আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২৪ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
সমসাময়িক
আমেরিকা আবার আন্দোলনমুখর
পড়ুয়ারা আবার প্রাঙ্গণে। আমেরিকার কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় এপ্রিল মাসে শুরু হয়েছিল স্লোগান-গান ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিবাদ বার্তা। মাস পেরিয়ে গেলেও সেই আলোড়ন থামেনি। বরং ছড়িয়ে পড়েছে আমেরিকার টেক্সাস, অ্যারিজোনা, সাউথ ও নর্থ ক্যারোলাইনা, ওয়াশিংটন ডিসি থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্র আন্দোলনের ঢেউ আটলান্টিক মহাসাগরের অন্য পাড়ের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও ছড়িয়ে পড়েছে। বাদ যায়নি ঐতিহ্যবাহী অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকী সুদূর অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় আজ আন্দোলনমুখর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশস্ত প্রাঙ্গণে ছাত্র-ছাত্রীরা ছোটো ছোটো তাঁবু খাটিয়ে রাত জাগছেন। দিনভর চলছে গান ও স্লোগান। এই সবই গাজা তথা প্যালেস্টাইনের উপর নেমে আসা ইজরায়েলি যুদ্ধ ও আগ্রাসনের প্রতিবাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম-নীতি-নিরাপত্তা ইত্যাদি কারণ দেখিয়ে কর্তৃপক্ষ আন্দোলন ভেঙে দেওয়ার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে। কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যামিল্টন হল-কে আন্দোলনকারীদের হাত থেকে মুক্ত করতে পুলিশ ডাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। নিউ ইয়র্কের এই বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া সিটি কলেজ কর্তৃপক্ষও পুলিশ ডেকেছিল। এই দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মিলিয়ে প্রায় ৩০০ জন আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করেছে নিউ ইয়র্ক পোলিস্ ডিপার্টমেন্ট (এনওয়াইপিডি)। তাঁদের মধ্যে কত জন পড়ুয়া, তা স্পষ্ট নয়।
প্রায় মাসখানেক ধরে কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়-সহ আমেরিকার বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে অবস্থান বিক্ষোভে বসেছেন প্যালেস্টাইনপন্থী পড়ুয়ারা। আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যামিল্টন হল দখল করে নিয়ে হলের বাইরে টাঙিয়ে দেন প্যালেস্টাইনের পতাকা। নিহত প্যালেস্টাইনি শিশুর নামে হ্যামিল্টন হলের নামকরণ করা হয় ‘হিন্দ হল’। তার পরেই এনওয়াইপিডি-কে ডাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। রাত ৯টা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ঢোকে পুলিশ। প্রথমে মই লাগানো ‘বেয়ার’ নামের এক বিশাল গাড়ির সাহায্যে হ্যামিল্টন হলের দোতলার জানলা দিয়ে পুলিশ ভিতরে ঢোকে। সেখানে যে আন্দোলনকারীরা ছিলেন, তাঁদের হল থেকে বেরিয়ে যেতে বলা হয়। যাঁরা হল ছেড়ে যেতে সম্মত হননি, তাঁদের গ্রেফতার করা হয়। কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, এভাবে ব্যারিকেড করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও ভবন দখল করা আইনবিরুদ্ধ। আন্দোলনকারীরা যেন স্বেচ্ছায় অবস্থান তুলে নেন। বোঝাই যাচ্ছে যে তাঁর সেই আর্জিতে কাজ হয়নি।
ক্যাম্পাসে তাঁবু খাটিয়ে যাঁরা অবস্থান-বিক্ষোভে বসেছিলেন, তাঁদেরও তুলে দেয় পুলিশ। কিছু আন্দোলনকারী বিনা বাধায় চলে যান। কিন্তু যাঁরা পুলিশকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে। সারারাত ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়েছে এনওয়াইপিডি। রাত পৌনে ১টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে সব আন্দোলনকারীকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে ধরপাকড়ের সময়ে কেউ জখম হননি বলে দাবি করেছে পুলিশ।
গত কয়েক দিন ধরে ইজরায়েল-বিরোধী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করায় ১৫ মে পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন বন্ধ রাখা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ১৭ মে পর্যন্ত ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন রাখার জন্য এনওয়াইপিডি-কে অনুরোধ জানান। এনওয়াইপিডি জানিয়েছেন, ১৫-২০ জন পুলিশকর্মী আপাতত বিশ্ববিদ্যালয়ে মোতায়েন থাকবেন।
নিউ ইয়র্কের এই দু’টি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও প্যালেস্টাইনপন্থী আন্দোলনকারীদের মোকাবিলায় আমেরিকার আরও বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ডাকা হয়েছিল। ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিনের ম্যাডিসন ক্যাম্পাসে পুলিশ এসে প্রথমে আন্দোলনকারীদের অবস্থান তুলে নেওয়ার জন্য ১৫ মিনিট সময় দেয়। আন্দোলনকারীরা তাতে কর্ণপাত করেননি। পড়ুয়াদের তোলা ভিডিয়ো থেকে দেখা গিয়েছে, এর পরেই পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ বেধে যায় আন্দোলনকারীদের। এই ক্যাম্পাস থেকে ৩৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেসেও আন্দোলনকারীদের মোকাবিলা করতে বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আপাতত পঠনপাঠন বন্ধ রাখা হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইয়েল, হার্ভার্ড, ইউনিভার্সিটি অব সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন - আন্দোলন চলছে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বাৎসরিক কনভোকেশন বয়কট করেছেন। হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব সাংবাদিক বৈঠকে জানিয়েছেন যে, দেশের প্রেসিডেন্ট পরিস্থিতির দিকে নজর রাখেছেন। প্রেস সচিবের কথায়, ‘‘যে কোনও ধরনের আন্দোলন চলতেই পারে, যতক্ষণ না বিক্ষোভকারীরা আইন ভঙ্গ করছেন।’’
ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি ব্লুমিংটনে গত ২৭ এপ্রিল যখন আন্দোলনরত পড়ুয়াদের শান্তিপূর্ণ অবস্থানে সশস্ত্র রায়ট পুলিশ নামানো হয়েছিল, তখন ক্যাম্পাসেই ছিলেন নৃতত্ত্ব বিভাগের জনৈক অধ্যাপক। পড়ুয়াদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত অধ্যাপক তখনই পড়ুয়াদের জমায়েতের দিকে এগিয়ে যান। কিন্তু সেখানে যেতেই তাঁকে মাটিতে ফেলে, হাত পিছমোড়া করে বেঁধে, গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে নিজের ক্যাম্পাসেই বেআইনি অনুপ্রবেশের অভিযোগ আনা হয়। একজন অধ্যাপককে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে দু’জন পুলিশ - এই ছবি দেশ-বিদেশের অসংখ্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এবং সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও তিনজন অধ্যাপককে সেদিন গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তাঁদের বিরুদ্ধে বেআইনি অনুপ্রবেশ-সহ বিভিন্ন চার্জ আনা হয়। জামিন পেলেও তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রবেশের উপরে অন্তত এক বছরের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। অন্য আর একজন অধ্যাপকের উপরে পাঁচ বছরের জন্য ক্যাম্পাসে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
আটলান্টার এমরি বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের চেয়ারপার্সন ছাত্র-ছাত্রীদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ দেখেছিলেন, তাতে অংশগ্রহণ করেননি। কিন্তু ক্যাম্পাস কর্তৃপক্ষ যখন সশস্ত্র পুলিশ ডেকে পড়ুয়াদের উপরে শারীরিক বলপ্রয়োগ করে গ্রেফতার করতে শুরু করে, তিনি সেখানে পৌঁছে যান এবং গ্রেফতার হন। একইভাবে নিউ হ্যাম্পশায়ারের ডার্টমাউথ কলেজের একজন অধ্যাপককে রীতিমতো বলপ্রয়োগ করে গ্রেফতার করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ডার্টমাউথ কলেজের অধ্যাপক দীর্ঘদিন ডার্টমাউথ কলেজের ‘জিউইশ স্টাডিজ়’ বা ইহুদি-বিষয়ক পাঠের অন্যতম বিশেষজ্ঞ। তিনি নিজেও ইহুদি। তাঁর কথায়, ‘‘'ইহুদি বিদ্বেষ দমনের নাম করে এইভাবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম।’’ তাঁকেও আপাতত কলেজ চত্বর থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে।
এই প্রতিবাদের প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছে অন্য অধ্যাপকদের গলাতেও। ওহায়ো স্টেট ইউনিভার্সিটির জনৈক অধ্যাপকের মতে, ‘‘কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। কোনও শান্তিপূর্ণ আলোচনা করার পরিবর্তে তারা সশস্ত্র পুলিশ ডেকে আন্দোলন ভাঙার চেষ্টা করছে। শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের দিকে নজর রাখছে স্নাইপার পুলিশ, তাদের জেলে পাঠানো হচ্ছে।’’
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের যেদিন অবস্থান বিক্ষোভ তোলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, সেদিন শিক্ষার্থীদের ঘিরে পুলিশের সামনে মানবশৃঙ্খল তৈরি করে দাঁড়িয়ে ছিলেন শিক্ষকেরা। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেসে ইজরায়েল-সমর্থক এবং ইজরায়েল-বিরোধী শিক্ষার্থীরা যে দিন মুখোমুখি হয়েছিলেন, সে দিন দু’দলের মাঝখানে সার বেঁধে দাঁড়িয়েছিলেন শিক্ষকেরা, যাতে বড়ো কোনও গন্ডগোল না হয়। তা ছাড়া, বেশ কিছু ক্যাম্পাসে দেখা গিয়েছে যে, অধ্যাপকেরা ছাত্র-ছাত্রীদের তাঁবুর কাছে বসে ক্লাসও নিচ্ছেন।
শুধু পড়ুয়াদের সমর্থন নয়, পুলিশ এবং কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদেও নেমেছেন অধ্যাপকেরা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছেন। ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে দাঁড়ানোর এই কাজটা মোটেও সহজ নয়। এতে অধ্যাপকদের চাকরি বা গবেষণার অনুদান হারানো, ডাক্তারি বা নার্সিংয়ের অধ্যাপকদের লাইসেন্স হারানো-সহ আরও নানা ঝুঁকি আছে। তাও তাঁরা ঝুঁকি নিচ্ছেন। তাঁদের কথায়, ‘‘এই পাগলামি থামাতেই হবে।’’
পুলিশি ধরপাকড়-গ্রেফতার, নিপীড়ন চলছে। এমনকী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাম কেটে দেওয়া বা বরখাস্তের সিদ্ধান্তও নিচ্ছে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গত এক মাসে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দু’ হাজারেরও বেশি ছাত্র-ছাত্রী গ্রেফতার হয়েছেন। আন্দোলন থামেনি, - ছড়িয়ে পড়েছে কানাডা, ফ্রান্সেও।
আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলন নতুন কোনো ঘটনা নয়। বরং ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় তার একটা উজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। নাগরিক অধিকার আন্দোলন, বর্ণবিদ্বেষ-বিরোধী আন্দোলন বা ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাই পালন করেছিলেন পথ প্রদর্শকের ভূমিকা। সাম্প্রতিক ইজরায়েল-বিরোধী আন্দোলন হয়তো তারই উত্তরাধিকার। ছাত্র-ছাত্রীদের দাবিগুলি অত্যন্ত স্পষ্ট। তাঁদের দাবি, - গাজা এবং প্যালেস্টাইনে ইজরায়েলের সামরিক কীর্তিকলাপ অক্ষুণ্ণ রাখার সঙ্গে যুক্ত, এমন যে কোনও সংস্থার সঙ্গে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। ইজরায়েলি সরকার বা সংস্থার দেওয়া অর্থ - যা দিয়ে ইজরায়েলের সামরিক সহায়তা সংক্রান্ত গবেষণা হয়, সেগুলি অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। ইজরায়েল থেকে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কোন খাতে কী অর্থ আসছে তা স্পষ্ট ভাষায় জানাতে হবে। ইজরায়েলের আগ্রাসী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে আন্দোলন শুরু হয়েছে এই দাবিদাওয়া তার ব্যতিক্রম নয়। বরং ছাত্র-ছাত্রী, সহমর্মী শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী ও সাধারণ মানুষের সোচ্চার প্রতিবাদ সেই আন্দোলনেরই অন্য এক ধারা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনও পর্যন্ত এই দাবিগুলি মেনে নেয়নি, বরং ছাত্র-ধরপাকড়, গ্রেফতার ও বরখাস্তের মতো পদক্ষেপে তাঁদের অবস্থানও আন্দাজ করা যায়।
ইজরায়েল নিয়ে ঢেঁকি গেলার মতো অবস্থায় পড়েছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। ইজরায়েলকে সামরিক সাহায্য করতে তাঁর আপত্তি নেই। আবার বিধ্বস্ত প্যালেস্টাইনের জন্য তিনি সাহায্য সামগ্রী পাঠিয়ে চলেছেন। পড়ুয়া-বিক্ষোভ এবং ভিন্ দেশের যুদ্ধে প্রচুর খরচের প্রশ্নে ভোটের আগে সব মিলিয়ে বেশ বিপাকে বর্তমান প্রেসিডেন্ট। অনেকের মতে ‘এখনকার ভিয়েতনাম’ হয়ে উঠতে পারে ইজরায়েল।
এদিকে শাস্তির মুখে পড়েছেন যে সব পড়ুয়া, তাঁদের জন্য ইয়েমেনের দরজা খোলা রয়েছে, বলে বার্তা দেওয়া হয়েছে। সানা ইউনিভার্সিটির এক আধিকারিক বলেন, “প্যালেস্টাইনের পাশে দাঁড়িয়ে আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাচ্ছি। প্যালেস্টাইনের পাশে এই লড়াইয়ে যত রকমভাবে থাকা সম্ভব, আমরা রয়েছি।” নির্দিষ্ট ইমেল-ঠিকানা দিয়ে সানা ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য আহ্বান জানান তিনি।
পণবন্দিদের মুক্তির বিনিময়েও হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ থামাতে রাজি নয় ইজরায়েল। তারা বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, হামাস-সহ গাজাকে ধূলিসাৎ না করা পর্যন্ত এই লড়াইয়ের শেষ নেই। ঘরে-বাইরে বিক্ষোভ-আন্দোলনের মুখেও নিজেদের অবস্থানে অনড় ইজরায়েল সরকার। রাগে ফুঁসছে দেশের মানুষ। তেল আভিভের ডেমোক্র্যাসি স্কোয়ারের সামনে প্রায় প্রতিদিনই সমবেত হচ্ছেন হাজার হাজার প্রতিবাদী মানুষ। তাদের দাবি, হামাসের ডেরা থেকে ইজরায়েলি বন্দিদের মুক্তি চাই। সরকার বদল চাই।
ইজরায়েলের রাজধানী তেল আভিভের চিত্র ভিন্ন। ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইজরায়েলে হামাসের হামলার পরে ‘চেঞ্জ জেনারেশন’ নামে একটি সংস্থা তৈরি হয়েছে সে দেশে। তাদের নেতৃত্বে পথে নেমেছেন বিক্ষোভকারীরা। দাবি, হামাসের ডেরা থেকে ইজরায়েলি বন্দিদের মুক্ত করে আনতে হবে এবং প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। পুলিশ তেল আভিভের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার অংশবিশেষ বন্ধ করে দিলেও বিক্ষোভ আটকানো যায়নি। বিক্ষোভে হামাসের হাতে বন্দিদের পরিবারের পাশাপাশি যুদ্ধে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্তেরা উপস্থিত ছিলেন।
এই পরিস্থিতিতে ভারতের ভূমিকায় দ্বিচারিতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের সভায় প্যালেস্টাইনের পক্ষে ভারতীয় প্রতিনিধি সোচ্চার। প্যালেস্টাইনকে রাষ্ট্রপুঞ্জের স্থায়ী সদস্য হিসেবে মেনে নেওয়ার প্রস্তাবে ভারত সম্মতি জানিয়েছে। অন্যদিকে, ইজরায়েলে কয়েক হাজার শ্রমিক পাঠাচ্ছে ভারত সরকার। আবার গাজা ভূখণ্ডে ইজরায়েলি সেনার হামলায় প্যালেস্টাইনি নাগরিকদের মৃত্যুর প্রতিবাদ জানিয়ে ফেসবুকের একটি পোস্টে ‘লাইক’ দেওয়ার ‘অপরাধে’ মুম্বইয়ের সোমাইয়া স্কুলের প্রধানশিক্ষিকাকে ইস্তফা দিতে বলেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ! কিন্তু তাতে তিনি রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বরখাস্ত করা হল প্রধানশিক্ষিকাকে। কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার এই ঘটনায় নীরব।
শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন এবং তার উপর নেমে আসা প্রত্যাঘাত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার আগ্রাসী আক্রমণকে আবার নতুন করে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছে। ইতিহাসের পুঁথিতে পড়া ছাত্র আন্দোলন দমাতে রাষ্ট্র কত নির্মম হতে পারে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাচ্ছে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থী। এখনকার শিক্ষার্থীদের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না কী ভাবে রাষ্ট্র গ্রাস করতে চায় সমাজ ও জীবনযাপন। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবসময়ই আক্রমণের প্রাথমিক লক্ষ্য। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিই যুগে যুগে মুক্ত বুদ্ধি, বিকল্প চিন্তা ও প্রতিবাদী চেতনার সূতিকাগার। ক্ষমতার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে প্রতিষ্ঠা দিতে সর্বদা পথ দেখিয়েছে আমেরিকার ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকসমাজ, গড়ে তুলেছে ক্যাম্পাস আন্দোলন। সাধারণ মানুষও সেইসব আন্দোলনের শরিক হয়েছেন। এ-হেন উদাহরণ গত শতকের আমেরিকায় অজস্রবার দেখা গেছে। একবিংশ শতাব্দীতে ইজরায়েলের আগ্রাসী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন তারই উত্তরাধিকার বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। সমধর্মী দৃষ্টান্ত এ দেশেও মিলবে, তবে তা হাতে গোনা, কারণ এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন দূরস্থান, বিক্ষোভ দানা বাঁধলেই নেমে আসে রাষ্ট্রের আক্রমণ। দিনের পর দিন ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গায়ে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনে রাষ্ট্র। তবে ভারতের যৌবন এখন দেশের স্বৈরশাসন উৎখাত করার কাজে ব্যস্ত। আশা করা যায় নির্বাচনের পর দেশে বিভাজনের রাজনীতি দূর হলে ভারতের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতেও বেজে উঠবে প্রতিবাদের দামামা।
ক্ষমতার প্রতিস্পর্ধী, সচেতন, সরব বিশ্ববিদ্যালয় কী করে জনচেতনা জাগাতে পারে, আমেরিকার শিক্ষার্থীরা সারা বিশ্বে সেই পথটি আরও একবার দেখাচ্ছেন। ইতিমধ্যেই তাঁরা সাময়িকভাবে জয়ী। আন্দোলন দমাতে না পেরে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ৯ মে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। আশা করা যায় এই জয়ের ধারা অব্যাহত থাকবে।