কার সঙ্গীত তখন উত্তর ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল ছিল। তার মধ্যে কাব্যগুণের বিশেষ অভাব ছিল। সামারাকুন-এর প্রয়াসে শ্রীলঙ্কার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যযুক্ত সঙ্গীত ক্রমে জনপ্রিয় হতে থাকে। বলা হয়, সেদেশের সঙ্গীতে তিনি এক নতুন যুগ আনেন। ১৯৪০ সালে তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত দেশাত্মবোধক গান 'নমো নমো মাতা'। মাহিন্দ কলেজের ছাত্রদের দিয়ে গানটি গাওয়ান। প্রথমে কলেজ চৌহদ্দির মধ্যে, পরে বৃহত্তর সমাজে। ক্রমে এটি খুব জনপ্রিয় হয়। ১৯৪৮-এ তাঁর পাঁচ বছরের পুত্রের মৃত্যুর পর মনের দুঃখে তিনি দেশ ছেড়ে চলে আসেন ভারতে। এখানে তাঁর অনেকগুলি চিত্র-প্রদর্শনী হয়, সেগুলি বোদ্ধাদের কাছ থেকে সমাদরও লাভ করে। কিন্তু ১৯৫১ সালে তিনি শ্রীলঙ্কা ফিরে যান এবং চিত্রকলা ছেড়ে সঙ্গীতেই মনোনিবেশ করেন। আর্থিক সমস্যা তাঁর সারা জীবনের সঙ্গী ছিল। রেডিওতে গান শিখিয়ে, নানা ধরনের অনুষ্ঠান করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
১৯৪৯-এ স্বাধীনতা লাভের পর সামারাকুন-এর সম্মতি নিয়ে গানটির দুয়েকটি শব্দ সামান্য অদলবদল করে ১৯৫০ সালে 'নমো নমো মাতা' সরকারিভাবে শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃত হয়।
কিন্তু প্রথম থেকেই একদল গোঁড়া পণ্ডিত তাঁর এই গানের, বিশেষ করে প্রথম ছত্রটির, ছন্দোরূপ নিয়ে, বিশেষ করে শব্দাংশের (সিলেব্ল) বিন্যাস নিয়ে, নানা প্রশ্ন তুলতে থাকেন। মূল আপত্তি ছিল এই যে সামারাকুন নাকি প্রাচীন ছন্দশাস্ত্রের নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন এবং এর অবশ্যম্ভাবী কুফল হল দেশের সর্বনাশ। উত্তরে সামারাকুন বলেন, ভারতে থাকাকালীন তিনি সংস্কৃত ছন্দশাস্ত্র খুব ভালোভাবেই অধ্যয়ন করেছিলেন, যেটা তাঁর সমালোচকরা কেউই করেননি, সুতরাং এসব বিষয়ে সমালোচকদের মতকে গুরুত্ব দিতে তিনি রাজি নন।
এরই মধ্যে ১৯৫২ সালে তীরবেগে ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ডন স্টিফেন সেনানায়েকে মারা গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে সামারাকুনের সমালোচকদের জিহ্বা ও কলম সক্রিয় হয়ে উঠলঃ বলি নাই? তারপর গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো ১৯৫৯ সালে প্রধানমন্ত্রী সলোমন ওয়েস্ট রিজওয়ে ডায়াস বন্দরনায়েকে খুন হলেন তালদুয়ে সোমরামা থেরো নামক এক বৌদ্ধ পুরোহিতের গুলিতে। এই অহিংস বৌদ্ধ পুরোহিত তাঁকে বুকে, তলপেটে এবং হাতে গুলি করেছিলেন। তাহলে! এবার তো একেবারে অকাট্য প্রমাণ! ওই ‘অপয়া’ জাতীয় সঙ্গীতের কুপ্রভাবেই তো এইসব ঘটনা ঘটছে! সুতরাং ১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আনন্দ সামারাকুনকে ডেকে পাঠাল শ্রীলঙ্কা সরকার এবং তাঁর প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করে ওই গানের প্রথম পঙ্ক্তির 'নমো নমো মাতা'-র বদলে চালু করা হল শাস্ত্রীয় ছন্দরীতি অনুসারী 'শ্রীলঙ্কামাতা, আপা শ্রীলঙ্কা'।
সহ্য করতে না পেরে সামারাকুন 'টাইম্স' কাগজে একটি চিঠি পাঠান। তাতে লেখেন, "জাতীয় সঙ্গীতটার মুণ্ডচ্ছেদ করা হয়েছে। তার ফলে কেবল গান নয়, গান-রচয়িতারও সর্বনাশ হয়েছে। আমি চরম ব্যর্থতাবোধে আক্রান্ত ও হতাশাগ্রস্ত, বুক ভেঙে গেছে আমার। একজন সামান্য সঙ্গীত-রচয়িতার ভাগ্যে যেদেশে এরকম সব ঘটনা ঘটে, সেদেশে বেঁচে থাকা একটা দুর্ভোগ। এর চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়"। ১৯৬২-র ৫ এপ্রিল তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায় তাঁর বিছানায়। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অত্যধিক মাত্রায় ঘুমের ওষুধ সেবনজনিত মৃত্যু’।
'শ্রীলঙ্কামাতা, আপা শ্রীলঙ্কা'-ই এখনও শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে চালু। প্রশ্ন, ১৯৬২ সালে শাস্ত্রসম্মত ছন্দে গীত শ্রীলঙ্কার এই জাতীয় সঙ্গীত চালু হওয়ার পর থেকে সেদেশে ঠিক কত মিলিগ্রাম শান্তি এসেছে? আবার কি তাহলে বদলাতে হবে তার ছন্দ?
ইতিহাসের এ কম বাঁকা মশকরা নয়। ‘তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি’ রাষ্ট্রিকতার সর্বোচ্চ স্তরে কীভাবে ‘বিচারের স্রোতঃপথ’কে গ্রাস করে ফেলে, তার অনন্য উদাহরণ এটি। হালফিল ভারতের যা দশা, তাতে এইরকম কিছুর জন্য আমাদেরও কি তৈরি থাকতে হবে? একটাই সান্ত্বনা, রবীন্দ্রনাথকে আর ঘুমের ওষুধ কেনার খরচটা করতে হবে না।
তথ্যসূত্রঃ
১) https://en.wikipedia.org/wiki/Sri_Lanka_Matha
২) https://archives.sundayobserver.lk/2006/05/14/jun02.asp
৩) ওই।